মামুনুর রশীদ
১২ নভেম্বর সকালেই একটি দুঃসংবাদ আমাকে বিমর্ষ করে দেয়। সেই সঙ্গে তাঁর অনেক ভক্ত-শুভাকাঙ্ক্ষী এবং আমার পরিচিত বন্ধুরা জানাতে শুরু করেন আমার প্রিয় অগ্রজ বন্ধু মনোজ মিত্র আর নেই। কলকাতা থেকেও অনেক বন্ধু সংবাদটি জানিয়েছেন। এর আগেও গুজব উঠেছিল মনোজ মিত্র মারা গেছেন, কিন্তু এর পরেই আমার এক বন্ধু পত্রিকা পাঠরত মনোজ মিত্রকে দেখালেন এবং জানালেন তিনি বেঁচে আছেন। মনোজ মিত্রের সঙ্গে পরিচয় আমার দীর্ঘদিনের, ৪০ বছরের বেশি সময়ের।
এমনিতেই নাট্যকার ও অভিনেতা হিসেবে আমি মনোজ মিত্রের ভক্ত ছিলাম আগে থেকে। একবার ১৯৯০ সালে প্রথম একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ ঘটল, পশ্চিমবঙ্গ নাট্য একাডেমি আয়োজিত নাট্যকার কর্মশালায়। কলকাতা থেকে বেশ দূরে সাগরদ্বীপে। ২১ জন তরুণ নাট্যকারকে নিয়ে ৭ জন নাট্য শিক্ষকের এই কর্মশালা। এই ৭ জনের মধ্যে আমি ছিলাম সবচেয়ে কনিষ্ঠ শিক্ষক। সেই কারণে নাট্যকারদের প্রচুর স্নেহ পেয়েছি। আর যাঁরা তরুণ নাট্যকার তাঁদের কাছ থেকে পেয়েছি বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা। সম্ভবত প্রায় ১২ দিনব্যাপী এই কর্মশালায় আমরা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে কাজ করেছিলাম। সেই সময় টেলিফোন যোগাযোগের তেমন কোনো সুবিধা ছিল না। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কর্মশালা চলত। এর মধ্যে বিকেল বেলাটা ছিল টিউটোরিয়াল। তখন ছিল শীতকাল। দুপুরের খাবারের পর তিন তরুণ নাট্যকারকে নিয়ে আমি সাগরপাড়ে গিয়ে বসতাম। নানান কথার ফাঁকে ফাঁকে, চা খেতে খেতে নাট্যকারদের সঙ্গে নাটকের ‘এম্পটি স্পেস’ নিয়ে কথা বলতাম, বালুর ওপরে মঞ্চের ছবি আঁকতাম, নাটকের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতাম। এর আগে আমি দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ফিরেছি। সেই দেশের নাটকের অভিজ্ঞতা নিয়েও কথা বলতাম। এমনি করেই ১২টা দিন কেটে গেল।
রাতের বেলায় আমাদের আড্ডা জমত। আড্ডায় অরুণ মুখার্জি, চন্দন সেন, অশোক মুখোপাধ্যায়, বিষ্ণু বসু, রবীন্দ্র ভট্টাচার্য এবং আরও দু-একজন থাকতেন। মনোজ মিত্র ছিলেন আমাদের মধ্যমণি। কারণ, তিনি ছিলেন আমাদের মধ্যে সবচেয়ে রসিক। আমরা কত কিছু যে বলতাম, কত যে নাটকের সংলাপ আওড়াতাম, কত যে রাজা-উজির মারতাম তার শেষ নেই। তারপর একদিন কর্মশালা শেষ হলো। আমরাও পরস্পরের সঙ্গে আজীবন বন্ধুত্বের সুতোয় নিজেদের বাঁধলাম।
মনোজ মিত্র আমার নাটক দেখতেন, আমিও মনোজ মিত্রের নাটক শুধু দেখতাম না, নতুন নাটক লিখলে তাঁর পাণ্ডুলিপি শোনানোর জন্য আমায় ডাকতেন। পাণ্ডুলিপি পাঠ করার পর সিগারেট এগিয়ে দিতাম, একটা মিষ্টি হাসি হেসে জিজ্ঞাসা করতেন, ‘কেমন লাগল গো?’ আমিও একটি সিগারেট ধরিয়ে বলতাম, ‘একটু পরে মনোজ দা।’ তারপর কখনো কখনো মধ্যরাত্রি পর্যন্ত নাটক নিয়ে আলোচনা চলত। এই নাটক শোনার এবং কথা বলার অভিজ্ঞতায় যুক্ত হতেন অরুণ মুখোপাধ্যায়, কখনো বিভাস চক্রবর্তী ও অশোক মুখোপাধ্যায়। কোনো গুরুজনসুলভ কথাবার্তা নেই, যেন আমরা সবাই একই বয়সের। অথচ এই তিনজনই আমার চেয়ে ১০ বছরের বড়।
সেই সময়ে অবশ্য আমার আরেকজন অগ্রজ বন্ধু ছিলেন, যিনি বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নট ও নাট্যকার উৎপল দত্ত। তাঁর সঙ্গেও গভীর রাত অবধি আড্ডা দেওয়ার অভিজ্ঞতা আমার আছে। সবার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ‘তুমি-আমি’। উৎপল দত্তের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের সম্পর্কের কারণে এই বন্ধুরা একটু ঈর্ষান্বিতই হতেন। কারণ, তাঁরা উৎপল দত্তের কাছে সহজ হতে পারতেন না। মনোজ দাদার সঙ্গে পারিবারিক সূত্রে আমি আবদ্ধ হয়ে যাই। বউদি, মনোজ দাদার পিতা অর্থাৎ কাকাবাবু সবার কাছ থেকেই আমি অকপট স্নেহ আদায় করেছি।
মনোজ দাদা যখন বাংলাদেশে আসেন দেশ নাটকের আমন্ত্রণে, তখনই জানতে পারি তাঁর বাবা এবং আমার বাবা টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে একই জায়গায় চাকরি করতেন ১৯৪৮ সালে। আমার যে বছর জন্ম হয়, সেই বছর মনোজ দাদার বয়স ১০। একদিন সকালে নাশতা করে আমরা টাঙ্গাইলের সেই কালিহাতীতে যাই। আমার বাবা ছিলেন পোস্টমাস্টার আর তাঁর বাবা ছিলেন ভারতীয় হাইকমিশনের কর্মকর্তা। আমরা আমাদের সেই সময়কার আবাসভূমিটা দেখলাম। তারপর দুই বাবার কাছে দুটি পোস্টকার্ড লিখলাম। পোস্টকার্ড পেয়ে খুবই আনন্দিত হলেন আমার এবং মনোজ দাদার বাবা। এরপর বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম তিনি মনোজ দাদার পরিবারকে চেনেন কি না। মনোজদার বাবা এবং আমার বাবা দুজনেই সেই সময়ের কথা স্মরণ করতে পারলেন এবং মহা আনন্দিত হলেন। দুজনের কেউ আজ আর বেঁচে নেই।
আমাদের সার্বক্ষণিক কথাবার্তাই হতো নাটক নিয়ে। দুই বাংলার নাটক, নাটকের সমস্যা, নাটকের ভবিষ্যৎ—এইসব। আমাদের পরিবারের লোকেরা বলত পৃথিবীতে যেন নাটকের বাইরে এদের আর কিছু নেই। আসলেই তাই। নাটকের লোকেরা খুব স্বার্থপর। নাটকের বাইরে তাঁদের বাইরের যে জগৎটা, সেই জগৎটা নিয়েই তাঁরা কাজ করেন। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে নাটকটাই তাঁদের মুখ্য আলোচনা, মুখ্য অবসর, মুখ্য জীবন। কিন্তু সবাই সমাজ নিয়ে পীড়িত—সমাজে অসাম্য, মানবিক এবং রাজনৈতিক সংকট।
সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, বাদল সরকার, বিজয় টেন্ডুলকার, মহেল এলকুঞ্চেয়ার, রতন থিয়াম বা রিচার্ড শেকম্যানসহ সবার সঙ্গেই আমার দীর্ঘ আড্ডা হতো। সবাইকে দেখেছি একই আলোচনার সীমানায়। সেই আলোচনায় রাজনীতিটা আসবেই। শাসকগোষ্ঠীর প্রতি সমালোচনা। মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন কেন হচ্ছে না, এসব নিয়েই কথাবার্তা হতো বেশি। তবে শিল্পে তার প্রতিফলন ঘটেনি খুব একটা, তা নিয়েও যেন কথার শেষ নেই। রাজনীতিবিদেরা কী করতে পারছেন, কী পারছেন না বা আমরা কতটা করতে পেরেছি বা পারছি না—তা নিয়েই দীর্ঘ দীর্ঘ আলোচনা।
সম্প্রতি কলকাতায় যাওয়ার পর কী করে যেন মনোজদা জানতে পেরেছেন আমি সেখানে। তিনি বারবার ফোনে তাগিদ দিতে শুরু করলেন আমি যেন অবশ্যই তাঁর সঙ্গে দেখা করি। সল্টলেকে তাঁর বাড়িতে যাওয়ার পর বুঝতে পারলাম অনেকক্ষণ ধরে তিনি আমার জন্য অপেক্ষা করেছেন। পাশাপাশি বসার পরেই আমার হাতটা ধরলেন, তাঁর চোখ ছলছল। আমার সঙ্গে বন্ধু ইমানুল ছিল। অনেকক্ষণ কথা না বলে আমাদের আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটল। ইমানুল অবাক হয়ে, বাক্রুদ্ধ হয়ে এই দৃশ্য দেখছিল। তারপর কথার ফুল ফুটল। সব স্মৃতিকথা। পাশের ঘরে বউদি রয়েছেন। তিনি দীর্ঘদিন পক্ষাঘাতগ্রস্ত শয্যাশায়ী। আমরা বউদিকে অনেকক্ষণ জাগাবার চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না। দাদা শেষ কথা বললেন, ‘মামুন, আমি আবার ঢাকায় যাব, আবার সেই কালিহাতীতে যাব, টাঙ্গাইলে তোমার মায়ের সঙ্গে দেখা করব।’ সেই আশা আমি মনের মধ্যে রেখেছিলাম বটে, কিন্তু ১২ নভেম্বর সকালেই সেখানে এক যবনিকা টানা হয়ে গেল। দৃশ্যত সেই যবনিকা টানা হলেও জীবনে তাঁর আসা-যাওয়া তো বন্ধ হবে না।
যেকোনো শিল্পীর জন্যই তাঁর সমসাময়িক কালটা কখনোই সুখের হয় না। আমরা যুদ্ধ করে একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি। কিন্তু তার পর থেকেই এই স্বদেশভূমিটা যেকোনো শিল্পীর জন্যই বিরুদ্ধ। আমরা সব সরকারের আমলেই সমালোচনামুখর। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো আমাদের কখনো নিজেদের মিত্র ভাবে না। হয়তো আমাদের এর মধ্যে কেউ কেউ দলবদ্ধ থেকে সরাসরি দলের হয়ে কাজ করেন। কিন্তু অধিকাংশই তা করেন না। আবার যাঁদের দলের সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক, তাঁরাও আন্দোলনের ডাক দিলে পাশে দাঁড়ান। তবে অবশ্যই সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে আমরা সবাই একসূত্রে দাঁড়িয়ে যাই। আমাদের এই দেশে কঠোর ধর্মীয় অনুশাসন আছে। সেখানে শিল্পকর্ম কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হলেও ওই দলগুলো কখনো সরাসরি আক্রমণ করে না।
কিন্তু সাম্প্রতিককালে সরকারকে সন্তুষ্ট করার জন্য কিছু ব্যক্তি শিল্পের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। তারা কোনো মতবাদ নিয়ে নয়, একেবারেই পেশিশক্তি নিয়ে শিল্পের কাজকে প্রতিহত করার চেষ্টা করছে। এই অপচেষ্টাকে আমাদের অসাম্প্রদায়িক সমাজ কোনো অবস্থাতেই প্রশ্রয় দিচ্ছে না। কিন্তু কিছু তথাকথিত শিক্ষিত লোক নানা ধরনের অপচেষ্টায় লিপ্ত হচ্ছে। এই প্রবণতাকে ধরে রাখছে এবং শিল্প-সাহিত্যে স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশকে বিঘ্নিত করার চেষ্টা করছে। আমরা যাঁরা শিল্পকর্ম করি, নানা প্রতিকূলতা এবং সংকটের মধ্য দিয়েই করি। এটা সবার বোঝা প্রয়োজন। দালালির কাজ করে খুব একটা মুনাফা এখান থেকে অর্জন করা সম্ভব নয়। কারণ, শিল্পকর্মে মিথ্যা বলা যায় না। নাটকের মঞ্চে তো একেবারেই নয়। এই প্রবণতা থেকে সবারই মুক্ত হওয়া আশু প্রয়োজন।
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব
১২ নভেম্বর সকালেই একটি দুঃসংবাদ আমাকে বিমর্ষ করে দেয়। সেই সঙ্গে তাঁর অনেক ভক্ত-শুভাকাঙ্ক্ষী এবং আমার পরিচিত বন্ধুরা জানাতে শুরু করেন আমার প্রিয় অগ্রজ বন্ধু মনোজ মিত্র আর নেই। কলকাতা থেকেও অনেক বন্ধু সংবাদটি জানিয়েছেন। এর আগেও গুজব উঠেছিল মনোজ মিত্র মারা গেছেন, কিন্তু এর পরেই আমার এক বন্ধু পত্রিকা পাঠরত মনোজ মিত্রকে দেখালেন এবং জানালেন তিনি বেঁচে আছেন। মনোজ মিত্রের সঙ্গে পরিচয় আমার দীর্ঘদিনের, ৪০ বছরের বেশি সময়ের।
এমনিতেই নাট্যকার ও অভিনেতা হিসেবে আমি মনোজ মিত্রের ভক্ত ছিলাম আগে থেকে। একবার ১৯৯০ সালে প্রথম একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ ঘটল, পশ্চিমবঙ্গ নাট্য একাডেমি আয়োজিত নাট্যকার কর্মশালায়। কলকাতা থেকে বেশ দূরে সাগরদ্বীপে। ২১ জন তরুণ নাট্যকারকে নিয়ে ৭ জন নাট্য শিক্ষকের এই কর্মশালা। এই ৭ জনের মধ্যে আমি ছিলাম সবচেয়ে কনিষ্ঠ শিক্ষক। সেই কারণে নাট্যকারদের প্রচুর স্নেহ পেয়েছি। আর যাঁরা তরুণ নাট্যকার তাঁদের কাছ থেকে পেয়েছি বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা। সম্ভবত প্রায় ১২ দিনব্যাপী এই কর্মশালায় আমরা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে কাজ করেছিলাম। সেই সময় টেলিফোন যোগাযোগের তেমন কোনো সুবিধা ছিল না। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কর্মশালা চলত। এর মধ্যে বিকেল বেলাটা ছিল টিউটোরিয়াল। তখন ছিল শীতকাল। দুপুরের খাবারের পর তিন তরুণ নাট্যকারকে নিয়ে আমি সাগরপাড়ে গিয়ে বসতাম। নানান কথার ফাঁকে ফাঁকে, চা খেতে খেতে নাট্যকারদের সঙ্গে নাটকের ‘এম্পটি স্পেস’ নিয়ে কথা বলতাম, বালুর ওপরে মঞ্চের ছবি আঁকতাম, নাটকের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতাম। এর আগে আমি দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ফিরেছি। সেই দেশের নাটকের অভিজ্ঞতা নিয়েও কথা বলতাম। এমনি করেই ১২টা দিন কেটে গেল।
রাতের বেলায় আমাদের আড্ডা জমত। আড্ডায় অরুণ মুখার্জি, চন্দন সেন, অশোক মুখোপাধ্যায়, বিষ্ণু বসু, রবীন্দ্র ভট্টাচার্য এবং আরও দু-একজন থাকতেন। মনোজ মিত্র ছিলেন আমাদের মধ্যমণি। কারণ, তিনি ছিলেন আমাদের মধ্যে সবচেয়ে রসিক। আমরা কত কিছু যে বলতাম, কত যে নাটকের সংলাপ আওড়াতাম, কত যে রাজা-উজির মারতাম তার শেষ নেই। তারপর একদিন কর্মশালা শেষ হলো। আমরাও পরস্পরের সঙ্গে আজীবন বন্ধুত্বের সুতোয় নিজেদের বাঁধলাম।
মনোজ মিত্র আমার নাটক দেখতেন, আমিও মনোজ মিত্রের নাটক শুধু দেখতাম না, নতুন নাটক লিখলে তাঁর পাণ্ডুলিপি শোনানোর জন্য আমায় ডাকতেন। পাণ্ডুলিপি পাঠ করার পর সিগারেট এগিয়ে দিতাম, একটা মিষ্টি হাসি হেসে জিজ্ঞাসা করতেন, ‘কেমন লাগল গো?’ আমিও একটি সিগারেট ধরিয়ে বলতাম, ‘একটু পরে মনোজ দা।’ তারপর কখনো কখনো মধ্যরাত্রি পর্যন্ত নাটক নিয়ে আলোচনা চলত। এই নাটক শোনার এবং কথা বলার অভিজ্ঞতায় যুক্ত হতেন অরুণ মুখোপাধ্যায়, কখনো বিভাস চক্রবর্তী ও অশোক মুখোপাধ্যায়। কোনো গুরুজনসুলভ কথাবার্তা নেই, যেন আমরা সবাই একই বয়সের। অথচ এই তিনজনই আমার চেয়ে ১০ বছরের বড়।
সেই সময়ে অবশ্য আমার আরেকজন অগ্রজ বন্ধু ছিলেন, যিনি বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নট ও নাট্যকার উৎপল দত্ত। তাঁর সঙ্গেও গভীর রাত অবধি আড্ডা দেওয়ার অভিজ্ঞতা আমার আছে। সবার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ‘তুমি-আমি’। উৎপল দত্তের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের সম্পর্কের কারণে এই বন্ধুরা একটু ঈর্ষান্বিতই হতেন। কারণ, তাঁরা উৎপল দত্তের কাছে সহজ হতে পারতেন না। মনোজ দাদার সঙ্গে পারিবারিক সূত্রে আমি আবদ্ধ হয়ে যাই। বউদি, মনোজ দাদার পিতা অর্থাৎ কাকাবাবু সবার কাছ থেকেই আমি অকপট স্নেহ আদায় করেছি।
মনোজ দাদা যখন বাংলাদেশে আসেন দেশ নাটকের আমন্ত্রণে, তখনই জানতে পারি তাঁর বাবা এবং আমার বাবা টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে একই জায়গায় চাকরি করতেন ১৯৪৮ সালে। আমার যে বছর জন্ম হয়, সেই বছর মনোজ দাদার বয়স ১০। একদিন সকালে নাশতা করে আমরা টাঙ্গাইলের সেই কালিহাতীতে যাই। আমার বাবা ছিলেন পোস্টমাস্টার আর তাঁর বাবা ছিলেন ভারতীয় হাইকমিশনের কর্মকর্তা। আমরা আমাদের সেই সময়কার আবাসভূমিটা দেখলাম। তারপর দুই বাবার কাছে দুটি পোস্টকার্ড লিখলাম। পোস্টকার্ড পেয়ে খুবই আনন্দিত হলেন আমার এবং মনোজ দাদার বাবা। এরপর বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম তিনি মনোজ দাদার পরিবারকে চেনেন কি না। মনোজদার বাবা এবং আমার বাবা দুজনেই সেই সময়ের কথা স্মরণ করতে পারলেন এবং মহা আনন্দিত হলেন। দুজনের কেউ আজ আর বেঁচে নেই।
আমাদের সার্বক্ষণিক কথাবার্তাই হতো নাটক নিয়ে। দুই বাংলার নাটক, নাটকের সমস্যা, নাটকের ভবিষ্যৎ—এইসব। আমাদের পরিবারের লোকেরা বলত পৃথিবীতে যেন নাটকের বাইরে এদের আর কিছু নেই। আসলেই তাই। নাটকের লোকেরা খুব স্বার্থপর। নাটকের বাইরে তাঁদের বাইরের যে জগৎটা, সেই জগৎটা নিয়েই তাঁরা কাজ করেন। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে নাটকটাই তাঁদের মুখ্য আলোচনা, মুখ্য অবসর, মুখ্য জীবন। কিন্তু সবাই সমাজ নিয়ে পীড়িত—সমাজে অসাম্য, মানবিক এবং রাজনৈতিক সংকট।
সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, বাদল সরকার, বিজয় টেন্ডুলকার, মহেল এলকুঞ্চেয়ার, রতন থিয়াম বা রিচার্ড শেকম্যানসহ সবার সঙ্গেই আমার দীর্ঘ আড্ডা হতো। সবাইকে দেখেছি একই আলোচনার সীমানায়। সেই আলোচনায় রাজনীতিটা আসবেই। শাসকগোষ্ঠীর প্রতি সমালোচনা। মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন কেন হচ্ছে না, এসব নিয়েই কথাবার্তা হতো বেশি। তবে শিল্পে তার প্রতিফলন ঘটেনি খুব একটা, তা নিয়েও যেন কথার শেষ নেই। রাজনীতিবিদেরা কী করতে পারছেন, কী পারছেন না বা আমরা কতটা করতে পেরেছি বা পারছি না—তা নিয়েই দীর্ঘ দীর্ঘ আলোচনা।
সম্প্রতি কলকাতায় যাওয়ার পর কী করে যেন মনোজদা জানতে পেরেছেন আমি সেখানে। তিনি বারবার ফোনে তাগিদ দিতে শুরু করলেন আমি যেন অবশ্যই তাঁর সঙ্গে দেখা করি। সল্টলেকে তাঁর বাড়িতে যাওয়ার পর বুঝতে পারলাম অনেকক্ষণ ধরে তিনি আমার জন্য অপেক্ষা করেছেন। পাশাপাশি বসার পরেই আমার হাতটা ধরলেন, তাঁর চোখ ছলছল। আমার সঙ্গে বন্ধু ইমানুল ছিল। অনেকক্ষণ কথা না বলে আমাদের আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটল। ইমানুল অবাক হয়ে, বাক্রুদ্ধ হয়ে এই দৃশ্য দেখছিল। তারপর কথার ফুল ফুটল। সব স্মৃতিকথা। পাশের ঘরে বউদি রয়েছেন। তিনি দীর্ঘদিন পক্ষাঘাতগ্রস্ত শয্যাশায়ী। আমরা বউদিকে অনেকক্ষণ জাগাবার চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না। দাদা শেষ কথা বললেন, ‘মামুন, আমি আবার ঢাকায় যাব, আবার সেই কালিহাতীতে যাব, টাঙ্গাইলে তোমার মায়ের সঙ্গে দেখা করব।’ সেই আশা আমি মনের মধ্যে রেখেছিলাম বটে, কিন্তু ১২ নভেম্বর সকালেই সেখানে এক যবনিকা টানা হয়ে গেল। দৃশ্যত সেই যবনিকা টানা হলেও জীবনে তাঁর আসা-যাওয়া তো বন্ধ হবে না।
যেকোনো শিল্পীর জন্যই তাঁর সমসাময়িক কালটা কখনোই সুখের হয় না। আমরা যুদ্ধ করে একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি। কিন্তু তার পর থেকেই এই স্বদেশভূমিটা যেকোনো শিল্পীর জন্যই বিরুদ্ধ। আমরা সব সরকারের আমলেই সমালোচনামুখর। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো আমাদের কখনো নিজেদের মিত্র ভাবে না। হয়তো আমাদের এর মধ্যে কেউ কেউ দলবদ্ধ থেকে সরাসরি দলের হয়ে কাজ করেন। কিন্তু অধিকাংশই তা করেন না। আবার যাঁদের দলের সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক, তাঁরাও আন্দোলনের ডাক দিলে পাশে দাঁড়ান। তবে অবশ্যই সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে আমরা সবাই একসূত্রে দাঁড়িয়ে যাই। আমাদের এই দেশে কঠোর ধর্মীয় অনুশাসন আছে। সেখানে শিল্পকর্ম কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হলেও ওই দলগুলো কখনো সরাসরি আক্রমণ করে না।
কিন্তু সাম্প্রতিককালে সরকারকে সন্তুষ্ট করার জন্য কিছু ব্যক্তি শিল্পের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। তারা কোনো মতবাদ নিয়ে নয়, একেবারেই পেশিশক্তি নিয়ে শিল্পের কাজকে প্রতিহত করার চেষ্টা করছে। এই অপচেষ্টাকে আমাদের অসাম্প্রদায়িক সমাজ কোনো অবস্থাতেই প্রশ্রয় দিচ্ছে না। কিন্তু কিছু তথাকথিত শিক্ষিত লোক নানা ধরনের অপচেষ্টায় লিপ্ত হচ্ছে। এই প্রবণতাকে ধরে রাখছে এবং শিল্প-সাহিত্যে স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশকে বিঘ্নিত করার চেষ্টা করছে। আমরা যাঁরা শিল্পকর্ম করি, নানা প্রতিকূলতা এবং সংকটের মধ্য দিয়েই করি। এটা সবার বোঝা প্রয়োজন। দালালির কাজ করে খুব একটা মুনাফা এখান থেকে অর্জন করা সম্ভব নয়। কারণ, শিল্পকর্মে মিথ্যা বলা যায় না। নাটকের মঞ্চে তো একেবারেই নয়। এই প্রবণতা থেকে সবারই মুক্ত হওয়া আশু প্রয়োজন।
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব
লুটপাটের জন্য কুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন শেখ হাসিনা ও তাঁর দলবল। মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে তিনি সাঙ্গপাঙ্গদের দিয়েছিলেন সম্পদ লুণ্ঠনের অধিকার। গত বছর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেও দেশে রয়ে গেছে লুটেরা সিন্ডিকেট। গণমাধ্যমে নতুন বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লুটপাট, চাঁদাবাজি ও দখল
৭ ঘণ্টা আগেশান্তিতে নোবেল পুরস্কার একসময় ছিল আন্তর্জাতিক নৈতিকতার শীর্ষ সম্মান—যেখানে পুরস্কার পেতেন তাঁরা, যাঁদের জীবন ও কর্ম বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় এক অনন্য দৃষ্টান্ত। আজ সেই পুরস্কার অনেকটা হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনৈতিক সৌজন্য উপহার। যা দেওয়া হয় যখন কারও হাত মলতে হয়, অহংকারে তেল দিতে হয় বা নিজের অ্যাজেন্ডা...
২০ ঘণ্টা আগেগত বছর জুলাই মাস থেকে আমাদের আন্দোলনকারী তরুণ ছাত্রছাত্রীদের মুখে ও কিছু কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মুখে, বেশি বেশি করে কয়েকটি বাক্য উচ্চারিত হয়ে আসছিল। বাকিগুলোর মধ্যে প্রথম যে বাক্যটি সবার কানে বেধেছে, সেটা হলো ‘বন্দোবস্ত’।
২০ ঘণ্টা আগেপ্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন সম্প্রতি রংপুরে অনুষ্ঠিত এক সভায় যে কথাগুলো বলেছেন, তা দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা এখন নির্বাচন কমিশনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
২০ ঘণ্টা আগে