Ajker Patrika

মোল্লা নাসিরউদ্দিনের গল্প স্রেফ গল্প নয়

বিধান রিবেরু
এবারের ঈদের আনন্দ শোভাযাত্রা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। 	ছবি: সংগৃহীত
এবারের ঈদের আনন্দ শোভাযাত্রা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ছবি: সংগৃহীত

আর কিছুদিন পরই পয়লা বৈশাখ। সেদিন মঙ্গল শোভাযাত্রা হবে, না আনন্দ শোভাযাত্রা, তা নিয়ে বিস্তর তর্ক-বিতর্কের পর স্থির হলো মঙ্গলেই সবাই নোঙর ফেলবে। আলাপ শুধু এখানে হলে ভালো হতো, দেখা গেল মঙ্গল শোভাযাত্রায় কোন ধরনের মোটিফ ও পুতুল থাকবে, তা নিয়েও চলল তুমুল তর্ক। বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিছু মোটিফ নিয়ে আপত্তি তোলা হলো। আগের তুলনা টানা হলো। আবার বলা হলো রাজনৈতিক পুতুল তো থাকতেই পারে। তো এই তুমুল তর্ক-বিতর্কের ভেতর কিছু কাটছাঁট হলো। উদ্বাহু পুতুল বাদ পড়ল। বৈশাখী শোভাযাত্রাসংক্রান্ত বাহাসের ভেতরেই অতিবাহিত হলো পবিত্র ঈদুল ফিতর।

সবাই ঈদের সময় অপূর্ব এক শোভাযাত্রা পর্যবেক্ষণ করল। যেখানে আরব্য রজনীর চেরাগি দৈত্য, আলাদিন, আলিবাবা প্রমুখ চরিত্র এসেছে। বাদ পড়েছে শেহেরজাদি, জেসমিন, মর্জিনাদের মতো নারী চরিত্র। তবে এই শোভাযাত্রায় সবচেয়ে বেশি আলোচনায় ছিলেন তুর্কি দেশের কাল্পনিক চরিত্র মোল্লা নাসিরউদ্দিন হোজ্জা। কারণ, লোকজন তাঁর মুখাবয়বে নাকি অন্য হোমরাচোমরাদের মিল খুঁজে পেয়েছে! নাসিরউদ্দিনের প্রসঙ্গ যখন এল, তখন ওনার সর্বজনশ্রুত একটি গল্পের কথা মনে করিয়ে দিই।

একবার নাসিরউদ্দিনকে দেখা গেল, রাতের বেলায় তিনি কী যেন খুঁজছেন রাস্তায়। এক পথচারী এসে জিজ্ঞেস করলেন, কী খুঁজছেন মোল্লা সাহেব? নাসিরউদ্দিন উত্তর দিলেন, চাবি খুঁজছি। পথচারী ভাবলেন মোল্লাকে তিনি একটু সহায়তা করবেন চাবি খোঁজায়। দুজন মিলে অনেক খোঁজাখুঁজি চলছে। তো পথচারী আবার জিজ্ঞেস করলেন, ঠিক কোন জায়গায় পড়েছিল আপনার চাবিটা? মোল্লা এবার গম্ভীর মুখে বললেন, ঘরে। জবাব শুনে পথচারীর মূর্ছা যাওয়ার দশা। তিনি বললেন, ঘরে চাবি হারিয়েছে, তো রাস্তায় এসে খুঁজছেন কেন? মোল্লা উত্তরে বললেন, ভাই, ঘরে আলো নেই, আর রাস্তায় আলো রয়েছে। যেখানে আলো, সেখানেই তো হারানো জিনিস খুঁজব। ঘরে খোঁজার আলো থাকলে ঘরেই খুঁজতাম।

গল্পটি স্রেফ গল্প হলে এটি পুনরায় বলে সময় নষ্ট করতাম না। বর্তমানে যা হচ্ছে বাংলাদেশে, এই গল্পের সঙ্গে প্রচণ্ড রকম সমাপতন ঘটে। আর এমনই তার মাত্রা যে, লোকজন পয়লা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রার পাল্টা জবাবে ঈদের আনন্দযাত্রাতে নাসিরউদ্দিনকে হাজির করে ফেলেছে। একেই বলে ফ্রয়েডের ‘অচেতন’। নাসিরউদ্দিন যেমন সমস্যা যেখানে, সেখানে না খুঁজে ভিন্ন জায়গায় গিয়ে সমাধান খুঁজছিল, বাংলাদেশেও এই আনন্দ শোভাযাত্রার পৃষ্ঠপোষক ও সমর্থকেরা ভিন্ন জায়গায় সমাধান খুঁজছেন। কারণ, তাঁরা জানেন, আসল সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা ও শক্তি তাঁদের নেই। সত্যিকারের সমাধানের জন্য যে অন্ধকার দূর করতে হবে, যে হাজার ওয়াটের আলো জ্বালাতে হবে, সেই জ্বালানি বা দূরদর্শিতা তাঁদের নেই।

বাংলাদেশের মানুষ কী চায়? একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ এবং পরিচ্ছন্ন ও জবাবদিহিমূলক রাজনীতি। এর জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রথমেই রাখা প্রয়োজন দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে। কারণ, শিক্ষার মাধ্যমেই একটি জাতির ভবিষ্যৎকে অভিন্ন মুখে ধাবিত করা সম্ভব। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কমপক্ষে পাঁচ রকম, ছেলেমেয়েরা ভিন্ন ভিন্ন চিন্তাধারা নিয়ে বড় হয় এখানে। সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার, মানবিক মর্যাদা ইত্যাদি সম্পর্কিত ধারণা তাদের একেক জনের একেক রকম। কাজেই তারা ভিন্ন ভিন্ন তরিকা নিয়ে যখন বড় হয়, তখন তারা রাষ্ট্রকে ভিন্ন ভিন্ন তরিকায় গড়ে তোলার চেষ্টা করে। আর তাতেই দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। এই দ্বন্দ্ব ধীরে ধীরে চরমে উন্নীত হয় এবং সেটার ছাপ সমাজ থেকে রাষ্ট্র—সর্বত্র প্রকট হয়ে ওঠে। কেউ মনে করে দেশীয় সমাজ ও সংস্কৃতি আগে। কেউ মনে করে ধর্মটা আগে। কেউ মনে করে বিদেশি সংস্কৃতিই সেরা। কেউ কেউ আবার হাইব্রিড! এই তো চলছে দেশে।

এখন যে আলাপটি ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, একাত্তর না চব্বিশ, এসব আলাপের গোড়াও কিন্তু সেই একটা জায়গাতেই। ন্যূনতম ইতিহাস জ্ঞান যাঁর আছে, তিনি কখনোই বাংলাদেশের একাত্তর সালের ইতিহাসের সঙ্গে এই ২০২৪-কে তুলনা করবেন না। কিন্তু গোড়ায় গলদ থাকলে যা হয়, সেটাই হচ্ছে। আর তার খেসারত দিতে হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধবিজড়িত স্থাপনা, জাদুঘর ও স্মৃতি সংরক্ষণ কেন্দ্রগুলোকে। শাহবাগের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা জাদুঘরে ভাঙচুর, ধানমন্ডি ৩২ শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া, লালমনিরহাটের বিডিআর রোডে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্মারক মঞ্চে স্থাপিত ম্যুরাল ভেঙে ফেলা ইত্যাদি সেসব বোঝাপড়ার গলদের একেকটি উদাহরণমাত্র। তালিকা দিয়ে লেখা ভারাক্রান্ত করতে চাই না। শুধু বলতে চাই, সমাধান আমরা যেখানে খুঁজছি, সমাধান সেখানে নেই।

আমরা দেশের নাম পাল্টাতে চাইছি। আমরা সংসদকে ভেঙে নতুন নিয়মে সাজাতে চাইছি। আমরা রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে সংস্কার কমিটি গঠন করে অনেক অনেক পরামর্শ দিতে চাইছি। আমরা আরও হাজারো জিনিস করতে চাইছি। কিন্তু ক্ষমা করবেন, এসব চাওয়া ও বলা দিয়ে অশ্বডিম্ব প্রসব বৈ কিছুই হবে না। যত দিন না পর্যন্ত একমুখী শিক্ষার মাধ্যমে এ দেশের শিশুরা প্রকৃত অর্থেই মানুষ হয়ে উঠছে, যত দিন না তারা মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের পাশাপাশি অপরকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসছে, যত দিন না পর্যন্ত তারা সহিষ্ণুতার অর্থ বুঝতে পারছে, তত দিন এ দেশের আর কিছু হবে না। ভবিষ্যৎ অন্ধকারেই থাকবে, আর আমরা সমাধানের ‘চাবি’ খুঁজতে থাকব অন্যের জ্বালিয়ে রাখা রাস্তায়।

একটি দেশের যদি তার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা না থাকে এবং তার বদলে যদি হঠকারী ও আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হতে থাকে, তাহলে সেই জাতির অধঃপতন ঠেকায় কে? দেখুন যে সরকারই বাংলাদেশে এসেছে, তারা কোমলমতি শিশুদের পাঠ্যবইয়ে তাদের বয়ান জোরপূর্বক ঢুকিয়ে দিয়েছে। তারা শিশুদের বাধ্য করেছে সেসব অখাদ্য লেখা, বিকৃত ইতিহাস ও একচোখা ভাবাদর্শকে মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় লিখতে। দুঃখজনক হলেও সত্য, সংস্কারের কথা বলা সরকারও এই বাজে চর্চা থেকে বেরোতে পারেনি। তারাও ব্যাপক অস্ত্রোপচার করেছে পাঠ্যবইগুলোতে। অথচ এসব বইতে বাংলা ভাষাসহ, বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার মহান লেখকদের লেখা অনুবাদ করে সিলেবাস বানানো যেত। শুধু তা-ই নয়, একক ধর্মবই বাতিল করে, সমন্বিত ধর্মবই তৈরি করা যেত। এতে করে শিশুরা সব ধর্ম সম্পর্কে জানতে পারত। শুধু তা-ই নয়, সমাজে অসাম্প্রদায়িক মনোভাব বাড়ত এবং মানুষ একে অপরের প্রতি

শ্রদ্ধাশীল ও সহিষ্ণু হয়ে উঠত। যেহেতু বড়দেরও বইগুলো পড়তে হতো, শিক্ষক ও অভিভাবক হিসেবে। দেশ একটি উন্নত জাতি পেত। কিন্তু ওই যে গোড়ায় গলদ! আমরা কেবল জানি বিভেদের পথে যেতে। বিভেদ তো তৈরি হয়ে আছে শৈশব থেকেই। ছোটবেলা থেকেই শেখানো হয় ‘আমরা আর তোমরা’।

শিক্ষাব্যবস্থা বলতে আমি শুধু শ্রেণিকক্ষকে বোঝাইনি। সামাজিক বলয়ের ভেতরেও এই শিক্ষাব্যবস্থা প্রসারিত

করতে হবে। পাড়া-মহল্লায় পাঠাগার ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বাড়াতে হবে। বইপড়া কর্মসূচি থাকতে হবে, ছেলেমেয়েরা নিয়ম করে চলচ্চিত্র দেখবে। নাটক মঞ্চস্থ করবে, কবিতা আবৃত্তি করবে, গান গাইবে।

দেশ মানে কিন্তু বিমূর্ত কিছু নয়, দেশ মানে দেশের মানুষ। এই মানুষেরাই রাজনীতি করে, রাষ্ট্র পরিচালনা করে, মানুষের মঙ্গল চিন্তা করে। এখন যারা এই দেশের ভবিষ্যৎ মানুষ, তাদের কথা ভাবা ব্যতিরেকে আপনি যদি দেশের সংস্কার করতে চান, তো সেটা নাসিরউদ্দিন হোজ্জার মতো পণ্ডশ্রমই হবে। উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালেই তো বোঝা যায় তফাতটা কোথায়? তাদের শিক্ষা খাতে বরাদ্দ কত? আর আমাদের কত? আমাদের শিক্ষা খাতে বরাদ্দ মোট দেশজ উৎপাদনের মাত্র (জিডিপি) দেড় শতাংশের একটু বেশি। এই বরাদ্দ দিয়ে যে কিছুই হয় না সেটা নীতিনির্ধারকেরা জানেন। কিন্তু তারপরও তাঁরা এসব ব্যাপারে নির্বিকার। একেবারে ব্যতিক্রমহীনভাবে প্রত্যেক সরকারই শিক্ষার ব্যাপারে একই আচরণ করেছে। ভুটানের মতো ছোট দেশ যদি শিক্ষা খাতে জিডিপির ৮ শতাংশের বেশি বরাদ্দ রাখতে পারে, আমরা নাকি মধ্যম আয়ের দেশ হয়েছি, কত হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হচ্ছে, আমাদের তবে শিক্ষার জন্য এত কার্পণ্য কেন? এটাই হওয়া উচিত গোড়ার প্রশ্নগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও চলচ্চিত্র সমালোচক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মামলার আসামিসহ বিএসইসির ২২ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত

সরকারি টাকায় ব্যক্তিগত সড়ক কার্পেটিং বিচারপতি খিজির হায়াতের, প্রমাণ পেয়েছে দুদক

অভিনেতা সিদ্দিককে মারধর করে থানায় সোপর্দ, ছিঁড়ে ফেলা হয় পরনের পোশাক

ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের তেলের বরাদ্দ ২৫০ থেকে বেড়ে ৫০০ লিটার

বগুড়ায় ছাত্রদল নেতার ওপর হামলা, পাঁচ নেতা-কর্মীকে শোকজ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত