Ajker Patrika

বিশ্বজুড়ে ডানপন্থার উত্থান

জাহীদ রেজা নূর  
বিশ্বজুড়ে ডানপন্থার উত্থান

একবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে এসে বিশ্বজুড়ে চরম ডানপন্থার উত্থান ঘটছে কেন? পৃথিবীটা যেন তেতে আছে। যেকোনো মুহূর্তে যেকোনো জায়গায় লাগতে পারে আগুন, যেকোনোভাবে জনগণকে উত্তেজিত করে আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। নিজের ভাগ বুঝে নেওয়ার জন্য অন্যের সমূহ ক্ষতি করাও হয়ে উঠেছে আদর্শিক অবস্থান। কেন এমনটা ঘটল, তা নিয়ে কথা বলা দরকার।

বিংশ শতাব্দী সাম্যের স্বপ্ন দেখিয়েছিল পৃথিবীকে। একটা সময় মনে হয়েছিল, আদর্শগতভাবে সমাজতান্ত্রিক সাম্যের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী। মনে হয়েছিল, পুঁজিবাদ বা সাম্রাজ্যবাদের পতন সময়ের ব্যাপার মাত্র। সাহিত্যে-সংস্কৃতিতে বাম ঘরানার ভাবধারা শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। উপনিবেশবাদ-মুক্ত হয়ে যে দেশগুলো স্বাধীনভাবে নিজেদের অস্তিত্ব ঘোষণা করছিল, সেই দেশগুলোর তরুণদের মধ্যেও জায়গা করে নিয়েছিল বামপন্থা। সব মানুষের উপকার করতে চায় যে ব্যবস্থা, তার প্রতি তরুণদের আগ্রহ থাকা অস্বাভাবিক নয়। বরং যেসব দেশে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষমতার হাতবদল হয়েছে কিংবা যেসব দেশের সরকার স্বৈরাচার হয়ে উঠছিল, তাদের বিরুদ্ধে বামপন্থীরাই গড়ে তুলেছে মূল আন্দোলন।

সবাই জানে, নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধও থমকে গেছে। যদিও বলা হচ্ছে, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন মানেই স্বপ্নের পতন নয়, কিন্তু সোভিয়েত দেশটির নানা অন্যায়, অবিচারের সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর অনেকেরই মনে হয়েছে, শুধু আদর্শ দিয়ে রাষ্ট্র চলে না, যিনি সেই আদর্শ ধারণ করে সরকার চালান, তাঁর ভাবনাই অন্যদের প্রভাবিত করে। অর্থাৎ, আদর্শ কীভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে, সেই বাস্তবায়নের পথে অন্যায় হচ্ছে কি না, তার দায় সেই শাসকের। কোনো আদর্শ নিজে নিজে চলতে পারে না। যিনি চালান, তাঁর হাতেই থাকে প্রয়োগের ক্ষমতা। সোভিয়েত দেশে সে রকম ঘটনাই দেখা গেছে। গণচীনকে এখন সমাজতান্ত্রিক দেশ বলা যায় কি না, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। মূলত, ক্ল্যাসিক ভাবনায় গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্রের যে সংজ্ঞা ছিল, সেগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রূপ বদলেছে। এখন তাদের আগের রূপে পাওয়া যাবে না। আর সেই আবছায়ার মধ্য দিয়েই জন্ম নিয়েছে উগ্র ডানপন্থা।

২.

ইউরোপ আর আমেরিকায় ডানপন্থার উত্থানের পেছনে অভিবাসন একটি বড় কারণ। স্থানীয় জনগণ ভাবছে, অভিবাসন বাড়লে তারা তাদের সংস্কৃতি, চাকরি, নিরাপত্তা হারাতে পারে। জনগণের এই ভয়কে পুঁজি করে চরম ডানপন্থীরা রাজনীতি করে। তারা ঘোষণা করে, ‘আমাদের দেশটা আর আমাদের থাকছে না, একে রক্ষা করার ভার আমার নিজের।’ এই ঘোষণার মাধ্যমে তারা দেশব্যাপী ঘৃণা ছড়ায়। ‘তোমাদের চাকরি অন্যরা নিয়ে যাচ্ছে’—এই কথা বলে জাতিবিদ্বেষ ছড়ায়। অভিবাসীদের বিরুদ্ধে চরমপন্থা গ্রহণ করে।

পুঁজিবাদী বলয়ের মূলধারার রাজনীতির শঠতা, করপোরেট ব্যবস্থাপনায় পুঁজিবাদের তোষণ ইত্যাদি দেখে সাধারণ মানুষ যখন হতাশ হয়, তখন তারা এমন একজন নেতাকে খোঁজে, যে নেতা মুখে যা আসে তা-ই বলে থাকে। সোজাসাপটা কথা বলার ছলে বিদ্যমান রুচি, সম্মান ইত্যাদিকেও আঘাত করতে থাকে। নেতা কাউকে তোয়াক্কা করছে না—এটা সাধারণ মানুষ পছন্দ করে। তারা ভাবেও না, এই ক্রুদ্ধ, প্রতিহিংসাপরায়ণ ভাবধারার মধ্যে অন্যকে ঘৃণা করার বীজ রয়েছে। যখন বুঝতে পারে, তখন দেরি হয়ে যায়। আমরা এখানে চরম ডানপন্থী কয়েকজন বিশ্বনেতার ব্যাপারে কথা বলব। বুঝতে চাইব, কী করে তাঁরা নিজের দেশের জনগণের সমর্থন পেয়েছেন।

নামগুলো সবার জানা। যুক্তরাষ্ট্রের ডোনাল্ড ট্রাম্প, ব্রাজিলের বলসোনারো, ফ্রান্সের মেরিন ল পেন, ইতালির জর্জিয়া মেলোনিকে নিয়ে কথা বলার আগে ডানপন্থার উত্থানের আরও কিছু কারণ খুঁজে দেখতে চাই।

৩.

উগ্র ডানপন্থার বিকাশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটকে আসক্ত হয়ে উঠেছে এ সময়ের মানুষ। এই মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে উগ্র ডানপন্থার বিস্তার ঘটানো সহজ। মানুষের কোমল মনকে পুঁজি করে তাকে রাগিয়ে তুলে, ভয় দেখিয়ে, ষড়যন্ত্রতত্ত্বের গোলকধাঁধায় ফেলে তার ভেতরের মনুষ্যত্বকে কাঁপিয়ে দেওয়া যায় এবং ধীরে ধীরে তার মনে অন্যের সম্পর্কে ঘৃণা জাগিয়ে তোলা যায়। সেটা ধর্ম, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, অন্য দেশ, অন্য সংস্কৃতি—যেকোনো কিছুর বিরোধিতা হতে পারে।

আমরা গত শতাব্দীর ৩০-এর দশকে এ রকম একটি প্রবণতা দেখেছিলাম। সে সময় কী করে নাৎসিবাদ, ফ্যাসিবাদের জন্ম হলো, সেটাও কৌতূহলোদ্দীপক আলোচনার বিষয়। কিন্তু আমরা তো আরও প্রায় ১০০ বছর এগিয়ে এসেছি। তার পরও নানাভাবে সেই মতবাদের সমালোচনা করেও কেন অনেকের মনেই সেই ফ্যাসিবাদ, সেই নাৎসিবাদের ভূত ঢুকে পড়ছে, সেটাই বিস্ময়ের ব্যাপার। ‘আমিই শ্রেষ্ঠ’—এই মতবাদই কি মানুষকে নৃশংস করে তুলছে?

আরও ভয়ংকর ব্যাপার, এখন আর শুধু সামরিক পোশাকে স্বৈরাচার আসে না। বিংশ শতাব্দীতে সামরিক পোশাকে স্বৈরাচার আসত এবং বিশ্বব্যাপী তার প্রতিবাদ হতো। এখন গণতান্ত্রিক বা সমাজতান্ত্রিক কিংবা ধর্মীয় লেবাসে সে আসে এবং আলাদিনের জিন হয়ে গোটা দেশের ঘাড়ে চেপে বসে।

মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর বেশির ভাগই স্বৈরশাসকদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। সেখানকার মানবাধিকার প্রশ্নটি বহু দিন ধরেই আলোচনার বিষয় হয়ে আছে। ইসরায়েলি আক্রমণের মুখে ফিলিস্তিনের প্রতি তাদের সমর্থন অনেকটাই মৌখিক। বছরের পর বছর ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইসরায়েলের চালানো বিভীষিকা থেকে ফিলিস্তিনকে বের করে আনার উপায় কি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর নেই? ইসরায়েলের হাতে থাকা পারমাণবিক অস্ত্রই কি শুধু এর কারণ? নাকি আরব দেশের স্বৈরাচারী সরকারগুলো এই সংকটকে দূরের কোনো সংকট মনে করে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে? মধ্যপ্রাচ্যের স্বৈরশাসন নিয়ে আলাদা আলোচনা হতে পারে। এখানে ইউরোপ-আমেরিকায় ডানপন্থার উত্থান নিয়ে কথা বলব।

৪.

বুঝেই বলছি, ইউরোপের দেশগুলো এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকায় যে উপনিবেশবাদ গড়ে তুলেছিল, তা মূলত ছিল অমানবিক। নিজেদের প্রভু আর অন্যদের দাস হিসেবে দেখার প্রবণতা ছিল তাদের। কিন্তু এ কথা সত্য, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশে ইউরোপীয়দের অবদান অনেক। রেনেসাঁ আন্দোলনের মাধ্যমে মানবতাবাদের উত্থান, চার্চ আর রাজতন্ত্র থেকে নিজেদের মুক্ত করার সংগ্রাম পৃথিবীকে অনেকটাই এগিয়ে দিয়েছে। এতসবের পরও ইউরোপে কট্টর ডানপন্থা জেঁকে বসবে, সেটা কল্পনায় আনা ছিল কঠিন। কিন্তু সেটাই ঘটেছে। গত শতাব্দীতে মুসোলিনি আর হিটলার অনায়াসেই নিজ দেশের মানুষের হৃদয় জয় করে নিয়েছিল। তারা এসেছিল গণতান্ত্রিক পন্থায়। এর পরের ইতিহাস সবার জানা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মনে করা হয়েছিল, উগ্র জাতীয়তাবাদ, ফ্যাসিবাদ, নাৎসিবাদের কবর রচিত হয়েছে। কিন্তু সেটা যে নিছক আশাবাদ, তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে বিশ্ব। খোদ ইউরোপের দেশগুলোয় উগ্র ডানেরা এখন শক্তিশালী। ফ্রান্সের কথাই বলি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দীর্ঘ সময় ধরে ফ্রান্স শাসন করেছে মধ্য ডান ও মধ্য বামের রাজনৈতিক দলগুলো। কিন্তু সত্তর-আশির দশকে ন্যাশনাল ফ্রন্টের মাধ্যমে ল পেনের আবির্ভাব দেশটিতে উগ্র ডানের বীজতলা রচনা করে। মূলত উগ্র জাতীয়তাবাদ আর অভিবাসনবিরোধী অবস্থান নিয়ে ল পেন ফ্রান্সের নাগরিকদের মন জয় করে নেওয়ার চেষ্টা করেন। তাঁর মধ্যে মুসলিমবিদ্বেষও প্রবল। অনেক ডানপন্থীর মতো ল পেনও অভিবাসনকে সামাজিক নিরাপত্তা, সামাজিক সম্পদের ওপর হুমকি বলে প্রচার করেন। অভিবাসন সন্ত্রাস বাড়িয়ে দেয় বলেও তিনি প্রচার করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর কন্যা মেরিন ল পেন জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকেন। তিনি দুবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেন। শেষবার ২০২২ সালে প্রায় ৪১ শতাংশ ভোট পান। তিনি যে ক্রমেই ক্ষমতার কাছাকাছি চলে আসছেন, সেটা বোঝা যায় তাঁর প্রতি ভোটারদের আস্থা প্রকাশে। মেরিন শুধু অভিবাসনবিরোধীই নন, তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ছাঁটাই করে নিজ দেশের শক্তিতে চলার পক্ষপাতী। যে দেশে বিশাল এক বিপ্লব হয়েছিল, ভলতেয়ার, রুশো যে দেশের চিন্তক, ভিক্তর উগো যে দেশের হয়ে সাহিত্যকে পৌঁছে দিয়েছিলেন উচ্চতার শিখরে, সেই দেশে এখন উগ্র ডানের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে।

ইতালির জর্জিয়া মেলোনিও অনেকটা মেরিন ল পেনের মতো। ২০২২ সাল থেকে তিনি ইতালির প্রধানমন্ত্রী। দেশটির প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী তিনি। তাঁর দল ‘ব্রাদার্স অব ইতালি’ চরম ডানপন্থী দল। মুসোলিনির ফ্যাসিবাদ রয়েছে তাঁর দলের শিকড়ে। জাতীয়তাবাদের কথা বলে রক্ষণশীলতার আশ্রয়েই গড়ে উঠেছে তাঁর রাজনীতি। মূলত অভিবাসনকেই পুঁজি করে দেশের জনগণের নজর কেড়ে থাকে উগ্র ডানেরা। মেলোনিও তার ব্যতিক্রম নন। ইতালির ঐতিহ্যবাহী পারিবারিক কাঠামো ও ধর্মকে গুরুত্ব দেন তিনি। এর মানে, সাংস্কৃতিক বিনিময়ে তিনি বিশ্বাস করেন না। এটাও উগ্র জাতীয়তাবাদী আদর্শ।

এই রাজনীতি ‘আমরা’ ও ‘অন্যরা’কে উৎসাহিত করে। এই ‘আমরা’ জাতিকে রক্ষণশীলতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার চরমে নিয়ে যায়। ডোনাল্ড ট্রাম্পের ডানপন্থা নিয়ে কথা বললেই তা পরিষ্কার হয়ে যাবে। সেটাও বলা হবে আগামী লেখায়।

লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত