ড. আলা উদ্দিন
দেশে চাল, গম ইত্যাদি খাদ্যের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত মজুত থাকা সত্ত্বেও অভ্যন্তরীণ বাজারে খাদ্যের দাম বাড়ার কারণ প্রতিবছরের সাধারণ ঘটনা হলেও তা খুবই রহস্যজনক। এই রহস্যের ভেতরে দেশের মানুষ অনেকটা বাধ্যগত নাগরিক। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্যশস্য পরিস্থিতি প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে নিরাপদ খাদ্য মজুতের পরিমাণ ১০ লাখ টন, সেখানে খাদ্যশস্যের মজুত ২০ লাখ টন ছাড়িয়েছে। অথচ প্রয়োজনীয় সব খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধিসহ সবজি ও কাঁচাবাজারের ঊর্ধ্বগতি এরই মধ্যে সাধারণ ও মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য নাভিশ্বাস হয়ে উঠেছে। মূল্য স্বাভাবিক করার পরিবর্তে পরোক্ষভাবে যুক্তি বা হুমকিও শোনা যায়—জিনিসপত্রের দাম না বাড়ালে আমদানি বন্ধ হয়ে যাবে, তখন পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যাবে! এই অমোঘ পরিস্থিতি আমাদের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক, নাকি সহগামী?
পবিত্র রমজান মাস আসন্ন। এরই মধ্যে সাধারণ মানুষের উৎকণ্ঠা শোনা যায়। নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে চারদিকে কথাবার্তা শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে বাজারে প্লাস্টিকের চাল পাওয়া যাচ্ছে! এরই মধ্যে খবরের কাগজের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ আশ্বাস দিয়েছে, ‘রমজানে নিত্যপণ্যের বাজার মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকবে।’ এ রকম খবরে প্রথম দিকে মনে একটু আশা জাগে, যেন সত্য হয়! পরক্ষণেই সংবিৎ ফিরে আসে, এটা তো প্রতিবছরই শুনি। বাস্তবটাও তো জানি। এ রকম সংবাদ কিংবা ওপরমহলের আশ্বাস প্রতিবছরই শুভেচ্ছার মতো পাওয়া যায়, প্রতিবছরই নিত্যপণ্যের দাম বাড়ে; তবে তা অবশ্যই মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে। কারণ ক্রয় ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে পণ্য পাওয়ার সুযোগ নেই; অন্তত, সাধারণ মানুষের জন্য। ২০ টাকার জিনিস ১০০ টাকা হলেও মানুষকে কিনতে হয়; কোনো পণ্য আগে যদি এক কেজি কেনা যেত, রমজান বা যেন উৎসবের আগে আগে গুনে গুনে ৫-১০টা করে কেনা হবে; কম খাবে। তবু কেনার ক্ষমতার মধ্যেই থাকবে। কম খেলে কিচ্ছু হয় না! বেশি খেলে গলা ধরে; ওজন বাড়ে। এবার না হয় পাঁচটা করে পেঁয়াজ কেনা হবে; গত বছর যদি তিন কেজি ছোলা কেনা হয়, এবার হয়তো দুই কেজি কেনা যাবে। অর্থাৎ, পরিমাণ কমালেও কেনা বন্ধ হবে না। তাই বলা যায়, আসলেই তা ক্রয়ক্ষমতার মধ্যেই থাকবে।
যাঁরা বেশি পরিমাণে কিনতে পছন্দ করেন, তারা না-হয় গুণগত মানে প্রশ্নে কিছুটা ছাড় দিয়ে তুলনামূলকভাবে কম দামি জিনিস কিনবেন। ছাড় তো দিতেই হবে; হয় দামে কিংবা মানে। তাই বলা যায়, দাম যাই-ই হোক না কেন, তা অবশ্যই ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকবে। জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে বলে কেনাকাটার অভাবে না খেয়ে থাকার কারণে কাউকে মৃত্যুবরণ করতে হবে না। এটাই হয়তো আমাদের জন্য সব থেকে স্বস্তির এবং একমাত্র সান্ত্বনার বিষয়। কেবল নিয়ন্ত্রণ হবে, তবে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে এবং তার নিয়ন্ত্রণক্ষমতা কারোর নেই কিংবা আদৌ কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছেন কি না, সে ব্যাপারে জনগণের মনে নতুন করে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সুযোগ নেই। কারণ বিষয়গুলো দিনের পর দিন, বছরের পর বছর একই রকমভাবে চলে আসছে।
তবে এই গোলোকায়নের যুগে মানুষ সবই জানে, সবই বোঝে। যদিও কিচ্ছুই করার নেই। এখন গ্রামের মানুষও জানেন, পৃথিবীর যেকোনো দেশে যেকোনো বড় ধরনের উৎসবের আগে নিত্যপণ্যের দাম, শৌখিন জিনিসপত্রের দাম এবং পারিবারিক জীবনের প্রয়োজনীয় প্রায় সব দ্রব্যের দাম উল্লেখযোগ্য হারে কম থাকে; বিশেষ ছাড় থাকে। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, যুক্তরাজ্য ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশের মানুষ বিভিন্ন সেলের (sale) অপেক্ষায় থাকে। বিভিন্ন উৎসবের আগে অনেক দেশে বিশেষ বিশেষ সেল দেওয়া হয়। বেশির ভাগ মানুষ, এমনকি ধনীরাও ওই সেলের অপেক্ষায় থাকে এবং বেশির ভাগ মানুষই তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় ঘরের আসবাবপত্র থেকে শুরু করে টেলিভিশন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মোবাইল, জুতা, জামাকাপড় সবকিছু সাধারণত সেল থেকে কিনে থাকে। কোনো কোনো দেশে সারা বছর ধরে সেল অব্যাহত থাকে; একেক এলাকায় একেক সময়; একেক মার্কেটে একেক সময়; পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন পণ্যের ওপর।
অথচ বাংলাদেশে যে সময়টাতে মানুষের সংকট প্রকট, সেই সময়ে যেসব পণ্য অপরিহার্য, সেগুলোর দাম হাতের নাগালের বাইরে যাবেই। প্রতিদিন খবরের কাগজে সংবাদ ছাপা হবে নিত্য/অনিত্য পণ্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে; কিন্তু না, কিছুতেই কিছু হয় না। দাম তার নিজের ইচ্ছার বাইরে কারও কথায় কমে না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এখন এমন স্বাভাবিক ও সহনীয়(!) পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে এটার প্রতিকার অপেক্ষা, কোন পণ্যের দাম কত এবং কোন পণ্য কতটুকু কেনা যাবে সেদিকেই মানুষের মূল আগ্রহ। এ লক্ষ্যে সংবাদপত্রগুলো নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। সংবাদমাধ্যমগুলোয় আজকাল বাজারের জিনিসপত্রের দাম নিয়ে প্রতিবেদন করার জন্য বিশেষ প্রতিনিধিও থাকে। কারণ রাজনীতি, আমলাতন্ত্র, বিনোদন বা খেলাধুলার মতো জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি স্বাভাবিক ঘটনা; যা মানুষ জানতে চায়, তার সামর্থ্যের সঙ্গে সংগতি রেখে কেনাকাটা করার জন্য, খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের জন্য। এ মাসে এক কেজি পেঁয়াজ কিনবে নাকি ১০টা কিনবে; কিংবা এই শীতে সবজি খাবে কি খাবে না—সেসব নির্ধারিত হয় এসব খবর পড়ে। ভাবনা থাকে, বেঁচে থাকলে পরেরবার পরিবর্তনের চেষ্টা করা যাবে!
বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতার বাগ্বিতণ্ডা নিয়েও টিভি মাধ্যমে সংবাদ প্রচারিত হয়; তবে মূল্যবৃদ্ধিতে অভিযোগ বা প্রতিকার চেয়ে আজকাল মানুষ কম কথা বলে। কারণ মানুষ জানে এসব বলে আর লাভ নেই। যারা মালিক, তারাই তো সিদ্ধান্ত নেন। তাই সাধারণ মানুষের ভিন্ন অবস্থান নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সাম্প্রতিক সময়ে ২০ টাকার জিনিস ১০০ টাকা হলেও মানুষ আর বেশি উচ্চবাচ্য করে না। দাম বাড়ছে তো বাড়ুক; একসময় নিশ্চয় কমবে; কিনতে না পারলে কিংবা কম কম খেলে তো আর মানুষ মরে না।
বস্তুত, দিনের পর দিন মানুষ এসব অনিয়ম দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছে এবং বুঝতে পেরেছে এসব বিষয়ের কথাবার্তা বলা অর্থহীন। যাঁরা এগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন, যাঁরা পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে তাঁদের মূলধন বাড়াচ্ছেন মানুষকে শোষণ করে, সেই শোষকদের মানুষ চেনে। তাঁরা ক্ষমতাবলয়ে অবস্থান করেন কিংবা ক্ষমতাবলয়ের সঙ্গে তাঁদের সম্পৃক্ততা ওতপ্রোত। তাই মানুষ দ্রব্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে মুখ খুলতে চায় না। চালের দাম বেড়ে গেলে আলু খাবে, আলুর দাম বেড়ে গেলে কচু খাবে, বাঁশ খাবে। মাঝে মাঝে ভোক্তা অধিকার সংগঠনের কথা টেলিভিশনে দেখা যায়, সংবাদপত্রে ছবিও প্রকাশিত হয়। তাদের দোষ দিয়েও লাভ নেই। তাদের প্রচেষ্টা থাকলেও,দ্রব্যমূল্যের ওপর কারও কোনো অধিকার নেই, নিয়ন্ত্রণ নেই। কেবল নিত্যপণ্যের দাম কেন, বাড়িভাড়া, বাসের ভাড়া সবই বাড়ে এ দেশে। এক অদ্ভুত ব্যাপার, যখন যেটার সংকট বা প্রয়োজন, তখন সেটার দাম বাড়ে। এই দেশে ৫০ টাকার হ্যান্ড স্যানিটাইজারের দাম ১০০ টাকা হয়; ১ টাকার প্যারাসিটামল ৫ টাকা হয়ে যায়; ১০০ টাকার বাসভাড়া ১৫০ টাকা হয়ে যায়।
জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণমুক্ত পরিবেশে বাড়ুক। বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। এই দেশে পবিত্র রমজান কিংবা ঈদের আগে আগে জিনিসপত্রের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ার কী কারণ? সাধারণ মানুষের মনে একটি প্রশ্ন, কেন প্রতিবছর রমজান মাসে ছোলা, দুধ, খেজুর এমনকি মুড়ির দাম বাড়ে? মধ্যপ্রাচ্যের কথা শুনতে পাই, সেখানে রমজান মাসে নামমাত্র মূল্যে খেজুর, ফল, জামা-কাপড়সহ সব পণ্য বিক্রি হয়; অথচ বাংলাদেশে ঘটে তার উল্টো।
তাই এ দেশে লুণ্ঠনকারী আর সাধারণ মানুষের কাছে উৎসবের তাৎপর্য এক নয়। যেকোনো উৎসব বা দুর্যোগে পুঁজিপতিদের লাভের ওপর লাভ; আর সাধারণ মানুষকে তখন পরিমিত থাকতে হয়। তাই রোজার মাসে বাঙালি মুসলিমকে দিনেরাতে সব সময় পরিমিত থাকতে হয়; প্রথমত সিয়াম সাধন বা রোজা রাখার মাধ্যমে; আবার জিনিসপত্র কেনাকাটায় সংযম সাধনের মাধ্যমে। দুর্যোগের সময়ও তাই। তাই পুঁজিপতিদের কাছে উৎসবও যা, দুর্যোগও তা; সবকিছুতেই লাভ। যত দিন না বাংলাদেশের রাজনীতি সত্যিকারের রাজনীতিবিদদের হাতে ফিরে আসছে, তত দিন বাংলাদেশের মানুষকে এই অবস্থার মধ্যে কালাতিপাত করতে হবে। এর বিকল্প নেই। হয় ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে হবে কিংবা ভোগ সামলাতে হবে—এটাই আপাত উপায়।
লেখক: অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
দেশে চাল, গম ইত্যাদি খাদ্যের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত মজুত থাকা সত্ত্বেও অভ্যন্তরীণ বাজারে খাদ্যের দাম বাড়ার কারণ প্রতিবছরের সাধারণ ঘটনা হলেও তা খুবই রহস্যজনক। এই রহস্যের ভেতরে দেশের মানুষ অনেকটা বাধ্যগত নাগরিক। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্যশস্য পরিস্থিতি প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে নিরাপদ খাদ্য মজুতের পরিমাণ ১০ লাখ টন, সেখানে খাদ্যশস্যের মজুত ২০ লাখ টন ছাড়িয়েছে। অথচ প্রয়োজনীয় সব খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধিসহ সবজি ও কাঁচাবাজারের ঊর্ধ্বগতি এরই মধ্যে সাধারণ ও মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য নাভিশ্বাস হয়ে উঠেছে। মূল্য স্বাভাবিক করার পরিবর্তে পরোক্ষভাবে যুক্তি বা হুমকিও শোনা যায়—জিনিসপত্রের দাম না বাড়ালে আমদানি বন্ধ হয়ে যাবে, তখন পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যাবে! এই অমোঘ পরিস্থিতি আমাদের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক, নাকি সহগামী?
পবিত্র রমজান মাস আসন্ন। এরই মধ্যে সাধারণ মানুষের উৎকণ্ঠা শোনা যায়। নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে চারদিকে কথাবার্তা শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে বাজারে প্লাস্টিকের চাল পাওয়া যাচ্ছে! এরই মধ্যে খবরের কাগজের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ আশ্বাস দিয়েছে, ‘রমজানে নিত্যপণ্যের বাজার মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকবে।’ এ রকম খবরে প্রথম দিকে মনে একটু আশা জাগে, যেন সত্য হয়! পরক্ষণেই সংবিৎ ফিরে আসে, এটা তো প্রতিবছরই শুনি। বাস্তবটাও তো জানি। এ রকম সংবাদ কিংবা ওপরমহলের আশ্বাস প্রতিবছরই শুভেচ্ছার মতো পাওয়া যায়, প্রতিবছরই নিত্যপণ্যের দাম বাড়ে; তবে তা অবশ্যই মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে। কারণ ক্রয় ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে পণ্য পাওয়ার সুযোগ নেই; অন্তত, সাধারণ মানুষের জন্য। ২০ টাকার জিনিস ১০০ টাকা হলেও মানুষকে কিনতে হয়; কোনো পণ্য আগে যদি এক কেজি কেনা যেত, রমজান বা যেন উৎসবের আগে আগে গুনে গুনে ৫-১০টা করে কেনা হবে; কম খাবে। তবু কেনার ক্ষমতার মধ্যেই থাকবে। কম খেলে কিচ্ছু হয় না! বেশি খেলে গলা ধরে; ওজন বাড়ে। এবার না হয় পাঁচটা করে পেঁয়াজ কেনা হবে; গত বছর যদি তিন কেজি ছোলা কেনা হয়, এবার হয়তো দুই কেজি কেনা যাবে। অর্থাৎ, পরিমাণ কমালেও কেনা বন্ধ হবে না। তাই বলা যায়, আসলেই তা ক্রয়ক্ষমতার মধ্যেই থাকবে।
যাঁরা বেশি পরিমাণে কিনতে পছন্দ করেন, তারা না-হয় গুণগত মানে প্রশ্নে কিছুটা ছাড় দিয়ে তুলনামূলকভাবে কম দামি জিনিস কিনবেন। ছাড় তো দিতেই হবে; হয় দামে কিংবা মানে। তাই বলা যায়, দাম যাই-ই হোক না কেন, তা অবশ্যই ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকবে। জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে বলে কেনাকাটার অভাবে না খেয়ে থাকার কারণে কাউকে মৃত্যুবরণ করতে হবে না। এটাই হয়তো আমাদের জন্য সব থেকে স্বস্তির এবং একমাত্র সান্ত্বনার বিষয়। কেবল নিয়ন্ত্রণ হবে, তবে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে এবং তার নিয়ন্ত্রণক্ষমতা কারোর নেই কিংবা আদৌ কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছেন কি না, সে ব্যাপারে জনগণের মনে নতুন করে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সুযোগ নেই। কারণ বিষয়গুলো দিনের পর দিন, বছরের পর বছর একই রকমভাবে চলে আসছে।
তবে এই গোলোকায়নের যুগে মানুষ সবই জানে, সবই বোঝে। যদিও কিচ্ছুই করার নেই। এখন গ্রামের মানুষও জানেন, পৃথিবীর যেকোনো দেশে যেকোনো বড় ধরনের উৎসবের আগে নিত্যপণ্যের দাম, শৌখিন জিনিসপত্রের দাম এবং পারিবারিক জীবনের প্রয়োজনীয় প্রায় সব দ্রব্যের দাম উল্লেখযোগ্য হারে কম থাকে; বিশেষ ছাড় থাকে। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, যুক্তরাজ্য ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশের মানুষ বিভিন্ন সেলের (sale) অপেক্ষায় থাকে। বিভিন্ন উৎসবের আগে অনেক দেশে বিশেষ বিশেষ সেল দেওয়া হয়। বেশির ভাগ মানুষ, এমনকি ধনীরাও ওই সেলের অপেক্ষায় থাকে এবং বেশির ভাগ মানুষই তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় ঘরের আসবাবপত্র থেকে শুরু করে টেলিভিশন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মোবাইল, জুতা, জামাকাপড় সবকিছু সাধারণত সেল থেকে কিনে থাকে। কোনো কোনো দেশে সারা বছর ধরে সেল অব্যাহত থাকে; একেক এলাকায় একেক সময়; একেক মার্কেটে একেক সময়; পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন পণ্যের ওপর।
অথচ বাংলাদেশে যে সময়টাতে মানুষের সংকট প্রকট, সেই সময়ে যেসব পণ্য অপরিহার্য, সেগুলোর দাম হাতের নাগালের বাইরে যাবেই। প্রতিদিন খবরের কাগজে সংবাদ ছাপা হবে নিত্য/অনিত্য পণ্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে; কিন্তু না, কিছুতেই কিছু হয় না। দাম তার নিজের ইচ্ছার বাইরে কারও কথায় কমে না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এখন এমন স্বাভাবিক ও সহনীয়(!) পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে এটার প্রতিকার অপেক্ষা, কোন পণ্যের দাম কত এবং কোন পণ্য কতটুকু কেনা যাবে সেদিকেই মানুষের মূল আগ্রহ। এ লক্ষ্যে সংবাদপত্রগুলো নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। সংবাদমাধ্যমগুলোয় আজকাল বাজারের জিনিসপত্রের দাম নিয়ে প্রতিবেদন করার জন্য বিশেষ প্রতিনিধিও থাকে। কারণ রাজনীতি, আমলাতন্ত্র, বিনোদন বা খেলাধুলার মতো জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি স্বাভাবিক ঘটনা; যা মানুষ জানতে চায়, তার সামর্থ্যের সঙ্গে সংগতি রেখে কেনাকাটা করার জন্য, খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের জন্য। এ মাসে এক কেজি পেঁয়াজ কিনবে নাকি ১০টা কিনবে; কিংবা এই শীতে সবজি খাবে কি খাবে না—সেসব নির্ধারিত হয় এসব খবর পড়ে। ভাবনা থাকে, বেঁচে থাকলে পরেরবার পরিবর্তনের চেষ্টা করা যাবে!
বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতার বাগ্বিতণ্ডা নিয়েও টিভি মাধ্যমে সংবাদ প্রচারিত হয়; তবে মূল্যবৃদ্ধিতে অভিযোগ বা প্রতিকার চেয়ে আজকাল মানুষ কম কথা বলে। কারণ মানুষ জানে এসব বলে আর লাভ নেই। যারা মালিক, তারাই তো সিদ্ধান্ত নেন। তাই সাধারণ মানুষের ভিন্ন অবস্থান নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সাম্প্রতিক সময়ে ২০ টাকার জিনিস ১০০ টাকা হলেও মানুষ আর বেশি উচ্চবাচ্য করে না। দাম বাড়ছে তো বাড়ুক; একসময় নিশ্চয় কমবে; কিনতে না পারলে কিংবা কম কম খেলে তো আর মানুষ মরে না।
বস্তুত, দিনের পর দিন মানুষ এসব অনিয়ম দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছে এবং বুঝতে পেরেছে এসব বিষয়ের কথাবার্তা বলা অর্থহীন। যাঁরা এগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন, যাঁরা পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে তাঁদের মূলধন বাড়াচ্ছেন মানুষকে শোষণ করে, সেই শোষকদের মানুষ চেনে। তাঁরা ক্ষমতাবলয়ে অবস্থান করেন কিংবা ক্ষমতাবলয়ের সঙ্গে তাঁদের সম্পৃক্ততা ওতপ্রোত। তাই মানুষ দ্রব্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে মুখ খুলতে চায় না। চালের দাম বেড়ে গেলে আলু খাবে, আলুর দাম বেড়ে গেলে কচু খাবে, বাঁশ খাবে। মাঝে মাঝে ভোক্তা অধিকার সংগঠনের কথা টেলিভিশনে দেখা যায়, সংবাদপত্রে ছবিও প্রকাশিত হয়। তাদের দোষ দিয়েও লাভ নেই। তাদের প্রচেষ্টা থাকলেও,দ্রব্যমূল্যের ওপর কারও কোনো অধিকার নেই, নিয়ন্ত্রণ নেই। কেবল নিত্যপণ্যের দাম কেন, বাড়িভাড়া, বাসের ভাড়া সবই বাড়ে এ দেশে। এক অদ্ভুত ব্যাপার, যখন যেটার সংকট বা প্রয়োজন, তখন সেটার দাম বাড়ে। এই দেশে ৫০ টাকার হ্যান্ড স্যানিটাইজারের দাম ১০০ টাকা হয়; ১ টাকার প্যারাসিটামল ৫ টাকা হয়ে যায়; ১০০ টাকার বাসভাড়া ১৫০ টাকা হয়ে যায়।
জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণমুক্ত পরিবেশে বাড়ুক। বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। এই দেশে পবিত্র রমজান কিংবা ঈদের আগে আগে জিনিসপত্রের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ার কী কারণ? সাধারণ মানুষের মনে একটি প্রশ্ন, কেন প্রতিবছর রমজান মাসে ছোলা, দুধ, খেজুর এমনকি মুড়ির দাম বাড়ে? মধ্যপ্রাচ্যের কথা শুনতে পাই, সেখানে রমজান মাসে নামমাত্র মূল্যে খেজুর, ফল, জামা-কাপড়সহ সব পণ্য বিক্রি হয়; অথচ বাংলাদেশে ঘটে তার উল্টো।
তাই এ দেশে লুণ্ঠনকারী আর সাধারণ মানুষের কাছে উৎসবের তাৎপর্য এক নয়। যেকোনো উৎসব বা দুর্যোগে পুঁজিপতিদের লাভের ওপর লাভ; আর সাধারণ মানুষকে তখন পরিমিত থাকতে হয়। তাই রোজার মাসে বাঙালি মুসলিমকে দিনেরাতে সব সময় পরিমিত থাকতে হয়; প্রথমত সিয়াম সাধন বা রোজা রাখার মাধ্যমে; আবার জিনিসপত্র কেনাকাটায় সংযম সাধনের মাধ্যমে। দুর্যোগের সময়ও তাই। তাই পুঁজিপতিদের কাছে উৎসবও যা, দুর্যোগও তা; সবকিছুতেই লাভ। যত দিন না বাংলাদেশের রাজনীতি সত্যিকারের রাজনীতিবিদদের হাতে ফিরে আসছে, তত দিন বাংলাদেশের মানুষকে এই অবস্থার মধ্যে কালাতিপাত করতে হবে। এর বিকল্প নেই। হয় ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে হবে কিংবা ভোগ সামলাতে হবে—এটাই আপাত উপায়।
লেখক: অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
রাখাইনে প্রস্তাবিত মানবিক করিডর বাস্তবায়নের আড়ালে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত স্বার্থ এবং চীন-ভারতের প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশকে জটিল ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানে ফেলতে পারে। এটি শুধু সীমান্ত নয়, বরং দেশের নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক ভারসাম্যকেও হুমকির মুখে ফেলতে পারে।
১১ ঘণ্টা আগেসম্প্রতি টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীতে একটি পাঠাগারে আক্রমণ চালিয়ে কিছু ব্যক্তি সব বইপুস্তক নিয়ে যায়। তাদের ইচ্ছে ছিল আগুন দিয়ে লাইব্রেরিটি ধ্বংস করে দেওয়া। কিন্তু একজন পুলিশ অফিসারের হস্তক্ষেপে লাইব্রেরিটি ভস্মীভূত হওয়া থেকে মুক্তি পায়।
১ দিন আগেমে দিবস আসে প্রতিবছর, আসে শ্রমিকের অধিকার ও মর্যাদার কথা মনে করিয়ে দিতে। ১৮৮৬ সালের শিকাগোর হে মার্কেট আন্দোলনের আগুন আজও নিভে যায়নি, বরং সময়ের পরম্পরায় সেই আগুনই আলো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে শ্রমিকশ্রেণির অধিকারের প্রশ্নে।
১ দিন আগেজার্মানির বিজ্ঞানী ও লেখক গেয়র্গ ক্রিস্টফ লিশটেনব্যর্গ তাঁর দার্শনিক নিবন্ধের এক জায়গায় বলেছিলেন, ‘সনাতনপন্থীরা এ-কথা মনে রাখেন না যে, মানুষের বিশ্বাস তাদের জ্ঞান এবং ইতিহাসের সাধারণ পরিবর্তনের ধারা অনুযায়ী বদলায়।
১ দিন আগে