সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

আমাদের নিজেদের দেশের খবর এড়ানোর উপায় নেই। এখানে প্রতিদিন অসংখ্য ঘটনা ঘটছে, চাঞ্চল্যকর ঘটনাও। কয়েকটির দিকে তাকানো যেতে পারে। করোনায় ভুগে অনেক মানুষ অকালে মারা গেছে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি মানুষকে কিন্তু আকস্মিকভাবে ও অকালে চলে যেতে হয়েছে সড়ক দুর্ঘটনায়।
একদিনের খবরই ধরা যাক। ৯ ফেব্রুয়ারির। সেদিন করোনায় মৃত্যু হয়েছে ১০ জনের, সড়ক দুর্ঘটনায় ২৩ জনের। করোনায় মৃত্যু তা-ও কিছুটা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করা হয়ে থাকে, সড়কে মৃত্যুকে মনে করা হয় নিতান্ত স্বাভাবিক। সড়ক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী প্রায় প্রতিদিনই তাঁর অদৃশ্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের উদ্দেশে একটি করে সুতীক্ষ্ণ বাণ নিক্ষেপ করেন, কিন্তু তাঁর মন্ত্রণালয়ের আসল যে প্রতিপক্ষ, সড়ক অব্যবস্থাপনা, সে বিষয়ে উচ্চবাচ্য করেন না। চলচ্চিত্রাভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন সড়কের নিরাপত্তা নিয়ে আন্দোলন করছেন, কাজটির সঙ্গে সড়ক দুর্ঘটনায় তাঁর স্ত্রীকে হারানোর বেদনা জড়িত রয়েছে; তাঁকে একজন সাবেক মন্ত্রী, প্রতিদিনই যিনি বিরোধী দলের লোকদের হুঁশিয়ার করে দিতেন, তিনি সুবিধামতো আর কাউকে না পেয়েই হবে, ইলিয়াস কাঞ্চনকে উন্মাদ বলে অভিহিত করেছেন। বোঝা যাচ্ছে সড়কে যাত্রীদের কপালের দুর্ভোগ কমার আপাতত কোনো কারণ নেই।
করোনা নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে, সড়ক নিয়ন্ত্রণে আসবে না। আর কেবল সড়কে বের হলেই যে নিরাপত্তাহীনতার মুখে পড়তে হবে, তা-ও নয়। ঘরে বসে থেকেও প্রাণহানি ঘটানো সম্ভব, উন্মত্ত চালকেরা ইদানীং চলন্ত বাস-ট্রাক নিয়ে ঘরের ভেতরেও হানা দিচ্ছেন।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী, যিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও, তিনি নিজেকেও অবশ্য আক্রমণের বাইরে রাখতে পারছেন না। না, বিরোধী দলের কাছ থেকে নয়; বিরোধী দলের কথাবার্তা তো মশার কামড়, বিরক্তিকর, তবে উপেক্ষণীয়; আক্রমণটা এসেছে তাঁর কনিষ্ঠ সহোদর ভাইয়ের কাছ থেকেই, যিনি আওয়ামী লীগেরই লোক এবং সামান্য কেউ নন; স্থানীয় পৌরসভার মেয়র। কনিষ্ঠ ভ্রাতা বলছেন, সত্যের পক্ষে অকুতোভয় অবস্থান নিয়ে দলীয় কিছু লোকের অপরাজনীতির বিরুদ্ধে লড়বেন। তাঁর অগ্রজ যেহেতু দলের সাধারণ সম্পাদক, তাই তাঁর বক্তব্য সবিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে। তাঁর স্বর একটু চড়াই।
যেমন সংবাদ সম্মেলনে তাঁর উক্তি: ‘আমার মুখ বন্ধ করতে ওবায়দুল কাদের (অর্থাৎ তাঁর অগ্রজ) ষড়যন্ত্র চক্রান্ত করছে।’ এটাকে গৃহবিবাদ বলা যাবে কি না, আমরা নিশ্চিত নই। তবে দলের ভেতর ‘বিদ্রোহী’রা যে আত্মপ্রকাশ করেছে, তা বোঝা যায় পৌর নির্বাচনের অবস্থার দিকে তাকালেই। সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা (নীরবে ও প্রকাশ্যেও) চলেছে দলের মনোনীত ও বিদ্রোহী প্রার্থী, এই দুইয়ের মধ্যেই; সংঘর্ষ ও প্রাণনাশের ঘটনাও ঘটেছে ওই কারণেই। দলীয় কর্তৃত্বকে যাতে একেবারে তৃণমূল পর্যন্ত প্রসারিত করা যায় সে অভিপ্রায়ে দলের লোকেরা সব নির্বাচনেই দলীয় প্রতীক নিয়ে লড়বেন, এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল। এখন যখন দেখা যাচ্ছে জেতার ব্যাপারে যেহেতু দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই, বিরোধী দলের প্রার্থীরা কার্যত অনুপস্থিত, বিদ্রোহীরাও দলেরই লোক, নির্বাচিত হলে তাঁরাও দলের পক্ষপুটেই প্রত্যাবর্তন করবেন, তাই এই প্রার্থীটি মনোনয়ন পেয়েছেন, ওই প্রার্থীটি পাননি, এমন ছাপটাপ ব্যবহার করার আবশ্যকতা নেই।
যিনি জিতবেন, তিনিই সরকারি দলে শামিল হবেন, এই বৈজ্ঞানিক নিয়মকে নিরুপদ্রবে কাজ করতে দেওয়াই সংগত। তবে গৃহবিবাদটা থাকবে, যাঁরা দলের লোক বলে দাবিদার, তাঁরা বঞ্চিত হলে সেই বঞ্চনার উত্তাপ কোনো না কোনোভাবে প্রকাশ পাবে। বিদ্রোহীদের বহিষ্কারও করা যাবে না, কারণ একে তো তাঁদের সংখ্যা অনেক, উপরন্তু দলের প্রতি তাঁদের আনুগত্য ইস্পাতের মতো কঠিন, পরীক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত। বহিষ্কারে দলের শক্তি কমবে। এসবের চেয়েও অবশ্য অনেক বড় বড় সমস্যা রয়েছে সমাজে। করোনার প্রকোপে অর্থনৈতিক মেরুকরণ প্রক্রিয়াটি আরও নির্মম হয়েছে। নিম্নমধ্যবিত্ত গরিব হয়েছে, গরিব মানুষ একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছে। মা-বাবা বিশেষ সংকটে পড়েছেন তাঁদের সন্তানদের নিয়ে।
পুরো দেড়টা বছর ওই সন্তানদের জীবন থেকে অপহৃত হয়ে গেছে। স্কুল-কলেজ বন্ধ ছিল। ছেলেমেয়েদের ভেতর অপরাধের প্রবণতা বেড়েছে। কিশোর গ্যাং তৈরির প্রক্রিয়া বেগবান ও বিস্তৃত হয়ে উঠেছে। মেয়েদের নিয়ে বিপদ আরও বেশি। তাদের ওপর লোলুপ দৃষ্টি নিক্ষিপ্ত হয়। সমবয়সী পুরুষদের তো বটেই, অন্য বয়সীদেরও। ধর্ষণ, মিথ্যা-প্রতিশ্রুতি, প্রতারণা—সবকিছুই আগের চেয়ে অধিক মাত্রাতেই চলছে। ফলে বাল্যবিবাহের হার বেড়েছে, তবে সেটা যে কী পরিমাণে, আমরা জানি না।
আর কেবল যে নিম্ন আয়ের পরিবারের ছেলেমেয়েদের নিয়েই সমস্যা তা তো নয়, অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলেমেয়েরাও ভালো নেই। তারাও অসুস্থ হয়ে পড়ছে। এরা কিশোর গ্যাং করে না, অন্যদের ওপর হামলা যে চালাবে এমন নয়; যা করার নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখে। তবে মারাত্মক সব অপরাধ এরাও করে থাকে। হতাশা, সৃষ্টিশীল কাজের অভাব, ভালো দৃষ্টান্তের অনুপস্থিতি, সুস্থ বিনোদনের স্বল্পতা, ভোগবাদিতার ব্যাপক বিস্তার, এদের আত্মপীড়নের, এমনকি অনাকাঙ্ক্ষিত পারস্পরিক পীড়নেরও অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে। দুটি ঘটনা সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে এবং সামাজিক প্রতিক্রিয়ার উপলক্ষ হয়েছে। দুটিই মৃত্যুর। দুটিতেই মামলা হয়েছে ধর্ষণ ও খুনের। প্রথমটি অল্প বয়স্ক এক বালিকা ও এক কিশোরকে ঘিরে। বালিকাটি মারা গেছে, কিশোরটি এখন জেলে। মেয়েটির মা-বাবার অভিযোগ, ছেলেটি তাঁদের নাবালিকা সন্তানকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিজের বাসায় নিয়ে গিয়ে প্রথমে ধর্ষণ ও পরে হত্যা করেছে।
তাঁদের ধারণা, একজন নয়, সঙ্গে আরও তিনজন কিশোর জড়িত ছিল। দ্বিতীয় ঘটনাটি বিষাক্ত মদ্যপানের। পাঁচজন, একটি মেয়ে ও চারটি ছেলে, মিলেমিশে এক রেস্টুরেন্টে বসে মদ্যপান করেছে। দেশি মদ, ভেজাল ছিল, তাতে বিষক্রিয়া হয়েছে। জানা যায়, এমন কাজ তারা প্রায়ই করে থাকে। তবে ওই দিন দুর্ঘটনা ঘটে যায়। এরা সবাই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। টাকাপয়সার অভাব নেই। মেয়েটির সঙ্গে ছেলেদের একজনের ‘প্রেমে’র সম্পর্ক। মদ্যপানের আসর ভেঙে যাওয়ার পর মেয়েটি অসুস্থ বোধ করলে তার প্রেমিক তাকে এক বান্ধবীর বাসায় নিয়ে যায়। সেখানে ছেলেটি ও মেয়েটি একত্রে রাত্রি যাপন করে। সকালে মেয়েটির অসুখ বাড়ে, তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়; সেখানে সে মারা যায়। তাদের সঙ্গী চারটি ছেলের মধ্যে একজনও মারা গেছে ওই ভেজাল মদ অতিরিক্ত পান করার দরুন। মেয়েটির মা-বাবা মেয়েটির কথিত প্রেমিকের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও হত্যা মামলা করেছেন।
প্রতিক্রিয়ায় আমরা নানা কথা বলছি ও শুনছি। বলাবলি চলছে যে এসব ঘটনার জন্য মা-বাবাই দায়ী। তাঁরা খেয়াল রাখেন না ছেলেমেয়েরা কী করছে। অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদের নিজেদের মধ্যেও প্রীতির সম্পর্ক নেই; ছেলেমেয়েরা প্রাচুর্যের মধ্যে বড় হয়, তাদের বাসায় লোকজন তেমন থাকে না, মা-বাবা বাইরে চলে যান, ছেলেমেয়েরা খালি বাসায় যা ইচ্ছা তা-ই করে। সবই সত্য। এসব আমরা বলছি, বলব, বলতেই থাকব। কিন্তু নির্মম সত্য তো এটাও যে মা-বাবা নিজেরাও বিদ্যমান ব্যবস্থারই অসহায় শিকার। তাঁরা ইচ্ছা করে যে ওসব বিচ্যুতি ঘটান তা নয়, ছেলেমেয়েদের মঙ্গল তাঁরা নিশ্চয়ই চান। কিন্তু পারেন না। সমাজ অসুস্থ। জীবনানন্দ দাশ যে গভীর অসুখের পীড়া দেখে কাতর হয়েছিলেন, বছরে বছরে সেটা বেড়েছে এবং এখন সুস্থ থাকাটা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে।
একাত্তরে যে কিশোর যুদ্ধ করেছে আজ সে আত্মপীড়ন করে। একাত্তরের শত্রু চিহ্নিত ছিল, বাইরে থেকে তারা এসেছে, আমরা তাদের চিনতে পারতাম; শত্রু এখন দেশের ভেতরেই। এ শত্রুটিকে অসুখ বলাই সংগত এবং অসুখটির নাম হলো পুঁজিবাদ। পাকিস্তানি হানাদারদের আমরা তাড়াতে পেরেছি, কিন্তু যে অসুখের তাড়নায় অস্থির হয়ে ওই হানাদারেরা আমাদের ওপর হামলা করেছিল, সেটা রয়ে গেছে; কেবল রয়েই যায়নি তার জন্য বিকাশের পথটি প্রশস্ত হয়েছে। বস্তুত বাংলাদেশে সত্যিকার মুক্তি যদি কারও ঘটে থাকে, তবে সেটা ওই পুঁজিবাদের। পুঁজিবাদের ওই মুক্তিই আমাদের বন্দী করে রেখেছে এবং নানাভাবে ও নানা দিক দিয়ে উৎপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে। ওই অসুখের চিকিৎসা একটাই; তাকে বিতাড়ন করা।
অসুখের তৎপরতার কাহিনি তো মহাভারতসমান, বলে শেষ করার নয়। ৫০ বছর পার হয়েছে, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরির কাজ শেষ হচ্ছে না। হবে কী করে? যুদ্ধের সময় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৮০ হাজার, বাড়তে বাড়তে সেটা এখন ২ লাখ ছাড়িয়েছে।
বাকিরা কোথা থেকে এল? কোন লোভে? আসলে মুক্তিযোদ্ধাদের নয়, জাতীয় স্বার্থে প্রয়োজন ছিল খাঁটি রাজাকারদের নির্ভেজাল তালিকা তৈরি করা। মধুলোভী ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা যে কত, তা নিশ্চিত জানা যাবে না। তাদের মধ্যে তো কয়েকজন সচিবও ছিলেন, শনাক্ত হয়েছেন। এই তো সেদিন এক দৈনিক পত্রিকায় পড়লাম, একটি এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় জামায়াতে ইসলামীর নায়েবের নামও স্থান পেয়েছে।
আর গৃহবিবাদ? কতভাবে যে তার প্রকাশ! মেহেরপুরে এক বৃদ্ধ ব্যক্তি, বয়স তাঁর আশি, নাম মুসা করিম, নিজ গৃহ থেকে বিতাড়িত হয়ে তিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে আবেদন জানিয়েছেন আত্মহত্যার অনুমতি চেয়ে। কারণ তাঁর কোনো আশ্রয় নেই।
বিষয়সম্পত্তি যা ছিল উত্তরাধিকারীদের দিয়ে দিয়েছেন। বিলি-বণ্টনে সন্তুষ্ট না হওয়ায় পরিবারের একপক্ষ তাঁকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। এটা সেই মেহেরপুরের ঘটনা, যার আমবাগানে প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার শপথ গ্রহণ করে বাংলাদেশকে মুক্ত করবে বলে। কিছুদিন আগে এক খবরে পড়েছিলাম, বৃদ্ধ মাতা বিতাড়িত হয়েছেন গৃহ থেকে। তিনিও বিষয়সম্পত্তি যা ছিল সন্তানদের দিয়ে নিঃস্ব হয়েছিলেন, সমাজ পিতৃতান্ত্রিক বটে; কিন্তু পিতা-মাতা সবাই সমান বোঝা, সম্পত্তি যদি না থাকে। ভরসা রাখি গৃহবিবাদগুলোর মীমাংসা ঘটবে গৃহযুদ্ধের ভেতর দিয়ে, যে যুদ্ধে সমাজ বদলাবে।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আমাদের নিজেদের দেশের খবর এড়ানোর উপায় নেই। এখানে প্রতিদিন অসংখ্য ঘটনা ঘটছে, চাঞ্চল্যকর ঘটনাও। কয়েকটির দিকে তাকানো যেতে পারে। করোনায় ভুগে অনেক মানুষ অকালে মারা গেছে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি মানুষকে কিন্তু আকস্মিকভাবে ও অকালে চলে যেতে হয়েছে সড়ক দুর্ঘটনায়।
একদিনের খবরই ধরা যাক। ৯ ফেব্রুয়ারির। সেদিন করোনায় মৃত্যু হয়েছে ১০ জনের, সড়ক দুর্ঘটনায় ২৩ জনের। করোনায় মৃত্যু তা-ও কিছুটা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করা হয়ে থাকে, সড়কে মৃত্যুকে মনে করা হয় নিতান্ত স্বাভাবিক। সড়ক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী প্রায় প্রতিদিনই তাঁর অদৃশ্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের উদ্দেশে একটি করে সুতীক্ষ্ণ বাণ নিক্ষেপ করেন, কিন্তু তাঁর মন্ত্রণালয়ের আসল যে প্রতিপক্ষ, সড়ক অব্যবস্থাপনা, সে বিষয়ে উচ্চবাচ্য করেন না। চলচ্চিত্রাভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন সড়কের নিরাপত্তা নিয়ে আন্দোলন করছেন, কাজটির সঙ্গে সড়ক দুর্ঘটনায় তাঁর স্ত্রীকে হারানোর বেদনা জড়িত রয়েছে; তাঁকে একজন সাবেক মন্ত্রী, প্রতিদিনই যিনি বিরোধী দলের লোকদের হুঁশিয়ার করে দিতেন, তিনি সুবিধামতো আর কাউকে না পেয়েই হবে, ইলিয়াস কাঞ্চনকে উন্মাদ বলে অভিহিত করেছেন। বোঝা যাচ্ছে সড়কে যাত্রীদের কপালের দুর্ভোগ কমার আপাতত কোনো কারণ নেই।
করোনা নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে, সড়ক নিয়ন্ত্রণে আসবে না। আর কেবল সড়কে বের হলেই যে নিরাপত্তাহীনতার মুখে পড়তে হবে, তা-ও নয়। ঘরে বসে থেকেও প্রাণহানি ঘটানো সম্ভব, উন্মত্ত চালকেরা ইদানীং চলন্ত বাস-ট্রাক নিয়ে ঘরের ভেতরেও হানা দিচ্ছেন।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী, যিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও, তিনি নিজেকেও অবশ্য আক্রমণের বাইরে রাখতে পারছেন না। না, বিরোধী দলের কাছ থেকে নয়; বিরোধী দলের কথাবার্তা তো মশার কামড়, বিরক্তিকর, তবে উপেক্ষণীয়; আক্রমণটা এসেছে তাঁর কনিষ্ঠ সহোদর ভাইয়ের কাছ থেকেই, যিনি আওয়ামী লীগেরই লোক এবং সামান্য কেউ নন; স্থানীয় পৌরসভার মেয়র। কনিষ্ঠ ভ্রাতা বলছেন, সত্যের পক্ষে অকুতোভয় অবস্থান নিয়ে দলীয় কিছু লোকের অপরাজনীতির বিরুদ্ধে লড়বেন। তাঁর অগ্রজ যেহেতু দলের সাধারণ সম্পাদক, তাই তাঁর বক্তব্য সবিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে। তাঁর স্বর একটু চড়াই।
যেমন সংবাদ সম্মেলনে তাঁর উক্তি: ‘আমার মুখ বন্ধ করতে ওবায়দুল কাদের (অর্থাৎ তাঁর অগ্রজ) ষড়যন্ত্র চক্রান্ত করছে।’ এটাকে গৃহবিবাদ বলা যাবে কি না, আমরা নিশ্চিত নই। তবে দলের ভেতর ‘বিদ্রোহী’রা যে আত্মপ্রকাশ করেছে, তা বোঝা যায় পৌর নির্বাচনের অবস্থার দিকে তাকালেই। সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা (নীরবে ও প্রকাশ্যেও) চলেছে দলের মনোনীত ও বিদ্রোহী প্রার্থী, এই দুইয়ের মধ্যেই; সংঘর্ষ ও প্রাণনাশের ঘটনাও ঘটেছে ওই কারণেই। দলীয় কর্তৃত্বকে যাতে একেবারে তৃণমূল পর্যন্ত প্রসারিত করা যায় সে অভিপ্রায়ে দলের লোকেরা সব নির্বাচনেই দলীয় প্রতীক নিয়ে লড়বেন, এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল। এখন যখন দেখা যাচ্ছে জেতার ব্যাপারে যেহেতু দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই, বিরোধী দলের প্রার্থীরা কার্যত অনুপস্থিত, বিদ্রোহীরাও দলেরই লোক, নির্বাচিত হলে তাঁরাও দলের পক্ষপুটেই প্রত্যাবর্তন করবেন, তাই এই প্রার্থীটি মনোনয়ন পেয়েছেন, ওই প্রার্থীটি পাননি, এমন ছাপটাপ ব্যবহার করার আবশ্যকতা নেই।
যিনি জিতবেন, তিনিই সরকারি দলে শামিল হবেন, এই বৈজ্ঞানিক নিয়মকে নিরুপদ্রবে কাজ করতে দেওয়াই সংগত। তবে গৃহবিবাদটা থাকবে, যাঁরা দলের লোক বলে দাবিদার, তাঁরা বঞ্চিত হলে সেই বঞ্চনার উত্তাপ কোনো না কোনোভাবে প্রকাশ পাবে। বিদ্রোহীদের বহিষ্কারও করা যাবে না, কারণ একে তো তাঁদের সংখ্যা অনেক, উপরন্তু দলের প্রতি তাঁদের আনুগত্য ইস্পাতের মতো কঠিন, পরীক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত। বহিষ্কারে দলের শক্তি কমবে। এসবের চেয়েও অবশ্য অনেক বড় বড় সমস্যা রয়েছে সমাজে। করোনার প্রকোপে অর্থনৈতিক মেরুকরণ প্রক্রিয়াটি আরও নির্মম হয়েছে। নিম্নমধ্যবিত্ত গরিব হয়েছে, গরিব মানুষ একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছে। মা-বাবা বিশেষ সংকটে পড়েছেন তাঁদের সন্তানদের নিয়ে।
পুরো দেড়টা বছর ওই সন্তানদের জীবন থেকে অপহৃত হয়ে গেছে। স্কুল-কলেজ বন্ধ ছিল। ছেলেমেয়েদের ভেতর অপরাধের প্রবণতা বেড়েছে। কিশোর গ্যাং তৈরির প্রক্রিয়া বেগবান ও বিস্তৃত হয়ে উঠেছে। মেয়েদের নিয়ে বিপদ আরও বেশি। তাদের ওপর লোলুপ দৃষ্টি নিক্ষিপ্ত হয়। সমবয়সী পুরুষদের তো বটেই, অন্য বয়সীদেরও। ধর্ষণ, মিথ্যা-প্রতিশ্রুতি, প্রতারণা—সবকিছুই আগের চেয়ে অধিক মাত্রাতেই চলছে। ফলে বাল্যবিবাহের হার বেড়েছে, তবে সেটা যে কী পরিমাণে, আমরা জানি না।
আর কেবল যে নিম্ন আয়ের পরিবারের ছেলেমেয়েদের নিয়েই সমস্যা তা তো নয়, অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলেমেয়েরাও ভালো নেই। তারাও অসুস্থ হয়ে পড়ছে। এরা কিশোর গ্যাং করে না, অন্যদের ওপর হামলা যে চালাবে এমন নয়; যা করার নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখে। তবে মারাত্মক সব অপরাধ এরাও করে থাকে। হতাশা, সৃষ্টিশীল কাজের অভাব, ভালো দৃষ্টান্তের অনুপস্থিতি, সুস্থ বিনোদনের স্বল্পতা, ভোগবাদিতার ব্যাপক বিস্তার, এদের আত্মপীড়নের, এমনকি অনাকাঙ্ক্ষিত পারস্পরিক পীড়নেরও অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে। দুটি ঘটনা সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে এবং সামাজিক প্রতিক্রিয়ার উপলক্ষ হয়েছে। দুটিই মৃত্যুর। দুটিতেই মামলা হয়েছে ধর্ষণ ও খুনের। প্রথমটি অল্প বয়স্ক এক বালিকা ও এক কিশোরকে ঘিরে। বালিকাটি মারা গেছে, কিশোরটি এখন জেলে। মেয়েটির মা-বাবার অভিযোগ, ছেলেটি তাঁদের নাবালিকা সন্তানকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিজের বাসায় নিয়ে গিয়ে প্রথমে ধর্ষণ ও পরে হত্যা করেছে।
তাঁদের ধারণা, একজন নয়, সঙ্গে আরও তিনজন কিশোর জড়িত ছিল। দ্বিতীয় ঘটনাটি বিষাক্ত মদ্যপানের। পাঁচজন, একটি মেয়ে ও চারটি ছেলে, মিলেমিশে এক রেস্টুরেন্টে বসে মদ্যপান করেছে। দেশি মদ, ভেজাল ছিল, তাতে বিষক্রিয়া হয়েছে। জানা যায়, এমন কাজ তারা প্রায়ই করে থাকে। তবে ওই দিন দুর্ঘটনা ঘটে যায়। এরা সবাই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। টাকাপয়সার অভাব নেই। মেয়েটির সঙ্গে ছেলেদের একজনের ‘প্রেমে’র সম্পর্ক। মদ্যপানের আসর ভেঙে যাওয়ার পর মেয়েটি অসুস্থ বোধ করলে তার প্রেমিক তাকে এক বান্ধবীর বাসায় নিয়ে যায়। সেখানে ছেলেটি ও মেয়েটি একত্রে রাত্রি যাপন করে। সকালে মেয়েটির অসুখ বাড়ে, তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়; সেখানে সে মারা যায়। তাদের সঙ্গী চারটি ছেলের মধ্যে একজনও মারা গেছে ওই ভেজাল মদ অতিরিক্ত পান করার দরুন। মেয়েটির মা-বাবা মেয়েটির কথিত প্রেমিকের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও হত্যা মামলা করেছেন।
প্রতিক্রিয়ায় আমরা নানা কথা বলছি ও শুনছি। বলাবলি চলছে যে এসব ঘটনার জন্য মা-বাবাই দায়ী। তাঁরা খেয়াল রাখেন না ছেলেমেয়েরা কী করছে। অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদের নিজেদের মধ্যেও প্রীতির সম্পর্ক নেই; ছেলেমেয়েরা প্রাচুর্যের মধ্যে বড় হয়, তাদের বাসায় লোকজন তেমন থাকে না, মা-বাবা বাইরে চলে যান, ছেলেমেয়েরা খালি বাসায় যা ইচ্ছা তা-ই করে। সবই সত্য। এসব আমরা বলছি, বলব, বলতেই থাকব। কিন্তু নির্মম সত্য তো এটাও যে মা-বাবা নিজেরাও বিদ্যমান ব্যবস্থারই অসহায় শিকার। তাঁরা ইচ্ছা করে যে ওসব বিচ্যুতি ঘটান তা নয়, ছেলেমেয়েদের মঙ্গল তাঁরা নিশ্চয়ই চান। কিন্তু পারেন না। সমাজ অসুস্থ। জীবনানন্দ দাশ যে গভীর অসুখের পীড়া দেখে কাতর হয়েছিলেন, বছরে বছরে সেটা বেড়েছে এবং এখন সুস্থ থাকাটা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে।
একাত্তরে যে কিশোর যুদ্ধ করেছে আজ সে আত্মপীড়ন করে। একাত্তরের শত্রু চিহ্নিত ছিল, বাইরে থেকে তারা এসেছে, আমরা তাদের চিনতে পারতাম; শত্রু এখন দেশের ভেতরেই। এ শত্রুটিকে অসুখ বলাই সংগত এবং অসুখটির নাম হলো পুঁজিবাদ। পাকিস্তানি হানাদারদের আমরা তাড়াতে পেরেছি, কিন্তু যে অসুখের তাড়নায় অস্থির হয়ে ওই হানাদারেরা আমাদের ওপর হামলা করেছিল, সেটা রয়ে গেছে; কেবল রয়েই যায়নি তার জন্য বিকাশের পথটি প্রশস্ত হয়েছে। বস্তুত বাংলাদেশে সত্যিকার মুক্তি যদি কারও ঘটে থাকে, তবে সেটা ওই পুঁজিবাদের। পুঁজিবাদের ওই মুক্তিই আমাদের বন্দী করে রেখেছে এবং নানাভাবে ও নানা দিক দিয়ে উৎপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে। ওই অসুখের চিকিৎসা একটাই; তাকে বিতাড়ন করা।
অসুখের তৎপরতার কাহিনি তো মহাভারতসমান, বলে শেষ করার নয়। ৫০ বছর পার হয়েছে, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরির কাজ শেষ হচ্ছে না। হবে কী করে? যুদ্ধের সময় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৮০ হাজার, বাড়তে বাড়তে সেটা এখন ২ লাখ ছাড়িয়েছে।
বাকিরা কোথা থেকে এল? কোন লোভে? আসলে মুক্তিযোদ্ধাদের নয়, জাতীয় স্বার্থে প্রয়োজন ছিল খাঁটি রাজাকারদের নির্ভেজাল তালিকা তৈরি করা। মধুলোভী ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা যে কত, তা নিশ্চিত জানা যাবে না। তাদের মধ্যে তো কয়েকজন সচিবও ছিলেন, শনাক্ত হয়েছেন। এই তো সেদিন এক দৈনিক পত্রিকায় পড়লাম, একটি এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় জামায়াতে ইসলামীর নায়েবের নামও স্থান পেয়েছে।
আর গৃহবিবাদ? কতভাবে যে তার প্রকাশ! মেহেরপুরে এক বৃদ্ধ ব্যক্তি, বয়স তাঁর আশি, নাম মুসা করিম, নিজ গৃহ থেকে বিতাড়িত হয়ে তিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে আবেদন জানিয়েছেন আত্মহত্যার অনুমতি চেয়ে। কারণ তাঁর কোনো আশ্রয় নেই।
বিষয়সম্পত্তি যা ছিল উত্তরাধিকারীদের দিয়ে দিয়েছেন। বিলি-বণ্টনে সন্তুষ্ট না হওয়ায় পরিবারের একপক্ষ তাঁকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। এটা সেই মেহেরপুরের ঘটনা, যার আমবাগানে প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার শপথ গ্রহণ করে বাংলাদেশকে মুক্ত করবে বলে। কিছুদিন আগে এক খবরে পড়েছিলাম, বৃদ্ধ মাতা বিতাড়িত হয়েছেন গৃহ থেকে। তিনিও বিষয়সম্পত্তি যা ছিল সন্তানদের দিয়ে নিঃস্ব হয়েছিলেন, সমাজ পিতৃতান্ত্রিক বটে; কিন্তু পিতা-মাতা সবাই সমান বোঝা, সম্পত্তি যদি না থাকে। ভরসা রাখি গৃহবিবাদগুলোর মীমাংসা ঘটবে গৃহযুদ্ধের ভেতর দিয়ে, যে যুদ্ধে সমাজ বদলাবে।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

আমাদের নিজেদের দেশের খবর এড়ানোর উপায় নেই। এখানে প্রতিদিন অসংখ্য ঘটনা ঘটছে, চাঞ্চল্যকর ঘটনাও। কয়েকটির দিকে তাকানো যেতে পারে। করোনায় ভুগে অনেক মানুষ অকালে মারা গেছে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি মানুষকে কিন্তু আকস্মিকভাবে ও অকালে চলে যেতে হয়েছে সড়ক দুর্ঘটনায়।
একদিনের খবরই ধরা যাক। ৯ ফেব্রুয়ারির। সেদিন করোনায় মৃত্যু হয়েছে ১০ জনের, সড়ক দুর্ঘটনায় ২৩ জনের। করোনায় মৃত্যু তা-ও কিছুটা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করা হয়ে থাকে, সড়কে মৃত্যুকে মনে করা হয় নিতান্ত স্বাভাবিক। সড়ক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী প্রায় প্রতিদিনই তাঁর অদৃশ্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের উদ্দেশে একটি করে সুতীক্ষ্ণ বাণ নিক্ষেপ করেন, কিন্তু তাঁর মন্ত্রণালয়ের আসল যে প্রতিপক্ষ, সড়ক অব্যবস্থাপনা, সে বিষয়ে উচ্চবাচ্য করেন না। চলচ্চিত্রাভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন সড়কের নিরাপত্তা নিয়ে আন্দোলন করছেন, কাজটির সঙ্গে সড়ক দুর্ঘটনায় তাঁর স্ত্রীকে হারানোর বেদনা জড়িত রয়েছে; তাঁকে একজন সাবেক মন্ত্রী, প্রতিদিনই যিনি বিরোধী দলের লোকদের হুঁশিয়ার করে দিতেন, তিনি সুবিধামতো আর কাউকে না পেয়েই হবে, ইলিয়াস কাঞ্চনকে উন্মাদ বলে অভিহিত করেছেন। বোঝা যাচ্ছে সড়কে যাত্রীদের কপালের দুর্ভোগ কমার আপাতত কোনো কারণ নেই।
করোনা নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে, সড়ক নিয়ন্ত্রণে আসবে না। আর কেবল সড়কে বের হলেই যে নিরাপত্তাহীনতার মুখে পড়তে হবে, তা-ও নয়। ঘরে বসে থেকেও প্রাণহানি ঘটানো সম্ভব, উন্মত্ত চালকেরা ইদানীং চলন্ত বাস-ট্রাক নিয়ে ঘরের ভেতরেও হানা দিচ্ছেন।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী, যিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও, তিনি নিজেকেও অবশ্য আক্রমণের বাইরে রাখতে পারছেন না। না, বিরোধী দলের কাছ থেকে নয়; বিরোধী দলের কথাবার্তা তো মশার কামড়, বিরক্তিকর, তবে উপেক্ষণীয়; আক্রমণটা এসেছে তাঁর কনিষ্ঠ সহোদর ভাইয়ের কাছ থেকেই, যিনি আওয়ামী লীগেরই লোক এবং সামান্য কেউ নন; স্থানীয় পৌরসভার মেয়র। কনিষ্ঠ ভ্রাতা বলছেন, সত্যের পক্ষে অকুতোভয় অবস্থান নিয়ে দলীয় কিছু লোকের অপরাজনীতির বিরুদ্ধে লড়বেন। তাঁর অগ্রজ যেহেতু দলের সাধারণ সম্পাদক, তাই তাঁর বক্তব্য সবিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে। তাঁর স্বর একটু চড়াই।
যেমন সংবাদ সম্মেলনে তাঁর উক্তি: ‘আমার মুখ বন্ধ করতে ওবায়দুল কাদের (অর্থাৎ তাঁর অগ্রজ) ষড়যন্ত্র চক্রান্ত করছে।’ এটাকে গৃহবিবাদ বলা যাবে কি না, আমরা নিশ্চিত নই। তবে দলের ভেতর ‘বিদ্রোহী’রা যে আত্মপ্রকাশ করেছে, তা বোঝা যায় পৌর নির্বাচনের অবস্থার দিকে তাকালেই। সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা (নীরবে ও প্রকাশ্যেও) চলেছে দলের মনোনীত ও বিদ্রোহী প্রার্থী, এই দুইয়ের মধ্যেই; সংঘর্ষ ও প্রাণনাশের ঘটনাও ঘটেছে ওই কারণেই। দলীয় কর্তৃত্বকে যাতে একেবারে তৃণমূল পর্যন্ত প্রসারিত করা যায় সে অভিপ্রায়ে দলের লোকেরা সব নির্বাচনেই দলীয় প্রতীক নিয়ে লড়বেন, এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল। এখন যখন দেখা যাচ্ছে জেতার ব্যাপারে যেহেতু দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই, বিরোধী দলের প্রার্থীরা কার্যত অনুপস্থিত, বিদ্রোহীরাও দলেরই লোক, নির্বাচিত হলে তাঁরাও দলের পক্ষপুটেই প্রত্যাবর্তন করবেন, তাই এই প্রার্থীটি মনোনয়ন পেয়েছেন, ওই প্রার্থীটি পাননি, এমন ছাপটাপ ব্যবহার করার আবশ্যকতা নেই।
যিনি জিতবেন, তিনিই সরকারি দলে শামিল হবেন, এই বৈজ্ঞানিক নিয়মকে নিরুপদ্রবে কাজ করতে দেওয়াই সংগত। তবে গৃহবিবাদটা থাকবে, যাঁরা দলের লোক বলে দাবিদার, তাঁরা বঞ্চিত হলে সেই বঞ্চনার উত্তাপ কোনো না কোনোভাবে প্রকাশ পাবে। বিদ্রোহীদের বহিষ্কারও করা যাবে না, কারণ একে তো তাঁদের সংখ্যা অনেক, উপরন্তু দলের প্রতি তাঁদের আনুগত্য ইস্পাতের মতো কঠিন, পরীক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত। বহিষ্কারে দলের শক্তি কমবে। এসবের চেয়েও অবশ্য অনেক বড় বড় সমস্যা রয়েছে সমাজে। করোনার প্রকোপে অর্থনৈতিক মেরুকরণ প্রক্রিয়াটি আরও নির্মম হয়েছে। নিম্নমধ্যবিত্ত গরিব হয়েছে, গরিব মানুষ একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছে। মা-বাবা বিশেষ সংকটে পড়েছেন তাঁদের সন্তানদের নিয়ে।
পুরো দেড়টা বছর ওই সন্তানদের জীবন থেকে অপহৃত হয়ে গেছে। স্কুল-কলেজ বন্ধ ছিল। ছেলেমেয়েদের ভেতর অপরাধের প্রবণতা বেড়েছে। কিশোর গ্যাং তৈরির প্রক্রিয়া বেগবান ও বিস্তৃত হয়ে উঠেছে। মেয়েদের নিয়ে বিপদ আরও বেশি। তাদের ওপর লোলুপ দৃষ্টি নিক্ষিপ্ত হয়। সমবয়সী পুরুষদের তো বটেই, অন্য বয়সীদেরও। ধর্ষণ, মিথ্যা-প্রতিশ্রুতি, প্রতারণা—সবকিছুই আগের চেয়ে অধিক মাত্রাতেই চলছে। ফলে বাল্যবিবাহের হার বেড়েছে, তবে সেটা যে কী পরিমাণে, আমরা জানি না।
আর কেবল যে নিম্ন আয়ের পরিবারের ছেলেমেয়েদের নিয়েই সমস্যা তা তো নয়, অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলেমেয়েরাও ভালো নেই। তারাও অসুস্থ হয়ে পড়ছে। এরা কিশোর গ্যাং করে না, অন্যদের ওপর হামলা যে চালাবে এমন নয়; যা করার নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখে। তবে মারাত্মক সব অপরাধ এরাও করে থাকে। হতাশা, সৃষ্টিশীল কাজের অভাব, ভালো দৃষ্টান্তের অনুপস্থিতি, সুস্থ বিনোদনের স্বল্পতা, ভোগবাদিতার ব্যাপক বিস্তার, এদের আত্মপীড়নের, এমনকি অনাকাঙ্ক্ষিত পারস্পরিক পীড়নেরও অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে। দুটি ঘটনা সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে এবং সামাজিক প্রতিক্রিয়ার উপলক্ষ হয়েছে। দুটিই মৃত্যুর। দুটিতেই মামলা হয়েছে ধর্ষণ ও খুনের। প্রথমটি অল্প বয়স্ক এক বালিকা ও এক কিশোরকে ঘিরে। বালিকাটি মারা গেছে, কিশোরটি এখন জেলে। মেয়েটির মা-বাবার অভিযোগ, ছেলেটি তাঁদের নাবালিকা সন্তানকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিজের বাসায় নিয়ে গিয়ে প্রথমে ধর্ষণ ও পরে হত্যা করেছে।
তাঁদের ধারণা, একজন নয়, সঙ্গে আরও তিনজন কিশোর জড়িত ছিল। দ্বিতীয় ঘটনাটি বিষাক্ত মদ্যপানের। পাঁচজন, একটি মেয়ে ও চারটি ছেলে, মিলেমিশে এক রেস্টুরেন্টে বসে মদ্যপান করেছে। দেশি মদ, ভেজাল ছিল, তাতে বিষক্রিয়া হয়েছে। জানা যায়, এমন কাজ তারা প্রায়ই করে থাকে। তবে ওই দিন দুর্ঘটনা ঘটে যায়। এরা সবাই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। টাকাপয়সার অভাব নেই। মেয়েটির সঙ্গে ছেলেদের একজনের ‘প্রেমে’র সম্পর্ক। মদ্যপানের আসর ভেঙে যাওয়ার পর মেয়েটি অসুস্থ বোধ করলে তার প্রেমিক তাকে এক বান্ধবীর বাসায় নিয়ে যায়। সেখানে ছেলেটি ও মেয়েটি একত্রে রাত্রি যাপন করে। সকালে মেয়েটির অসুখ বাড়ে, তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়; সেখানে সে মারা যায়। তাদের সঙ্গী চারটি ছেলের মধ্যে একজনও মারা গেছে ওই ভেজাল মদ অতিরিক্ত পান করার দরুন। মেয়েটির মা-বাবা মেয়েটির কথিত প্রেমিকের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও হত্যা মামলা করেছেন।
প্রতিক্রিয়ায় আমরা নানা কথা বলছি ও শুনছি। বলাবলি চলছে যে এসব ঘটনার জন্য মা-বাবাই দায়ী। তাঁরা খেয়াল রাখেন না ছেলেমেয়েরা কী করছে। অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদের নিজেদের মধ্যেও প্রীতির সম্পর্ক নেই; ছেলেমেয়েরা প্রাচুর্যের মধ্যে বড় হয়, তাদের বাসায় লোকজন তেমন থাকে না, মা-বাবা বাইরে চলে যান, ছেলেমেয়েরা খালি বাসায় যা ইচ্ছা তা-ই করে। সবই সত্য। এসব আমরা বলছি, বলব, বলতেই থাকব। কিন্তু নির্মম সত্য তো এটাও যে মা-বাবা নিজেরাও বিদ্যমান ব্যবস্থারই অসহায় শিকার। তাঁরা ইচ্ছা করে যে ওসব বিচ্যুতি ঘটান তা নয়, ছেলেমেয়েদের মঙ্গল তাঁরা নিশ্চয়ই চান। কিন্তু পারেন না। সমাজ অসুস্থ। জীবনানন্দ দাশ যে গভীর অসুখের পীড়া দেখে কাতর হয়েছিলেন, বছরে বছরে সেটা বেড়েছে এবং এখন সুস্থ থাকাটা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে।
একাত্তরে যে কিশোর যুদ্ধ করেছে আজ সে আত্মপীড়ন করে। একাত্তরের শত্রু চিহ্নিত ছিল, বাইরে থেকে তারা এসেছে, আমরা তাদের চিনতে পারতাম; শত্রু এখন দেশের ভেতরেই। এ শত্রুটিকে অসুখ বলাই সংগত এবং অসুখটির নাম হলো পুঁজিবাদ। পাকিস্তানি হানাদারদের আমরা তাড়াতে পেরেছি, কিন্তু যে অসুখের তাড়নায় অস্থির হয়ে ওই হানাদারেরা আমাদের ওপর হামলা করেছিল, সেটা রয়ে গেছে; কেবল রয়েই যায়নি তার জন্য বিকাশের পথটি প্রশস্ত হয়েছে। বস্তুত বাংলাদেশে সত্যিকার মুক্তি যদি কারও ঘটে থাকে, তবে সেটা ওই পুঁজিবাদের। পুঁজিবাদের ওই মুক্তিই আমাদের বন্দী করে রেখেছে এবং নানাভাবে ও নানা দিক দিয়ে উৎপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে। ওই অসুখের চিকিৎসা একটাই; তাকে বিতাড়ন করা।
অসুখের তৎপরতার কাহিনি তো মহাভারতসমান, বলে শেষ করার নয়। ৫০ বছর পার হয়েছে, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরির কাজ শেষ হচ্ছে না। হবে কী করে? যুদ্ধের সময় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৮০ হাজার, বাড়তে বাড়তে সেটা এখন ২ লাখ ছাড়িয়েছে।
বাকিরা কোথা থেকে এল? কোন লোভে? আসলে মুক্তিযোদ্ধাদের নয়, জাতীয় স্বার্থে প্রয়োজন ছিল খাঁটি রাজাকারদের নির্ভেজাল তালিকা তৈরি করা। মধুলোভী ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা যে কত, তা নিশ্চিত জানা যাবে না। তাদের মধ্যে তো কয়েকজন সচিবও ছিলেন, শনাক্ত হয়েছেন। এই তো সেদিন এক দৈনিক পত্রিকায় পড়লাম, একটি এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় জামায়াতে ইসলামীর নায়েবের নামও স্থান পেয়েছে।
আর গৃহবিবাদ? কতভাবে যে তার প্রকাশ! মেহেরপুরে এক বৃদ্ধ ব্যক্তি, বয়স তাঁর আশি, নাম মুসা করিম, নিজ গৃহ থেকে বিতাড়িত হয়ে তিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে আবেদন জানিয়েছেন আত্মহত্যার অনুমতি চেয়ে। কারণ তাঁর কোনো আশ্রয় নেই।
বিষয়সম্পত্তি যা ছিল উত্তরাধিকারীদের দিয়ে দিয়েছেন। বিলি-বণ্টনে সন্তুষ্ট না হওয়ায় পরিবারের একপক্ষ তাঁকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। এটা সেই মেহেরপুরের ঘটনা, যার আমবাগানে প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার শপথ গ্রহণ করে বাংলাদেশকে মুক্ত করবে বলে। কিছুদিন আগে এক খবরে পড়েছিলাম, বৃদ্ধ মাতা বিতাড়িত হয়েছেন গৃহ থেকে। তিনিও বিষয়সম্পত্তি যা ছিল সন্তানদের দিয়ে নিঃস্ব হয়েছিলেন, সমাজ পিতৃতান্ত্রিক বটে; কিন্তু পিতা-মাতা সবাই সমান বোঝা, সম্পত্তি যদি না থাকে। ভরসা রাখি গৃহবিবাদগুলোর মীমাংসা ঘটবে গৃহযুদ্ধের ভেতর দিয়ে, যে যুদ্ধে সমাজ বদলাবে।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আমাদের নিজেদের দেশের খবর এড়ানোর উপায় নেই। এখানে প্রতিদিন অসংখ্য ঘটনা ঘটছে, চাঞ্চল্যকর ঘটনাও। কয়েকটির দিকে তাকানো যেতে পারে। করোনায় ভুগে অনেক মানুষ অকালে মারা গেছে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি মানুষকে কিন্তু আকস্মিকভাবে ও অকালে চলে যেতে হয়েছে সড়ক দুর্ঘটনায়।
একদিনের খবরই ধরা যাক। ৯ ফেব্রুয়ারির। সেদিন করোনায় মৃত্যু হয়েছে ১০ জনের, সড়ক দুর্ঘটনায় ২৩ জনের। করোনায় মৃত্যু তা-ও কিছুটা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করা হয়ে থাকে, সড়কে মৃত্যুকে মনে করা হয় নিতান্ত স্বাভাবিক। সড়ক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী প্রায় প্রতিদিনই তাঁর অদৃশ্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের উদ্দেশে একটি করে সুতীক্ষ্ণ বাণ নিক্ষেপ করেন, কিন্তু তাঁর মন্ত্রণালয়ের আসল যে প্রতিপক্ষ, সড়ক অব্যবস্থাপনা, সে বিষয়ে উচ্চবাচ্য করেন না। চলচ্চিত্রাভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন সড়কের নিরাপত্তা নিয়ে আন্দোলন করছেন, কাজটির সঙ্গে সড়ক দুর্ঘটনায় তাঁর স্ত্রীকে হারানোর বেদনা জড়িত রয়েছে; তাঁকে একজন সাবেক মন্ত্রী, প্রতিদিনই যিনি বিরোধী দলের লোকদের হুঁশিয়ার করে দিতেন, তিনি সুবিধামতো আর কাউকে না পেয়েই হবে, ইলিয়াস কাঞ্চনকে উন্মাদ বলে অভিহিত করেছেন। বোঝা যাচ্ছে সড়কে যাত্রীদের কপালের দুর্ভোগ কমার আপাতত কোনো কারণ নেই।
করোনা নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে, সড়ক নিয়ন্ত্রণে আসবে না। আর কেবল সড়কে বের হলেই যে নিরাপত্তাহীনতার মুখে পড়তে হবে, তা-ও নয়। ঘরে বসে থেকেও প্রাণহানি ঘটানো সম্ভব, উন্মত্ত চালকেরা ইদানীং চলন্ত বাস-ট্রাক নিয়ে ঘরের ভেতরেও হানা দিচ্ছেন।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী, যিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও, তিনি নিজেকেও অবশ্য আক্রমণের বাইরে রাখতে পারছেন না। না, বিরোধী দলের কাছ থেকে নয়; বিরোধী দলের কথাবার্তা তো মশার কামড়, বিরক্তিকর, তবে উপেক্ষণীয়; আক্রমণটা এসেছে তাঁর কনিষ্ঠ সহোদর ভাইয়ের কাছ থেকেই, যিনি আওয়ামী লীগেরই লোক এবং সামান্য কেউ নন; স্থানীয় পৌরসভার মেয়র। কনিষ্ঠ ভ্রাতা বলছেন, সত্যের পক্ষে অকুতোভয় অবস্থান নিয়ে দলীয় কিছু লোকের অপরাজনীতির বিরুদ্ধে লড়বেন। তাঁর অগ্রজ যেহেতু দলের সাধারণ সম্পাদক, তাই তাঁর বক্তব্য সবিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে। তাঁর স্বর একটু চড়াই।
যেমন সংবাদ সম্মেলনে তাঁর উক্তি: ‘আমার মুখ বন্ধ করতে ওবায়দুল কাদের (অর্থাৎ তাঁর অগ্রজ) ষড়যন্ত্র চক্রান্ত করছে।’ এটাকে গৃহবিবাদ বলা যাবে কি না, আমরা নিশ্চিত নই। তবে দলের ভেতর ‘বিদ্রোহী’রা যে আত্মপ্রকাশ করেছে, তা বোঝা যায় পৌর নির্বাচনের অবস্থার দিকে তাকালেই। সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা (নীরবে ও প্রকাশ্যেও) চলেছে দলের মনোনীত ও বিদ্রোহী প্রার্থী, এই দুইয়ের মধ্যেই; সংঘর্ষ ও প্রাণনাশের ঘটনাও ঘটেছে ওই কারণেই। দলীয় কর্তৃত্বকে যাতে একেবারে তৃণমূল পর্যন্ত প্রসারিত করা যায় সে অভিপ্রায়ে দলের লোকেরা সব নির্বাচনেই দলীয় প্রতীক নিয়ে লড়বেন, এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল। এখন যখন দেখা যাচ্ছে জেতার ব্যাপারে যেহেতু দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই, বিরোধী দলের প্রার্থীরা কার্যত অনুপস্থিত, বিদ্রোহীরাও দলেরই লোক, নির্বাচিত হলে তাঁরাও দলের পক্ষপুটেই প্রত্যাবর্তন করবেন, তাই এই প্রার্থীটি মনোনয়ন পেয়েছেন, ওই প্রার্থীটি পাননি, এমন ছাপটাপ ব্যবহার করার আবশ্যকতা নেই।
যিনি জিতবেন, তিনিই সরকারি দলে শামিল হবেন, এই বৈজ্ঞানিক নিয়মকে নিরুপদ্রবে কাজ করতে দেওয়াই সংগত। তবে গৃহবিবাদটা থাকবে, যাঁরা দলের লোক বলে দাবিদার, তাঁরা বঞ্চিত হলে সেই বঞ্চনার উত্তাপ কোনো না কোনোভাবে প্রকাশ পাবে। বিদ্রোহীদের বহিষ্কারও করা যাবে না, কারণ একে তো তাঁদের সংখ্যা অনেক, উপরন্তু দলের প্রতি তাঁদের আনুগত্য ইস্পাতের মতো কঠিন, পরীক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত। বহিষ্কারে দলের শক্তি কমবে। এসবের চেয়েও অবশ্য অনেক বড় বড় সমস্যা রয়েছে সমাজে। করোনার প্রকোপে অর্থনৈতিক মেরুকরণ প্রক্রিয়াটি আরও নির্মম হয়েছে। নিম্নমধ্যবিত্ত গরিব হয়েছে, গরিব মানুষ একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছে। মা-বাবা বিশেষ সংকটে পড়েছেন তাঁদের সন্তানদের নিয়ে।
পুরো দেড়টা বছর ওই সন্তানদের জীবন থেকে অপহৃত হয়ে গেছে। স্কুল-কলেজ বন্ধ ছিল। ছেলেমেয়েদের ভেতর অপরাধের প্রবণতা বেড়েছে। কিশোর গ্যাং তৈরির প্রক্রিয়া বেগবান ও বিস্তৃত হয়ে উঠেছে। মেয়েদের নিয়ে বিপদ আরও বেশি। তাদের ওপর লোলুপ দৃষ্টি নিক্ষিপ্ত হয়। সমবয়সী পুরুষদের তো বটেই, অন্য বয়সীদেরও। ধর্ষণ, মিথ্যা-প্রতিশ্রুতি, প্রতারণা—সবকিছুই আগের চেয়ে অধিক মাত্রাতেই চলছে। ফলে বাল্যবিবাহের হার বেড়েছে, তবে সেটা যে কী পরিমাণে, আমরা জানি না।
আর কেবল যে নিম্ন আয়ের পরিবারের ছেলেমেয়েদের নিয়েই সমস্যা তা তো নয়, অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলেমেয়েরাও ভালো নেই। তারাও অসুস্থ হয়ে পড়ছে। এরা কিশোর গ্যাং করে না, অন্যদের ওপর হামলা যে চালাবে এমন নয়; যা করার নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখে। তবে মারাত্মক সব অপরাধ এরাও করে থাকে। হতাশা, সৃষ্টিশীল কাজের অভাব, ভালো দৃষ্টান্তের অনুপস্থিতি, সুস্থ বিনোদনের স্বল্পতা, ভোগবাদিতার ব্যাপক বিস্তার, এদের আত্মপীড়নের, এমনকি অনাকাঙ্ক্ষিত পারস্পরিক পীড়নেরও অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে। দুটি ঘটনা সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে এবং সামাজিক প্রতিক্রিয়ার উপলক্ষ হয়েছে। দুটিই মৃত্যুর। দুটিতেই মামলা হয়েছে ধর্ষণ ও খুনের। প্রথমটি অল্প বয়স্ক এক বালিকা ও এক কিশোরকে ঘিরে। বালিকাটি মারা গেছে, কিশোরটি এখন জেলে। মেয়েটির মা-বাবার অভিযোগ, ছেলেটি তাঁদের নাবালিকা সন্তানকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিজের বাসায় নিয়ে গিয়ে প্রথমে ধর্ষণ ও পরে হত্যা করেছে।
তাঁদের ধারণা, একজন নয়, সঙ্গে আরও তিনজন কিশোর জড়িত ছিল। দ্বিতীয় ঘটনাটি বিষাক্ত মদ্যপানের। পাঁচজন, একটি মেয়ে ও চারটি ছেলে, মিলেমিশে এক রেস্টুরেন্টে বসে মদ্যপান করেছে। দেশি মদ, ভেজাল ছিল, তাতে বিষক্রিয়া হয়েছে। জানা যায়, এমন কাজ তারা প্রায়ই করে থাকে। তবে ওই দিন দুর্ঘটনা ঘটে যায়। এরা সবাই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। টাকাপয়সার অভাব নেই। মেয়েটির সঙ্গে ছেলেদের একজনের ‘প্রেমে’র সম্পর্ক। মদ্যপানের আসর ভেঙে যাওয়ার পর মেয়েটি অসুস্থ বোধ করলে তার প্রেমিক তাকে এক বান্ধবীর বাসায় নিয়ে যায়। সেখানে ছেলেটি ও মেয়েটি একত্রে রাত্রি যাপন করে। সকালে মেয়েটির অসুখ বাড়ে, তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়; সেখানে সে মারা যায়। তাদের সঙ্গী চারটি ছেলের মধ্যে একজনও মারা গেছে ওই ভেজাল মদ অতিরিক্ত পান করার দরুন। মেয়েটির মা-বাবা মেয়েটির কথিত প্রেমিকের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও হত্যা মামলা করেছেন।
প্রতিক্রিয়ায় আমরা নানা কথা বলছি ও শুনছি। বলাবলি চলছে যে এসব ঘটনার জন্য মা-বাবাই দায়ী। তাঁরা খেয়াল রাখেন না ছেলেমেয়েরা কী করছে। অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদের নিজেদের মধ্যেও প্রীতির সম্পর্ক নেই; ছেলেমেয়েরা প্রাচুর্যের মধ্যে বড় হয়, তাদের বাসায় লোকজন তেমন থাকে না, মা-বাবা বাইরে চলে যান, ছেলেমেয়েরা খালি বাসায় যা ইচ্ছা তা-ই করে। সবই সত্য। এসব আমরা বলছি, বলব, বলতেই থাকব। কিন্তু নির্মম সত্য তো এটাও যে মা-বাবা নিজেরাও বিদ্যমান ব্যবস্থারই অসহায় শিকার। তাঁরা ইচ্ছা করে যে ওসব বিচ্যুতি ঘটান তা নয়, ছেলেমেয়েদের মঙ্গল তাঁরা নিশ্চয়ই চান। কিন্তু পারেন না। সমাজ অসুস্থ। জীবনানন্দ দাশ যে গভীর অসুখের পীড়া দেখে কাতর হয়েছিলেন, বছরে বছরে সেটা বেড়েছে এবং এখন সুস্থ থাকাটা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে।
একাত্তরে যে কিশোর যুদ্ধ করেছে আজ সে আত্মপীড়ন করে। একাত্তরের শত্রু চিহ্নিত ছিল, বাইরে থেকে তারা এসেছে, আমরা তাদের চিনতে পারতাম; শত্রু এখন দেশের ভেতরেই। এ শত্রুটিকে অসুখ বলাই সংগত এবং অসুখটির নাম হলো পুঁজিবাদ। পাকিস্তানি হানাদারদের আমরা তাড়াতে পেরেছি, কিন্তু যে অসুখের তাড়নায় অস্থির হয়ে ওই হানাদারেরা আমাদের ওপর হামলা করেছিল, সেটা রয়ে গেছে; কেবল রয়েই যায়নি তার জন্য বিকাশের পথটি প্রশস্ত হয়েছে। বস্তুত বাংলাদেশে সত্যিকার মুক্তি যদি কারও ঘটে থাকে, তবে সেটা ওই পুঁজিবাদের। পুঁজিবাদের ওই মুক্তিই আমাদের বন্দী করে রেখেছে এবং নানাভাবে ও নানা দিক দিয়ে উৎপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে। ওই অসুখের চিকিৎসা একটাই; তাকে বিতাড়ন করা।
অসুখের তৎপরতার কাহিনি তো মহাভারতসমান, বলে শেষ করার নয়। ৫০ বছর পার হয়েছে, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরির কাজ শেষ হচ্ছে না। হবে কী করে? যুদ্ধের সময় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৮০ হাজার, বাড়তে বাড়তে সেটা এখন ২ লাখ ছাড়িয়েছে।
বাকিরা কোথা থেকে এল? কোন লোভে? আসলে মুক্তিযোদ্ধাদের নয়, জাতীয় স্বার্থে প্রয়োজন ছিল খাঁটি রাজাকারদের নির্ভেজাল তালিকা তৈরি করা। মধুলোভী ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা যে কত, তা নিশ্চিত জানা যাবে না। তাদের মধ্যে তো কয়েকজন সচিবও ছিলেন, শনাক্ত হয়েছেন। এই তো সেদিন এক দৈনিক পত্রিকায় পড়লাম, একটি এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় জামায়াতে ইসলামীর নায়েবের নামও স্থান পেয়েছে।
আর গৃহবিবাদ? কতভাবে যে তার প্রকাশ! মেহেরপুরে এক বৃদ্ধ ব্যক্তি, বয়স তাঁর আশি, নাম মুসা করিম, নিজ গৃহ থেকে বিতাড়িত হয়ে তিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে আবেদন জানিয়েছেন আত্মহত্যার অনুমতি চেয়ে। কারণ তাঁর কোনো আশ্রয় নেই।
বিষয়সম্পত্তি যা ছিল উত্তরাধিকারীদের দিয়ে দিয়েছেন। বিলি-বণ্টনে সন্তুষ্ট না হওয়ায় পরিবারের একপক্ষ তাঁকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। এটা সেই মেহেরপুরের ঘটনা, যার আমবাগানে প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার শপথ গ্রহণ করে বাংলাদেশকে মুক্ত করবে বলে। কিছুদিন আগে এক খবরে পড়েছিলাম, বৃদ্ধ মাতা বিতাড়িত হয়েছেন গৃহ থেকে। তিনিও বিষয়সম্পত্তি যা ছিল সন্তানদের দিয়ে নিঃস্ব হয়েছিলেন, সমাজ পিতৃতান্ত্রিক বটে; কিন্তু পিতা-মাতা সবাই সমান বোঝা, সম্পত্তি যদি না থাকে। ভরসা রাখি গৃহবিবাদগুলোর মীমাংসা ঘটবে গৃহযুদ্ধের ভেতর দিয়ে, যে যুদ্ধে সমাজ বদলাবে।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ত্রিমুখী সম্পর্ক নিয়ে অনেক মুভি হয়েছে। এ রকম মুভি দেখেননি, এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। কেবল মুভিতেই কেন, বাস্তবেও ত্রিমুখী সম্পর্কের অনেক ঘটনা আমরা দেখে থাকি। সব ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ত্রিভুজ সম্পর্কের শেষ পরিণতি সাধারণত ভালো হয় না।
১৩ ঘণ্টা আগে
আমরা চব্বিশের আন্দোলন দেখেছি—বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন থেকে যা রূপ নেয় স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে। এর আগপর্যন্ত স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সম্পর্কে জেনেছি নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান এবং নূর হোসেনের আত্মত্যাগের কথা। অনেকে দুটো ঘটনারই সাক্ষী। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর নূর হোসেন শহীদ হন পুলিশের গুলিতে।
১৩ ঘণ্টা আগে
গত এক বছরে আমাদের জাতি এক অভূতপূর্ব রাজনৈতিক প্রজ্ঞা লাভ করেছে। জাতীয় গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ঘরের ভেতর থেকে চায়ের দোকান, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়—সর্বত্রই রাজনৈতিক আলোচনা, পর্যালোচনা এবং সেই সঙ্গে যাঁর যাঁর সুচিন্তিত মন্তব্যও দিয়ে যাচ্ছেন।
১৩ ঘণ্টা আগে
দেশে এমনিতেই ফসলি জমি হ্রাস পাচ্ছে। সেটি কমে যাওয়া মানে খাদ্যের উৎপাদনও কমে যাওয়া। যে কারণে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়ে থাকে, কোনো আবাদি জমি যাতে পতিত না থাকে।
১৩ ঘণ্টা আগেমাসুদ কামাল

ত্রিমুখী সম্পর্ক নিয়ে অনেক মুভি হয়েছে। এ রকম মুভি দেখেননি, এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। কেবল মুভিতেই কেন, বাস্তবেও ত্রিমুখী সম্পর্কের অনেক ঘটনা আমরা দেখে থাকি। সব ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ত্রিভুজ সম্পর্কের শেষ পরিণতি সাধারণত ভালো হয় না।
গত বছরের এ সময়ে আমাদের রাজনীতিতে খুব শক্ত একটা ত্রিভুজ সম্পর্ক দেখা গিয়েছিল। বিএনপি-অন্তর্বর্তী সরকার-জামায়াত—এই তিন পক্ষের দহরম-মহরম। তাদের সবারই লক্ষ্য তখন ছিল রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করা। এর প্রাথমিক ধাপ, কদিন আগে অর্থাৎ ২০২৪-এর অক্টোবরে অর্জিত হয়েছে। সে দিন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে এই সরকার একটা নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ করেছে। এরপর বাকি ছিল মূল দল আওয়ামী লীগকে অকার্যকর ও অপ্রাসঙ্গিক করা। গত বছরের এ সময়ে সেই চেষ্টা আমরা দেখেছি। প্রশাসনিকভাবে যেমন, ঠিক তেমনি সামাজিকভাবেও স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিস্ট দল হিসেবে আওয়ামী লীগবিরোধী প্রচারণা বেশ জোরেশোরেই চলছিল। এ কাজে বিএনপি, জামায়াত, সরকার—সবাই বেশ আন্তরিকও ছিল। সে সময়ে মাঠের শক্তি হিসেবে বেশ বড় একটা ভূমিকা রেখেছে এনসিপি বা জাতীয় নাগরিক পার্টি। তারপর মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে যখন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলো, আমার বিবেচনায় ত্রিভুজ দহরম-মহরমের সেটাই ছিল পিক-টাইম। এর পর থেকে নিজ নিজ স্বার্থ নিয়ে ধীরে ধীরে সবাই মাঠে নেমে পড়ল। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকল দূরত্ব।
মে মাসের ১২ তারিখে আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলো, তার মাসখানেক পর জুনের ১৫ তারিখে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস লন্ডনে গিয়ে বৈঠক করলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে। বলতে গেলে ওই বৈঠকটাই যেন সম্পর্কে ভাঙনের ক্ষেত্রে একটা প্রকাশ্য কারণ হতে পারল। জামায়াত অভিযোগ তুলল সরকারের প্রতি—বলল, বিএনপির প্রতি পক্ষপাতিত্ব করছে সরকার। অভিযোগের পেছনের কারণটিও তারা প্রকাশ করল। বলল, ওই বৈঠকের পরই নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় হিসেবে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধের কথাটি বলা হয়েছে। একটিমাত্র দলের শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথার পরিপ্রেক্ষিতে যদি নির্বাচনের সময় নির্ধারিত হয়, তাহলে সেই দলের প্রতি সরকারের পক্ষপাতের বিষয়টি অস্বীকার করা তো সহজ হয় না।
জুনের পর থেকে যত দিন যেতে থাকল, সাধারণ মানুষের কাছেও বিএনপি-জামায়াতের মুখোমুখি অবস্থানটা পরিষ্কার হতে থাকল। ঐকমত্য কমিশনেও দেখা গেল দুই দলের এই বিরোধের প্রকাশ। সংস্কারের অনেক প্রস্তাবেই বিএনপি-জামায়াতকে পরস্পরবিরোধী অবস্থানে দেখা গেল। বিএনপির পক্ষ থেকে একের পর এক আসতে থাকল নোট অব ডিসেন্ট বা আপত্তি। এরপর আবার বিপত্তি দেখা গেল জুলাই সনদ বাস্তবায়নে যে ‘গণভোট’ করার কথা বলা হচ্ছে, সেটি অনুষ্ঠানের তারিখ নিয়ে। বিএনপি বলল, নির্বাচনের দিনই হোক গণভোট, বিপরীতে জামায়াত বলছে—নির্বাচনের আগে, সম্ভব হলে এই নভেম্বরেই গণভোট হতে হবে। গণভোটের রায় নিয়ে, সেটার ওপর ভিত্তি করেই হবে নির্বাচন। আবার জুলাই সনদ বাস্তবায়নের যে আদেশ, তার খসড়া নিয়েও বড় ধরনের আপত্তি তুলল বিএনপি। আপত্তির মাত্রাটা এতটাই প্রবল যে, তারা বলল—জুলাই সনদ নিয়ে ঐকমত্য কমিশন তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। খেলায় যে রেফারির ওপর সব পক্ষ ভরসা রাখে, সে রেফারিই এবার গোল দিয়ে বসে আছে। অর্থাৎ চরম পক্ষপাতের অভিযোগ। যে কমিশনের প্রধান হচ্ছেন খোদ সরকারপ্রধান ড. ইউনূস, তাঁরই বিরুদ্ধে পক্ষপাত ও প্রতারণার অভিযোগ! বিষয়টি কিন্তু এরপর আর হালকা থাকল না।
তাহলে এখন কী হবে? গণভোট কবে হবে? গণভোটে জনগণের সামনে প্রশ্ন কী থাকবে? এসব প্রশ্নের সমাধান কে দেবে? ঐকমত্য কমিশনের প্রধান ও সক্রিয় দুই ব্যক্তি ড. আলী রীয়াজ ও মনির হায়দার এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছেন। তড়িঘড়ি করে তাঁদের এই চলে যাওয়া নিয়েও নানা ধরনের সন্দেহ উচ্চারিত হতে থাকল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই দুজনকে নিয়ে দেখা গেল নানা ধরনের ট্রল। সমাধানের পথ হিসেবে বলা হলো, সরকারপ্রধান ড. ইউনূস এর সমাধান করবেন। এ প্রবণতা আমরা আগের সরকারের আমলেও দেখেছি। সবকিছুই যেন শেখ হাসিনা করতেন। যত সাফল্য, সব তাঁর। মন্ত্রীদের কিছু জিজ্ঞাসা করা হলে বলতেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় এ সাফল্য এসেছে।’ আবার যদি কোনো জটিলতা দেখা দিত, সবাই মিলে মিটিং করে শেষে সিদ্ধান্ত হতো ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’ এর সমাধান দেবেন। দল, অঙ্গসংগঠন, কিংবা ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের কোনো কমিটি করতে হবে—অবধারিতভাবেই দায়িত্ব চলে যাবে ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর’ কাছে। এভাবেই একজন ব্যক্তি স্বৈরাচারী হয়ে ওঠেন। একপর্যায়ে তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেন, তিনি ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত কেউ নিতে পারে না। সব কাজ তাঁকেই করতে হয়। তিনি আসলে অন্যদের মতো নয়, তিনি অনেকটা মহাপুরুষের মতো। আমার মতে, এই স্বৈরাচারী মনোভাবের শুরুটা হয় আশপাশে থাকা মোসাহেবদের কারণেই। এবারও তা-ই হয়েছে, মোসাহেবরা বলতে শুরু করেছেন—ড. ইউনূসই দেবেন শেষ সিদ্ধান্ত!
সরকার অবশ্য অদ্ভুত একটা কাজ করেছে। যখন তাদের ওপর দায়িত্ব এল সংকট নিরসনের, তারা একটা বৈঠক করল, আর বলে দিল—সাত দিনের সময় দেওয়া হলো, এর মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের বসে সমস্যার নিরসন করতে হবে। যে বিরোধের নিরসন টানা আট মাস রাজনৈতিক দলগুলো একসঙ্গে বসে সমাধান করতে পারেনি, সেটা সাত দিনে কীভাবে সম্ভব হবে? তা ছাড়া আরেকটি কথাও উচ্চারিত হচ্ছে। জুলাই সনদ নিয়ে এই বিরোধ, বাস্তবায়ন প্রস্তাবে নোট অব ডিসেন্টগুলোকে না রাখা, এটা আসলে কার দায়? এ অপকর্মটি করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। যে কমিশনের প্রধান আবার ড. ইউনূস নিজে। তাহলে যে ক্রাইসিস সৃষ্টি করেছে ড. ইউনূসের কমিশন, সেটির সমাধানের দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর দেওয়া কেন? এদিকে আবার সেই সাত দিনও শেষ হয়ে গেছে গতকাল রোববার। কোনো সমাধান কি হয়েছে? এখন কী হবে? যথারীতি সেই একই কথা বলা হচ্ছে—ড. ইউনূসই দেবেন সমাধান। কিন্তু কীভাবে? তিনি কি খুব বড় রাজনীতিবিদ? আবার যদি ড. ইউনূস কিংবা তাঁর পরিষদ যদি কোনো একটা সিদ্ধান্ত দেয়, তাহলে সেটাকে কি আর ঐকমত্যের সিদ্ধান্ত বলা যাবে? এটা তো তাঁর সরকারের সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে। সরকারই যদি সিদ্ধান্ত দেবে, তাহলে আর সংস্কার কমিশনের নামে এত নাটকের কী প্রয়োজন ছিল? এত সময়ক্ষেপণই বা কেন করা হলো?
এতসব প্রশ্নের জবাব আসলে কে দেবে, কী দেবে, কেউ জানে না। হয়তো জবাব কখনোই পাওয়া যাবে না। তবে বিএনপি কিন্তু এরই মধ্যে সরকারের দিকে আঙুল তুলতে শুরু করেছে। এর মধ্যে গত শনিবার দেখলাম বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ সরাসরি সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে বললেন—এভাবে সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়ার কোনো এখতিয়ার এই সরকারের নেই। এই সরকার যে কোনো নির্বাচিত সরকার নয়, এটাও তিনি তাদের স্মরণে রাখতে বলেছেন। জামায়াতে ইসলামী আবার এ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। তারা এরই মধ্যে আট দলের একটা জোট বানিয়ে নিয়েছে। এই আট দলকে নিয়ে রাস্তায়ও নেমে গেছে পাঁচ দফা দাবি আদায়ে। তাদের এক শীর্ষস্থানীয় নেতা প্রকাশ্যে বলেছেন—ঘি তাদের চাই। আর এই ঘি পেতে যদি আঙুল বাঁকা করতে হয়, তারা সেটাই করবে। এ বক্তব্য কি কেবলই রেটরিক, নাকি এর মধ্যে প্রচ্ছন্ন কোনো হুমকি আছে; সেটাও কিন্তু চিন্তার বিষয়। এসবের বিপরীতে বিএনপিও বসে নেই। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী শনিবার এক জায়গায় বললেন, বিএনপির মতো বড় দলের কর্মীরা যদি রাস্তায় নামে, তাহলে সংঘাত হতে পারে।
এ রকম পরিস্থিতিতে জনগণের অবস্থান কোথায়? আমরা এখন বসে আছি ক্লাইমেক্সের অপেক্ষায়! এরই মধ্যে পরস্পরের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ আমরা দেখতে পাচ্ছি।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

ত্রিমুখী সম্পর্ক নিয়ে অনেক মুভি হয়েছে। এ রকম মুভি দেখেননি, এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। কেবল মুভিতেই কেন, বাস্তবেও ত্রিমুখী সম্পর্কের অনেক ঘটনা আমরা দেখে থাকি। সব ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ত্রিভুজ সম্পর্কের শেষ পরিণতি সাধারণত ভালো হয় না।
গত বছরের এ সময়ে আমাদের রাজনীতিতে খুব শক্ত একটা ত্রিভুজ সম্পর্ক দেখা গিয়েছিল। বিএনপি-অন্তর্বর্তী সরকার-জামায়াত—এই তিন পক্ষের দহরম-মহরম। তাদের সবারই লক্ষ্য তখন ছিল রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করা। এর প্রাথমিক ধাপ, কদিন আগে অর্থাৎ ২০২৪-এর অক্টোবরে অর্জিত হয়েছে। সে দিন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে এই সরকার একটা নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ করেছে। এরপর বাকি ছিল মূল দল আওয়ামী লীগকে অকার্যকর ও অপ্রাসঙ্গিক করা। গত বছরের এ সময়ে সেই চেষ্টা আমরা দেখেছি। প্রশাসনিকভাবে যেমন, ঠিক তেমনি সামাজিকভাবেও স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিস্ট দল হিসেবে আওয়ামী লীগবিরোধী প্রচারণা বেশ জোরেশোরেই চলছিল। এ কাজে বিএনপি, জামায়াত, সরকার—সবাই বেশ আন্তরিকও ছিল। সে সময়ে মাঠের শক্তি হিসেবে বেশ বড় একটা ভূমিকা রেখেছে এনসিপি বা জাতীয় নাগরিক পার্টি। তারপর মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে যখন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলো, আমার বিবেচনায় ত্রিভুজ দহরম-মহরমের সেটাই ছিল পিক-টাইম। এর পর থেকে নিজ নিজ স্বার্থ নিয়ে ধীরে ধীরে সবাই মাঠে নেমে পড়ল। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকল দূরত্ব।
মে মাসের ১২ তারিখে আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলো, তার মাসখানেক পর জুনের ১৫ তারিখে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস লন্ডনে গিয়ে বৈঠক করলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে। বলতে গেলে ওই বৈঠকটাই যেন সম্পর্কে ভাঙনের ক্ষেত্রে একটা প্রকাশ্য কারণ হতে পারল। জামায়াত অভিযোগ তুলল সরকারের প্রতি—বলল, বিএনপির প্রতি পক্ষপাতিত্ব করছে সরকার। অভিযোগের পেছনের কারণটিও তারা প্রকাশ করল। বলল, ওই বৈঠকের পরই নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় হিসেবে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধের কথাটি বলা হয়েছে। একটিমাত্র দলের শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথার পরিপ্রেক্ষিতে যদি নির্বাচনের সময় নির্ধারিত হয়, তাহলে সেই দলের প্রতি সরকারের পক্ষপাতের বিষয়টি অস্বীকার করা তো সহজ হয় না।
জুনের পর থেকে যত দিন যেতে থাকল, সাধারণ মানুষের কাছেও বিএনপি-জামায়াতের মুখোমুখি অবস্থানটা পরিষ্কার হতে থাকল। ঐকমত্য কমিশনেও দেখা গেল দুই দলের এই বিরোধের প্রকাশ। সংস্কারের অনেক প্রস্তাবেই বিএনপি-জামায়াতকে পরস্পরবিরোধী অবস্থানে দেখা গেল। বিএনপির পক্ষ থেকে একের পর এক আসতে থাকল নোট অব ডিসেন্ট বা আপত্তি। এরপর আবার বিপত্তি দেখা গেল জুলাই সনদ বাস্তবায়নে যে ‘গণভোট’ করার কথা বলা হচ্ছে, সেটি অনুষ্ঠানের তারিখ নিয়ে। বিএনপি বলল, নির্বাচনের দিনই হোক গণভোট, বিপরীতে জামায়াত বলছে—নির্বাচনের আগে, সম্ভব হলে এই নভেম্বরেই গণভোট হতে হবে। গণভোটের রায় নিয়ে, সেটার ওপর ভিত্তি করেই হবে নির্বাচন। আবার জুলাই সনদ বাস্তবায়নের যে আদেশ, তার খসড়া নিয়েও বড় ধরনের আপত্তি তুলল বিএনপি। আপত্তির মাত্রাটা এতটাই প্রবল যে, তারা বলল—জুলাই সনদ নিয়ে ঐকমত্য কমিশন তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। খেলায় যে রেফারির ওপর সব পক্ষ ভরসা রাখে, সে রেফারিই এবার গোল দিয়ে বসে আছে। অর্থাৎ চরম পক্ষপাতের অভিযোগ। যে কমিশনের প্রধান হচ্ছেন খোদ সরকারপ্রধান ড. ইউনূস, তাঁরই বিরুদ্ধে পক্ষপাত ও প্রতারণার অভিযোগ! বিষয়টি কিন্তু এরপর আর হালকা থাকল না।
তাহলে এখন কী হবে? গণভোট কবে হবে? গণভোটে জনগণের সামনে প্রশ্ন কী থাকবে? এসব প্রশ্নের সমাধান কে দেবে? ঐকমত্য কমিশনের প্রধান ও সক্রিয় দুই ব্যক্তি ড. আলী রীয়াজ ও মনির হায়দার এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছেন। তড়িঘড়ি করে তাঁদের এই চলে যাওয়া নিয়েও নানা ধরনের সন্দেহ উচ্চারিত হতে থাকল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই দুজনকে নিয়ে দেখা গেল নানা ধরনের ট্রল। সমাধানের পথ হিসেবে বলা হলো, সরকারপ্রধান ড. ইউনূস এর সমাধান করবেন। এ প্রবণতা আমরা আগের সরকারের আমলেও দেখেছি। সবকিছুই যেন শেখ হাসিনা করতেন। যত সাফল্য, সব তাঁর। মন্ত্রীদের কিছু জিজ্ঞাসা করা হলে বলতেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় এ সাফল্য এসেছে।’ আবার যদি কোনো জটিলতা দেখা দিত, সবাই মিলে মিটিং করে শেষে সিদ্ধান্ত হতো ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’ এর সমাধান দেবেন। দল, অঙ্গসংগঠন, কিংবা ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের কোনো কমিটি করতে হবে—অবধারিতভাবেই দায়িত্ব চলে যাবে ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর’ কাছে। এভাবেই একজন ব্যক্তি স্বৈরাচারী হয়ে ওঠেন। একপর্যায়ে তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেন, তিনি ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত কেউ নিতে পারে না। সব কাজ তাঁকেই করতে হয়। তিনি আসলে অন্যদের মতো নয়, তিনি অনেকটা মহাপুরুষের মতো। আমার মতে, এই স্বৈরাচারী মনোভাবের শুরুটা হয় আশপাশে থাকা মোসাহেবদের কারণেই। এবারও তা-ই হয়েছে, মোসাহেবরা বলতে শুরু করেছেন—ড. ইউনূসই দেবেন শেষ সিদ্ধান্ত!
সরকার অবশ্য অদ্ভুত একটা কাজ করেছে। যখন তাদের ওপর দায়িত্ব এল সংকট নিরসনের, তারা একটা বৈঠক করল, আর বলে দিল—সাত দিনের সময় দেওয়া হলো, এর মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের বসে সমস্যার নিরসন করতে হবে। যে বিরোধের নিরসন টানা আট মাস রাজনৈতিক দলগুলো একসঙ্গে বসে সমাধান করতে পারেনি, সেটা সাত দিনে কীভাবে সম্ভব হবে? তা ছাড়া আরেকটি কথাও উচ্চারিত হচ্ছে। জুলাই সনদ নিয়ে এই বিরোধ, বাস্তবায়ন প্রস্তাবে নোট অব ডিসেন্টগুলোকে না রাখা, এটা আসলে কার দায়? এ অপকর্মটি করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। যে কমিশনের প্রধান আবার ড. ইউনূস নিজে। তাহলে যে ক্রাইসিস সৃষ্টি করেছে ড. ইউনূসের কমিশন, সেটির সমাধানের দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর দেওয়া কেন? এদিকে আবার সেই সাত দিনও শেষ হয়ে গেছে গতকাল রোববার। কোনো সমাধান কি হয়েছে? এখন কী হবে? যথারীতি সেই একই কথা বলা হচ্ছে—ড. ইউনূসই দেবেন সমাধান। কিন্তু কীভাবে? তিনি কি খুব বড় রাজনীতিবিদ? আবার যদি ড. ইউনূস কিংবা তাঁর পরিষদ যদি কোনো একটা সিদ্ধান্ত দেয়, তাহলে সেটাকে কি আর ঐকমত্যের সিদ্ধান্ত বলা যাবে? এটা তো তাঁর সরকারের সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে। সরকারই যদি সিদ্ধান্ত দেবে, তাহলে আর সংস্কার কমিশনের নামে এত নাটকের কী প্রয়োজন ছিল? এত সময়ক্ষেপণই বা কেন করা হলো?
এতসব প্রশ্নের জবাব আসলে কে দেবে, কী দেবে, কেউ জানে না। হয়তো জবাব কখনোই পাওয়া যাবে না। তবে বিএনপি কিন্তু এরই মধ্যে সরকারের দিকে আঙুল তুলতে শুরু করেছে। এর মধ্যে গত শনিবার দেখলাম বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ সরাসরি সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে বললেন—এভাবে সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়ার কোনো এখতিয়ার এই সরকারের নেই। এই সরকার যে কোনো নির্বাচিত সরকার নয়, এটাও তিনি তাদের স্মরণে রাখতে বলেছেন। জামায়াতে ইসলামী আবার এ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। তারা এরই মধ্যে আট দলের একটা জোট বানিয়ে নিয়েছে। এই আট দলকে নিয়ে রাস্তায়ও নেমে গেছে পাঁচ দফা দাবি আদায়ে। তাদের এক শীর্ষস্থানীয় নেতা প্রকাশ্যে বলেছেন—ঘি তাদের চাই। আর এই ঘি পেতে যদি আঙুল বাঁকা করতে হয়, তারা সেটাই করবে। এ বক্তব্য কি কেবলই রেটরিক, নাকি এর মধ্যে প্রচ্ছন্ন কোনো হুমকি আছে; সেটাও কিন্তু চিন্তার বিষয়। এসবের বিপরীতে বিএনপিও বসে নেই। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী শনিবার এক জায়গায় বললেন, বিএনপির মতো বড় দলের কর্মীরা যদি রাস্তায় নামে, তাহলে সংঘাত হতে পারে।
এ রকম পরিস্থিতিতে জনগণের অবস্থান কোথায়? আমরা এখন বসে আছি ক্লাইমেক্সের অপেক্ষায়! এরই মধ্যে পরস্পরের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ আমরা দেখতে পাচ্ছি।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

আমাদের নিজেদের দেশের খবর এড়ানোর উপায় নেই। এখানে প্রতিদিন অসংখ্য ঘটনা ঘটছে, চাঞ্চল্যকর ঘটনাও। কয়েকটির দিকে তাকানো যেতে পারে। করোনায় ভুগে অনেক মানুষ অকালে মারা গেছে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি মানুষকে কিন্তু আকস্মিকভাবে ও অকালে চলে যেতে হয়েছে সড়ক দুর্ঘটনায়।
১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১
আমরা চব্বিশের আন্দোলন দেখেছি—বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন থেকে যা রূপ নেয় স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে। এর আগপর্যন্ত স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সম্পর্কে জেনেছি নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান এবং নূর হোসেনের আত্মত্যাগের কথা। অনেকে দুটো ঘটনারই সাক্ষী। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর নূর হোসেন শহীদ হন পুলিশের গুলিতে।
১৩ ঘণ্টা আগে
গত এক বছরে আমাদের জাতি এক অভূতপূর্ব রাজনৈতিক প্রজ্ঞা লাভ করেছে। জাতীয় গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ঘরের ভেতর থেকে চায়ের দোকান, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়—সর্বত্রই রাজনৈতিক আলোচনা, পর্যালোচনা এবং সেই সঙ্গে যাঁর যাঁর সুচিন্তিত মন্তব্যও দিয়ে যাচ্ছেন।
১৩ ঘণ্টা আগে
দেশে এমনিতেই ফসলি জমি হ্রাস পাচ্ছে। সেটি কমে যাওয়া মানে খাদ্যের উৎপাদনও কমে যাওয়া। যে কারণে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়ে থাকে, কোনো আবাদি জমি যাতে পতিত না থাকে।
১৩ ঘণ্টা আগেশহীদ নূর হোসেন দিবস
সৈয়দা সাদিয়া শাহরীন

আমরা চব্বিশের আন্দোলন দেখেছি—বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন থেকে যা রূপ নেয় স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে। এর আগপর্যন্ত স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সম্পর্কে জেনেছি নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান এবং নূর হোসেনের আত্মত্যাগের কথা। অনেকে দুটো ঘটনারই সাক্ষী। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর নূর হোসেন শহীদ হন পুলিশের গুলিতে। কারণটা শুধু তাঁর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেওয়া ছিল না, ছিল তাঁর বুকে-পিঠে লেখা স্লোগানও—‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। নূর হোসেনের এই অদম্য সাহসই যে পরবর্তী সময়ে চব্বিশের জুলাই-আগস্টে তরুণদের মাঝে ছড়িয়ে যায়, সেটা না বললেও চলে। কেননা, ইতিহাস সাক্ষী এবং শিক্ষক—দুটো ভূমিকা পালন করে। শহীদ নূর হোসেন দিবসের নেপথ্যে কী, কেন তিনি শহীদ হন? এসব প্রশ্নের উত্তর না পেলে হয়তো আজকের প্রজন্ম অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারত না। তাই নূর হোসেনকে ভুলে যাওয়া যায় না।
বেবিট্যাক্সিচালকের সন্তান নূর হোসেনের জন্ম ঢাকায়, নারিন্দায়, ১৯৬১ সালে। পড়ালেখার দৌড় বেশি দূর যায়নি, অষ্টম শ্রেণিতেই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। কিন্তু রাজনীতিতে সক্রিয়। আর মোটর ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। ছিলেন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের বনগ্রাম শাখার প্রচার সম্পাদক। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি না নিয়েও রাজনীতির শব্দ নিয়ে খেলায় মেধার পরিচয় দিয়েছিলেন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময়। জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনকালে নাখোশ হয়ে আর সবার সঙ্গে রাজনৈতিক মিছিলে যোগ দেওয়ার আগের দিন, অর্থাৎ ১৯৮৭ সালের ৯ নভেম্বর নূর হোসেন ঠিক করে ফেলেছিলেন কী হবে তাঁর স্লোগান। সেদিন পপুলার আর্ট নামের একটি দোকান থেকে সাদা রং দিয়ে নিজের বুকে লিখিয়ে নেন ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’। আর পিঠে লেখান ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। প্রচার সম্পাদকের কাজটা ভালোই জানতেন! এই কাজ করে বাড়ি গেলেন না। দুদিন আগেই ঘরছাড়া হয়েছিলেন যদিও। আশ্রয় নিয়েছিলেন একটি মসজিদে। পরিবার ১০ নভেম্বর সকালে তাঁকে খুঁজে পেলেও তিনি বাড়ি ফিরতে চাননি। গায়ে কাপড় টেনে ঢেকে দিয়েছিলেন সেই কঠোর স্লোগান।
কাজ শেষে বাড়ি ফিরবে বলে মা-বাবাকে বিদায় দিয়েছিলেন নূর হোসেন। কিন্তু ফেরা আর হলো কই? ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর জোটবদ্ধ বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহ ‘ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি’ গ্রহণ করে। কর্মসূচির লক্ষ্য ছিল সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি আদায়। সেদিন স্বৈরাচারবিরোধী যে মিছিলটি পল্টন এলাকার ‘জিরো পয়েন্ট’ অতিক্রম করছিল, সেখানে ছিলেন নূর। কাঁদানে গ্যাস ও গুলি ছুড়ে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ করে দেয় তৎকালীন সরকারের পালিত পুলিশ। নূর হোসেনকে তখন আলাদা করে চেনা যাচ্ছিল খুব সহজে, গায়ে লেখা শ্বেত স্লোগানের কারণে। গুলি এসে বিঁধেছিল সেই গায়ে। তাঁর সঙ্গে সেদিন নিহত হন যুবলীগ নেতা বাবুলও। কিন্তু অষ্টম শ্রেণি পাস নূর হোসেনের গায়ে লেখা স্লোগান তাঁকে আজও অমর করে রেখেছে।
কোঁকড়া চুলের নূর হোসেন তিন দশক পরেও তরুণ, প্রাসঙ্গিক। তাঁর আত্মত্যাগ পরবর্তীকালে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় পথ দেখায়। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পতন ঘটে এরশাদ সরকারের। যে গণতন্ত্রকে মুক্তি দিতে নূর প্রাণ দিয়েছিলেন, সেই গণতন্ত্র বন্দী হয়ে গিয়েছিল আবারও। আর আবারও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং সরকার পতন হলো, কিন্তু গণতন্ত্র কি আজও মুক্তি পেল? কখনো পাবে? এ প্রশ্ন হয়তো নূর হোসেন মনে মনে ভাবছেন, অন্য জগতে বসে। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা।
লেখক: সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

আমরা চব্বিশের আন্দোলন দেখেছি—বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন থেকে যা রূপ নেয় স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে। এর আগপর্যন্ত স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সম্পর্কে জেনেছি নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান এবং নূর হোসেনের আত্মত্যাগের কথা। অনেকে দুটো ঘটনারই সাক্ষী। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর নূর হোসেন শহীদ হন পুলিশের গুলিতে। কারণটা শুধু তাঁর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেওয়া ছিল না, ছিল তাঁর বুকে-পিঠে লেখা স্লোগানও—‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। নূর হোসেনের এই অদম্য সাহসই যে পরবর্তী সময়ে চব্বিশের জুলাই-আগস্টে তরুণদের মাঝে ছড়িয়ে যায়, সেটা না বললেও চলে। কেননা, ইতিহাস সাক্ষী এবং শিক্ষক—দুটো ভূমিকা পালন করে। শহীদ নূর হোসেন দিবসের নেপথ্যে কী, কেন তিনি শহীদ হন? এসব প্রশ্নের উত্তর না পেলে হয়তো আজকের প্রজন্ম অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারত না। তাই নূর হোসেনকে ভুলে যাওয়া যায় না।
বেবিট্যাক্সিচালকের সন্তান নূর হোসেনের জন্ম ঢাকায়, নারিন্দায়, ১৯৬১ সালে। পড়ালেখার দৌড় বেশি দূর যায়নি, অষ্টম শ্রেণিতেই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। কিন্তু রাজনীতিতে সক্রিয়। আর মোটর ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। ছিলেন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের বনগ্রাম শাখার প্রচার সম্পাদক। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি না নিয়েও রাজনীতির শব্দ নিয়ে খেলায় মেধার পরিচয় দিয়েছিলেন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময়। জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনকালে নাখোশ হয়ে আর সবার সঙ্গে রাজনৈতিক মিছিলে যোগ দেওয়ার আগের দিন, অর্থাৎ ১৯৮৭ সালের ৯ নভেম্বর নূর হোসেন ঠিক করে ফেলেছিলেন কী হবে তাঁর স্লোগান। সেদিন পপুলার আর্ট নামের একটি দোকান থেকে সাদা রং দিয়ে নিজের বুকে লিখিয়ে নেন ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’। আর পিঠে লেখান ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। প্রচার সম্পাদকের কাজটা ভালোই জানতেন! এই কাজ করে বাড়ি গেলেন না। দুদিন আগেই ঘরছাড়া হয়েছিলেন যদিও। আশ্রয় নিয়েছিলেন একটি মসজিদে। পরিবার ১০ নভেম্বর সকালে তাঁকে খুঁজে পেলেও তিনি বাড়ি ফিরতে চাননি। গায়ে কাপড় টেনে ঢেকে দিয়েছিলেন সেই কঠোর স্লোগান।
কাজ শেষে বাড়ি ফিরবে বলে মা-বাবাকে বিদায় দিয়েছিলেন নূর হোসেন। কিন্তু ফেরা আর হলো কই? ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর জোটবদ্ধ বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহ ‘ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি’ গ্রহণ করে। কর্মসূচির লক্ষ্য ছিল সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি আদায়। সেদিন স্বৈরাচারবিরোধী যে মিছিলটি পল্টন এলাকার ‘জিরো পয়েন্ট’ অতিক্রম করছিল, সেখানে ছিলেন নূর। কাঁদানে গ্যাস ও গুলি ছুড়ে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ করে দেয় তৎকালীন সরকারের পালিত পুলিশ। নূর হোসেনকে তখন আলাদা করে চেনা যাচ্ছিল খুব সহজে, গায়ে লেখা শ্বেত স্লোগানের কারণে। গুলি এসে বিঁধেছিল সেই গায়ে। তাঁর সঙ্গে সেদিন নিহত হন যুবলীগ নেতা বাবুলও। কিন্তু অষ্টম শ্রেণি পাস নূর হোসেনের গায়ে লেখা স্লোগান তাঁকে আজও অমর করে রেখেছে।
কোঁকড়া চুলের নূর হোসেন তিন দশক পরেও তরুণ, প্রাসঙ্গিক। তাঁর আত্মত্যাগ পরবর্তীকালে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় পথ দেখায়। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পতন ঘটে এরশাদ সরকারের। যে গণতন্ত্রকে মুক্তি দিতে নূর প্রাণ দিয়েছিলেন, সেই গণতন্ত্র বন্দী হয়ে গিয়েছিল আবারও। আর আবারও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং সরকার পতন হলো, কিন্তু গণতন্ত্র কি আজও মুক্তি পেল? কখনো পাবে? এ প্রশ্ন হয়তো নূর হোসেন মনে মনে ভাবছেন, অন্য জগতে বসে। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা।
লেখক: সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

আমাদের নিজেদের দেশের খবর এড়ানোর উপায় নেই। এখানে প্রতিদিন অসংখ্য ঘটনা ঘটছে, চাঞ্চল্যকর ঘটনাও। কয়েকটির দিকে তাকানো যেতে পারে। করোনায় ভুগে অনেক মানুষ অকালে মারা গেছে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি মানুষকে কিন্তু আকস্মিকভাবে ও অকালে চলে যেতে হয়েছে সড়ক দুর্ঘটনায়।
১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১
ত্রিমুখী সম্পর্ক নিয়ে অনেক মুভি হয়েছে। এ রকম মুভি দেখেননি, এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। কেবল মুভিতেই কেন, বাস্তবেও ত্রিমুখী সম্পর্কের অনেক ঘটনা আমরা দেখে থাকি। সব ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ত্রিভুজ সম্পর্কের শেষ পরিণতি সাধারণত ভালো হয় না।
১৩ ঘণ্টা আগে
গত এক বছরে আমাদের জাতি এক অভূতপূর্ব রাজনৈতিক প্রজ্ঞা লাভ করেছে। জাতীয় গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ঘরের ভেতর থেকে চায়ের দোকান, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়—সর্বত্রই রাজনৈতিক আলোচনা, পর্যালোচনা এবং সেই সঙ্গে যাঁর যাঁর সুচিন্তিত মন্তব্যও দিয়ে যাচ্ছেন।
১৩ ঘণ্টা আগে
দেশে এমনিতেই ফসলি জমি হ্রাস পাচ্ছে। সেটি কমে যাওয়া মানে খাদ্যের উৎপাদনও কমে যাওয়া। যে কারণে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়ে থাকে, কোনো আবাদি জমি যাতে পতিত না থাকে।
১৩ ঘণ্টা আগেমামুনুর রশীদ

গত এক বছরে আমাদের জাতি এক অভূতপূর্ব রাজনৈতিক প্রজ্ঞা লাভ করেছে। জাতীয় গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ঘরের ভেতর থেকে চায়ের দোকান, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়—সর্বত্রই রাজনৈতিক আলোচনা, পর্যালোচনা এবং সেই সঙ্গে যাঁর যাঁর সুচিন্তিত মন্তব্যও দিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিদিনই সকাল-বিকেল কিছু না কিছু ঘটনা ঘটছে, সেসবের ওপরও তাৎক্ষণিক মন্তব্য হয়ে যাচ্ছে। এবারের উচ্চমাধ্যমিকের ফলেও তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। শিক্ষার্থীরাও পড়াশোনায় তেমন মনোযোগী হতে পারছে না। সমগ্র আলোচনা ওই রাজনীতিতে। চায়ের কাপেই বড় বড় সিদ্ধান্ত হয়ে যাচ্ছে।
মধ্যবিত্তের বাজারঘাটে টান পড়লেও তা আলোচনায় খুব একটা জায়গা পাচ্ছে না। রাজনীতিই মুখ্য এবং মুখ্য আলোচনার বিষয়। একটা বিষয় অবশ্য দেখার আছে—ক্লান্তিহীন, আড্ডাবাজ বাঙালি যেকোনো বিষয়ের ওপর আলোচনা করতে এবং সিদ্ধান্ত দিতে বড়ই উৎসাহী। ক্রিকেট খেলা দেখতে দেখতে অবলীলায় বিশ্ববিখ্যাত ব্যাটার বা বোলারদের ভুল ধরতে একটুও বিলম্ব করে না।
বলা হয়ে থাকে, সম্মিলিতভাবে বাঙালি সব সময়ই সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। জাতি যে এত রাজনীতিসচেতন হয়ে পড়ল, সেও ভালো কথা। কিন্তু যখন দেখি কোথাও সড়ক দুর্ঘটনা হলো বা পুলিশের লাঠিপেটায় রক্তাক্ত দেহ পড়ে আছে, কোথাও কোনো নারীর অসম্মান হচ্ছে, তখন তার ফোনের ক্যামেরাটি গর্জে ওঠে বটে কিন্তু মানুষ আগায় না। সবকিছু যে ক্যামেরায় ধারণ করার বিষয় নয়, প্রতিবাদী হওয়া প্রয়োজন, তা বোঝার বোধ হয় এখন আর দরকার নেই।
আমাদের লেখাপড়ার সময়টা ছিল ষাটের দশক, যখন দেশে বিপুল পরিমাণে নানা জায়গায় আন্দোলন চলছিল। তার মধ্যে শিল্প-সাহিত্য, বিজ্ঞানচিন্তা এবং বড় বড় রাজনৈতিক তত্ত্ব নিয়েও কথাবার্তা হতো। মিছিলে যাওয়ার আগে ও পরে এসব বিষয় নিয়ে তর্কের ঝড় উঠত। এই তর্কাতর্কির ফলেই একটা বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু এখন এমন একটা সময় এসেছে, যখন রাজনীতিই একমাত্র আলোচনা, তর্কবিতর্কের বিষয়।
এই সময়ের মধ্যে যে কত মানবিক বিপর্যয় ঘটে গেল, দুর্নীতি সকল সময়ের রেকর্ড অতিক্রম করল। শিক্ষাব্যবস্থা নিম্নমুখী, কতিপয় দুর্বৃত্ত আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠল—তার আলোচনা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ করে না। অসহায় কিছু মানুষকে দেখা যায় কোর্ট-কাচারিতে, জেলখানায় দৌড়াদৌড়ি করতে। আবার থানায় প্রচুর মানুষের ভিড়। মানুষ ভেবেছিল একটা পরিবর্তন আসবে, দুর্নীতির কবর রচনা হবে, সরকার একটি কল্যাণমুখী প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবে, দুর্নীতি বিদায় করতে যেমন কমিশন গঠন করেছে, তা দিয়েই চিরতরে এই অসুখটি নির্মূল হয়ে যাবে। কিন্তু তা হলো না। নির্বাচনই এখন একমাত্র আলোচনার বিষয়। অধিকাংশ লোক ভাবছে নির্বাচন হবে না। এই অবিশ্বাসই-বা কেন? মানুষ একটা আস্থাহীনতা এবং অবিশ্বাসের জায়গায় দাঁড়িয়ে গেল কেন?
বাঙালি চিরকালই সরকারবিরোধী। কারণ আছে অনেক। কিন্তু আস্থাহীনতা যদি সংক্রামক হয়ে জাতির সর্বক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে যায়, তাহলে তার পরিণতি কী হবে? উত্তরের জন্য বহু দূর অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই। এখনই দেখা যাচ্ছে মানবিক মূল্যবোধে ধস নেমেছে, যার হাজার হাজার উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে। আরও বহুবার বলেছি, রাষ্ট্রকে আমরা মানবিক করতে পারিনি। সব দল মিলেই ব্যবস্থাটা এমন হয়েছে যে সরকার রাষ্ট্রকে অধিকার করে ফেলেছে, সমাজ কোনোমতে ধিকিধিকি জ্বলছে। তবে সমাজের শক্তি এখনো আছে। নইলে যে নৈরাজ্যকে আমরা দেখেছি, তাতে দেশে বিপুল পরিমাণে দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়ে অনেক কিছুই তছনছ হয়ে যেত। কোনো কোনো ওয়াজ-মাহফিল থেকে যেসব উসকানিমূলক বক্তব্য আসে, তাতে সব জায়গায় অগ্ন্যুৎপাত হওয়ার কথা। কিছু কিছু জায়গায় যে তা হয়নি, তা-ও সত্য নয়। অনেক জায়গায়ই ফেসবুকের একটি পোস্ট অনেক দাঙ্গাবাজির কারণ হয়েছে। সেসব ঘটনায় আমাদের সমাজ সত্যিই একটা ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এবার কোনো শক্তিই তেমন দুর্বার হয়ে উঠতে পারেনি। আর সমাজের সবচেয়ে বড় শক্তিটি এখনো সোচ্চার হতে পারেনি।
আমাদের অর্ধশতকের শিক্ষাব্যবস্থা মানুষকে সত্য বলতে শেখায়নি। রাজনীতিবিদ, আমলা, বিচারক, শিক্ষক ও শিক্ষাব্যবস্থার নিয়ন্ত্রকও সত্য ভাষাকে উৎসাহিত করেনি। একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা সর্বত্রই উৎসাহিত হয়েছে। আজকে যে শুধু রাজনীতিই একমাত্র আলোচ্য বিষয়, তার কারণও হচ্ছে সমাজের অন্য সমস্যাগুলোর সমাধান না করে একটি দুর্নীতির পথই বেছে নিয়েছে সবাই। যদি সব জায়গায়ই একটা সুস্থ-স্বাভাবিক ধারা অব্যাহত থাকত, তাহলে এ জায়গায় এসে দাঁড়াতাম না আমরা। সমাজের সর্বত্র সত্যকে মূল্যায়ন করার একটা ব্যবস্থাই পারত সমাজকে রক্ষা করতে। রাজনীতির বৃহত্তর অর্থে প্রয়োগটাও হয়নি।
মানুষের মহত্তম কল্যাণের পথটা রাজনীতিই খুলে দেয়। চীন, রাশিয়া, কিউবার বিপ্লবে সে দেশগুলোর জনগণ একটা মুক্তির পথ পেয়েছিল। তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক সব ধর্মান্ধতা এবং গোঁড়ামি থেকে একটা মুক্ত সমাজ গড়েছিলেন। আমাদের দেশেও লাখ লাখ মানুষ দেশের জন্য বড় বড় ত্যাগ স্বীকার করেছেন। কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্ব তা সমাজের কাজে ব্যবহার করতে পারেননি। একটাই বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা হলো ক্ষমতা। ক্ষমতার ব্যবহার এবং অপব্যবহার একটি সমাজের জন্য যে কত ভয়ংকর হতে পারে, তা আমরা দেখেছি। এটা সবাই স্বীকার করছেন, আমরা একটি সংকটকাল পার করছি। তার মধ্যেও মানুষের মনে আশা জাগে—একটা সুদিন আসবে। কীভাবে যে সে আশা পূর্ণ হবে আমি জানি না, কেউ জানে কি না জানি না, তবে কেউ না কেউ নিশ্চয়ই জানেন। জেনে থাকলে আমাদের খবর দেবেন।
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব

গত এক বছরে আমাদের জাতি এক অভূতপূর্ব রাজনৈতিক প্রজ্ঞা লাভ করেছে। জাতীয় গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ঘরের ভেতর থেকে চায়ের দোকান, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়—সর্বত্রই রাজনৈতিক আলোচনা, পর্যালোচনা এবং সেই সঙ্গে যাঁর যাঁর সুচিন্তিত মন্তব্যও দিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিদিনই সকাল-বিকেল কিছু না কিছু ঘটনা ঘটছে, সেসবের ওপরও তাৎক্ষণিক মন্তব্য হয়ে যাচ্ছে। এবারের উচ্চমাধ্যমিকের ফলেও তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। শিক্ষার্থীরাও পড়াশোনায় তেমন মনোযোগী হতে পারছে না। সমগ্র আলোচনা ওই রাজনীতিতে। চায়ের কাপেই বড় বড় সিদ্ধান্ত হয়ে যাচ্ছে।
মধ্যবিত্তের বাজারঘাটে টান পড়লেও তা আলোচনায় খুব একটা জায়গা পাচ্ছে না। রাজনীতিই মুখ্য এবং মুখ্য আলোচনার বিষয়। একটা বিষয় অবশ্য দেখার আছে—ক্লান্তিহীন, আড্ডাবাজ বাঙালি যেকোনো বিষয়ের ওপর আলোচনা করতে এবং সিদ্ধান্ত দিতে বড়ই উৎসাহী। ক্রিকেট খেলা দেখতে দেখতে অবলীলায় বিশ্ববিখ্যাত ব্যাটার বা বোলারদের ভুল ধরতে একটুও বিলম্ব করে না।
বলা হয়ে থাকে, সম্মিলিতভাবে বাঙালি সব সময়ই সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। জাতি যে এত রাজনীতিসচেতন হয়ে পড়ল, সেও ভালো কথা। কিন্তু যখন দেখি কোথাও সড়ক দুর্ঘটনা হলো বা পুলিশের লাঠিপেটায় রক্তাক্ত দেহ পড়ে আছে, কোথাও কোনো নারীর অসম্মান হচ্ছে, তখন তার ফোনের ক্যামেরাটি গর্জে ওঠে বটে কিন্তু মানুষ আগায় না। সবকিছু যে ক্যামেরায় ধারণ করার বিষয় নয়, প্রতিবাদী হওয়া প্রয়োজন, তা বোঝার বোধ হয় এখন আর দরকার নেই।
আমাদের লেখাপড়ার সময়টা ছিল ষাটের দশক, যখন দেশে বিপুল পরিমাণে নানা জায়গায় আন্দোলন চলছিল। তার মধ্যে শিল্প-সাহিত্য, বিজ্ঞানচিন্তা এবং বড় বড় রাজনৈতিক তত্ত্ব নিয়েও কথাবার্তা হতো। মিছিলে যাওয়ার আগে ও পরে এসব বিষয় নিয়ে তর্কের ঝড় উঠত। এই তর্কাতর্কির ফলেই একটা বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু এখন এমন একটা সময় এসেছে, যখন রাজনীতিই একমাত্র আলোচনা, তর্কবিতর্কের বিষয়।
এই সময়ের মধ্যে যে কত মানবিক বিপর্যয় ঘটে গেল, দুর্নীতি সকল সময়ের রেকর্ড অতিক্রম করল। শিক্ষাব্যবস্থা নিম্নমুখী, কতিপয় দুর্বৃত্ত আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠল—তার আলোচনা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ করে না। অসহায় কিছু মানুষকে দেখা যায় কোর্ট-কাচারিতে, জেলখানায় দৌড়াদৌড়ি করতে। আবার থানায় প্রচুর মানুষের ভিড়। মানুষ ভেবেছিল একটা পরিবর্তন আসবে, দুর্নীতির কবর রচনা হবে, সরকার একটি কল্যাণমুখী প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবে, দুর্নীতি বিদায় করতে যেমন কমিশন গঠন করেছে, তা দিয়েই চিরতরে এই অসুখটি নির্মূল হয়ে যাবে। কিন্তু তা হলো না। নির্বাচনই এখন একমাত্র আলোচনার বিষয়। অধিকাংশ লোক ভাবছে নির্বাচন হবে না। এই অবিশ্বাসই-বা কেন? মানুষ একটা আস্থাহীনতা এবং অবিশ্বাসের জায়গায় দাঁড়িয়ে গেল কেন?
বাঙালি চিরকালই সরকারবিরোধী। কারণ আছে অনেক। কিন্তু আস্থাহীনতা যদি সংক্রামক হয়ে জাতির সর্বক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে যায়, তাহলে তার পরিণতি কী হবে? উত্তরের জন্য বহু দূর অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই। এখনই দেখা যাচ্ছে মানবিক মূল্যবোধে ধস নেমেছে, যার হাজার হাজার উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে। আরও বহুবার বলেছি, রাষ্ট্রকে আমরা মানবিক করতে পারিনি। সব দল মিলেই ব্যবস্থাটা এমন হয়েছে যে সরকার রাষ্ট্রকে অধিকার করে ফেলেছে, সমাজ কোনোমতে ধিকিধিকি জ্বলছে। তবে সমাজের শক্তি এখনো আছে। নইলে যে নৈরাজ্যকে আমরা দেখেছি, তাতে দেশে বিপুল পরিমাণে দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়ে অনেক কিছুই তছনছ হয়ে যেত। কোনো কোনো ওয়াজ-মাহফিল থেকে যেসব উসকানিমূলক বক্তব্য আসে, তাতে সব জায়গায় অগ্ন্যুৎপাত হওয়ার কথা। কিছু কিছু জায়গায় যে তা হয়নি, তা-ও সত্য নয়। অনেক জায়গায়ই ফেসবুকের একটি পোস্ট অনেক দাঙ্গাবাজির কারণ হয়েছে। সেসব ঘটনায় আমাদের সমাজ সত্যিই একটা ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এবার কোনো শক্তিই তেমন দুর্বার হয়ে উঠতে পারেনি। আর সমাজের সবচেয়ে বড় শক্তিটি এখনো সোচ্চার হতে পারেনি।
আমাদের অর্ধশতকের শিক্ষাব্যবস্থা মানুষকে সত্য বলতে শেখায়নি। রাজনীতিবিদ, আমলা, বিচারক, শিক্ষক ও শিক্ষাব্যবস্থার নিয়ন্ত্রকও সত্য ভাষাকে উৎসাহিত করেনি। একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা সর্বত্রই উৎসাহিত হয়েছে। আজকে যে শুধু রাজনীতিই একমাত্র আলোচ্য বিষয়, তার কারণও হচ্ছে সমাজের অন্য সমস্যাগুলোর সমাধান না করে একটি দুর্নীতির পথই বেছে নিয়েছে সবাই। যদি সব জায়গায়ই একটা সুস্থ-স্বাভাবিক ধারা অব্যাহত থাকত, তাহলে এ জায়গায় এসে দাঁড়াতাম না আমরা। সমাজের সর্বত্র সত্যকে মূল্যায়ন করার একটা ব্যবস্থাই পারত সমাজকে রক্ষা করতে। রাজনীতির বৃহত্তর অর্থে প্রয়োগটাও হয়নি।
মানুষের মহত্তম কল্যাণের পথটা রাজনীতিই খুলে দেয়। চীন, রাশিয়া, কিউবার বিপ্লবে সে দেশগুলোর জনগণ একটা মুক্তির পথ পেয়েছিল। তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক সব ধর্মান্ধতা এবং গোঁড়ামি থেকে একটা মুক্ত সমাজ গড়েছিলেন। আমাদের দেশেও লাখ লাখ মানুষ দেশের জন্য বড় বড় ত্যাগ স্বীকার করেছেন। কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্ব তা সমাজের কাজে ব্যবহার করতে পারেননি। একটাই বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা হলো ক্ষমতা। ক্ষমতার ব্যবহার এবং অপব্যবহার একটি সমাজের জন্য যে কত ভয়ংকর হতে পারে, তা আমরা দেখেছি। এটা সবাই স্বীকার করছেন, আমরা একটি সংকটকাল পার করছি। তার মধ্যেও মানুষের মনে আশা জাগে—একটা সুদিন আসবে। কীভাবে যে সে আশা পূর্ণ হবে আমি জানি না, কেউ জানে কি না জানি না, তবে কেউ না কেউ নিশ্চয়ই জানেন। জেনে থাকলে আমাদের খবর দেবেন।
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব

আমাদের নিজেদের দেশের খবর এড়ানোর উপায় নেই। এখানে প্রতিদিন অসংখ্য ঘটনা ঘটছে, চাঞ্চল্যকর ঘটনাও। কয়েকটির দিকে তাকানো যেতে পারে। করোনায় ভুগে অনেক মানুষ অকালে মারা গেছে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি মানুষকে কিন্তু আকস্মিকভাবে ও অকালে চলে যেতে হয়েছে সড়ক দুর্ঘটনায়।
১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১
ত্রিমুখী সম্পর্ক নিয়ে অনেক মুভি হয়েছে। এ রকম মুভি দেখেননি, এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। কেবল মুভিতেই কেন, বাস্তবেও ত্রিমুখী সম্পর্কের অনেক ঘটনা আমরা দেখে থাকি। সব ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ত্রিভুজ সম্পর্কের শেষ পরিণতি সাধারণত ভালো হয় না।
১৩ ঘণ্টা আগে
আমরা চব্বিশের আন্দোলন দেখেছি—বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন থেকে যা রূপ নেয় স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে। এর আগপর্যন্ত স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সম্পর্কে জেনেছি নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান এবং নূর হোসেনের আত্মত্যাগের কথা। অনেকে দুটো ঘটনারই সাক্ষী। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর নূর হোসেন শহীদ হন পুলিশের গুলিতে।
১৩ ঘণ্টা আগে
দেশে এমনিতেই ফসলি জমি হ্রাস পাচ্ছে। সেটি কমে যাওয়া মানে খাদ্যের উৎপাদনও কমে যাওয়া। যে কারণে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়ে থাকে, কোনো আবাদি জমি যাতে পতিত না থাকে।
১৩ ঘণ্টা আগেসম্পাদকীয়

দেশে এমনিতেই ফসলি জমি হ্রাস পাচ্ছে। সেটি কমে যাওয়া মানে খাদ্যের উৎপাদনও কমে যাওয়া। যে কারণে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়ে থাকে, কোনো আবাদি জমি যাতে পতিত না থাকে।
সেই ফসলি জমির মাটিই যদি কেটে নেওয়া হয়, তাহলে খাদ্য উৎপাদনের কী হবে! মাদারীপুর সদর উপজেলায় আড়িয়াল খাঁ ও কুমার নদের পাড়ের অন্তত ২০টি স্থান থেকে অবৈধভাবে মাটি কেটে বিক্রি করছেন স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি। তাঁদের একজন হলেন ইলিয়াস চৌকিদার। প্রতিদিন রাত থেকে ভোর পর্যন্ত ট্রলারে করে অবাধে মাটি কেটে নেওয়ার ফলে নদীপাড়ের গ্রামগুলোর মানুষের জীবনে এক বিশাল ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে।
বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০-এর ৪-এর খ ও গ ধারা অনুযায়ী সেতু, কালভার্ট, বাঁধ, সড়ক, রেললাইন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার ১ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে বালু বা মাটি তোলা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু যাঁরা মাটি কাটেন তাঁরা এই আইন মানেন না। আইন অমান্য করার জন্য তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। কিন্তু তাঁদের বিরুদ্ধে কম ক্ষেত্রেই ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়। প্রশাসন অবৈধভাবে মাটি কাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় না কেন, সেটা বোধগম্য নয়।
নদীর পাড় থেকে মাটি কাটার কারণে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হচ্ছে, যা ভাঙনে সহায়তা করবে। শুধু নদীভাঙনই নয়, এভাবে মাটি কাটার ফলে একজন কৃষকের সবজিখেত সরাসরি ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়েছে। কয়েকজন কৃষক অভিযোগ করেছেন, ফসলি জমির মাটি কেটে নেওয়ায় জমির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পাচ্ছে এবং ফলনও কমে গেছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ সত্ত্বেও ইলিয়াস চৌকিদার মাটি কাটা অব্যাহত রেখেছেন। এমনকি প্রতিবাদ করায় তিনি গ্রামের একজনকে ‘চোখ তুলে ফেলার’ হুমকিও দিয়েছেন। ভুক্তভোগী স্থানীয় বাসিন্দারা বহুবার প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দিলেও কোনো আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
অবৈধভাবে এই মাটি কাটা রোধে নদের তীরবর্তী এলাকাগুলোতে নিয়মিত টহলের ব্যবস্থা চালু করা দরকার। কেবল দিনের বেলাতেই নয়, মাটি কাটার মূল সময় অর্থাৎ রাতে ও ভোরে কঠোর নজরদারি বাড়াতে হবে। পাশাপাশি যাঁরা রাজনৈতিক প্রভাবে এ ধরনের অপকর্ম করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। কেবল জরিমানা নয়, মাটি কাটার সরঞ্জাম জব্দ এবং কঠোর কারাদণ্ড নিশ্চিত করতে হবে, যাতে অন্যরা এমন কাজ করার সাহস না পান।
নদীর পাড়ের ফসলি জমি বাঁচানো না গেলে, পুরো গ্রামই একদিন মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে পারে। সে জন্য প্রশাসনকে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, যাতে এই দুই নদ স্বাভাবিকভাবে প্রবাহিত হতে পারে এবং নদের দুই পাড়ের স্থানীয় মানুষজন ভাঙন ও ভূমি হারানোর আতঙ্ক থেকে মুক্তি পান।
অবৈধভাবে মাটি কাটা প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। মাটি ব্যবস্থাপনা নিয়ে সরকারি যে আইন রয়েছে, আমরা সেই আইনের বাস্তবায়ন দেখতে চাই।

দেশে এমনিতেই ফসলি জমি হ্রাস পাচ্ছে। সেটি কমে যাওয়া মানে খাদ্যের উৎপাদনও কমে যাওয়া। যে কারণে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়ে থাকে, কোনো আবাদি জমি যাতে পতিত না থাকে।
সেই ফসলি জমির মাটিই যদি কেটে নেওয়া হয়, তাহলে খাদ্য উৎপাদনের কী হবে! মাদারীপুর সদর উপজেলায় আড়িয়াল খাঁ ও কুমার নদের পাড়ের অন্তত ২০টি স্থান থেকে অবৈধভাবে মাটি কেটে বিক্রি করছেন স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি। তাঁদের একজন হলেন ইলিয়াস চৌকিদার। প্রতিদিন রাত থেকে ভোর পর্যন্ত ট্রলারে করে অবাধে মাটি কেটে নেওয়ার ফলে নদীপাড়ের গ্রামগুলোর মানুষের জীবনে এক বিশাল ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে।
বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০-এর ৪-এর খ ও গ ধারা অনুযায়ী সেতু, কালভার্ট, বাঁধ, সড়ক, রেললাইন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার ১ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে বালু বা মাটি তোলা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু যাঁরা মাটি কাটেন তাঁরা এই আইন মানেন না। আইন অমান্য করার জন্য তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। কিন্তু তাঁদের বিরুদ্ধে কম ক্ষেত্রেই ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়। প্রশাসন অবৈধভাবে মাটি কাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় না কেন, সেটা বোধগম্য নয়।
নদীর পাড় থেকে মাটি কাটার কারণে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হচ্ছে, যা ভাঙনে সহায়তা করবে। শুধু নদীভাঙনই নয়, এভাবে মাটি কাটার ফলে একজন কৃষকের সবজিখেত সরাসরি ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়েছে। কয়েকজন কৃষক অভিযোগ করেছেন, ফসলি জমির মাটি কেটে নেওয়ায় জমির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পাচ্ছে এবং ফলনও কমে গেছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ সত্ত্বেও ইলিয়াস চৌকিদার মাটি কাটা অব্যাহত রেখেছেন। এমনকি প্রতিবাদ করায় তিনি গ্রামের একজনকে ‘চোখ তুলে ফেলার’ হুমকিও দিয়েছেন। ভুক্তভোগী স্থানীয় বাসিন্দারা বহুবার প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দিলেও কোনো আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
অবৈধভাবে এই মাটি কাটা রোধে নদের তীরবর্তী এলাকাগুলোতে নিয়মিত টহলের ব্যবস্থা চালু করা দরকার। কেবল দিনের বেলাতেই নয়, মাটি কাটার মূল সময় অর্থাৎ রাতে ও ভোরে কঠোর নজরদারি বাড়াতে হবে। পাশাপাশি যাঁরা রাজনৈতিক প্রভাবে এ ধরনের অপকর্ম করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। কেবল জরিমানা নয়, মাটি কাটার সরঞ্জাম জব্দ এবং কঠোর কারাদণ্ড নিশ্চিত করতে হবে, যাতে অন্যরা এমন কাজ করার সাহস না পান।
নদীর পাড়ের ফসলি জমি বাঁচানো না গেলে, পুরো গ্রামই একদিন মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে পারে। সে জন্য প্রশাসনকে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, যাতে এই দুই নদ স্বাভাবিকভাবে প্রবাহিত হতে পারে এবং নদের দুই পাড়ের স্থানীয় মানুষজন ভাঙন ও ভূমি হারানোর আতঙ্ক থেকে মুক্তি পান।
অবৈধভাবে মাটি কাটা প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। মাটি ব্যবস্থাপনা নিয়ে সরকারি যে আইন রয়েছে, আমরা সেই আইনের বাস্তবায়ন দেখতে চাই।

আমাদের নিজেদের দেশের খবর এড়ানোর উপায় নেই। এখানে প্রতিদিন অসংখ্য ঘটনা ঘটছে, চাঞ্চল্যকর ঘটনাও। কয়েকটির দিকে তাকানো যেতে পারে। করোনায় ভুগে অনেক মানুষ অকালে মারা গেছে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি মানুষকে কিন্তু আকস্মিকভাবে ও অকালে চলে যেতে হয়েছে সড়ক দুর্ঘটনায়।
১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১
ত্রিমুখী সম্পর্ক নিয়ে অনেক মুভি হয়েছে। এ রকম মুভি দেখেননি, এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। কেবল মুভিতেই কেন, বাস্তবেও ত্রিমুখী সম্পর্কের অনেক ঘটনা আমরা দেখে থাকি। সব ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ত্রিভুজ সম্পর্কের শেষ পরিণতি সাধারণত ভালো হয় না।
১৩ ঘণ্টা আগে
আমরা চব্বিশের আন্দোলন দেখেছি—বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন থেকে যা রূপ নেয় স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে। এর আগপর্যন্ত স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সম্পর্কে জেনেছি নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান এবং নূর হোসেনের আত্মত্যাগের কথা। অনেকে দুটো ঘটনারই সাক্ষী। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর নূর হোসেন শহীদ হন পুলিশের গুলিতে।
১৩ ঘণ্টা আগে
গত এক বছরে আমাদের জাতি এক অভূতপূর্ব রাজনৈতিক প্রজ্ঞা লাভ করেছে। জাতীয় গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ঘরের ভেতর থেকে চায়ের দোকান, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়—সর্বত্রই রাজনৈতিক আলোচনা, পর্যালোচনা এবং সেই সঙ্গে যাঁর যাঁর সুচিন্তিত মন্তব্যও দিয়ে যাচ্ছেন।
১৩ ঘণ্টা আগে