আজকের দিনে শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বড় করণীয় হলো দলীয় আনুগত্যের গণ্ডি ভেঙে নিজেদের সম্মিলিত স্বার্থে একত্র হওয়া। ডাকসুকে কেবল রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রতীক নয়, বরং শিক্ষার্থীদের অধিকার, শিক্ষার মানোন্নয়ন, গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি এবং নিরাপদ ও মানবিক ক্যাম্পাস গঠনের কার্যকর প্ল্যাটফর্ম হিসেবে দাঁড় করানোই হবে তাঁদের প্রকৃত দায়িত্ব।
চিররঞ্জন সরকার
ডাকসু নির্বাচন ঘিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আজ সরগরম। একাধিক প্যানেল, অসংখ্য পোস্টার, ব্যানার ও স্লোগানে মুখরিত ক্যাম্পাস। দীর্ঘদিন অবহেলিত এই কেন্দ্রীয় সংসদকে শিক্ষার্থীরা আবার আলোচনায় টেনে এনেছেন, আবারও সামনে এসেছে জাতীয় রাজনীতিতে এর সম্ভাব্য প্রভাব। আসলে ডাকসুর নাম এলেই চোখে ভেসে ওঠে এর গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আমরা বলি জাতির বিবেক—কারণ, এখান থেকেই শুরু হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের অগ্নিশিখা, এখানেই রোপিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের বীজ, এখান থেকেই উঠে এসেছিল সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের অদম্য প্রেরণা। সেই সব আন্দোলন-সংগ্রামের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র ছিল ডাকসু। এটি শুধু শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষার মঞ্চই ছিল না, বরং দেশের বৃহত্তর রাজনীতিরও চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে দীর্ঘ সময় ধরে। একসময় এই সংসদের নেতৃস্থানীয়রা জাতীয় নেতৃত্বের শূন্যস্থান পূরণ করেছেন, দেশের রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, সেই ঐতিহ্যবাহী ডাকসু আজ অনেক শিক্ষার্থীর কাছেই গুরুত্ব হারিয়েছে। দীর্ঘদিন নির্বাচন না হওয়া, কার্যত অচলাবস্থার কারণে এটি এখন প্রায় অকার্যকর এক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তবু নির্বাচন ঘিরে নতুন করে যে আলোচনা শুরু হয়েছে, তা অনেকের কাছে আশার সঞ্চার করেছে। অনেকে মনে করছেন, হয়তো আবারও ডাকসু হয়ে উঠতে পারে শিক্ষার্থীদের প্রেরণার কেন্দ্রবিন্দু এবং দেশের রাজনৈতিক চর্চার প্রাণমঞ্চ।
এখানে একটি কথা বলা ভালো, ডাকসু নিয়ে আমাদের দেশে মাতামাতি থাকলেও পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের তেমন কোনো গুরুত্ব নেই। হার্ভার্ড, স্ট্যানফোর্ড, এমআইটি বা অক্সফোর্ডের মতো বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেখানে পড়াশোনার জন্য যে টাকা খরচ করতে হয়, সেটা জোগাড় করতেই হিমশিম খান শিক্ষার্থীরা। ফলে পড়াশোনার বাইরে সময় দেওয়াটা তাঁদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। এত বিপুল ব্যয় বহন করতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা টের পান তাঁদের সময়ই সবচেয়ে বড় মূলধন। সকাল থেকে রাত অবধি তাঁরা ডুবে থাকেন পড়াশোনা ও গবেষণায়। তাঁদের কাছে জ্ঞান অর্জন ও দক্ষতা উন্নয়নই জীবনের একমাত্র বিনিয়োগ। ফলে কোটি টাকার প্রলোভন দেখালেও কেউ রাজি হবেন না ছাত্র সংসদের নেতা হওয়ার জন্য। ক্ষমতার রাজনীতির জন্য তাঁদের কাছে কোনো সময় নেই, তাঁদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ কেবল একাডেমিক শিক্ষা, জ্ঞান, দক্ষতা ও যোগ্যতা।
অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র একেবারেই ভিন্ন। এখানে একজন শিক্ষার্থীর টিউশন ফি সেমিস্টারপ্রতি ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা মাত্র, আর মাসিক খরচ গড়ে ৫ হাজার থেকে ৮ হাজার টাকারও কম। এত কম খরচে উচ্চশিক্ষা পাওয়ার সুযোগ নিঃসন্দেহে একটি আশীর্বাদ, কিন্তু একই সঙ্গে এর উল্টো প্রভাবও পড়ছে। অনেক শিক্ষার্থী মনে করেন তাঁদের পড়াশোনার সময় ও খরচ কোনো বড় মূলধন নয়। বরং তাঁরা ভাবেন, রাজনীতিতে সক্রিয় হলে সহজেই পাওয়া যায় প্রভাব, ক্ষমতা আর অর্থ। পড়াশোনায় যতই মনোযোগ দেওয়া হোক না কেন, ভবিষ্যৎ নিশ্চিত নয়; কিন্তু দলীয় রাজনীতি এক শর্টকাট পথ। এভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের আসল উদ্দেশ্য—জ্ঞানচর্চা গৌণ হয়ে পড়ে, আর রাজনৈতিক আনুগত্য হয়ে ওঠে মুখ্য।
অবশ্য এর জন্য ডাকসু নির্বাচনের প্রয়োজনও হয় না। বড় দলের নেতা হতে পারলেই অপ্রতিহত ক্ষমতা ভোগ করার সুযোগ মিলে যায়। স্বাধীনতার পর ডাকসু নির্বাচন তাই ক্রমেই অনিয়মিত হয়ে পড়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১০৪ বছর আগে, ১৯২১ সালে। আর বিশ্ববিদ্যালয়টির কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের প্রথম ভোট হয় ১৯২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে। সেই থেকে ১০০ বছরে ছাত্র সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে মাত্র ৩৭ বার। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৫৪ বছরে নির্বাচন হয়েছে সবচেয়ে কম, মাত্র সাতবার। বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত ডাকসু ও হল সংসদগুলো গঠনতন্ত্র অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিতর্ক, আবৃত্তি, রচনা ও অভ্যন্তরীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজন এবং নানা ধরনের প্রকাশনা বের করার কাজই বেশি করেছে। ষাটের দশকের শুরুতে শিক্ষা আন্দোলন, আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন ও উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে ডাকসুর রাজনৈতিক ভূমিকাই বড় হয়ে দেখা দেয়।
মুক্তিযুদ্ধের পর ছাত্ররাজনীতিতে দলীয় প্রভাব বাড়তে থাকে। ১৯৯১ সালে গণতন্ত্রে ফেরার পর ডাকসুর নির্বাচন বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ প্রায় তিন দশক পর সর্বশেষ ২০১৯ সালে যে নির্বাচন হলো, সেটিও বিতর্কিত ছিল। বিতর্কিত সেই নির্বাচনের পর ডাকসু ও হল সংসদ কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা রাখতে পারেনি। এবারের নির্বাচনের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আজ ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হচ্ছে ডাকসু নির্বাচন। সামনে প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি আবারও দলীয় প্রভাবাধীন ছাত্ররাজনীতির কবলে পড়বে, শিক্ষার্থীদের কি আবার গণরুমে থাকতে হবে, জোর করে মিছিলে আনা হবে, আগের মতো নির্যাতন ও নিপীড়ন চলবে?
তবে ২০২৪ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে ডাকসু নির্বাচনের গুরুত্ব আবারও সামনে এসেছে। জাতীয় পর্যায়ে নেতৃত্বের পুনর্গঠন, গণতান্ত্রিক চর্চা পুনরুদ্ধারের আলোচনা এবং তরুণ প্রজন্মকে মূলধারার রাজনীতিতে যুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা ডাকসুকে নতুন করে ভাবার সুযোগ তৈরি করেছে। কারণ, আজকের শিক্ষার্থীরাই আগামী দিনের রাজনীতিক, নীতিনির্ধারক এবং রাষ্ট্রনায়ক। সেই বাস্তবতা থেকে ডাকসুকে যদি শিক্ষার্থীদের প্রকৃত সমস্যা—আবাসন, শিক্ষার মান, নিরাপত্তা, কর্মসংস্থানের সুযোগ ইত্যাদি প্রশ্নকে কেন্দ্র করে শক্তিশালী প্ল্যাটফর্মে রূপান্তর করা যায়, তবে এটি আবারও প্রাণ ফিরে পেতে পারে। আর এ জন্য দরকার ডাকসুকে দলীয় রাজনীতির ছায়া থেকে মুক্ত করে স্বতন্ত্র ও স্বচ্ছ একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করানো। অন্যথায় যতবারই নির্বাচন হোক না কেন, ডাকসু থেকে যাবে শুধুই আনুষ্ঠানিকতার খাতায় নাম লেখা একটি প্রতিষ্ঠান—যেখানে নেই শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের আলোকবর্তিকা, নেই জ্ঞানভিত্তিক নেতৃত্ব তৈরির অনুপ্রেরণা।
এ জন্য প্রয়োজন দলীয় প্রভাবমুক্ত নির্বাচন। শিক্ষার্থীদের সমস্যা—আবাসন, গবেষণা, স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপত্তা—এসব বিষয়ে ডাকসুর সরাসরি কাজ করার দায়িত্ব নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি সময়ের চাহিদা অনুযায়ী এর গঠনতন্ত্রে সংস্কার আনতে হবে। সহিংসতা ও দখলদারত্ব থেকে বেরিয়ে এসে শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। আর সবচেয়ে বড় কথা, শিক্ষার্থীদের বুঝতে হবে তাঁদের সময় ও জ্ঞানই ভবিষ্যতের সবচেয়ে বড় সম্পদ। ডাকসুর আসল কাজ হওয়া উচিত সেই উপলব্ধি ছড়িয়ে দেওয়া।
আজকের দিনে শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বড় করণীয় হলো দলীয় আনুগত্যের গণ্ডি ভেঙে নিজেদের সম্মিলিত স্বার্থে একত্র হওয়া। ডাকসুকে কেবল রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রতীক নয়, বরং শিক্ষার্থীদের অধিকার, শিক্ষার মানোন্নয়ন, গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি এবং নিরাপদ ও মানবিক ক্যাম্পাস গঠনের কার্যকর প্ল্যাটফর্ম হিসেবে দাঁড় করানোই হবে তাঁদের প্রকৃত দায়িত্ব। দলীয় সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে ডাকসু আবারও হবে অপসংস্কৃতি, সহিংসতা ও অবিশ্বাসের আরেকটি মঞ্চ। কিন্তু যদি শিক্ষার্থীরা নিজেরাই উদ্যোগ নিয়ে দলীয় প্রভাবমুক্ত একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তোলেন, তবে ডাকসু হয়ে উঠতে পারে আগামী প্রজন্মের জন্য পরিবর্তনের রূপকার।
এখানে প্রজন্মভিত্তিক দায়িত্বও অত্যন্ত স্পষ্ট। প্রবীণ প্রজন্ম, যারা ডাকসুর অতীত গৌরবের সাক্ষী, তাদের কর্তব্য হলো সেই অভিজ্ঞতা, সংগ্রামের শিক্ষা ও ঐতিহাসিক চেতনা দিয়ে নতুনদের পথ দেখানো। কিন্তু পথ দেখানো মানেই নিয়ন্ত্রণ নয়—বরং তাদের উচিত তরুণদের সৃজনশীলতাকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং সমর্থন জোগানো। অন্যদিকে, তরুণ প্রজন্মের কাজ হলো নতুন বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে নিজেদের চিন্তাধারা, প্রযুক্তি-দক্ষতা ও স্বপ্ন দিয়ে পরিবর্তনের পথ নির্মাণ করা। অতীতের অভিজ্ঞতা আর বর্তমানের উদ্যম যদি একসঙ্গে কাজ করে, তবে ডাকসু কেবল বিশ্ববিদ্যালয় নয়, দেশের জন্যও একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারবে।
ডাকসুর সামনে তাই এক দ্বিমুখী পথ খোলা। একদিকে রয়েছে হারানো ঐতিহ্য ও গৌরব পুনরুদ্ধারের বিশাল সুযোগ—যেখানে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই হবেন গণতন্ত্রের রক্ষক ও পরিবর্তনের অগ্রদূত। অন্যদিকে রয়েছে আনুষ্ঠানিকতার খোলসে বন্দী থেকে পুরোনো অপসংস্কৃতি, সহিংসতা ও দলীয় আধিপত্যের পুনরাবৃত্তির ভয়াবহ ঝুঁকি। কোন পথে যাবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা, সেই সিদ্ধান্তই কেবল ডাকসুর ভাগ্য নয়, দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের মানচিত্রও নির্ধারণ করবে। তরুণদের হাতে আছে সেই কলম, যা দিয়ে তারা লিখতে পারে এক নতুন ইতিহাস—অথবা আবারও পুনরাবৃত্ত করতে পারে ভাঙা স্বপ্নের করুণ কাহিনি।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
ডাকসু নির্বাচন ঘিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আজ সরগরম। একাধিক প্যানেল, অসংখ্য পোস্টার, ব্যানার ও স্লোগানে মুখরিত ক্যাম্পাস। দীর্ঘদিন অবহেলিত এই কেন্দ্রীয় সংসদকে শিক্ষার্থীরা আবার আলোচনায় টেনে এনেছেন, আবারও সামনে এসেছে জাতীয় রাজনীতিতে এর সম্ভাব্য প্রভাব। আসলে ডাকসুর নাম এলেই চোখে ভেসে ওঠে এর গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আমরা বলি জাতির বিবেক—কারণ, এখান থেকেই শুরু হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের অগ্নিশিখা, এখানেই রোপিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের বীজ, এখান থেকেই উঠে এসেছিল সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের অদম্য প্রেরণা। সেই সব আন্দোলন-সংগ্রামের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র ছিল ডাকসু। এটি শুধু শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষার মঞ্চই ছিল না, বরং দেশের বৃহত্তর রাজনীতিরও চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে দীর্ঘ সময় ধরে। একসময় এই সংসদের নেতৃস্থানীয়রা জাতীয় নেতৃত্বের শূন্যস্থান পূরণ করেছেন, দেশের রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, সেই ঐতিহ্যবাহী ডাকসু আজ অনেক শিক্ষার্থীর কাছেই গুরুত্ব হারিয়েছে। দীর্ঘদিন নির্বাচন না হওয়া, কার্যত অচলাবস্থার কারণে এটি এখন প্রায় অকার্যকর এক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তবু নির্বাচন ঘিরে নতুন করে যে আলোচনা শুরু হয়েছে, তা অনেকের কাছে আশার সঞ্চার করেছে। অনেকে মনে করছেন, হয়তো আবারও ডাকসু হয়ে উঠতে পারে শিক্ষার্থীদের প্রেরণার কেন্দ্রবিন্দু এবং দেশের রাজনৈতিক চর্চার প্রাণমঞ্চ।
এখানে একটি কথা বলা ভালো, ডাকসু নিয়ে আমাদের দেশে মাতামাতি থাকলেও পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের তেমন কোনো গুরুত্ব নেই। হার্ভার্ড, স্ট্যানফোর্ড, এমআইটি বা অক্সফোর্ডের মতো বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেখানে পড়াশোনার জন্য যে টাকা খরচ করতে হয়, সেটা জোগাড় করতেই হিমশিম খান শিক্ষার্থীরা। ফলে পড়াশোনার বাইরে সময় দেওয়াটা তাঁদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। এত বিপুল ব্যয় বহন করতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা টের পান তাঁদের সময়ই সবচেয়ে বড় মূলধন। সকাল থেকে রাত অবধি তাঁরা ডুবে থাকেন পড়াশোনা ও গবেষণায়। তাঁদের কাছে জ্ঞান অর্জন ও দক্ষতা উন্নয়নই জীবনের একমাত্র বিনিয়োগ। ফলে কোটি টাকার প্রলোভন দেখালেও কেউ রাজি হবেন না ছাত্র সংসদের নেতা হওয়ার জন্য। ক্ষমতার রাজনীতির জন্য তাঁদের কাছে কোনো সময় নেই, তাঁদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ কেবল একাডেমিক শিক্ষা, জ্ঞান, দক্ষতা ও যোগ্যতা।
অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র একেবারেই ভিন্ন। এখানে একজন শিক্ষার্থীর টিউশন ফি সেমিস্টারপ্রতি ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা মাত্র, আর মাসিক খরচ গড়ে ৫ হাজার থেকে ৮ হাজার টাকারও কম। এত কম খরচে উচ্চশিক্ষা পাওয়ার সুযোগ নিঃসন্দেহে একটি আশীর্বাদ, কিন্তু একই সঙ্গে এর উল্টো প্রভাবও পড়ছে। অনেক শিক্ষার্থী মনে করেন তাঁদের পড়াশোনার সময় ও খরচ কোনো বড় মূলধন নয়। বরং তাঁরা ভাবেন, রাজনীতিতে সক্রিয় হলে সহজেই পাওয়া যায় প্রভাব, ক্ষমতা আর অর্থ। পড়াশোনায় যতই মনোযোগ দেওয়া হোক না কেন, ভবিষ্যৎ নিশ্চিত নয়; কিন্তু দলীয় রাজনীতি এক শর্টকাট পথ। এভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের আসল উদ্দেশ্য—জ্ঞানচর্চা গৌণ হয়ে পড়ে, আর রাজনৈতিক আনুগত্য হয়ে ওঠে মুখ্য।
অবশ্য এর জন্য ডাকসু নির্বাচনের প্রয়োজনও হয় না। বড় দলের নেতা হতে পারলেই অপ্রতিহত ক্ষমতা ভোগ করার সুযোগ মিলে যায়। স্বাধীনতার পর ডাকসু নির্বাচন তাই ক্রমেই অনিয়মিত হয়ে পড়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১০৪ বছর আগে, ১৯২১ সালে। আর বিশ্ববিদ্যালয়টির কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের প্রথম ভোট হয় ১৯২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে। সেই থেকে ১০০ বছরে ছাত্র সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে মাত্র ৩৭ বার। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৫৪ বছরে নির্বাচন হয়েছে সবচেয়ে কম, মাত্র সাতবার। বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত ডাকসু ও হল সংসদগুলো গঠনতন্ত্র অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিতর্ক, আবৃত্তি, রচনা ও অভ্যন্তরীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজন এবং নানা ধরনের প্রকাশনা বের করার কাজই বেশি করেছে। ষাটের দশকের শুরুতে শিক্ষা আন্দোলন, আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন ও উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে ডাকসুর রাজনৈতিক ভূমিকাই বড় হয়ে দেখা দেয়।
মুক্তিযুদ্ধের পর ছাত্ররাজনীতিতে দলীয় প্রভাব বাড়তে থাকে। ১৯৯১ সালে গণতন্ত্রে ফেরার পর ডাকসুর নির্বাচন বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ প্রায় তিন দশক পর সর্বশেষ ২০১৯ সালে যে নির্বাচন হলো, সেটিও বিতর্কিত ছিল। বিতর্কিত সেই নির্বাচনের পর ডাকসু ও হল সংসদ কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা রাখতে পারেনি। এবারের নির্বাচনের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আজ ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হচ্ছে ডাকসু নির্বাচন। সামনে প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি আবারও দলীয় প্রভাবাধীন ছাত্ররাজনীতির কবলে পড়বে, শিক্ষার্থীদের কি আবার গণরুমে থাকতে হবে, জোর করে মিছিলে আনা হবে, আগের মতো নির্যাতন ও নিপীড়ন চলবে?
তবে ২০২৪ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে ডাকসু নির্বাচনের গুরুত্ব আবারও সামনে এসেছে। জাতীয় পর্যায়ে নেতৃত্বের পুনর্গঠন, গণতান্ত্রিক চর্চা পুনরুদ্ধারের আলোচনা এবং তরুণ প্রজন্মকে মূলধারার রাজনীতিতে যুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা ডাকসুকে নতুন করে ভাবার সুযোগ তৈরি করেছে। কারণ, আজকের শিক্ষার্থীরাই আগামী দিনের রাজনীতিক, নীতিনির্ধারক এবং রাষ্ট্রনায়ক। সেই বাস্তবতা থেকে ডাকসুকে যদি শিক্ষার্থীদের প্রকৃত সমস্যা—আবাসন, শিক্ষার মান, নিরাপত্তা, কর্মসংস্থানের সুযোগ ইত্যাদি প্রশ্নকে কেন্দ্র করে শক্তিশালী প্ল্যাটফর্মে রূপান্তর করা যায়, তবে এটি আবারও প্রাণ ফিরে পেতে পারে। আর এ জন্য দরকার ডাকসুকে দলীয় রাজনীতির ছায়া থেকে মুক্ত করে স্বতন্ত্র ও স্বচ্ছ একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করানো। অন্যথায় যতবারই নির্বাচন হোক না কেন, ডাকসু থেকে যাবে শুধুই আনুষ্ঠানিকতার খাতায় নাম লেখা একটি প্রতিষ্ঠান—যেখানে নেই শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের আলোকবর্তিকা, নেই জ্ঞানভিত্তিক নেতৃত্ব তৈরির অনুপ্রেরণা।
এ জন্য প্রয়োজন দলীয় প্রভাবমুক্ত নির্বাচন। শিক্ষার্থীদের সমস্যা—আবাসন, গবেষণা, স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপত্তা—এসব বিষয়ে ডাকসুর সরাসরি কাজ করার দায়িত্ব নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি সময়ের চাহিদা অনুযায়ী এর গঠনতন্ত্রে সংস্কার আনতে হবে। সহিংসতা ও দখলদারত্ব থেকে বেরিয়ে এসে শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। আর সবচেয়ে বড় কথা, শিক্ষার্থীদের বুঝতে হবে তাঁদের সময় ও জ্ঞানই ভবিষ্যতের সবচেয়ে বড় সম্পদ। ডাকসুর আসল কাজ হওয়া উচিত সেই উপলব্ধি ছড়িয়ে দেওয়া।
আজকের দিনে শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বড় করণীয় হলো দলীয় আনুগত্যের গণ্ডি ভেঙে নিজেদের সম্মিলিত স্বার্থে একত্র হওয়া। ডাকসুকে কেবল রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রতীক নয়, বরং শিক্ষার্থীদের অধিকার, শিক্ষার মানোন্নয়ন, গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি এবং নিরাপদ ও মানবিক ক্যাম্পাস গঠনের কার্যকর প্ল্যাটফর্ম হিসেবে দাঁড় করানোই হবে তাঁদের প্রকৃত দায়িত্ব। দলীয় সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে ডাকসু আবারও হবে অপসংস্কৃতি, সহিংসতা ও অবিশ্বাসের আরেকটি মঞ্চ। কিন্তু যদি শিক্ষার্থীরা নিজেরাই উদ্যোগ নিয়ে দলীয় প্রভাবমুক্ত একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তোলেন, তবে ডাকসু হয়ে উঠতে পারে আগামী প্রজন্মের জন্য পরিবর্তনের রূপকার।
এখানে প্রজন্মভিত্তিক দায়িত্বও অত্যন্ত স্পষ্ট। প্রবীণ প্রজন্ম, যারা ডাকসুর অতীত গৌরবের সাক্ষী, তাদের কর্তব্য হলো সেই অভিজ্ঞতা, সংগ্রামের শিক্ষা ও ঐতিহাসিক চেতনা দিয়ে নতুনদের পথ দেখানো। কিন্তু পথ দেখানো মানেই নিয়ন্ত্রণ নয়—বরং তাদের উচিত তরুণদের সৃজনশীলতাকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং সমর্থন জোগানো। অন্যদিকে, তরুণ প্রজন্মের কাজ হলো নতুন বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে নিজেদের চিন্তাধারা, প্রযুক্তি-দক্ষতা ও স্বপ্ন দিয়ে পরিবর্তনের পথ নির্মাণ করা। অতীতের অভিজ্ঞতা আর বর্তমানের উদ্যম যদি একসঙ্গে কাজ করে, তবে ডাকসু কেবল বিশ্ববিদ্যালয় নয়, দেশের জন্যও একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারবে।
ডাকসুর সামনে তাই এক দ্বিমুখী পথ খোলা। একদিকে রয়েছে হারানো ঐতিহ্য ও গৌরব পুনরুদ্ধারের বিশাল সুযোগ—যেখানে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই হবেন গণতন্ত্রের রক্ষক ও পরিবর্তনের অগ্রদূত। অন্যদিকে রয়েছে আনুষ্ঠানিকতার খোলসে বন্দী থেকে পুরোনো অপসংস্কৃতি, সহিংসতা ও দলীয় আধিপত্যের পুনরাবৃত্তির ভয়াবহ ঝুঁকি। কোন পথে যাবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা, সেই সিদ্ধান্তই কেবল ডাকসুর ভাগ্য নয়, দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের মানচিত্রও নির্ধারণ করবে। তরুণদের হাতে আছে সেই কলম, যা দিয়ে তারা লিখতে পারে এক নতুন ইতিহাস—অথবা আবারও পুনরাবৃত্ত করতে পারে ভাঙা স্বপ্নের করুণ কাহিনি।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
যে বিষয়ে আজ লিখব বলে ভাবছি, সে সম্পর্কে আমার জ্ঞান অতি সামান্য, প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। তবু দুই দিন যাবৎ মনটা খুবই খারাপ হয়ে আছে পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে। বলে রাখা ভালো, ক্লাস থ্রি পর্যন্ত আমি মাদ্রাসায় পড়েছি। আমার বড় চাচা ছিলেন একজন ইসলামিক জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ।
৮ ঘণ্টা আগেভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলায় এক নারকীয় ঘটনা ঘটেছে। বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের অভিযোগ তুলে এক নারীকে গাছের সঙ্গে বেঁধে, চুল কেটে, গলায় জুতার মালা পরিয়ে হেনস্তা করা হয়েছে। আর এই অপকর্মে নেতৃত্ব দিয়েছেন এক বিএনপি নেতা!
৮ ঘণ্টা আগেমুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বললেই আওয়ামী লীগ ও ফ্যাসিস্টের ‘দোসর’ তকমা দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হেনস্তা তো বটেই, কখনো কখনো ব্যক্তি বা জনসমষ্টির ওপর সরাসরি আক্রমণের ঘটনাও ঘটানো হচ্ছে। একই রকমভাবে আক্রান্ত হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় বিশেষ মতবাদের বিপক্ষের ব্যক্তি-গোষ্ঠী এবং নারীসমাজসহ ধর্মীয়...
১ দিন আগে‘গ্লোবাল সাউথ’ আজ একটি শক্তিশালী ধারণা—যেখানে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, পরিবেশগত, সাংস্কৃতিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতার মাধ্যমে দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলো নতুন সংহতি গড়ে তুলছে। এটিকে সাউথ-সাউথ কো-অপারেশন বলা হয়। একসময় যেখানে বিশ্বরাজনীতির নিয়ন্ত্রণ ছিল মূলত উত্তর গোলার্ধের উন্নত দেশগুলোর হাতে...
১ দিন আগে