Ajker Patrika

ভূ-রাজনৈতিক হরর শো

মিত্রতা মানে শুধু অস্ত্র কেনা নয়, আত্মা বেচাও

চিররঞ্জন সরকার
ভূ-রাজনীতিতে ‘বড় ভাই’ দেশগুলোকে সমীহ করে চলতে হয় ছোট দেশগুলোর। প্রতীকী ছবি: পেক্সেলস
ভূ-রাজনীতিতে ‘বড় ভাই’ দেশগুলোকে সমীহ করে চলতে হয় ছোট দেশগুলোর। প্রতীকী ছবি: পেক্সেলস

ভূ-রাজনীতি এখন আর কূটনৈতিক বৈঠকে করমর্দন, জাতিসংঘে গলাবাজি, কিংবা চায়ের কাপ হাতে ঝকঝকে ছবির শুটিংয়ের নাম নয়। আজকের ভূ-রাজনীতি একেবারে ‘হাই ডেফিনিশন হরর থ্রিলার’—যেখানে প্রতিটি চুক্তিপত্র মানে শুধু উন্নয়ন নয়, আত্মার একটি করে কিস্তি বন্ধক রাখা। মিত্রতা মানে এখন আর বন্ধুত্ব নয়, বরং এক লম্বা ইনস্টলমেন্ট প্ল্যান—যেখানে কবে, কীভাবে তোমার আত্মার শেষ কিস্তিটুকু তুলবে তারা, সেই হিসাব আগেই অ্যালগরিদমে সেট করা।

আগে দুই দেশ বন্ধুত্ব করত সিনেমা বানিয়ে, সাংস্কৃতিক উৎসবে নাচগান করে, ক্রিকেট সিরিজ দিয়ে, আর রাষ্ট্রপ্রধানেরা একে অপরকে ‘বড় ভাই’, ‘ছোট ভাই’, বা ‘মিলেমিশে থাকার প্রতীক’ বলে সম্বোধন করতেন। এখন বন্ধুত্ব মানে—তোমার দেশে আমার সামরিক ঘাঁটি, তোমার বাজারে আমার ডিফেন্স কনট্রাক্ট, আর তোমার বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার স্কলারশিপ প্রোগ্রামে মগজধোলাইয়ের ব্যবস্থা।

আমেরিকা বলে: ‘তুমি যদি আমাদের বন্ধু হও, তাহলে আমরা এফ-থার্টি ফাইভ যুদ্ধবিমান দেব—শুধু যুদ্ধ নয়, সঙ্গে থাকবে মানবাধিকার মূল্যায়ন, গণতন্ত্রের এক্সেল শিট, আর মাঝে মাঝে কিছু নিষেধাজ্ঞা—তোমার আচরণ যদি আমাদের স্ট্যান্ডার্ডে না পড়ে।’

চীন বলে: ‘তুমি আমাদের বেল্ট অ্যান্ড রোডে ঢোকো। আমরা রেললাইন দেব, বন্দর বানাব, পাওয়ার প্ল্যান্ট বসাব। শুধু ছোট্ট একটা কথা—ইনফ্রাস্ট্রাকচারটা তোমার হলেও চাবিটা থাকবে আমাদের হাতে।’

রাশিয়া বলে: ‘তেল নাও, ভালো দামে। মাথায় তেলও দেব, মনেও শান্তি আসবে। তবে যদি বেশি পশ্চিমে তাকাও, তাহলে হঠাৎ একদিন দেখবে—তোমার দেশে “নতুন রাজনৈতিক বিকল্প” ভাইরাল হয়ে গেছে, যাদের নাম আগে কোনো মিছিলে শোননি—কিন্তু এখন তারা “জনগণের চাওয়া”।’

এটাই আজকের ভূ-রাজনীতির বাস্তবতা—এক ভয়াবহ অথচ দারুণ অভিনয়পূর্ণ সার্কাস, যেখানে রাষ্ট্ররা কূটনীতিক মুখোশ পরে লড়াই করে, নীতির নামে নাটক চলে, আর বন্ধুত্ব মানে হয় ‘আমার সঙ্গে থেকো না হলে তোমার বিদ্যুৎ থাকবে না।’

এ যেন নেটফ্লিক্সের ‘জিওপলিটিকস আনলিমিটেড’—এক ধারাবাহিক সিরিজ, যেখানে প্রতিটি দেশ একেকটা পর্ব। কেউ থ্রিলার, কেউ ট্র্যাজেডি, কেউবা নিছক কমেডি। আর আমরা? দর্শক—যখন-তখন প্লট টুইস্টে জড়িয়ে পড়া চরিত্র। অথচ স্ক্রিপ্ট আমাদের হাতে নেই।

একসময় জোট মানে ছিল আদর্শের মিল—ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র, মুক্তবাজার, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। এখন জোট মানে—কে কাকে এনএসএর স্নিফার গিফট করেছে, কার দেশে কয়টা ডেটা সেন্টার খুলেছে, আর কে কার সার্ভেইলেন্স কনট্রাক্টে সাইন করেছে।

একটা উদাহরণ দিই। ধরুন, আপনি একজন উন্নয়নশীল দেশের সরকারপ্রধান। হঠাৎ একদিন দাওয়াত আসে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিক ডায়ালগ’-এ। গায়ে চাপান ঢাকাই জামদানি, হাতে নেন শান্তির প্রতীক। গিয়ে আবিষ্কার করেন—‘শান্তি’ মানে: ‘তুমি যদি আমাদের মিত্র হও, তাহলে তোমার দেশে একটা সেনাক্যাম্প খুলব, আর তোমার রাডার সিস্টেমে নতুন সফটওয়্যার ইনস্টল করব—যেটা চলে আমাদের সার্ভারে।’

আপনি প্রশ্ন করেন, ‘এই সফটওয়্যারে কী কী ফিচার আছে?’ উত্তর আসে, ‘ওটা ক্লাসিফায়েড। তবে নিশ্চিন্ত থাকুন—আপনার নিরাপত্তা আমরা নিশ্চিত করব, সার্ভেইলেন্স চালিয়ে।’

এখন যুদ্ধও বদলে গেছে। আগে যুদ্ধ মানে ছিল ট্যাংক, কামান, বোমা। এখন যুদ্ধ মানে—

  • হ্যাকাররা রাত ৩টায় আপনার বিমানবন্দরের লাইট নিভিয়ে দেয়।
  • জাতীয় পত্রিকা হঠাৎ বলে, ‘আমাদের নেতা গোপনে বিদেশে পলায়নের ছক কষছেন।’ সেই রিপোর্ট লেখে এক সাংবাদিক, যার বাসা মাল্টায়, অফিস লন্ডনে, মাইনে আসে ভার্জিন আইল্যান্ড থেকে।

এখন যুদ্ধ মানে—মিডিয়া হাইজ্যাক, ট্রেড ওয়ার, আর ‘ফিউচার টেক ডায়ালগ’ নামক সম্মেলন, যেখানে অ্যাজেন্ডায় থাকে এআই, অথচ ঘরে হয় সেমিনার: ‘হাউ টু ইনস্টল স্পাইওয়্যার ইন পার্টনার নেশনস ইউজিং ফাইভ-জি টাওয়ারস।’

মিত্রতা এখন একধরনের ‘ডেটিং অ্যাপ ফর নেশনস’। সোয়াইপ রাইট করলে আপনি পাবেন ড্রোন, সফটওয়্যার, স্যাটেলাইট। কিন্তু ভুল করে যদি সোয়াইপ লেফট করেন? তাহলে একদিন হঠাৎ আবিষ্কার করবেন—আপনার দেশে এক বিরোধী দল জন্ম নিয়েছে রাতারাতি। তারা টুইটারে ভাইরাল, ফেসবুকে দেশপ্রেমিক, আর টিকটকে কোরিওগ্রাফ করে প্রতিবাদ করে।

চীন আর আমেরিকার দ্বন্দ্বে মাঝখানে এখন প্রতিটি দেশ এক বাচ্চা—যাকে দুই পক্ষই চকলেট দেখিয়ে কাছে টানতে চায়। কিন্তু একবার যদি ভুল চকলেট খেয়ে ফেলে? শুরু হয়—ডেট ট্র্যাপ, ডেটা ট্র্যাপ, ড্রোন ডিপ্লোমেসি।

আরেকটা মজার বিষয়—‘ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের প্রশিক্ষণ’ প্রোগ্রাম। পশ্চিমা দেশগুলোতে আমাদের সম্ভাবনাময় নেতারা যান, ইংরেজি শেখেন, ব্লু-শার্ট পরে বক্তৃতা দেন, আর ফিরে এসে এমন কূটনীতি করেন, যাতে ‘নিরপেক্ষতা’ শব্দটা কাগজে থাকে, বাস্তবে নয়।

এই যেমন কেউ একজন ‘নিরপেক্ষ’—তবু তাঁর দেশে তিনটি সামরিক ঘাঁটি, চারটি গোপন মনিটরিং সেন্টার, আর পাঁচটি এনজিও—যারা ‘ডেমোক্রেসি এনহ্যান্সমেন্ট’ নামে এক রহস্যময় যজ্ঞে ব্যস্ত।

দেখুন, বন্ধুত্ব খারাপ নয়। প্রশ্ন হলো—এই বন্ধুত্ব কি সমান ভিত্তির ওপর গড়া? নাকি কেউ কারও কাঁধে বসে, মুখে হাসি রেখে বলছে, ‘তুমি আমার বন্ধু। তাই তোমার সব সিদ্ধান্ত আগে আমাকে জানাবে। আমি না চাইলে তুমি তোমার বোনের বিয়েতেও যেতে পারবে না!’

এখন এমন এক সময় চলছে, যেখানে রাষ্ট্রদূত বদলের খবর প্রথমে জানে উইকিলিকস কিংবা কোনো দুর্বোধ্য সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট, সরকারি ঘোষণার আগেই। রাষ্ট্রপ্রধানের সফর হয় ‘নতুন দিগন্ত উন্মোচনের’ নামে, অথচ সেই দিগন্তের প্রকৃত চিত্র থাকে সফরের ‘হিডেন অ্যানেক্সারে’—যেটা হয়তো ৩০ বছর পর জনসমক্ষে আসবে, যদি তখনো ফ্রিডম অব ইনফরমেশন অ্যাক্ট বলে কিছু বেঁচে থাকে এবং সেটা আর কোনো রাষ্ট্রীয় ‘সিকিউরিটি এক্সেপশন’-এ আটকে না যায়।

আজকের ভূ-রাজনীতি এক বিরাট স্ক্রিপ্টবিহীন থ্রিলার—লুকানো ক্যামেরায় তোলা এক নীরব, নিঃশব্দ শো। আপনি ভাবেন আপনি জানেন সব; টিভিতে যা দেখে থাকেন, তা-ই যেন আসল ছবি। অথচ বাস্তব হলো—আপনার দেশের মন্ত্রিসভার বৈঠকের সিদ্ধান্ত বিদেশি মন্ত্রণালয়ে আগে থেকেই ব্রিফ হয়ে যায়। কারণ, আপনার ডিজিটাল ক্যালেন্ডার চলে তাদের ক্লাউডে, আপনার ফোনের আপডেট আসে তাদের সার্ভার থেকে, আর আপনার ‘কনফিডেনশিয়াল মেমো’ বেরিয়ে পড়ে কোনো এক কফি-শপের ওয়াই-ফাই থেকে।

সবশেষে, আজকের ভূ-রাজনীতি এক হরর সিনেমা, যেখানে আপনি শুধু দর্শক নন—আপনি নিজেই সেই চরিত্র, যার মুখোশ পরানো। এবং চরিত্ররাও জানে না কে হিরো, কে ভিলেন; কে মিত্র, কে কনট্রাক্টর; কে বন্ধু, আর কে সার্ভিস প্রোভাইডার—তা বোঝা যায় তখন, যখন আপনি দেখতে পান: আপনার আত্মা গুগল ম্যাপে লোকেশন শেয়ার করছে, আর দেশের অর্থনীতি বিদেশি থিংক ট্যাংকের এক্সেল শিটে বসে আছে—‘পেন্ডিং অ্যাপ্রুভাল’ ট্যাগে।

এই যুগে মিত্রতা মানে শুধু যৌথ বিবৃতি নয়—নিঃশর্ত বিশ্বাস-বাণিজ্য। মানে: তুমি যদি তাদের দলে থাকো, তাহলে ট্যাংক তোমার রাস্তায় চলবে—তোমার পতাকা জড়িয়ে। আর তুমি যদি না থাকো, তবে তোমার ওপর নেমে আসবে একের পর এক ‘স্মার্ট’ নিষেধাজ্ঞা, ‘ন্যারেটিভ ম্যানেজমেন্ট’, আর এক অদ্ভুত ধরনের ‘গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণ’, যার পূর্বাভাস আসে টুইটারে, আর এক্সিকিউশন হয় ইউএনের সাইড লাইনে।

তাই, পরেরবার যখন কোনো কূটনীতিক হেসে বলবেন, ‘আমরা বন্ধু’—তখন একটু তাকিয়ে দেখবেন, সেই হাসির কোণে ছুরি লুকিয়ে আছে কি না। আর মনে রাখবেন—আজকের পৃথিবীতে মিত্রতা মানে শুধু অস্ত্র কেনা নয়, আত্মা বেচাও!

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত