Ajker Patrika

ফিলিপাইনের কৃষি ও কৃষক

শাইখ সিরাজ
ফিলিপাইনের কৃষক অ্যালভিসের সঙ্গে কথা বলছেন লেখক। ছবি: হৃদয়ে মাটি ও মানুষ
ফিলিপাইনের কৃষক অ্যালভিসের সঙ্গে কথা বলছেন লেখক। ছবি: হৃদয়ে মাটি ও মানুষ

কৈশোরে একবার পড়েছিলাম, ফাঁসির দড়ি তৈরি হয় ‘ম্যানিলা রোপ’ দিয়ে। তখন বুঝতাম না ‘ম্যানিলা’ কী! পরে জেনেছি, ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলা থেকেই এই বিশেষ দড়ির নামকরণ। ‘ম্যানিলা রোপ’ তৈরি হয় অ্যাবাকা নামের কলাগাছ-জাতীয় এক উদ্ভিদ থেকে। গাছের তন্তু থেকে তৈরি হয় দড়ি, কাপড়, কারুপণ্য, এমনকি বস্তাও। কোমল অথচ টেকসই এই তন্তুর বৈশিষ্ট্য বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। আজও পৃথিবীর ৮৬ শতাংশ অ্যাবাকার জোগান দেয় ফিলিপাইন।

একাধিকবার সুযোগ হয়েছে ফিলিপাইনের কৃষি ও কৃষকের জীবন কাছ থেকে দেখার। বিশেষত আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা কেন্দ্র ইরির সদর দপ্তর লাস বানোসে ধান গবেষণার রিপোর্ট করতে গিয়ে এই দেশের ভেতর-বাহির ঘুরে দেখার অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ করেছে আমাকে।

অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাহাড়, সমুদ্র আর বনভূমি, আর তার ফাঁকে ফাঁকে সবুজ সমতল। মোট ৭ হাজার ৬৪৩টি দ্বীপবেষ্টিত দেশ ফিলিপাইন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৈরী আবহাওয়া মোকাবিলা করেই ফিলিপাইনের প্রায় ১২ কোটি মানুষ নিজেদের অর্থনীতিকে এশিয়ার মধ্যে সুসংহত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমার দেখার আগ্রহ ছিল সে দেশের কৃষি ও কৃষক রাষ্ট্রের কাছ থেকে কতটা সুযোগ পাচ্ছেন? কেমন আছেন সেখানকার কৃষক?

রাজধানী ম্যানিলা থেকে ছুটে গেলাম সর্ব-উত্তরের প্রদেশ ইলোকোস নর্তের পিদিগ জেলায়। গাড়িতে করে চলছিলাম এক শহর থেকে আরেক শহরে। মাঝেমধ্যে গ্রামে থামছিলাম। সেখানকার কৃষকের সঙ্গে কথা বলছিলাম। পথের দুই পাশজুড়ে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি সৌন্দর্য আর গ্রামীণ অবকাঠামো দেখে বোঝা যায় বৈশ্বিক উন্নয়নের ছোঁয়া ভালোমতোই লেগেছে ওখানকার কৃষকের জীবনেও।

একটা গ্রামে এসে থামলাম আমরা। গ্রামের নাম আবুকায়। মাঠজুড়ে ধান আর ধান। বলে রাখি এ অঞ্চলটি মূলত ধান চাষের জন্য প্রসিদ্ধ। ফসল বৈচিত্র্য খুব একটা চোখে পড়ল না। কৃষকদের বর্তমান অবস্থা ও সরকার কর্তৃক কী ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়, সেসব বিষয়ে জানতে ফিলিপাইনের ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক মাঠ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হলো। তিনি জানালেন, এই অঞ্চলের মূল সমস্যাই ছিল খরাপ্রবণতা। তাই ইরি আর ফিলরাইস খরাসহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। সেই ধান চাষ করে কৃষকেরা উপকৃত হচ্ছেন।

অ্যালান নামের এক কৃষকের সঙ্গে কথা হলো। বাংলাদেশ থেকে গিয়েছি শুনে আনন্দিত হলেন তিনি। কারণ, তিনি আট বছর ছিলেন কোরিয়ায়। সেখানে তিনি যেখানে কাজ করতেন, তার বস ছিলেন বাংলাদেশি। জানতে চাইলাম, কৃষি কেমন লাভজনক? বললেন, কৃষি লাভজনক। তবে এই অঞ্চল ধানপ্রধান। ধানে তেমন লাভ নেই। সরকারের নানা রকম সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কারণে কৃষকেরা ধান চাষ করেন। তবে এখানেও কