ট্রাম্পের শুল্কনীতির বুমেরাং
হুসাইন আহমদ
বিতর্ক যাঁর নিত্যসঙ্গী, তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ব্যবসায়ী থেকে রাষ্ট্রনায়ক বনে যাওয়া আশি ছুঁই ছুঁই এই ব্যক্তি এমন সব কর্মকাণ্ড করছেন, যেগুলো মার্কিন প্রেসিডেন্টদের চর্চিত ধ্রুপদি সংস্কৃতির সঙ্গে বেমানান। ট্রাম্প এমন অনেক নীতি গ্রহণ করছেন, যেগুলো যুক্তরাষ্ট্র বা তাঁর ঘোষিত লক্ষ্যের সঙ্গে স্পষ্টতই সাংঘর্ষিক। ট্রাম্পের দ্বিচারিতার একটি বড় উদাহরণ হলো ভারত ও ব্রিকস জোট নিয়ে তাঁর অবস্থান।
ভূ-রাজনীতির দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক সব সময় গুরুত্বপূর্ণ। এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে মার্কিন প্রভাব বজায় রাখতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে ভারত। ওয়াশিংটন দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করেছে, বেইজিংয়ের বিপক্ষে মিত্র হিসেবে দিল্লিকে পাশে রাখতে। সে ক্ষেত্রে দিল্লিও ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। চীনের প্রভাব ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ‘কোয়াড’ নামের নিরাপত্তা জোটেও ভারত যুক্ত হয়েছে। তার ধারাবাহিকতায় প্রথম মেয়াদে ট্রাম্পের সঙ্গেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সম্পর্ক উষ্ণই ছিল।
কিন্তু দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হয়ে ট্রাম্প বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যে নীতি নিয়েছেন, তা গোটা দুনিয়ার অর্থনীতি শুধু নয়, ক্ষমতার ভারসাম্যকে নাড়িয়ে দিয়েছে। ভারতের ক্ষেত্রে এর প্রভাব হতে পারে সুদূরপ্রসারী। দেশটির ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন ট্রাম্প। তাঁর ধারণা, ভারতকে এভাবে চাপে ফেলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে ব্যবহার করা যাবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো—এক দশকের বেশি সময় ধরে মার্কিন প্রভাববলয় ধীরে ধীরে দুর্বল হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাজনৈতিক স্বার্থে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ব্যবহারের ঘটনা বাড়ছে।
আর মার্কিন বিধিনিষেধের অনিবার্য পরিণতি হিসেবে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ছে বহু দেশ। এই দুই দেশের ওপর নানা মাত্রায় মার্কিন নিষেধাজ্ঞা বিশ্ববাণিজ্যে ডলারের বিকল্পের চাহিদা তীব্রতর করে তুলেছে। গত কয়েক বছরে ভারতসহ বহু দেশ চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে কারেন্সি সোয়াপ বা মুদ্রা বিনিময় চালু করেছে। বৈরী প্রতিবেশী ভারত ও চীন সম্পর্কোন্নয়নের পথে হাঁটছে। ২০২৪ সালের কাজান ব্রিকস সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের বৈঠক ছিল বড় উদাহরণ। ট্রাম্পের শুল্কনীতি ও সাম্প্রতিক আচরণ ভারতকে চীনের কাছে ঘেঁষতে বাধ্য করছে।
খুব সম্প্রতিও তার নজির দেখা গেল। পাঁচ বছর আগে বন্ধ হওয়া দুই দেশের মধ্যে সরাসরি ফ্লাইট আবার চালু হচ্ছে। হিমালয়ের পাদদেশের লাদাখ সীমান্ত নিয়ে চীন-ভারত দ্বন্দ্ব কয়েক দশকের পুরোনো। ২০২০ সালে লাদাখে ভয়াবহ সংঘাতে অন্তত ২০ জন ভারতীয় ও বেশ কয়েকজন চীনা সেনা নিহত হলে দুই দেশের সম্পর্ক তলানিতে নেমে যায়। তখন সরাসরি ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যায়।
চলতি সপ্তাহে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর নয়াদিল্লি সফরে আবার সরাসরি ফ্লাইট চালুর ঘোষণা আসে। চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, দুই দেশই সীমান্ত চিহ্নিতকরণ আলোচনার অগ্রগতির আশা দেখছে। চীন-ভারত তিনটি সীমান্ত-বাণিজ্য বাজার পুনরায় খোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। উভয় দেশ আবার পর্যটক ভিসা দেওয়ার এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদারের ব্যাপারে সম্মত হয়েছে।
শুধু ফ্লাইট চালু নয়, আগস্টের শেষে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) সম্মেলনে যোগ দিতে চীন সফরে যাবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সাত বছর পর এই সফরে তিনি চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করবেন। এর আগে সর্বশেষ ২০১৮ সালে চীন সফর করেন মোদি। মজার ব্যাপার হলো, এই সম্মেলনে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও উপস্থিত থাকবেন।
ভারত-চীন সম্পর্কের উষ্ণতা এমন সময়ে ছড়াচ্ছে, যখন রাশিয়ার তেল আমদানির কারণে ভারতের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন ট্রাম্প। এর সঙ্গে চীনের পণ্যের ওপর মার্কিন শুল্ক নিয়েও চলছে দেনদরবার। চীন-ভারত সমঝোতা দীর্ঘদিনের প্রক্রিয়ার অংশ হলেও ট্রাম্পের বৈরিতা তাতে গতি ও আন্তরিকতা নিয়ে এসেছে। এ অবস্থায় মার্কিন নেতৃত্বাধীন কোয়াড জোটের ভবিষ্যৎ নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্কের টানাপোড়েনের কতগুলো কারণ আছে—এক. পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি মধ্যস্থতায় ট্রাম্পের দাবি করা কৃতিত্বকে ভারতের উড়িয়ে দেওয়া। দুই. কৃষি খাতে মার্কিন শুল্ক ছাড় না দিয়ে বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে দেনদরবারে ভারতের অনমনীয়তা। তিন. রাশিয়ার তেল আমদানির জন্য ভারতের ওপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ। কিন্তু ভারতকে চাপে ফেলতে ট্রাম্পকে সাহস জুগিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ইইউ তার চাপের কাছে নতি স্বীকার করে অসম বাণিজ্য চুক্তি করেছে। ইউরোপীয় পণ্যে যুক্তরাষ্ট্র ১৫ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছে, অথচ মার্কিন পণ্য শুল্ক ছাড়াই ইউরোপে ঢুকছে।
কিন্তু ভারত ইউরোপ নয়। এটি বিশ্বের সর্বাধিক জনবহুল দেশ, তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি এবং দীর্ঘদিন ধরে স্বাধীন, জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করছে। ট্রাম্পের চাপে এত সহজে ভারত নতি স্বীকার করবে বলে মনে হয় না। ভারতের সঙ্গে বিরোধ বাড়ানোর অজুহাত হিসেবে ট্রাম্প ব্যবহার করছেন রাশিয়ার তেল আমদানি ইস্যু। কারণ, ইউক্রেন যুদ্ধের পর পশ্চিমা বিশ্ব যেখানে রাশিয়ার তেল বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে, সেখানে ভারত অন্যতম বড় ক্রেতা হয়ে উঠেছে।
তবে রাশিয়ার তেল নিয়ে মার্কিনসহ পশ্চিমা বিধিনিষেধেও দ্বিচারিতা আছে। রাশিয়ার কাছ থেকে চীন বেশি বেশি তেল কিনলেও দেশটির ওপর ভারতের মতো চাপ দিচ্ছেন না ট্রাম্প। তাই ট্রাম্পের আসল উদ্দেশ্য রাশিয়া নয়, ভারতের ওপর চাপ বাড়ানো। কিন্তু পরিহাসের বিষয় হলো, ভারত রাশিয়ার তেল কিনলেও সবটা কিন্তু নিজে ব্যবহার করছে না, একটা অংশ প্রক্রিয়াজাত করে আবার ইউরোপেই রপ্তানি করছে।
ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যে যুক্তরাষ্ট্র বড় ঘাটতিতে রয়েছে। ২০২৪ সালে দুই দেশের বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ২১২ বিলিয়ন ডলার, যার বড় অংশই ভারতের। ট্রাম্প এই বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে মরিয়া। ভারত থেকে আসা ওষুধ বা হিরে সহজেই অন্য উৎস থেকে পাওয়া সম্ভব। তাই ট্রাম্প মনে করছেন, ভারতের ওপর চাপ দিলে সেটি কার্যকর হবে। চীনের ক্ষেত্রে বাস্তবতা
ভিন্ন। কারণ, চীনের ইলেকট্রনিকস, যন্ত্রাংশ, সেমিকন্ডাক্টর, এমনকি বিরল খনিজ উপকরণের ওপর বেশ নির্ভরশীল যুক্তরাষ্ট্র।
কিন্তু ভারতের রাজনৈতিক অবস্থান তাকে বাড়তি ক্ষমতা দিয়েছে। ব্রিকসে চীন-রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করে যুক্তরাষ্ট্রকে বার্তা দিতে পারে দিল্লি। এই পরিস্থিতিই এখন ব্রিকসের ভেতরে নতুন ঐক্যের জন্ম দিচ্ছে। কাজান সম্মেলনে রাশিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। চীন ও ভারতের মধ্যে আলোচনার মধ্যস্থতা করে মস্কো। পরের বছর উভয় দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে সীমান্ত নিয়ে সংলাপ শুরু করে।
শুধু ভারত নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোও একই বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ভিয়েতনামের ওপর ট্রাম্প শুল্ক চাপানোর ঘোষণা দেওয়ার পর চীন দ্রুত এগিয়ে আসে। সি চিন পিং নিজে ভিয়েতনামে গিয়ে একসঙ্গে ৪৫টি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। ২০২৫ সালের ব্রিকস সম্মেলনে নতুন অংশীদার দেশ হিসেবে ভিয়েতনামকে দেখা গেল।
ব্রিকস জোট বিশ্বের মোট জনসংখ্যার বড় অংশকে প্রতিনিধিত্ব করে। ডোনাল্ড ট্রাম্প বরাবরই ব্রিকসকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় হুমকি হিসেবে তুলে ধরেছেন। ডলারের বিকল্প মুদ্রা প্রবর্তনের চেষ্টার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন তিনি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ব্রিকস জোট ডলারের বিকল্প তৈরির পথে গেলে সদস্যদেশগুলোর ওপর বাড়তি ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করবেন তিনি।
কিন্তু ট্রাম্পের এই হুমকি-ধমকি উল্টো ফল দিচ্ছে। ব্রিকস দুর্বল হওয়ার বদলে শক্তিশালী হচ্ছে। এই জোটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ব্রাজিল। দেশটির বর্তমান বামপন্থী প্রেসিডেন্ট লুইস ইনাসিও লুলা দা সিলভার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছেন ট্রাম্প। লুলার বিরোধীপক্ষ ডানপন্থী জইর বলসোনারোর সঙ্গে গলায় গলায় ভাব ট্রাম্পের। তাই, লুলার ওপর বাড়তি চাপ দিতে ব্রাজিলের পণ্যে ৫০ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছেন তিনি। এতে চীনের সঙ্গে ব্রাজিলের ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে। তা ছাড়া, ডলারের বিকল্প মুদ্রাব্যবস্থা গড়ে তোলার বিষয়ে লুলা খুবই সোচ্চার।
দীর্ঘদিন ধরে ওয়াশিংটনের কৌশল ছিল ভাগ করে শাসন করা—রাশিয়া ও চীনকে আলাদা রাখা, ভারতকে চীনের বিপক্ষে ব্যবহার করা, ভিয়েতনামকে চীনের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড় করানো। কিন্তু ট্রাম্পের আক্রমণাত্মক শুল্কনীতি সেই পরিকল্পনাকে ব্যর্থ করছে। ভারত-চীন কাছাকাছি আসছে, ব্রাজিল আরও বেশি ঝুঁকছে চীনের দিকে, নতুনভাবে ব্রিকসে যুক্ত হয়েছে ভিয়েতনাম। ফলাফল—ব্রিকস আরও শক্তিশালী হচ্ছে, আর গ্লোবাল সাউথের চোখে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
বিতর্ক যাঁর নিত্যসঙ্গী, তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ব্যবসায়ী থেকে রাষ্ট্রনায়ক বনে যাওয়া আশি ছুঁই ছুঁই এই ব্যক্তি এমন সব কর্মকাণ্ড করছেন, যেগুলো মার্কিন প্রেসিডেন্টদের চর্চিত ধ্রুপদি সংস্কৃতির সঙ্গে বেমানান। ট্রাম্প এমন অনেক নীতি গ্রহণ করছেন, যেগুলো যুক্তরাষ্ট্র বা তাঁর ঘোষিত লক্ষ্যের সঙ্গে স্পষ্টতই সাংঘর্ষিক। ট্রাম্পের দ্বিচারিতার একটি বড় উদাহরণ হলো ভারত ও ব্রিকস জোট নিয়ে তাঁর অবস্থান।
ভূ-রাজনীতির দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক সব সময় গুরুত্বপূর্ণ। এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে মার্কিন প্রভাব বজায় রাখতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে ভারত। ওয়াশিংটন দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করেছে, বেইজিংয়ের বিপক্ষে মিত্র হিসেবে দিল্লিকে পাশে রাখতে। সে ক্ষেত্রে দিল্লিও ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। চীনের প্রভাব ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ‘কোয়াড’ নামের নিরাপত্তা জোটেও ভারত যুক্ত হয়েছে। তার ধারাবাহিকতায় প্রথম মেয়াদে ট্রাম্পের সঙ্গেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সম্পর্ক উষ্ণই ছিল।
কিন্তু দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হয়ে ট্রাম্প বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যে নীতি নিয়েছেন, তা গোটা দুনিয়ার অর্থনীতি শুধু নয়, ক্ষমতার ভারসাম্যকে নাড়িয়ে দিয়েছে। ভারতের ক্ষেত্রে এর প্রভাব হতে পারে সুদূরপ্রসারী। দেশটির ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন ট্রাম্প। তাঁর ধারণা, ভারতকে এভাবে চাপে ফেলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে ব্যবহার করা যাবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো—এক দশকের বেশি সময় ধরে মার্কিন প্রভাববলয় ধীরে ধীরে দুর্বল হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাজনৈতিক স্বার্থে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ব্যবহারের ঘটনা বাড়ছে।
আর মার্কিন বিধিনিষেধের অনিবার্য পরিণতি হিসেবে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ছে বহু দেশ। এই দুই দেশের ওপর নানা মাত্রায় মার্কিন নিষেধাজ্ঞা বিশ্ববাণিজ্যে ডলারের বিকল্পের চাহিদা তীব্রতর করে তুলেছে। গত কয়েক বছরে ভারতসহ বহু দেশ চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে কারেন্সি সোয়াপ বা মুদ্রা বিনিময় চালু করেছে। বৈরী প্রতিবেশী ভারত ও চীন সম্পর্কোন্নয়নের পথে হাঁটছে। ২০২৪ সালের কাজান ব্রিকস সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের বৈঠক ছিল বড় উদাহরণ। ট্রাম্পের শুল্কনীতি ও সাম্প্রতিক আচরণ ভারতকে চীনের কাছে ঘেঁষতে বাধ্য করছে।
খুব সম্প্রতিও তার নজির দেখা গেল। পাঁচ বছর আগে বন্ধ হওয়া দুই দেশের মধ্যে সরাসরি ফ্লাইট আবার চালু হচ্ছে। হিমালয়ের পাদদেশের লাদাখ সীমান্ত নিয়ে চীন-ভারত দ্বন্দ্ব কয়েক দশকের পুরোনো। ২০২০ সালে লাদাখে ভয়াবহ সংঘাতে অন্তত ২০ জন ভারতীয় ও বেশ কয়েকজন চীনা সেনা নিহত হলে দুই দেশের সম্পর্ক তলানিতে নেমে যায়। তখন সরাসরি ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যায়।
চলতি সপ্তাহে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর নয়াদিল্লি সফরে আবার সরাসরি ফ্লাইট চালুর ঘোষণা আসে। চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, দুই দেশই সীমান্ত চিহ্নিতকরণ আলোচনার অগ্রগতির আশা দেখছে। চীন-ভারত তিনটি সীমান্ত-বাণিজ্য বাজার পুনরায় খোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। উভয় দেশ আবার পর্যটক ভিসা দেওয়ার এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদারের ব্যাপারে সম্মত হয়েছে।
শুধু ফ্লাইট চালু নয়, আগস্টের শেষে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) সম্মেলনে যোগ দিতে চীন সফরে যাবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সাত বছর পর এই সফরে তিনি চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করবেন। এর আগে সর্বশেষ ২০১৮ সালে চীন সফর করেন মোদি। মজার ব্যাপার হলো, এই সম্মেলনে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও উপস্থিত থাকবেন।
ভারত-চীন সম্পর্কের উষ্ণতা এমন সময়ে ছড়াচ্ছে, যখন রাশিয়ার তেল আমদানির কারণে ভারতের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন ট্রাম্প। এর সঙ্গে চীনের পণ্যের ওপর মার্কিন শুল্ক নিয়েও চলছে দেনদরবার। চীন-ভারত সমঝোতা দীর্ঘদিনের প্রক্রিয়ার অংশ হলেও ট্রাম্পের বৈরিতা তাতে গতি ও আন্তরিকতা নিয়ে এসেছে। এ অবস্থায় মার্কিন নেতৃত্বাধীন কোয়াড জোটের ভবিষ্যৎ নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্কের টানাপোড়েনের কতগুলো কারণ আছে—এক. পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি মধ্যস্থতায় ট্রাম্পের দাবি করা কৃতিত্বকে ভারতের উড়িয়ে দেওয়া। দুই. কৃষি খাতে মার্কিন শুল্ক ছাড় না দিয়ে বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে দেনদরবারে ভারতের অনমনীয়তা। তিন. রাশিয়ার তেল আমদানির জন্য ভারতের ওপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ। কিন্তু ভারতকে চাপে ফেলতে ট্রাম্পকে সাহস জুগিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ইইউ তার চাপের কাছে নতি স্বীকার করে অসম বাণিজ্য চুক্তি করেছে। ইউরোপীয় পণ্যে যুক্তরাষ্ট্র ১৫ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছে, অথচ মার্কিন পণ্য শুল্ক ছাড়াই ইউরোপে ঢুকছে।
কিন্তু ভারত ইউরোপ নয়। এটি বিশ্বের সর্বাধিক জনবহুল দেশ, তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি এবং দীর্ঘদিন ধরে স্বাধীন, জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করছে। ট্রাম্পের চাপে এত সহজে ভারত নতি স্বীকার করবে বলে মনে হয় না। ভারতের সঙ্গে বিরোধ বাড়ানোর অজুহাত হিসেবে ট্রাম্প ব্যবহার করছেন রাশিয়ার তেল আমদানি ইস্যু। কারণ, ইউক্রেন যুদ্ধের পর পশ্চিমা বিশ্ব যেখানে রাশিয়ার তেল বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে, সেখানে ভারত অন্যতম বড় ক্রেতা হয়ে উঠেছে।
তবে রাশিয়ার তেল নিয়ে মার্কিনসহ পশ্চিমা বিধিনিষেধেও দ্বিচারিতা আছে। রাশিয়ার কাছ থেকে চীন বেশি বেশি তেল কিনলেও দেশটির ওপর ভারতের মতো চাপ দিচ্ছেন না ট্রাম্প। তাই ট্রাম্পের আসল উদ্দেশ্য রাশিয়া নয়, ভারতের ওপর চাপ বাড়ানো। কিন্তু পরিহাসের বিষয় হলো, ভারত রাশিয়ার তেল কিনলেও সবটা কিন্তু নিজে ব্যবহার করছে না, একটা অংশ প্রক্রিয়াজাত করে আবার ইউরোপেই রপ্তানি করছে।
ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যে যুক্তরাষ্ট্র বড় ঘাটতিতে রয়েছে। ২০২৪ সালে দুই দেশের বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ২১২ বিলিয়ন ডলার, যার বড় অংশই ভারতের। ট্রাম্প এই বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে মরিয়া। ভারত থেকে আসা ওষুধ বা হিরে সহজেই অন্য উৎস থেকে পাওয়া সম্ভব। তাই ট্রাম্প মনে করছেন, ভারতের ওপর চাপ দিলে সেটি কার্যকর হবে। চীনের ক্ষেত্রে বাস্তবতা
ভিন্ন। কারণ, চীনের ইলেকট্রনিকস, যন্ত্রাংশ, সেমিকন্ডাক্টর, এমনকি বিরল খনিজ উপকরণের ওপর বেশ নির্ভরশীল যুক্তরাষ্ট্র।
কিন্তু ভারতের রাজনৈতিক অবস্থান তাকে বাড়তি ক্ষমতা দিয়েছে। ব্রিকসে চীন-রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করে যুক্তরাষ্ট্রকে বার্তা দিতে পারে দিল্লি। এই পরিস্থিতিই এখন ব্রিকসের ভেতরে নতুন ঐক্যের জন্ম দিচ্ছে। কাজান সম্মেলনে রাশিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। চীন ও ভারতের মধ্যে আলোচনার মধ্যস্থতা করে মস্কো। পরের বছর উভয় দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে সীমান্ত নিয়ে সংলাপ শুরু করে।
শুধু ভারত নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোও একই বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ভিয়েতনামের ওপর ট্রাম্প শুল্ক চাপানোর ঘোষণা দেওয়ার পর চীন দ্রুত এগিয়ে আসে। সি চিন পিং নিজে ভিয়েতনামে গিয়ে একসঙ্গে ৪৫টি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। ২০২৫ সালের ব্রিকস সম্মেলনে নতুন অংশীদার দেশ হিসেবে ভিয়েতনামকে দেখা গেল।
ব্রিকস জোট বিশ্বের মোট জনসংখ্যার বড় অংশকে প্রতিনিধিত্ব করে। ডোনাল্ড ট্রাম্প বরাবরই ব্রিকসকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় হুমকি হিসেবে তুলে ধরেছেন। ডলারের বিকল্প মুদ্রা প্রবর্তনের চেষ্টার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন তিনি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ব্রিকস জোট ডলারের বিকল্প তৈরির পথে গেলে সদস্যদেশগুলোর ওপর বাড়তি ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করবেন তিনি।
কিন্তু ট্রাম্পের এই হুমকি-ধমকি উল্টো ফল দিচ্ছে। ব্রিকস দুর্বল হওয়ার বদলে শক্তিশালী হচ্ছে। এই জোটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ব্রাজিল। দেশটির বর্তমান বামপন্থী প্রেসিডেন্ট লুইস ইনাসিও লুলা দা সিলভার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছেন ট্রাম্প। লুলার বিরোধীপক্ষ ডানপন্থী জইর বলসোনারোর সঙ্গে গলায় গলায় ভাব ট্রাম্পের। তাই, লুলার ওপর বাড়তি চাপ দিতে ব্রাজিলের পণ্যে ৫০ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছেন তিনি। এতে চীনের সঙ্গে ব্রাজিলের ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে। তা ছাড়া, ডলারের বিকল্প মুদ্রাব্যবস্থা গড়ে তোলার বিষয়ে লুলা খুবই সোচ্চার।
দীর্ঘদিন ধরে ওয়াশিংটনের কৌশল ছিল ভাগ করে শাসন করা—রাশিয়া ও চীনকে আলাদা রাখা, ভারতকে চীনের বিপক্ষে ব্যবহার করা, ভিয়েতনামকে চীনের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড় করানো। কিন্তু ট্রাম্পের আক্রমণাত্মক শুল্কনীতি সেই পরিকল্পনাকে ব্যর্থ করছে। ভারত-চীন কাছাকাছি আসছে, ব্রাজিল আরও বেশি ঝুঁকছে চীনের দিকে, নতুনভাবে ব্রিকসে যুক্ত হয়েছে ভিয়েতনাম। ফলাফল—ব্রিকস আরও শক্তিশালী হচ্ছে, আর গ্লোবাল সাউথের চোখে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠাপানির জলাভূমি টাঙ্গুয়ার হাওর। আয়তন ১২৬ বর্গকিলোমিটার। হাওরের অবস্থান সুনামগঞ্জ জেলার মধ্যনগর ও তাহিরপুর উপজেলায়। এই হাওর শুধু মিঠাপানির জলাভূমিই নয়; নয়নাভিরাম এবং জীববৈচিত্র্যের অন্যতম আধার। এ ছাড়া হাজার হাজার মানুষের জীবিকার উৎসস্থল এই হাওর।
৮ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশে মাছ ধরতে জেলেরা এখন প্রাচীন পদ্ধতি আর ব্যবহার করছেন না। প্রায়ই দেখা যাচ্ছে বিষ প্রয়োগে মাছ শিকারের খবর। জেলেরা এক ধরনের অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড বা গ্যাস ট্যাবলেট দিয়ে মাছ শিকার করছেন। এই ট্যাবলেট অত্যন্ত ক্ষতিকর। কেননা, এটি পানিতে ফেললে জলে থাকা সব মাছ তো মারা যায়ই, সঙ্গে মাটির নিচের মাছগুলোও
৮ ঘণ্টা আগেচুরিবিদ্যা মহাবিদ্যা যদি না পড়ে ধরা—এই প্রবাদকে সত্যে পরিণত করেছেন জনৈক চোর। মাওলানা ভাসানী সেতুর সড়কবাতির তার চুরি করার পর এবার তিনি চুরি করেছেন শতাধিক রিফ্লেক্টর লাইট। পাঠক, আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে ২৫ আগস্ট, সোমবার আমরা গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে তিস্তা নদীর ওপর নির্মিত এই সেতুর তার চুরির প্রতিবেদন
৮ ঘণ্টা আগেনজরুলের মূল শক্তি ছিল তাঁর গতি এবং কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। কোমলে-কঠোরে গড়া ছিল তাঁর জীবন। তাই প্রেমের কবিতা, সাম্যের কবিতা, ইসলামি কবিতা কিংবা শ্যামা সংগীত, কোনোখানেই তিনি স্থির হয়ে দাঁড়াননি। যা কিছু সুন্দর, তার প্রতি আস্থা রেখেছেন আজীবন।
১ দিন আগে