Ajker Patrika

সূর্যের আগুন বেশি ভয়ংকর, না রাজনীতির

আহমেদ শমসের
সূর্যের আগুন বেশি ভয়ংকর, না রাজনীতির

মে মাসে সূর্য যেন শুধু তাপ নয়, আগুন ছড়াচ্ছে। আকাশ থেকে যেন নেমে এসেছে মাথার ওপর, ওপর থেকে ঢুকে গেছে, যাচ্ছে ভেতরে। শহরের রাস্তায় আগুনের মতো উত্তাপ, গ্রামগঞ্জে পানির জন্য হাহাকার। শিশুরা ঘুমাতে পারছে না, ছটফট করছে, কৃষকের কপাল শুকনো, হাঁসফাঁস করছেন বয়স্করা। সবাই খুঁজছে একটু শীতল হাওয়া, দুদণ্ড শান্তি! এই গরম যেন কেবল আবহাওয়ার ব্যাপার নয়; হয়ে দাঁড়িয়েছে একধরনের জীবনযুদ্ধ, প্রতিদিনের বাস্তবতা।

তবে শুধু সূর্যকে দোষ দিলে ঠিক হবে না। এই উত্তাপের পাশে আরেক রকম গরমও আছে—রাজনীতির গরম। যমুনা ঘেরাও, শাহবাগে ব্লকেড, দেশের বিভিন্ন রাস্তায় অবরোধ-বিক্ষোভ, মানুষের ওপর দমন-পীড়ন, বিভাজনের রাজনীতি। প্রশ্ন উঠতে পারে, দুই আগুনের মধ্যে কোনটা বেশি ভয়ংকর?

প্রাকৃতিক গরমে মানুষ হিট স্ট্রোকে মারা যায়, অসুস্থ হয়। কিন্তু রাজনীতির গরমে? তখন মানুষ কেবল মরেই না, একে অপরকে মেরেও ফেলে। সূর্যের উত্তাপ আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না, কিন্তু রাজনীতির উত্তাপ তো আমাদেরই বানানো। সেটাকে তো চাইলে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আসলে আমরা যেন কোনো কিছুই নিয়ন্ত্রণ করতে চাই না। অথবা অন্যকে নিয়ন্ত্রণ করে নিজে থাকতে চাই নিয়ন্ত্রণহীন!

প্রকৃতির গরম যেমন কষ্টদায়ক, রাজনীতির গরম তেমনি ভয়ানক। শহরে কিংবা দেশজুড়ে যদি পর্যাপ্ত গাছ থাকত, ছায়া থাকত, পানি থাকত, বিদ্যুৎ থাকত—তবে কি গরম এত ভয়ানক লাগত? জলবায়ু পরিবর্তন হঠাৎ আসেনি, এটা বছরের পর বছর ধরে হয়েছে। কিন্তু আমরা পরিকল্পনা করিনি, গাছ কেটেছি, নদী ভরাট করেছি, জলাধার দখল করেছি। সবকিছু দখলে সুখ নেই, দখলের সুখ যে সাময়িক—তা-ও আমরা বুঝতে চাইনি, চাই না।

পরিবেশ নিয়ে যে আন্দোলন হয়, সেগুলোও নানা সময় দমন করা হয়। কার্যকর পরিবেশনীতি তৈরি করা হয়নি। তাই আজকের এই ভয়াবহ গরমের পেছনে রাজনীতির গাফিলতিও আছে, হাত আছে অপরাজনীতির।

সূর্যের উত্তাপ অস্বস্তি দেয়, শরীরে জ্বালা ধরায়। আর রাজনীতির উত্তাপে? রাজনীতির উত্তাপ তো শুধু অস্বস্তিকর নয়, সেটা কখনো কখনো মানুষও মারে, সমাজকেও ভেঙে দেয়। পরিবারে মতভেদ, বন্ধুত্বে ফাটল, সমাজে বিভক্তি—সবই এর ফল। যেখানে সহনশীলতা নেই, সেখানে রাজনৈতিক উত্তাপ মানেই হিংসা, অনাস্থা আর ভয়।

সূর্যের গরম কষ্টদায়ক, কিন্তু তা সাময়িক। অথচ রাজনীতির গরম বহু বছর, বহু প্রজন্ম ধরে ক্ষতি করে যায়। গুজরাট বা দিল্লির দাঙ্গা হঠাৎ হয়েছিল, কিন্তু তার ক্ষত আজও আছে। আমাদের দেশেও রাজনৈতিক সংঘাতে শুধু মৃত্যু নয়, বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হয়, যা সমাজকে দুর্বল করে।

তাই এই প্রশ্নটা কেবল আবহাওয়ার নয়, বরং রাষ্ট্র আর নাগরিকদের সচেতনতার প্রশ্ন। রাষ্ট্র কি এমনভাবে তৈরি হয়েছে, যা দুর্যোগ মোকাবিলা করতে পারে? তৈরি হয়নি। তবে আমরা এমন রাজনীতি তৈরি করেছি, যা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মতো মানুষের জীবনে কষ্টকে স্থায়ী করছে।

এই লেখার উদ্দেশ্য কাউকে ভয় দেখানো নয়। বরং বোঝানো যে প্রকৃতিকে আমরা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না, কিন্তু রাজনীতিকে ঠিক করতে পারি। পরিবেশ বাঁচাতে যেমন সচেতনতা দরকার, তেমনি রাজনীতিকে মানবিক করতে দরকার জনগণের অংশগ্রহণ, জবাবদিহি আর বিকল্প কণ্ঠস্বর।

যে রাজনীতি দায়িত্ব ভুলে ক্ষমতার খেলা খেলতে ব্যস্ত, যারা ভিন্নমতকে দমন করে, তারা কখনোই শান্তি দিতে পারে না। বরং তারা সমাজে আরও গরম বাড়ায়—ভয়ের, সন্দেহের, ঘৃণার।

ভাবুন তো, যদি তাপপ্রবাহে পাঁচজন মারা যায়, আর রাজনৈতিক সহিংসতায় ১৫ জন—তবে কোনটা বেশি ভয়ংকর? আবার, গরমে মানুষ একে অপরকে পানি দেয়, ছায়ায় আশ্রয় দেয়। কিন্তু রাজনীতির উত্তাপে মানুষ পরস্পরকে আঘাত করে, অবিশ্বাস করে, ঘৃণা ছড়ায়। তাই প্রাকৃতিক গরম কষ্ট দেয়, কিন্তু রাজনীতির গরম অনেক সময় সমাজকে ভেঙে দেয়।

আমরা এখন একটা কঠিন সময় পার করছি। প্রাকৃতিক গরমের বিরুদ্ধে আমরা বৈজ্ঞানিক উপায়ে লড়তে পারি। কিন্তু রাজনীতির উত্তাপ যদি ঘৃণা, প্রতিশোধ আর অহংকারে ভরে যায়—তাহলে তার আগুন সহজে নেভে না। তাই দরকার শীতল মাথার রাজনীতি, সহনশীল সমাজ, দায়িত্বশীল রাষ্ট্র। না হলে সূর্যের আগুন যতটা না পোড়াবে, তার চেয়ে বেশি জ্বালিয়ে দেবে আমাদের রাজনীতি।

আমরা যত দিন না এই দুই আগুন—সূর্য আর রাজনীতির—একসঙ্গে বুঝতে পারি, তত দিন আমাদের জীবন আগুনে পুড়তে থাকবে। মনে হবে, জন্ম থেকে জ্বলছি। কিন্তু আমরা তো চাই শান্তির জীবন, সম্প্রীতির জীবন। সেই জীবন এনে দেওয়ার রাজনীতি কি আমরা কখনো খুঁজব না?

আমরা কি কেবল অভিযোগ করেই যাব? নাকি এই দুই আগুন—সূর্য আর রাজনীতি—দুটোকেই বোঝার চেষ্টা করব এবং সেখানে সমাধানের পথ খুঁজে নেব?

প্রথমত, আমরা যে পরিবেশগত দুর্যোগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, তা আর কেবল কোনো এক গ্রীষ্মকালের ঘটনাই নয়। জলবায়ু পরিবর্তন এখন বাস্তব এবং নির্বিচারে আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ঢুকে পড়েছে। এই পরিবর্তনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রাষ্ট্র ও নাগরিক—উভয়েরই ভূমিকা জরুরি। কিন্তু পরিবেশবিষয়ক নীতিমালা কি যথেষ্ট শক্তিশালী? নাকি সেগুলো কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ? উন্নয়ন প্রকল্পের নামে গাছ কাটা, জলাশয় দখল, নদীভাঙনের গাফিলতি—এসব যদি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেই অনুমোদিত হয়, তাহলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধের আশা করাটা কতটা বাস্তবসম্মত? দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক উত্তাপ শুধু রাজনৈতিক অঙ্গনে সীমাবদ্ধ থাকে না। তা শিক্ষায়, সমাজে, ধর্মে, এমনকি আমাদের দৈনন্দিন সম্পর্কেও অনুপ্রবেশ করে। রাজনৈতিক নেতারা যদি দায়িত্বহীন বক্তব্য দেন, মিথ্যা প্রচার করেন, কিংবা সহিংস উসকানি দেন, তাহলে সমাজে সেই উত্তাপ শুধু বিতর্ক নয়, বিভাজন তৈরি করে। আর একবার সেই বিভাজনের আগুন জ্বলে উঠলে তা নেভানো কঠিন হয়। আমরা একাধিকবার দেখেছি, একটি সামান্য রাজনৈতিক বক্তব্য কিংবা মিথ্যা ফেসবুক পোস্ট থেকেও কীভাবে সহিংসতা ছড়িয়েছে, ঘরবাড়ি পুড়েছে, নিরীহ মানুষ গৃহহীন হয়েছে।

তবে এখানেই শেষ নয়। আশার জায়গা হলো, রাজনীতির উত্তাপ মানুষই তৈরি করে, মানুষই তা নিবারণ করতে পারে। আমাদের প্রয়োজন দায়বদ্ধ রাজনীতি, যেখানে বিরোধিতা থাকবে কিন্তু তা সহিংসতায় রূপ নেবে না; যেখানে মতপার্থক্য থাকবে, কিন্তু তা ঘৃণায় পরিণত হবে না। প্রয়োজন সেই রাজনৈতিক নেতৃত্ব, যাঁরা নির্বাচনের সময় কৌশল নয়, ভবিষ্যৎ ভাবেন; যাঁরা দমন নয়, সংলাপে বিশ্বাস করেন।

এই পরিবর্তন রাতারাতি সম্ভব নয় আবার অসম্ভবও নয়। গণতান্ত্রিক চর্চা, মুক্ত গণমাধ্যম, সচেতন নাগরিক অংশগ্রহণ—এসবই রাজনীতিকে শীতল করার উপায়। আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় দরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি।

সবশেষে, আমাদের ভাবতে হবে, কোন সমাজে আমরা বাঁচতে চাই? আগুনের মধ্যে বিভক্ত, আতঙ্কিত, আর সন্দেহপরায়ণ এক সমাজে? নাকি ছায়ায় ভরা, সংলাপমুখর, স্বস্তিকর এক সমাজে? সূর্যকে আমরা থামাতে পারি না, কিন্তু ছায়া তৈরি করতে পারি। রাজনীতিকে আমরা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না, কিন্তু তাতে অংশ নিয়ে তাকে পরিবর্তনের দিকে ঠেলে দিতে পারি।

এই গ্রীষ্মে, যখন ঘাম ঝরছে, রাস্তায় বহুদূর পর্যন্ত একটু ছায়া নেই, তখন শুধু শরীর নয়—মনও ক্লান্ত। তাই সময় এসেছে শুধু তাপমাত্রা নয়, রাজনীতির উত্তাপ নিয়েও ভাবার। কারণ, প্রকৃতির আগুন নিভে যায় বৃষ্টিতে, কিন্তু আমরা সবাই মিলে পানি ঢালতে এগিয়ে না এলে রাজনীতির আগুন নেভে না।

লেখক: সাংবাদিক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত