Ajker Patrika

বেদনা ও বিদ্রোহ মিলিয়েই বাঙালি সংস্কৃতি

বেদনা ও বিপদ এখন সারা পৃথিবীতে প্রধান সত্য। নানাবিধ বিষের ক্রিয়ায় মানুষ জর্জরিত। কিন্তু বেদনা মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করছে না, মানুষ বিদ্রোহী হয়ে যে উঠবে, তেমনটা ঘটছে না। বিপদের মধ্যে আরেক বিপদ, বড় বিপদই বলা যায়, এখন দেশজুড়ে। যাঁরা আস্থা রাখেন মানুষের ভবিষ্যতের ওপর এবং সে-কারণে মানুষের মনুষ্যত্বের ওপরই, তাঁরা নিশ্চয়ই পরাভূত হবেন না।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
বেদনা ও বিদ্রোহ মিলিয়েই বাঙালি সংস্কৃতি

বিদ্যমান ব্যবস্থার বিপরীতে বিকল্পটা একই সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং মতাদর্শিক। এর জন্য দরকার পড়বে সামাজিক বিপ্লবের। প্রতিটি দেশেই। যেটা স্থানীয়ভাবে গড়ে তোলা চাই, তবে তার চরিত্রটা অবশ্যই থাকবে আন্তর্জাতিক। পুঁজিবাদ যেমন আন্তর্জাতিক, তার বিকল্পও হওয়া দরকার তার চেয়ে গভীরভাবে আন্তর্জাতিক। সমাজবিপ্লবের জন্য খুব বেশি করে প্রয়োজন সাংস্কৃতিক অনুশীলনের ও প্রস্তুতির। সাহিত্য, সংগীত, খেলাধুলা, আলোচনা-বিতর্ক, নাটক, নৃত্য, প্রচারমাধ্যম—সবকিছুর মধ্য দিয়ে সাংস্কৃতিক কাজটা এগিয়ে নেওয়া আবশ্যক।

পুঁজিবাদ ওই কাজকেই বিশেষ রকমের কঠিন করে তুলেছে। বৈশ্বিক এই আদর্শের কাছে সবকিছুরই ওজন হয় মুনাফার বাটখারায়। সংস্কৃতির চর্চাকেও সে বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত করতে তুমুলভাবে আগ্রহী। স্পর্শমাত্র পণ্যে পরিণত করার ক্ষমতা সে রাখেও। সংস্কৃতির বাণিজ্যিক চর্চার বিপক্ষে এবং মানবিক চর্চার পক্ষে আজ দাঁড়ানো চাই। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সংস্কৃতির মানবিক চর্চারই অপর নাম সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চা।

পুঁজিবাদ মনেপ্রাণে সংস্কৃতির এই চর্চার বিরোধী। সংস্কৃতিচর্চা বিনোদন সরবরাহ করবে, এটা ঠিক আছে। অশ্লীল হলে তো আরও ভালো। তাতে বাণিজ্য জমবে এবং তার চেয়ে বড় একটা প্রাপ্তি ঘটবে, সেটা হলো মানুষকে সামাজিক বিপ্লববিরোধী করা যাবে। বিপ্লববিরোধিতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠার চমৎকার নিদর্শন এখন পাওয়া যাচ্ছে সর্বাধিক উন্নত-বলে-কথিত আমেরিকায়। সেখানে শ্বেতশ্রেষ্ঠত্ববাদী উন্মত্ততা এমন পর্যায়ে উঠেছে যে ভিন্ন বর্ণের মানুষকে হত্যা শুরু হওয়ার দশা। এবং ওই বর্ণশ্রেষ্ঠত্ববাদীরা নির্বাচনে তাঁদের প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পকেই জিতিয়েছেন এবং তাঁর বিজয়ে বিশ্বজুড়ে ট্রাম্পের কর্তৃত্ববাদী আগ্রাসী তৎপরতা ক্রমাগত ভয়ংকর হয়ে উঠেছে।

পুঁজিবাদ গভীর ধরনের সাহিত্যের চর্চা একেবারেই পছন্দ করে না। সে জন্য দেখছি পাঠককে যে-সাহিত্য ধাক্কা দেয়, চিন্তিত করে, বিদ্যমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করে, তার প্রচার নেই, বাজারও নেই। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তি অত্যন্ত সম্মানজনক ঘটনা। সেই পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল বব ডিলানকে, যিনি উঁচু মানের একজন সংগীত রচয়িতা এবং সংগীতশিল্পী অবশ্যই, কিন্তু নিজেকে তিনি সাহিত্যিক

বলে মনে করেন না, যে জন্য পুরস্কার গ্রহণে তাঁর রীতিমতো দ্বিধা ছিল। এর পরে এক বছর তো পুরস্কার দেওয়াই হলো না দাতা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের মধ্যে বিরোধ থাকার কারণে। তবে অন্তরালে যা-ই থাকুক, সামনে থেকে তো বোঝা যাচ্ছে সাহিত্যচর্চা তার আগের, এবং সর্বকালের গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে।

কিন্তু সাহিত্য তো থাকবে। এই পৃথিবীতে মানুষ যত দিন থাকবে, ঠিক তত দিন সাহিত্যও থাকবে। কারণ, সাহিত্য মানুষের মনুষ্যত্বকে ধারণ ও লালন করে। কিন্তু সে জন্য সাহিত্যকে গভীর হতে হবে, মনভোলানোর ছলাকলানির্ভর হলে চলবে না। যাকে আধুনিক যুগ বলা হয়, সে-কালে আওয়াজ উঠেছে ‘আনন্দের সাহিত্য চাই’, কেউবা আবার ঘোষণাই দিয়েছেন, সহেনা সহেনা প্রাণে জনতার জঘন্য মিতালী। উদারনীতিক যিনি, তিনি বলেছেন, অদৃশ্য কোনো একটা শক্তি নিশ্চয়ই আছেন, যিনি মেলাবেন ঝোড়ো হাওয়াটায় ও পোড়োবাড়িটায়।

মার্ক্সবাদে বিশ্বাসী কবিও চেষ্টা করেছেন বিপ্লবী মার্ক্সের সঙ্গে ঘোরতর রক্ষণশীল টি এস এলিয়টের মিলন ঘটানোর। এসব কাজ সাহিত্যকে গভীরতা দেয়নি, এমনকি সাহিত্যের গুরুত্বকে যে দৃশ্যমান করবে, সে কাজটাও করতে পারেনি। সুবিধা হয়েছে পুঁজিবাদী সংস্কৃতির চর্চার। এটা বোধ করি মানতেই হবে, বাংলাদেশের প্রকৃতি, সংস্কৃতিতে একধরনের বিষণ্নতা বিরাজ করছে। গাছপালা, নদ-নদী, অর্থনীতির কৃষিনির্ভরতা, বহুকালের খাদ্যাভ্যাস—সবকিছু নরম ধরনের। মাংসের চেয়ে মাছ ও শাকসবজি এখানকার মানুষের অধিক পছন্দ। তারা স্বল্পে সন্তুষ্ট। কোনো ধরনের ঝামেলায় জড়াতে চায় না।

আমাদের সমাজ অবশ্যই পিতৃতান্ত্রিক, ভীষণভাবে পিতৃতান্ত্রিক; কিন্তু সংস্কৃতিতে মাতার ভূমিকা থাকে, সেটা যত অপ্রত্যক্ষ ততই কার্যকর, শিরা-উপশিরার মতো। ঘরগেরস্তালির নিত্যদিনের পরিচালনা ও সন্তানের লালন-পালনের মাধ্যমে এবং আহার প্রস্তুত ও পরিবেশনার ভেতরে মা আছেন। মা থাকেন। সবকিছুতে স্নেহের মিশ্রণ ঘটিয়ে। মা নিজে কিন্তু বিষণ্নই থাকেন। বাধ্য হন থাকতে। ওদিকে সংস্কৃতিতে আবার ভয়ও কাজ করে। সুদীর্ঘকালের পরাধীনতা মানুষকে দরিদ্র করে রেখেছে। এ দেশে সম্পদ কখনোই কম ছিল না; শ্রম দিয়ে মানুষ উৎপাদনও করেছে, কিন্তু এখানকার সম্পদ পাচার হয়ে গেছে, বিদেশে।

ভূমি উর্বর। ফসল ফলে সহজে। কিন্তু সে-ফসল উৎপাদনকারীরা পায় না। লুণ্ঠিত হয়ে যায়। আবার বন্যা এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায় অনেক কিছু। ভয়টা আর কাটে না।সংস্কৃতির বিশেষ উপাদান শিক্ষা। সেই শিক্ষাতেও ওই ভয়টা নিয়মিত শিক্ষা দেওয়া হয়। বাল্যশিক্ষার বইতে আমরা একেবারে প্রথমেই পড়েছি ‘অ’তে অজগর আসছে তেড়ে। এখন হয়তো বর্ণপরিচয়ের বইতে ‘অ’বর্ণের ওই পরিচয়টি নেই; কিন্তু পুরো শিক্ষাব্যবস্থায় ভয়টা ব্যাপ্ত রয়ে গেছে। ভয় ফেল করবার। ফেল করলে শাস্তি পাবার।

ভয়ের উল্টো পিঠে থাকে লোভ। বর্ণপরিচয়ে ‘আ’তে ছিল, ‘আমটি আমি খাব পেড়ে।’ আমগাছটি আমি লাগাইনি, আমের ফলনে আমার কোনো শ্রম নেই; কিন্তু গাছে যেহেতু সেটি ঝুলছে, তাই আমি সেটি পেড়ে নেব, খেয়ে ফেলব, কাউকে দেব না। কি পুঁজিবাদী কি সামন্তবাদী—সব ব্যবস্থাতেই ভীতি ও প্রলোভনের এই দ্বৈত শিক্ষাটা অনবরত দেওয়া হচ্ছে। দারিদ্র্য, ভীতি ও লোভ (যা পূরণ হয় না), এরা মিলে বাড়িয়ে তোলে মাতার বিষণ্নতা। বাঙালির, বিশেষ করে পূর্ববঙ্গের বাঙালির

এই বিষণ্নতা অত্যন্ত সুন্দরভাবে ধরা পড়েছে জীবনানন্দ দাশের কবিতায়। এই বিষণ্নতার অন্তরে রয়েছে গভীর বেদনা, দুর্ভর হতাশা। কিন্তু বাঙালির ভেতর আবার বিদ্রোহও আছে। আসলে বেদনা ও বিদ্রোহ—দুটো মিলিয়েই বাঙালির সংস্কৃতি। বেদনা ও বিদ্রোহের ভেতরকার সম্পর্কটা দ্বান্দ্বিক; এতে কোনো পক্ষই জয়ী হয় না, তবে বাড়ে বিষণ্নতা। জীবনানন্দ দাশ যেমন বেদনাকে মূর্ত করেছেন, তেমনি তাঁরই সমসাময়িক কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহকে সামনে নিয়ে এসেছিলেন। পরবর্তী সময়ে সুকান্ত ভট্টাচার্যও ওই বিদ্রোহের, তথা বিপ্লবের যে আকাঙ্ক্ষা, তারই কবি। সময় জিনিসটা জীবনানন্দ ও সুকান্ত—উভয়ের জন্যই সত্য।

সময়কে বোঝাবার জন্য ঘড়ির রূপক দুজনেই ব্যবহার করেছেন। জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতা ‘ঘড়ির দুইটি ছোটো কালো হাত’ কবিতাতে বলছেন যে ঘড়ির কাঁটা তাঁদেরকে, তাঁকে ও তাঁর প্রিয়তমাকে, নিয়ে যেতে চায় যেন ‘শব্দহীন মাটি ঘাসের দিকে’, যেখানে ‘সাহস সংকল্প প্রেম আমাদের কোনো দিন যাবে না’; তবু সেদিকেই যেতে হয়, ‘কী গভীর সহজ অভ্যাসে’। অভ্যাসটা মৃত্যুর দিকে যাওয়ারই। কিন্তু সাহস সংকল্প প্রেম, এরা তো মিথ্যা নয়; তারা আছে, তারা মৃত্যুর দিকে যাবে না।

আর ওই সাহস সংকল্প প্রেমই দেখি মুখর হয়ে উঠেছে সুকান্তের ‘বিদ্রোহের গান’ কবিতায়: ‘বেজে উঠল কি সময়ের ঘড়ি?/ এসো তবে আজ বিদ্রোহ করি।’বেদনা ও বিপদ এখন সারা পৃথিবীতে প্রধানসত্য। নানাবিধ বিষের ক্রিয়ায় মানুষ জর্জরিত।কিন্তু বেদনা মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করছে না, মানুষবিদ্রোহী হয়ে যে উঠবে, তেমনটা ঘটছে না। বিপদেরমধ্যে আরেক বিপদ, বড় বিপদই বলা যায়, এখন দেশজুড়ে। যাঁরা আস্থা রাখেন মানুষের ভবিষ্যতের ওপর এবং সেই কারণে মানুষের মনুষ্যত্বের পরই, তাঁরা নিশ্চয়ই পরাভূত হবেন না। পৃথিবীটাকে বদলাবেন। তার জন্য প্রয়োজন হবে বেদনার্ত মানুষদের ঐক্য, আর সে-ঐক্য গড়ে তোলার জন্য অত্যাবশ্যক যা, তা হলো সমাজ-রূপান্তরকামী সংস্কৃতির চর্চা।

সাহিত্য তাতে খুব বড় একটা ভূমিকা রাখবে। সাহিত্যের মূল কাজটাই তো হলো সংবেদনশীলতার মধ্য দিয়ে মানুষের সঙ্গে মানুষের সংহতি গড়ে তোলা; পুঁজিবাদ যেটা চায় না। পুঁজিবাদের কাজ বিচ্ছিন্নতা তৈরি করা। সাহিত্যও সংস্কৃতিরই অংশ; এবং সংস্কৃতির কাজও হচ্ছে ঐক্য সৃষ্টি। তবে সাহিত্যে যেমন, সংস্কৃতিতেও তেমনি প্রতিক্রিয়াশীলতা কার্যকর থাকে। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণবিদ্বেষ, নারী-পুরুষে বৈষম্য, উগ্র জাতীয়তাবাদ—এসবের লালন-পালন প্রতিক্রিয়াশীলতার তৎপরতারই অংশ। নতুন সমাজ ও সংস্কৃতি গড়বার জন্য তাই প্রয়োজন সামাজিক বিপ্লবের।

সত্য হলো এই যে পুঁজিবাদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন সমানে চলছে। মনুষ্যত্বের পক্ষে দাঁড়াবার জন্য ঘণ্টাধ্বনি অনবরত বাজছে। সেটা না শুনলে বিপদ এগিয়ে আসবে। এই ঘণ্টাধ্বনি কেবল বাংলাদেশে নয়, বাজছে বিশ্বব্যাপী। ডাক দিচ্ছে সংবেদনশীল মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য, পুঁজিবাদের বিষাক্ত নৃশংসতার বিরুদ্ধে। ডাক দিচ্ছে বিপ্লবাভিমুখী বিদ্রোহের।

লেখক: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ইমেরিটাস অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

দাম্পত্য কলহের গুঞ্জন, মুখ খুললেন জাহিদ হাসান

অবশেষে ইকবালের পরিবারমুক্ত হলো প্রিমিয়ার ব্যাংক

‘হেল্প, হেল্প’ বলে চিৎকার—শিক্ষক এগিয়ে যেতেই গলায় ছুরি চালাল কিশোরী

‘আপত্তিকর’ ভিডিও: বিএফআইইউর প্রধান শাহীনুলকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠালেন গভর্নর

১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাদের যৌন সহিংসতার প্রসঙ্গ জাতিসংঘে তুললেন ভারতীয় দূত

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত