এম আর খায়রুল উমাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত ছিলেন। ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশের (আইডিইবি) সাবেক সভাপতি। তিনি পেশাজীবী ও সামাজিক সংগঠনের কর্মী এবং কলাম লেখক। তাঁর সঙ্গে বিএসসি এবং ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বর্তমান আন্দোলন নিয়ে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানা।
মাসুদ রানা
বিএসসি এবং ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের কাজের সুযোগ, পদোন্নতি এবং বেতন-ভাতার যে বৈষম্য দেখা যায়, তার মূল কারণগুলো কী বলে আপনি মনে করেন?
দেশের প্রকৌশল ও কারিগরি কর্মকাণ্ড পরিচালনায় বিএসসি এবং ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করার কথা। যেকোনো উন্নয়ন কার্যক্রমের সুন্দর, সফল বাস্তবায়নের জন্য তা জরুরিও। যেকোনো দেশ ও জাতি একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সামনে রেখে জনবল তৈরি করে। প্রত্যাশা করে সবার মিলিত প্রয়াসে জনকল্যাণ নিশ্চিত হবে। জাতি তার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সুচারুরূপে পরিচালনার জন্য বিএসসি প্রকৌশলী তৈরি করেছে। তাঁদের কাজ প্ল্যানিং, ডিজাইন এবং রিসার্চ। আর ডিপ্লোমা প্রকৌশলী তৈরি করা হয়েছে বিএসসি প্রকৌশলীদের কাজের এক্সিকিউশন ও সুপারভিশন করার জন্য। যেহেতু শিক্ষা পৃথক, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পৃথক, ফলে ‘বৈষম্য’ কথাটা যথাযথ মনে হয় না। তবে ‘বৈষম্য’ না হলেও কাজের ক্ষেত্রে যে সমস্যা আছে তা প্রকাশ্য।
দেশে শিক্ষা অনুযায়ী কর্মের বিভাজন নেই। একজন অন্যের কাজের মধ্যে চলে আসছেন। দেশ যাঁকে যে কাজের জন্য তৈরি করেছে, তিনি যদি সেই কাজে নিয়োজিত থাকেন, তাহলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। কোনো দ্বন্দ্বই থাকে না। কিন্তু দেশের সর্বত্র নিরাময়ের পথ না খুঁজে, ব্যথা প্রশমনের প্রলেপ সন্ধান করার প্রবণতা প্রকট। ফলে যুগের পর যুগ সমস্যার সমাধান হয় না। দেশ ও জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
‘প্রকৌশলী’ উপাধি শুধু বিএসসি প্রকৌশলীদের জন্য সীমাবদ্ধ রাখার দাবি কেন করা হচ্ছে? এই উপাধি ব্যবহারে কী এমন পার্থক্য তৈরি হবে, যা উভয় পক্ষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ?
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের মাঝে সাম্য, আইনের শাসন ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশা জাগিয়েছিল। সেই প্রত্যাশা আমরা কখন, কীভাবে, কোথায় হারিয়ে ফেলেছি, তা বিজ্ঞজনেরাই বলতে পারবেন। সাধারণ মানুষ শুধু দেখছে সেই হারিয়ে ফেলা প্রত্যাশার বুকে পা দিয়ে একটা অভিজাত সমাজ উঠে আসছে। দেশের একশ্রেণির মানুষ নিজেকে অভিজাত করার প্রতিযোগিতায় দুই চোখ বন্ধ করে দৌড়াচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে নিজেদের নামের আগে একটা উপাধি বসিয়ে তারা যে সাধারণের থেকে আলাদা, তা বোঝাতে চায়। বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে, মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা আমাদের মধ্যে জাগ্রত হলে আমরা এমন সব দাবি থেকে বের হয়ে আসতে পারব।
অভিজাত সমাজব্যবস্থায় উপাধির গুরুত্ব অপরিসীম। উপাধি বিক্রি করে খেতাবধারীরা সমাজে স্থান করে নেন। তাই আধুনিক সভ্যতার সব রকম সুবিধায় লালিত-পালিত ভদ্র সন্তানেরা রাস্তায় মারপিট করে, স্লোগান দিয়ে, মিছিল করে নিজেদের দাবি প্রতিষ্ঠায় নিবেদিত। কেউ বিশ্বাস করে না যে প্রতিজন মানুষের কর্মই হচ্ছে তার স্বীকৃতি। দেশের প্রকৌশলীদের যে ডিগ্রি দেওয়া হয়ে থাকে, তা হচ্ছে বিএসসি-ইন-ইঞ্জিনিয়ারিং। এটা যদি ‘প্রকৌশলী’ উপাধিতে সীমাবদ্ধ রাখা হয়, তাহলে যাঁরা মাস্টার্স শেষ করেন তাঁদের উপাধি কী হবে? এ প্রশ্ন কেউ করে না। সাধারণ মানুষ শুধু দেখে, ওনারা ‘প্রকৌশলী’ উপাধি ব্যবহার করে অভিজাতের তালিকায় নাম লিখিয়েছেন। সে কারণেই ডিপ্লোমা-ইন-ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করা অনেকেই ‘প্রকৌশলী’ উপাধি ব্যবহার করে অভিজাত হওয়ার প্রচেষ্টায় রত।
বিএসসি প্রকৌশলীরা কেন মনে করেন যে নবম গ্রেডের সহকারী প্রকৌশলী পদে শুধু তাঁদের নিয়োগ দেওয়া উচিত?
স্বাধীনতা লাভের পর থেকে আজ পর্যন্ত মানবসম্পদ নিয়ে দেশের কোনো পরিকল্পনা নেই। তাই কোন পেশায় কত জনশক্তি প্রয়োজন, তার হিসাব কারও কাছে নেই। সে কারণে ক্ষমতার বলয়ে থাকা মানুষেরা রাজনৈতিক ও ব্যক্তিস্বার্থে তাদের ইচ্ছেমতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে এবং সে প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের সনদ দিয়ে কর্মক্ষেত্রে যুদ্ধে নামিয়ে দিচ্ছে। আমরা এই শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারি, কিন্তু দেশের ভবিষ্যৎ প্রতিনিধি হিসেবে তাঁদের ফেলে দেওয়া খুব কঠিন। আমাদের দেশে অভিভাবকেরা নিজ সন্তানকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত দেখতে চান। এই চাওয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পায় প্রকৌশলী ও চিকিৎসক। যেহেতু দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থাই পরিকল্পনাহীন এবং কর্মক্ষেত্রে সুযোগ সীমিত, ফলে কর্মযুদ্ধে নিজেদের অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করার মানসে বিএসসি প্রকৌশলীদের এমন দাবি স্বাভাবিক।
বিএসসি প্রকৌশলীরা নিজেদের মেধা ও যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে সহকারী প্রকৌশলী নয়, প্রকৌশলী পদের দাবিদার। বিএসসি প্রকৌশলীরা দেশের শিল্পায়নে এবং আধুনিক কৃষির উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারেন, প্রাকৃতিক গ্যাসের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারেন, বিদেশি পরিকল্পনায় যমুনা সেতুর অভিজ্ঞতা থেকে দ্বিতীয় পদ্মা সেতুর প্ল্যানিং করতে পারেন, অতীত বিদেশি পরিকল্পনা দেখে নিজ মেধায় তিস্তা ব্যারাজ তৈরি করতে পারেন। এ কাজগুলো শুরু করতে পারলে জনগণই স্নাতক প্রকৌশলীদের পঞ্চম গ্রেডে দায়িত্ব পালনে বাধাহীন সমর্থন দিয়ে যাবে।
আজ দেশের উন্নয়ন অবকাঠামোর কোনো জীবনমান নেই। অবকাঠামো কত দিন জীবন পাবে কেউ তার নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। একটাও উন্নয়ন প্রকল্প পাওয়া যাবে না, যা প্রাক্কলিত মূল্যে ও সময়ে শেষ করা গেছে। বিএসসি প্রকৌশলীরা যদি নিজেদের মেধার বিকাশ এখানে প্রয়োগ করে দেশ ও জাতির অর্থনৈতিক মুক্তিতে ভূমিকা রাখেন, তবে জনগণই তাঁদের দাবি পূরণে এগিয়ে আসবে।
ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের জন্য সরকার সহকারী প্রকৌশলী পদের যে কোটা দিয়েছে, তা প্রকৃত অর্থে একটা গোঁজামিল। বিজ্ঞজনেরা বলে থাকেন, দেশের প্রকৌশল ও কারিগরি কর্মকাণ্ডের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ কাজই এক্সিকিউশন ও সুপারভিশনের, যা ডিপ্লোমা-ইন-ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। এ বিবেচনায় মাঠপর্যায়ের শতভাগ পদ ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের অধিকারে থাকার কথা, সেখানে কোটা তাঁদের বঞ্চিত করেছে।
উপসহকারী প্রকৌশলী পদটি ঐতিহ্যগতভাবে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের জন্য সংরক্ষিত। বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারদের কেন এই পদে আবেদন করার সুযোগ থাকা উচিত বলে তাঁরা মনে করেন? এতে তো ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের চাকরি পেতে সমস্যা হওয়ার কথা।
বাংলাদেশের শতকরা এক ভাগ মানুষও বিশ্বাস করে কি না সন্দেহ আছে যে, একজন বিশেষায়িত পেশাজীবী তৈরিতে সাধারণ জনগণের করের একটা বিরাট অংশ ব্যয় হয়। শুধু মেধা ও পারিবারিক বৈভব কাউকে পেশাজীবী করে না। একজন বিশেষায়িত পেশাজীবী তৈরি করতে পারিবারিক ব্যয়ের কয়েক গুণ বেশি সরকারি ব্যয় হয়ে থাকে। তাই দেশ ও জাতির কল্যাণে প্রতিটি পেশার মানুষের কাছ থেকে সর্বোচ্চ প্রতিদান দেশবাসী প্রত্যাশা করে। কিন্তু আমাদের মেধাবী সন্তানেরা নিজ নিজ পেশার জন্য নির্ধারিত সুযোগ গ্রহণের চেয়ে অন্য পেশায় নিয়োজিত হয়ে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনে দারুণ পছন্দ করে থাকেন। জাতীয় ক্ষতি বিবেচনায় পেশা পরিবর্তনের প্রতিযোগিতা অবিলম্বে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। বিএসসি প্রকৌশলীরা তাঁদের মেধা ও তত্ত্বীয় জ্ঞানের কারণে প্রকৌশল ও কারিগরি কর্মক্ষেত্রে যেকোনো পদ দখলে সক্ষম, এ ক্ষেত্রে তাঁদের সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তবে পদ দখল করতে পারলেও তত্ত্বীয় জ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগ তাঁদের পক্ষে যথাযথভাবে, সুচারুরূপে করা কঠিন। কারণ, যেকোনো প্রকল্প সফল করতে তিন ধরনের পেশাজীবী প্রয়োজন হয়ে থাকে। এখানে কেউ কারও বিকল্প নয়, একে অন্যের পরিপূরক। তারপরেও বিএসসি প্রকৌশলীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার যদি শিক্ষা অনুযায়ী কর্মকে গুরুত্ব না দিয়ে পাইলট দিয়ে গরুর গাড়ি চালাতে চায়, তাহলে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের কর্মসংস্থানে সমস্যা হলেও করার কিছু নেই। তবে সরকারের হঠকারী সিদ্ধান্তের ফলে দেশের চিকিৎসাসেবার যে বেহাল অবস্থা হয়েছে, এখানেও তা-ই হবে। বিদেশনির্ভরতা এখনো আছে, ভবিষ্যতে তা আরও বাড়বে।
ডিপ্লোমা প্রকৌশলীরা প্রায়ই অভিযোগ করেন যে তাঁদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও বিএসসি প্রকৌশলীদের তুলনায় কম মূল্যায়ন করা হয়। এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী?
ডিপ্লোমা প্রকৌশলী বা পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের সব সমস্যা সমাধানের ভার উচ্চ সরকারি পদে আসীন বিএসসি প্রকৌশলীদের হাতে। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে, বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিত অভিজাতরা নিজের নীল রক্তকে নীল রাখার তাগিদে দেশ ও জাতির কল্যাণের কথা ভুলে গেছেন। বিএসসি প্রকৌশলী ও ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের ভিন্নতা থাকলেও কাজের ক্ষেত্র কিন্তু পৃথক নয়। মাঠপর্যায়ে যে যার পদ অনুযায়ী একই কাজ করে থাকে। এখানেই অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার অবমূল্যায়ন। শিক্ষা অনুযায়ী কর্মের সুযোগ সৃষ্টি এবং সাধারণ সম্মান শিক্ষার মতো প্রকৌশল শিক্ষাকে যদি একমুখী করা যায়, তাহলে আজকের বিভেদ নিরসন সম্ভব। পরস্পর পরস্পরের প্রতি সম্মান রেখে ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যাবে। তাই ‘নিজের জন্য সামনে ফাঁকা মাঠ চাই আর পেছনে যারা আছে তাদের জন্য সামান্য গলিও রাখা চলবে না’–এ মানসিকতা থেকে বিএসসি প্রকৌশলীদের বেরিয়ে আসার আহ্বান জানাই। তাতেই জাতি হিসেবে আমাদের মঙ্গল হবে।
বিএসসি এবং ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের কাজের সুযোগ, পদোন্নতি এবং বেতন-ভাতার যে বৈষম্য দেখা যায়, তার মূল কারণগুলো কী বলে আপনি মনে করেন?
দেশের প্রকৌশল ও কারিগরি কর্মকাণ্ড পরিচালনায় বিএসসি এবং ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করার কথা। যেকোনো উন্নয়ন কার্যক্রমের সুন্দর, সফল বাস্তবায়নের জন্য তা জরুরিও। যেকোনো দেশ ও জাতি একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সামনে রেখে জনবল তৈরি করে। প্রত্যাশা করে সবার মিলিত প্রয়াসে জনকল্যাণ নিশ্চিত হবে। জাতি তার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সুচারুরূপে পরিচালনার জন্য বিএসসি প্রকৌশলী তৈরি করেছে। তাঁদের কাজ প্ল্যানিং, ডিজাইন এবং রিসার্চ। আর ডিপ্লোমা প্রকৌশলী তৈরি করা হয়েছে বিএসসি প্রকৌশলীদের কাজের এক্সিকিউশন ও সুপারভিশন করার জন্য। যেহেতু শিক্ষা পৃথক, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পৃথক, ফলে ‘বৈষম্য’ কথাটা যথাযথ মনে হয় না। তবে ‘বৈষম্য’ না হলেও কাজের ক্ষেত্রে যে সমস্যা আছে তা প্রকাশ্য।
দেশে শিক্ষা অনুযায়ী কর্মের বিভাজন নেই। একজন অন্যের কাজের মধ্যে চলে আসছেন। দেশ যাঁকে যে কাজের জন্য তৈরি করেছে, তিনি যদি সেই কাজে নিয়োজিত থাকেন, তাহলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। কোনো দ্বন্দ্বই থাকে না। কিন্তু দেশের সর্বত্র নিরাময়ের পথ না খুঁজে, ব্যথা প্রশমনের প্রলেপ সন্ধান করার প্রবণতা প্রকট। ফলে যুগের পর যুগ সমস্যার সমাধান হয় না। দেশ ও জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
‘প্রকৌশলী’ উপাধি শুধু বিএসসি প্রকৌশলীদের জন্য সীমাবদ্ধ রাখার দাবি কেন করা হচ্ছে? এই উপাধি ব্যবহারে কী এমন পার্থক্য তৈরি হবে, যা উভয় পক্ষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ?
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের মাঝে সাম্য, আইনের শাসন ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশা জাগিয়েছিল। সেই প্রত্যাশা আমরা কখন, কীভাবে, কোথায় হারিয়ে ফেলেছি, তা বিজ্ঞজনেরাই বলতে পারবেন। সাধারণ মানুষ শুধু দেখছে সেই হারিয়ে ফেলা প্রত্যাশার বুকে পা দিয়ে একটা অভিজাত সমাজ উঠে আসছে। দেশের একশ্রেণির মানুষ নিজেকে অভিজাত করার প্রতিযোগিতায় দুই চোখ বন্ধ করে দৌড়াচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে নিজেদের নামের আগে একটা উপাধি বসিয়ে তারা যে সাধারণের থেকে আলাদা, তা বোঝাতে চায়। বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে, মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা আমাদের মধ্যে জাগ্রত হলে আমরা এমন সব দাবি থেকে বের হয়ে আসতে পারব।
অভিজাত সমাজব্যবস্থায় উপাধির গুরুত্ব অপরিসীম। উপাধি বিক্রি করে খেতাবধারীরা সমাজে স্থান করে নেন। তাই আধুনিক সভ্যতার সব রকম সুবিধায় লালিত-পালিত ভদ্র সন্তানেরা রাস্তায় মারপিট করে, স্লোগান দিয়ে, মিছিল করে নিজেদের দাবি প্রতিষ্ঠায় নিবেদিত। কেউ বিশ্বাস করে না যে প্রতিজন মানুষের কর্মই হচ্ছে তার স্বীকৃতি। দেশের প্রকৌশলীদের যে ডিগ্রি দেওয়া হয়ে থাকে, তা হচ্ছে বিএসসি-ইন-ইঞ্জিনিয়ারিং। এটা যদি ‘প্রকৌশলী’ উপাধিতে সীমাবদ্ধ রাখা হয়, তাহলে যাঁরা মাস্টার্স শেষ করেন তাঁদের উপাধি কী হবে? এ প্রশ্ন কেউ করে না। সাধারণ মানুষ শুধু দেখে, ওনারা ‘প্রকৌশলী’ উপাধি ব্যবহার করে অভিজাতের তালিকায় নাম লিখিয়েছেন। সে কারণেই ডিপ্লোমা-ইন-ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করা অনেকেই ‘প্রকৌশলী’ উপাধি ব্যবহার করে অভিজাত হওয়ার প্রচেষ্টায় রত।
বিএসসি প্রকৌশলীরা কেন মনে করেন যে নবম গ্রেডের সহকারী প্রকৌশলী পদে শুধু তাঁদের নিয়োগ দেওয়া উচিত?
স্বাধীনতা লাভের পর থেকে আজ পর্যন্ত মানবসম্পদ নিয়ে দেশের কোনো পরিকল্পনা নেই। তাই কোন পেশায় কত জনশক্তি প্রয়োজন, তার হিসাব কারও কাছে নেই। সে কারণে ক্ষমতার বলয়ে থাকা মানুষেরা রাজনৈতিক ও ব্যক্তিস্বার্থে তাদের ইচ্ছেমতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে এবং সে প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের সনদ দিয়ে কর্মক্ষেত্রে যুদ্ধে নামিয়ে দিচ্ছে। আমরা এই শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারি, কিন্তু দেশের ভবিষ্যৎ প্রতিনিধি হিসেবে তাঁদের ফেলে দেওয়া খুব কঠিন। আমাদের দেশে অভিভাবকেরা নিজ সন্তানকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত দেখতে চান। এই চাওয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পায় প্রকৌশলী ও চিকিৎসক। যেহেতু দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থাই পরিকল্পনাহীন এবং কর্মক্ষেত্রে সুযোগ সীমিত, ফলে কর্মযুদ্ধে নিজেদের অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করার মানসে বিএসসি প্রকৌশলীদের এমন দাবি স্বাভাবিক।
বিএসসি প্রকৌশলীরা নিজেদের মেধা ও যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে সহকারী প্রকৌশলী নয়, প্রকৌশলী পদের দাবিদার। বিএসসি প্রকৌশলীরা দেশের শিল্পায়নে এবং আধুনিক কৃষির উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারেন, প্রাকৃতিক গ্যাসের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারেন, বিদেশি পরিকল্পনায় যমুনা সেতুর অভিজ্ঞতা থেকে দ্বিতীয় পদ্মা সেতুর প্ল্যানিং করতে পারেন, অতীত বিদেশি পরিকল্পনা দেখে নিজ মেধায় তিস্তা ব্যারাজ তৈরি করতে পারেন। এ কাজগুলো শুরু করতে পারলে জনগণই স্নাতক প্রকৌশলীদের পঞ্চম গ্রেডে দায়িত্ব পালনে বাধাহীন সমর্থন দিয়ে যাবে।
আজ দেশের উন্নয়ন অবকাঠামোর কোনো জীবনমান নেই। অবকাঠামো কত দিন জীবন পাবে কেউ তার নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। একটাও উন্নয়ন প্রকল্প পাওয়া যাবে না, যা প্রাক্কলিত মূল্যে ও সময়ে শেষ করা গেছে। বিএসসি প্রকৌশলীরা যদি নিজেদের মেধার বিকাশ এখানে প্রয়োগ করে দেশ ও জাতির অর্থনৈতিক মুক্তিতে ভূমিকা রাখেন, তবে জনগণই তাঁদের দাবি পূরণে এগিয়ে আসবে।
ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের জন্য সরকার সহকারী প্রকৌশলী পদের যে কোটা দিয়েছে, তা প্রকৃত অর্থে একটা গোঁজামিল। বিজ্ঞজনেরা বলে থাকেন, দেশের প্রকৌশল ও কারিগরি কর্মকাণ্ডের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ কাজই এক্সিকিউশন ও সুপারভিশনের, যা ডিপ্লোমা-ইন-ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। এ বিবেচনায় মাঠপর্যায়ের শতভাগ পদ ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের অধিকারে থাকার কথা, সেখানে কোটা তাঁদের বঞ্চিত করেছে।
উপসহকারী প্রকৌশলী পদটি ঐতিহ্যগতভাবে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের জন্য সংরক্ষিত। বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারদের কেন এই পদে আবেদন করার সুযোগ থাকা উচিত বলে তাঁরা মনে করেন? এতে তো ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের চাকরি পেতে সমস্যা হওয়ার কথা।
বাংলাদেশের শতকরা এক ভাগ মানুষও বিশ্বাস করে কি না সন্দেহ আছে যে, একজন বিশেষায়িত পেশাজীবী তৈরিতে সাধারণ জনগণের করের একটা বিরাট অংশ ব্যয় হয়। শুধু মেধা ও পারিবারিক বৈভব কাউকে পেশাজীবী করে না। একজন বিশেষায়িত পেশাজীবী তৈরি করতে পারিবারিক ব্যয়ের কয়েক গুণ বেশি সরকারি ব্যয় হয়ে থাকে। তাই দেশ ও জাতির কল্যাণে প্রতিটি পেশার মানুষের কাছ থেকে সর্বোচ্চ প্রতিদান দেশবাসী প্রত্যাশা করে। কিন্তু আমাদের মেধাবী সন্তানেরা নিজ নিজ পেশার জন্য নির্ধারিত সুযোগ গ্রহণের চেয়ে অন্য পেশায় নিয়োজিত হয়ে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনে দারুণ পছন্দ করে থাকেন। জাতীয় ক্ষতি বিবেচনায় পেশা পরিবর্তনের প্রতিযোগিতা অবিলম্বে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। বিএসসি প্রকৌশলীরা তাঁদের মেধা ও তত্ত্বীয় জ্ঞানের কারণে প্রকৌশল ও কারিগরি কর্মক্ষেত্রে যেকোনো পদ দখলে সক্ষম, এ ক্ষেত্রে তাঁদের সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তবে পদ দখল করতে পারলেও তত্ত্বীয় জ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগ তাঁদের পক্ষে যথাযথভাবে, সুচারুরূপে করা কঠিন। কারণ, যেকোনো প্রকল্প সফল করতে তিন ধরনের পেশাজীবী প্রয়োজন হয়ে থাকে। এখানে কেউ কারও বিকল্প নয়, একে অন্যের পরিপূরক। তারপরেও বিএসসি প্রকৌশলীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার যদি শিক্ষা অনুযায়ী কর্মকে গুরুত্ব না দিয়ে পাইলট দিয়ে গরুর গাড়ি চালাতে চায়, তাহলে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের কর্মসংস্থানে সমস্যা হলেও করার কিছু নেই। তবে সরকারের হঠকারী সিদ্ধান্তের ফলে দেশের চিকিৎসাসেবার যে বেহাল অবস্থা হয়েছে, এখানেও তা-ই হবে। বিদেশনির্ভরতা এখনো আছে, ভবিষ্যতে তা আরও বাড়বে।
ডিপ্লোমা প্রকৌশলীরা প্রায়ই অভিযোগ করেন যে তাঁদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও বিএসসি প্রকৌশলীদের তুলনায় কম মূল্যায়ন করা হয়। এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী?
ডিপ্লোমা প্রকৌশলী বা পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের সব সমস্যা সমাধানের ভার উচ্চ সরকারি পদে আসীন বিএসসি প্রকৌশলীদের হাতে। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে, বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিত অভিজাতরা নিজের নীল রক্তকে নীল রাখার তাগিদে দেশ ও জাতির কল্যাণের কথা ভুলে গেছেন। বিএসসি প্রকৌশলী ও ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের ভিন্নতা থাকলেও কাজের ক্ষেত্র কিন্তু পৃথক নয়। মাঠপর্যায়ে যে যার পদ অনুযায়ী একই কাজ করে থাকে। এখানেই অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার অবমূল্যায়ন। শিক্ষা অনুযায়ী কর্মের সুযোগ সৃষ্টি এবং সাধারণ সম্মান শিক্ষার মতো প্রকৌশল শিক্ষাকে যদি একমুখী করা যায়, তাহলে আজকের বিভেদ নিরসন সম্ভব। পরস্পর পরস্পরের প্রতি সম্মান রেখে ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যাবে। তাই ‘নিজের জন্য সামনে ফাঁকা মাঠ চাই আর পেছনে যারা আছে তাদের জন্য সামান্য গলিও রাখা চলবে না’–এ মানসিকতা থেকে বিএসসি প্রকৌশলীদের বেরিয়ে আসার আহ্বান জানাই। তাতেই জাতি হিসেবে আমাদের মঙ্গল হবে।
বিএসসি এবং ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের কাজের ধরন ও রুটই ভিন্ন। কাজের পরিধিও আলাদা। ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের চার বছরের সিলেবাসে আসলে ফিল্ডে কাজ করার জন্যই প্রস্তুত করা হয়। ফিল্ডের কাজ ইমপ্লিমেন্ট করতে এবং ফিল্ডের খুঁটিনাটি বিষয়ে তাঁদেরকে তৈরি করা হয়। সুতরাং তাঁরা ফিল্ড লেভেল বিশেষজ্ঞ, এটা অস্বীকার করার সুযোগ
২ দিন আগেআজ ১২ রবিউল আউয়াল, পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)। এই মহিমান্বিত দিনে মানবজাতির ইতিহাসে এক নতুন সূর্যের উদয় হয়েছিল মক্কার মরু প্রান্তরে। মা আমিনার কোল আলোকিত করেজন্ম নিয়েছিলেন এক মহামানব—যিনি বিশ্বমানবতার মুক্তিদূত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাঁর আগমনে অজ্ঞানতা ও বর্বরতার ঘোর আঁধার ভেদ করে সূচনা হয়েছিল
২ দিন আগেখবরটি শুনতে অসম্ভব বলে মনে হলেও, বাস্তবতা এই যে প্রযুক্তির রমরমা বিকাশের সময়ে বাংলাদেশের প্রান্তিক এক জনপদে এখনো বিশুদ্ধ খাওয়ার পানির ব্যবস্থা নেই। ২ সেপ্টেম্বর আজকের পত্রিকার প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, রাঙামাটির ভারত সীমান্তবর্তী বরকল ও জুরাছড়ি উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের প্রায় ৪০ হাজার মানুষ...
৩ দিন আগেদ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্তিমে জাপানের আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণের ৮০তম বার্ষিকীতে সম্প্রতি বেইজিংয়ে হয়ে গেল চীনের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সামরিক কুচকাওয়াজ। চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের আমন্ত্রণে সেই কুচকাওয়াজ দেখতে উপস্থিত ছিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উন।
৩ দিন আগে