Ajker Patrika

আপসহীন রাজনীতিবিদ ও চিন্তাযোদ্ধা

মাসুদ রানা
বদরুদ্দীন উমর (২০ ডিসেম্বর ১৯৩১–৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫)
বদরুদ্দীন উমর (২০ ডিসেম্বর ১৯৩১–৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫)

৭ সেপ্টেম্বর বদরুদ্দীন উমরের জীবনের প্রস্থান হয়েছে। তাঁর এই প্রস্থানের মধ্য দিয়ে তিন পুরুষের রাজনৈতিক ধারারও সমাপ্তি ঘটেছে। তাঁর দাদা আবুল কাসেম ছিলেন তৎকালীন জাতীয় কংগ্রেসের পার্লামেন্টারিয়ান বোর্ডের সদস্য। বাবা আবুল হাশিম ছিলেন মুসলিম লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতা। আর তিনি ছিলেন কমিউনিস্ট ধারার নেতা।

বদরুদ্দীন উমর একই সঙ্গে রাজনীতিবিদ, লেখক-গবেষক, ইতিহাসবিদ ও মার্ক্সীয় তাত্ত্বিক। ক্ষমতার কাছে মাথা নত করেননি শেষ পর্যন্ত। তাঁকে অনেকে শুধু ভাষা আন্দোলনের গবেষক হিসেবে দেখে থাকেন। কিন্তু এর বাইরেও তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন।

পাকিস্তান জমানায় অনেক বুদ্ধিজীবী, লেখক-গবেষকে দেশের যুগান্তকারী আন্দোলনগুলোকে বিশেষ করে ভাষা আন্দোলনকে একপার্শ্বিকভাবে দেখেছিলেন, তখন তিনি সেই আন্দোলনে জনমানুষের ভূমিকাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। এভাবে তিনি তৎকালীন পূর্ব বাংলার মানুষের বিদ্রোহ, জনগণের কোন অংশ তাতে শক্তি জোগাল, দুর্বলতাটা কোথায় ছিল বলে আজও মুক্তি আসেনি, তা আমাদের সামনে তুলে ধরলেন তাঁর লিখিত তিন খণ্ডে—‘পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’তে।

বার্ধক্য অনেকের শরীর ও মনের শিরদাঁড়া বাঁকা করে দেয়, জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি সমাজ ও রাষ্ট্রের সামনে সততা ও মনীষা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সময়ের কাছে একজন রাজনীতিবিদের কাজ শুধু বিজয়ের জয়গান গাওয়া নয়, পরাজয় এবং তার কারণটা কোথায় লুকিয়ে আছে, তা অনুসন্ধান এবং পথ বাতলে দেওয়াটাও অন্যতম কাজ। তিনি এই জরুরি কাজেরই অন্যতম ব্যক্তি ছিলেন।

পাকিস্তান আমলে তাঁর সংস্কৃতি চিন্তার ট্রিলজি যেমন ‘সাম্প্রদায়িকতা’, ‘সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা’ ও ‘সংস্কৃতির সংকট’ বইগুলো পাকিস্তানবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির গোমর ফাঁস করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বাঙালিত্বের সঙ্গে মুসলমানিত্বের বিরোধ যে কৃত্রিম ব্যাপার, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা বলে যাকে চিহ্নিত করা হয়, তা যে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার, জাতীয়তাবাদী ধারণা শেষ পর্যন্ত কীভাবে স্বৈরতন্ত্রে রূপ নেয়, রাজনীতি যে শ্রেণির বাইরে ক্রিয়া করে না—সেসব তিনি তাঁর লেখালেখির মধ্য দিয়ে স্পষ্ট করেছেন। এই বই তিনটি প্রকাশ হওয়ার পর তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তাঁর প্রতি নাখোশ হয়। পরবর্তী সময়ে জীবন কীভাবে চলবে, সে চিন্তা না করে এক মহা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। তাঁর লেখক-গবেষকসত্তার পাশাপাশি তিনি শুধু অক্সফোর্ড ফেরত বিদ্বানের গরিমাই ছাড়েননি, আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা ছেড়ে দেন। সেটা ১৯৬৮ সালের কথা। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে দিয়ে লেখালেখি ও রাজনীতিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন।

বদরুদ্দীন উমরের আত্মজীবনী ‘আমার জীবন’ থেকে জানা যায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সময় তাঁর রাজনৈতিক চিন্তা ও সক্রিয়তার কথা। যার শুরু ১৯৬৪ সালে। সে বছর ভিয়েতনামে মার্কিন বিমানবাহিনীর টংকিং উপসাগরে হামলার ঘটনায় তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮০ জনের বেশি শিক্ষককে সমবেত এবং বিবৃতি দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী হামলার প্রতিবাদ করেন। তিনি বিবৃতি সংগঠিত করেই নিষ্ক্রিয় থাকেননি; ভিয়েতনামে হামলার প্রতিবাদে তিনি মার্কিন কনস্যুলেটে চিঠি দিয়ে তিন মাসের জন্য আমেরিকায় লিডারশিপ এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে যাওয়ার আমন্ত্রণও প্রত্যাখ্যান করেন। একইভাবে পাকিস্তানের মতাদর্শকে চ্যালেঞ্জ করার কারণে সরকারের সঙ্গে তাঁর বৈরিতা প্রবল হতে থাকায় তিনি পাকিস্তান সরকারের বৃত্তি নিয়ে ব্রিটেনের সোয়াসয়ে পিএইচডি করতে যাওয়ার বিষয়টি আর গ্রহণ করেননি।

এরপর তিনি লেখালেখির মাধ্যমে আমাদের ইতিহাসের গিঁটগুলো খুলতে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বই লেখেন। উনিশ শতকের কলকাতাকেন্দ্রিক বঙ্গীয় রেনেসাঁ নিয়ে তিনি পাল্টা যুক্তি হাজির করেন, যা এত দিন ধরে সেখানকার বুদ্ধিজীবীরা বঙ্গীয় রেনেসাঁ নিয়ে মহা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন। সেই জায়গা ধরে তিনি হাজির করেন বঙ্গীয় রেনসাঁর পাল্টা বয়ান, যা তিনি ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাংলার কৃষক’ ও ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও উনিশ শতকের বাঙালি সমাজ’ বই দুটিতে তুলে এনেছেন। এই ধারণা আমাদের নতুন এক ইতিহাসের কাছে নিয়ে যায়। আবার বঙ্গভঙ্গ ও ভারত ভাগের দায় যে কংগ্রেস নেতাদের, সেটা প্রমাণ করে তিনি তুলে এনেছেন ‘বঙ্গভঙ্গ ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি’ ও ‘ভারতীয় জাতীয় আন্দোলন’ গ্রন্থে। এই বই দুটি লেখার আগপর্যন্ত জয়া চ্যাটার্জির ‘ভারত ভাগ’ এবং সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ‘বাংলা বিভাজনের রাজনীতি-অর্থনীতি’ প্রকাশিত হয়নি।

