পরাগ মাঝি
আইরিস মার্ডক ছিলেন দার্শনিক ও ঔপন্যাসিক, নৈতিকতার প্রশ্নকে যিনি নতুনভাবে ভেবেছিলেন। তাঁর মতে, নৈতিকতা মানে কেবল কর্তব্যবোধ, নিয়ম মানা বা আইনশৃঙ্খলার প্রতি আনুগত্য নয়। বরং নৈতিকতার আসল কেন্দ্রে রয়েছে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, আমরা অন্য মানুষকে কীভাবে দেখি এবং কতটা মনোযোগ দিয়ে তাঁর প্রতি ভালোবাসা নিয়ে তাকাই।
‘ভালোবাসা’ রোমান্টিক হোক, পারিবারিক কিংবা বন্ধুত্বের হোক—মানুষকে গভীরভাবে বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। শেক্সপিয়ারের ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’ শুধু প্রেমের গল্প নয়, বরং প্রেম কীভাবে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দিতে পারে, তারই নাটকীয় প্রকাশ। কোনো মা-বাবা যখন প্রথমবার সন্তানের মুখ দেখেন, তখন যে গভীর আবেগে তাঁরা ভেসে যান, সেটিও একধরনের ভালোবাসার শক্তিশালী প্রকাশ।
প্রশ্ন হলো—এই আবেগের সঙ্গে নৈতিকতার সম্পর্ক কী? প্রথাগত দর্শনের কথা যদি বলা হয়, বিশেষ করে ইমানুয়েল কান্টের ভাবনা অনুসারে—নৈতিকতা হলো কর্তব্য, সবার প্রতি সমানভাবে দায়িত্ব। আবেগ সেখানে স্থান পায় না। কারণ তা অপ্রত্যাশিত, অনিশ্চিত এবং ব্যক্তিগত। কেউ দাবি করলেই তাঁকে ভালোবাসা দেওয়া যায় না—কারণ এটি স্বতঃস্ফূর্ত, নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সুতরাং, অনেক দার্শনিকের কাছে নৈতিকতা ও ভালোবাসা একে অপরের থেকে আলাদা।
কিন্তু মার্ডক একেবারেই ভিন্ন পথে হাঁটলেন। তাঁর মতে, নৈতিক জীবনের কেন্দ্রবিন্দুই হলো ভালোবাসা। ‘দ্য আইডিয়া অব পারফেকশন’ (১৯৬২) প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন—নৈতিকতার মূলে রয়েছে প্রেম ও মনোযোগ। তিনি ‘অন গড অ্যান্ড গুড’ (১৯৬৯) বইয়ে আরও স্পষ্ট করে বলেছেন—‘আমাদের দরকার এমন এক নৈতিক দর্শন, যেখানে ভালোবাসার ধারণা আবার কেন্দ্রে ফিরে আসবে।’
মার্ডক বলেন, ‘আমাদের নৈতিক জীবন নির্ভর করে আমরা পৃথিবীকে কীভাবে দেখি তার ওপর। যদি কাউকে আমি শত্রু হিসেবে দেখি, তবে তাঁর সঙ্গে শত্রুর মতোই আচরণ করব। আবার যদি সম্ভাব্য বন্ধুর মতো দেখি, তবে উষ্ণতা ও যত্ন দিয়ে কাছে যাব। তাই কাজের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো দৃষ্টি—আমরা কাকে কেমনভাবে দেখছি।’
মার্ডকের মতে, নৈতিকতার মূল চাবিকাঠি হলো ‘মনোযোগ’। এর মানে অন্যকে ন্যায্যভাবে দেখা, তাঁর প্রকৃত রূপ বোঝার চেষ্টা করা। আমাদের কল্পনা ও কুসংস্কার যেন সেই দৃষ্টি বিকৃত না করে।
মার্ডক একটি কল্পিত উদাহরণ দেন। এক মা তাঁর পুত্রবধূকে সহ্য করতে পারেন না। তিনি মনে করেন, তাঁর পুত্রবধূ অপরিশীলিত, সাধারণ, কৃত্রিম আর মর্যাদাবোধহীন। এত কিছু ভাবলেও মা এটি পুত্রবধূকে বুঝতে দেন না, বরং বাইরের আচরণে তিনি অনেক ভদ্র ব্যবহারই করেন। প্রশ্ন হলো—তিনি যখন পুত্রবধূকে ‘মনে মনে’ ছোট করছেন, তখনো কি এটি নৈতিকভাবে ভুল?
মার্ডক বলছেন—হ্যাঁ। কারণ, নৈতিকতা শুধু কাজ নয়, বরং দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেও নিহিত। যদি আমি কাউকে অন্যায়ভাবে নিচু চোখে দেখি, তবে সেটিও একধরনের নৈতিক ব্যর্থতা।
প্রশ্ন হলো—কেন আমরা অন্যকে বিকৃতভাবে দেখি?
মার্ডকের মতে, এর প্রধান কারণ হলো অহং। এটি আমাদের ভেতরে এমন এক শক্তি, যা সর্বদা নিজের স্বার্থে ব্যস্ত, আত্মরক্ষায় নিমগ্ন। এই আত্মকেন্দ্রিকতা আমাদের চোখে একধরনের কুয়াশা তৈরি করে, যার ফলে আমরা অন্যকে সত্যিকারভাবে দেখতে পারি না।
দ্য ‘সোভের্নিটি অব গড’ (১৯৭০) বইয়ে তিনি লিখেছেন, ‘আমরা আতঙ্কগ্রস্ত প্রাণী। আমাদের মন অবিরত সক্রিয়, নিজের চারপাশে এমন এক স্বপ্নজাল তৈরি করি, যা আংশিকভাবে বাস্তবকে ঢেকে ফেলে।’
এই স্বপ্নজালই হলো কল্পনা বা ফ্যান্টাসি। আমরা প্রায়ই অন্যকে আমাদের সুবিধামতো কল্পনা করি—কখনো শ্রেণিগত কুসংস্কারে, কখনো ব্যক্তিগত ঈর্ষায়, আবার কখনো সামাজিক রীতিনীতির কারণে। ফলে অন্যকে তাঁর আসল রূপে নয়, বরং বিকৃত রূপে দেখি।
ভালোবাসা কি তবে বিকৃত দৃষ্টি ভাঙার শক্তি? মূলত এমন প্রশ্নেই ভালোবাসা কেন্দ্রে চলে আসে। মার্ডক বলেন, অহংকে ভাঙতে হলে আমাদের দরকার এমন এক শক্তি, যা আমাদের ভেতর থেকে টেনে বের করে আনে বাইরের জগতে, অন্য মানুষের দিকে। আর সেই শক্তি হলো ভালোবাসা!
ভালোবাসা মানে কেবল আবেগ নয়, বরং মনোযোগী ও ন্যায্য দৃষ্টি। যখন আমরা কাউকে ভালোবাসি, তখন তাঁকে কেবল নিজের স্বার্থের চোখে দেখি না, বরং তাঁকে তাঁর নিজের মর্যাদায় দেখতে চেষ্টা করি। এভাবে ভালোবাসা আমাদের ভেতরের কল্পনার কুয়াশা সরিয়ে দেয় এবং অন্যজন যেমন, তাঁকে তেমনভাবেই বুঝতে সাহায্য করে।
পরিবর্তনের গল্পও আছে। আবারও সেই মা ও পুত্রবধূর উদাহরণে ফেরা যাক। যদি মা সত্যিই নৈতিক হতে চান, তবে তাঁকে নিজের ভেতরেই ফিরে তাকাতে হবে। তাহলে হয়তো তিনি বুঝতে পারবেন—তিনি আসলে ঈর্ষান্বিত, পুরোনো ধ্যানধারণায় আচ্ছন্ন, এমনকি সামাজিক কুসংস্কারে আক্রান্ত। ধীরে ধীরে তিনি যদি পূত্রবধূর দিকে মনোযোগ দেন, যাকে আগে অপরিশীলিত ভাবতেন, তাহলে তিনি দেখবেন, তাঁর পুত্রবধূটি আসলে সরল ও খোলামেলা। আগে যাকে শিশুসুলভ ভাবতেন, তাঁকে মনে হবে এখন প্রাণবন্ত!
এটাই হলো মনোযোগী ভালোবাসা বা ‘অ্যাটেনটিভ লাভ’। অহংকে একপাশে সরিয়ে অন্যকে তাঁর প্রকৃত রূপে দেখা। এটি নিজেই একটি নৈতিক কাজ।
তবে ভালোবাসার বিপদও আছে। অবশ্যই ভালোবাসা কখনো কখনো ভুলও হতে পারে। রোমিও যেমন প্রথমে রোজালিনের প্রেমে ছিলেন, পরে জুলিয়েটকে দেখে মুহূর্তেই নতুন প্রেমে পড়লেন। এমন ভালোবাসা অন্ধ, ভ্রান্ত ও কল্পনার ওপর দাঁড়ানো। মার্ডকের মতে, এই ধরনের ভালোবাসা আসলে অসম্পূর্ণ। সত্যিকারের ভালোবাসা হলো সেই মনোযোগ, যা অন্যকে তাঁর বাস্তব রূপে দেখতে শেখায়।
এখন প্রশ্ন হলো—আমরা কীভাবে এই ধরনের মনোযোগী ভালোবাসা চর্চা করব? মার্ডক বলেন, এর সহজ সমাধান নেই। তবে ধীরে ধীরে অনুশীলন সম্ভব। তিনটি উপায়ে হতে পারে এই অনুশীলন। প্রথমত, অন্যের দিকে মনোযোগ দেওয়া। নিজের ব্যস্ততা থেকে বের হয়ে অন্যকে সময় দেওয়া, ধৈর্য নিয়ে শোনা। দ্বিতীয়ত, নিজের কুসংস্কারকে চিনতে পারা। আমরা যখন বুঝি যে কারও প্রতি অন্যায়ভাবে বিচার করছি, তখন সেটি স্বীকার করাই প্রথম ধাপ। তৃতীয়ত, শিল্পকলায় অংশ নেওয়া। মার্ডকের মতে, শিল্পকলা বা কোনো নতুন দক্ষতা শেখার মধ্যে আমরা অন্য কিছুর প্রতি বিনয়ী মনোযোগ দিতে শিখি। এটি আমাদের আত্মকেন্দ্রিকতা কমায়।
আইরিস মার্ডকের দর্শন আমাদের মনে করিয়ে দেয়—নৈতিকতা মানে শুধু বাইরের আচরণ নয়, বরং ভেতরের দৃষ্টিভঙ্গি। অহং ও কল্পনার জাল ছিঁড়ে অন্যকে সত্যিকারভাবে দেখার জন্য আমাদের দরকার ভালোবাসা।
আজকের বিভক্ত পৃথিবীতে, যেখানে মানুষ মানুষকে প্রায়ই শ্রেণি, ধর্ম, জাতি বা ব্যক্তিগত স্বার্থের চোখে দেখে, সেখানে মার্ডকের বার্তা অত্যন্ত জরুরি। ভালোবাসা আমাদের শেখায়—অন্যকে তাঁর নিজের মর্যাদায় দেখা, তাঁকে ন্যায্যভাবে বোঝা।
সুতরাং, কেন ভালোবাসাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—তার উত্তর স্পষ্ট। কারণ, ভালোবাসাই আমাদের ভেতরের কুয়াশা ভাঙতে পারে, আমাদের সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করায় এবং আমাদের নৈতিক মানুষ হতে সাহায্য করে।
লেখক: সাংবাদিক
আইরিস মার্ডক ছিলেন দার্শনিক ও ঔপন্যাসিক, নৈতিকতার প্রশ্নকে যিনি নতুনভাবে ভেবেছিলেন। তাঁর মতে, নৈতিকতা মানে কেবল কর্তব্যবোধ, নিয়ম মানা বা আইনশৃঙ্খলার প্রতি আনুগত্য নয়। বরং নৈতিকতার আসল কেন্দ্রে রয়েছে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, আমরা অন্য মানুষকে কীভাবে দেখি এবং কতটা মনোযোগ দিয়ে তাঁর প্রতি ভালোবাসা নিয়ে তাকাই।
‘ভালোবাসা’ রোমান্টিক হোক, পারিবারিক কিংবা বন্ধুত্বের হোক—মানুষকে গভীরভাবে বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। শেক্সপিয়ারের ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’ শুধু প্রেমের গল্প নয়, বরং প্রেম কীভাবে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দিতে পারে, তারই নাটকীয় প্রকাশ। কোনো মা-বাবা যখন প্রথমবার সন্তানের মুখ দেখেন, তখন যে গভীর আবেগে তাঁরা ভেসে যান, সেটিও একধরনের ভালোবাসার শক্তিশালী প্রকাশ।
প্রশ্ন হলো—এই আবেগের সঙ্গে নৈতিকতার সম্পর্ক কী? প্রথাগত দর্শনের কথা যদি বলা হয়, বিশেষ করে ইমানুয়েল কান্টের ভাবনা অনুসারে—নৈতিকতা হলো কর্তব্য, সবার প্রতি সমানভাবে দায়িত্ব। আবেগ সেখানে স্থান পায় না। কারণ তা অপ্রত্যাশিত, অনিশ্চিত এবং ব্যক্তিগত। কেউ দাবি করলেই তাঁকে ভালোবাসা দেওয়া যায় না—কারণ এটি স্বতঃস্ফূর্ত, নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সুতরাং, অনেক দার্শনিকের কাছে নৈতিকতা ও ভালোবাসা একে অপরের থেকে আলাদা।
কিন্তু মার্ডক একেবারেই ভিন্ন পথে হাঁটলেন। তাঁর মতে, নৈতিক জীবনের কেন্দ্রবিন্দুই হলো ভালোবাসা। ‘দ্য আইডিয়া অব পারফেকশন’ (১৯৬২) প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন—নৈতিকতার মূলে রয়েছে প্রেম ও মনোযোগ। তিনি ‘অন গড অ্যান্ড গুড’ (১৯৬৯) বইয়ে আরও স্পষ্ট করে বলেছেন—‘আমাদের দরকার এমন এক নৈতিক দর্শন, যেখানে ভালোবাসার ধারণা আবার কেন্দ্রে ফিরে আসবে।’
মার্ডক বলেন, ‘আমাদের নৈতিক জীবন নির্ভর করে আমরা পৃথিবীকে কীভাবে দেখি তার ওপর। যদি কাউকে আমি শত্রু হিসেবে দেখি, তবে তাঁর সঙ্গে শত্রুর মতোই আচরণ করব। আবার যদি সম্ভাব্য বন্ধুর মতো দেখি, তবে উষ্ণতা ও যত্ন দিয়ে কাছে যাব। তাই কাজের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো দৃষ্টি—আমরা কাকে কেমনভাবে দেখছি।’
মার্ডকের মতে, নৈতিকতার মূল চাবিকাঠি হলো ‘মনোযোগ’। এর মানে অন্যকে ন্যায্যভাবে দেখা, তাঁর প্রকৃত রূপ বোঝার চেষ্টা করা। আমাদের কল্পনা ও কুসংস্কার যেন সেই দৃষ্টি বিকৃত না করে।
মার্ডক একটি কল্পিত উদাহরণ দেন। এক মা তাঁর পুত্রবধূকে সহ্য করতে পারেন না। তিনি মনে করেন, তাঁর পুত্রবধূ অপরিশীলিত, সাধারণ, কৃত্রিম আর মর্যাদাবোধহীন। এত কিছু ভাবলেও মা এটি পুত্রবধূকে বুঝতে দেন না, বরং বাইরের আচরণে তিনি অনেক ভদ্র ব্যবহারই করেন। প্রশ্ন হলো—তিনি যখন পুত্রবধূকে ‘মনে মনে’ ছোট করছেন, তখনো কি এটি নৈতিকভাবে ভুল?
মার্ডক বলছেন—হ্যাঁ। কারণ, নৈতিকতা শুধু কাজ নয়, বরং দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেও নিহিত। যদি আমি কাউকে অন্যায়ভাবে নিচু চোখে দেখি, তবে সেটিও একধরনের নৈতিক ব্যর্থতা।
প্রশ্ন হলো—কেন আমরা অন্যকে বিকৃতভাবে দেখি?
মার্ডকের মতে, এর প্রধান কারণ হলো অহং। এটি আমাদের ভেতরে এমন এক শক্তি, যা সর্বদা নিজের স্বার্থে ব্যস্ত, আত্মরক্ষায় নিমগ্ন। এই আত্মকেন্দ্রিকতা আমাদের চোখে একধরনের কুয়াশা তৈরি করে, যার ফলে আমরা অন্যকে সত্যিকারভাবে দেখতে পারি না।
দ্য ‘সোভের্নিটি অব গড’ (১৯৭০) বইয়ে তিনি লিখেছেন, ‘আমরা আতঙ্কগ্রস্ত প্রাণী। আমাদের মন অবিরত সক্রিয়, নিজের চারপাশে এমন এক স্বপ্নজাল তৈরি করি, যা আংশিকভাবে বাস্তবকে ঢেকে ফেলে।’
এই স্বপ্নজালই হলো কল্পনা বা ফ্যান্টাসি। আমরা প্রায়ই অন্যকে আমাদের সুবিধামতো কল্পনা করি—কখনো শ্রেণিগত কুসংস্কারে, কখনো ব্যক্তিগত ঈর্ষায়, আবার কখনো সামাজিক রীতিনীতির কারণে। ফলে অন্যকে তাঁর আসল রূপে নয়, বরং বিকৃত রূপে দেখি।
ভালোবাসা কি তবে বিকৃত দৃষ্টি ভাঙার শক্তি? মূলত এমন প্রশ্নেই ভালোবাসা কেন্দ্রে চলে আসে। মার্ডক বলেন, অহংকে ভাঙতে হলে আমাদের দরকার এমন এক শক্তি, যা আমাদের ভেতর থেকে টেনে বের করে আনে বাইরের জগতে, অন্য মানুষের দিকে। আর সেই শক্তি হলো ভালোবাসা!
ভালোবাসা মানে কেবল আবেগ নয়, বরং মনোযোগী ও ন্যায্য দৃষ্টি। যখন আমরা কাউকে ভালোবাসি, তখন তাঁকে কেবল নিজের স্বার্থের চোখে দেখি না, বরং তাঁকে তাঁর নিজের মর্যাদায় দেখতে চেষ্টা করি। এভাবে ভালোবাসা আমাদের ভেতরের কল্পনার কুয়াশা সরিয়ে দেয় এবং অন্যজন যেমন, তাঁকে তেমনভাবেই বুঝতে সাহায্য করে।
পরিবর্তনের গল্পও আছে। আবারও সেই মা ও পুত্রবধূর উদাহরণে ফেরা যাক। যদি মা সত্যিই নৈতিক হতে চান, তবে তাঁকে নিজের ভেতরেই ফিরে তাকাতে হবে। তাহলে হয়তো তিনি বুঝতে পারবেন—তিনি আসলে ঈর্ষান্বিত, পুরোনো ধ্যানধারণায় আচ্ছন্ন, এমনকি সামাজিক কুসংস্কারে আক্রান্ত। ধীরে ধীরে তিনি যদি পূত্রবধূর দিকে মনোযোগ দেন, যাকে আগে অপরিশীলিত ভাবতেন, তাহলে তিনি দেখবেন, তাঁর পুত্রবধূটি আসলে সরল ও খোলামেলা। আগে যাকে শিশুসুলভ ভাবতেন, তাঁকে মনে হবে এখন প্রাণবন্ত!
এটাই হলো মনোযোগী ভালোবাসা বা ‘অ্যাটেনটিভ লাভ’। অহংকে একপাশে সরিয়ে অন্যকে তাঁর প্রকৃত রূপে দেখা। এটি নিজেই একটি নৈতিক কাজ।
তবে ভালোবাসার বিপদও আছে। অবশ্যই ভালোবাসা কখনো কখনো ভুলও হতে পারে। রোমিও যেমন প্রথমে রোজালিনের প্রেমে ছিলেন, পরে জুলিয়েটকে দেখে মুহূর্তেই নতুন প্রেমে পড়লেন। এমন ভালোবাসা অন্ধ, ভ্রান্ত ও কল্পনার ওপর দাঁড়ানো। মার্ডকের মতে, এই ধরনের ভালোবাসা আসলে অসম্পূর্ণ। সত্যিকারের ভালোবাসা হলো সেই মনোযোগ, যা অন্যকে তাঁর বাস্তব রূপে দেখতে শেখায়।
এখন প্রশ্ন হলো—আমরা কীভাবে এই ধরনের মনোযোগী ভালোবাসা চর্চা করব? মার্ডক বলেন, এর সহজ সমাধান নেই। তবে ধীরে ধীরে অনুশীলন সম্ভব। তিনটি উপায়ে হতে পারে এই অনুশীলন। প্রথমত, অন্যের দিকে মনোযোগ দেওয়া। নিজের ব্যস্ততা থেকে বের হয়ে অন্যকে সময় দেওয়া, ধৈর্য নিয়ে শোনা। দ্বিতীয়ত, নিজের কুসংস্কারকে চিনতে পারা। আমরা যখন বুঝি যে কারও প্রতি অন্যায়ভাবে বিচার করছি, তখন সেটি স্বীকার করাই প্রথম ধাপ। তৃতীয়ত, শিল্পকলায় অংশ নেওয়া। মার্ডকের মতে, শিল্পকলা বা কোনো নতুন দক্ষতা শেখার মধ্যে আমরা অন্য কিছুর প্রতি বিনয়ী মনোযোগ দিতে শিখি। এটি আমাদের আত্মকেন্দ্রিকতা কমায়।
আইরিস মার্ডকের দর্শন আমাদের মনে করিয়ে দেয়—নৈতিকতা মানে শুধু বাইরের আচরণ নয়, বরং ভেতরের দৃষ্টিভঙ্গি। অহং ও কল্পনার জাল ছিঁড়ে অন্যকে সত্যিকারভাবে দেখার জন্য আমাদের দরকার ভালোবাসা।
আজকের বিভক্ত পৃথিবীতে, যেখানে মানুষ মানুষকে প্রায়ই শ্রেণি, ধর্ম, জাতি বা ব্যক্তিগত স্বার্থের চোখে দেখে, সেখানে মার্ডকের বার্তা অত্যন্ত জরুরি। ভালোবাসা আমাদের শেখায়—অন্যকে তাঁর নিজের মর্যাদায় দেখা, তাঁকে ন্যায্যভাবে বোঝা।
সুতরাং, কেন ভালোবাসাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—তার উত্তর স্পষ্ট। কারণ, ভালোবাসাই আমাদের ভেতরের কুয়াশা ভাঙতে পারে, আমাদের সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করায় এবং আমাদের নৈতিক মানুষ হতে সাহায্য করে।
লেখক: সাংবাদিক
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধই ছিল পৃথিবীতে প্রথম বড় ধরনের সামরিক সংঘাত। ১৯৪৭ সালের ৩০ নভেম্বরের জাতিসংঘ প্রস্তাবের নাম করে বস্তুত ব্রিটিশ ও মার্কিন মদদে ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে স্বাধীন ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতেই ওই যুদ্ধের শুরু এবং একধরনের...
৪ ঘণ্টা আগেআমাদের দৈনন্দিন কথোপকথনে অন্যতম ব্যবহৃত শব্দ হলো ‘বেতালা’। পরিস্থিতির প্রসঙ্গভেদে সাধারণত বেতালা শব্দটি আমরা কোনো ব্যক্তির চারিত্রিক বা আচরণগত কোনো দিকের প্রতি ইঙ্গিত করা অর্থে ব্যবহার করি।
৪ ঘণ্টা আগেঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসু একসময় হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক চর্চা ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব তৈরির এক অমূল্য ক্ষেত্র। ষাটের দশকের গণ-আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত এবং পরবর্তী সময়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের দিনগুলোতেও...
৪ ঘণ্টা আগেবিদ্যমান ব্যবস্থার বিপরীতে বিকল্পটা একই সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং মতাদর্শিক। এর জন্য দরকার পড়বে সামাজিক বিপ্লবের। প্রতিটি দেশেই। যেটা স্থানীয়ভাবে গড়ে তোলা চাই, তবে তার চরিত্রটা অবশ্যই থাকবে আন্তর্জাতিক।
১ দিন আগে