এ ধরনের লেখালেখির পাশাপাশি তাঁকে আমরা রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় থাকতে দেখি। আমাদের দেশে রাজনীতির বাইরে গিয়ে বুদ্ধিজীবিতার চর্চার একটা রেওয়াজ প্রচলিত আছে। মানে বুদ্ধিজীবিতার সঙ্গে সক্রিয় রাজনীতির একটা ফারাক দেখা যায়। কিন্তু তিনি রাজনীতি ও বুদ্ধিজীবিতাকে সমান্তরাল রেখায় ধরে হেঁটেছেন। সে কারণে তাঁর লেখালেখি শুধু বুদ্ধিজীবিতার বুদবুদে আবিষ্ট থাকেনি, সেই লেখালেখির তাড়না তাঁকে রাজনৈতিক সক্রিয়তার দিকে টেনে নিয়ে গেছে। এ কারণে প্রথমে তিনি বিভিন্ন তৎকালীন পিকিংপন্থী পার্টির সঙ্গে যুক্ত হন। কিন্তু অল্প দিনের মধ্যে তাত্ত্বিকভাবে পার্টির কিংবদন্তি নেতাদের সঙ্গে বাস্তব কাজের বিরোধ থেকে তিনি পার্টি ত্যাগ করতে বাধ্য হন। যেমন স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তাঁর সঙ্গে বিরোধ ঘটে পিকিং ধারার অন্যতম নেতা কমরেড আবদুল হক ও তোয়াহার সঙ্গে। তাঁরা দুজন পাকিস্তানিদের পক্ষে অবস্থান নিলে বদরুদ্দীন উমর সেই তত্ত্বের বিরোধিতা করে সেই সময় বাঙালির মুক্তির সংগ্রামের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন।

’৭১-এর স্বাধীনতাযুদ্ধের পরে তিনি নতুন ভাবনায় পার্টি গঠনের দিকে অগ্রসর হন, যেটা কোনোভাবেই উপমহাদেশের প্রচলিত বাম ধারার রাজনীতির মতো রুশ, পিকিং ও মাও ধারার মতো ছিল না। তিনি পার্টি গঠনের প্রথম থেকেই নির্বাচনী রাজনীতির বিপক্ষে ছিলেন। আবার তিনি গ্রাম দিয়ে শহর দখলের রাজনীতির পথকেও ভুল বলেছেন। সে জন্য তাঁর পার্টির ক্ষমতা দখলের রাজনীতি ছিল জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে গণ-অভ্যুত্থানের পথ। এই চিন্তার ধারায় তিনি আজীবন স্থির ছিলেন। যদিও তাঁর নেতৃত্বাধীন পার্টি তেমনভাবে বিস্তৃতি লাভ করেনি।

আমার কাছে মনে হয়, তাঁর মতো জেদি, সৎ ও সাহসী মানুষের রাজনৈতিক নেতা হওয়ার কি আদৌ প্রয়োজন ছিল? তিনি তো একাই একটি প্রতিষ্ঠান। সে কারণেই আদমজী, ফিলিপস, ইতিহাস পরিষদ পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক এবং সর্বশেষ স্বাধীনতা পদক প্রত্যাখ্যান করতে তিনি এতটুকু দ্বিধান্বিত ছিলেন না।

সাপ্তাহিক ভিত্তিতে তাঁর পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা ‘যুদ্ধপূর্ব বাঙলাদেশ’ এবং ‘যুদ্ধোত্তর বাঙলাদেশ’ বই দুটি সেই সময়ের ঘটে যাওয়া ঘটনাবলির ভিন্ন এক দৃষ্টিতে লেখা। সেসব লেখা থেকে পাঠক জানতে পারবে সেই সময়ের ঘটনার ধারা বিবরণী।

বদরুদ্দীন উমর জীবনের শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস রেখেছেন, পুঁজিবাদই শেষ কথা নয়। সোভিয়েত সমাজতন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে, তবে একই সঙ্গে তিনি জোর দিয়ে বলতে চেয়েছেন পুঁজিবাদেরও শেষ পরিণতি আছে। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘সমাজতন্ত্রের আদৌ কোনো ভবিষ্যৎ আছে কি না, এ প্রশ্ন যদি কেউ তোলে, তাহলে এর বিপরীতে প্রশ্ন করতে হবে, পুঁজিবাদেরও কোনো ভবিষ্যৎ আছে কি না।’ সেই আশাবাদের জায়গায় দাঁড়িয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শে স্থির ছিলেন। তিনি প্রস্থান করেছেন। তবে তাঁর আপসহীন মনীষা দীর্ঘ সময় আমাদের অনুপ্রাণিত করবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত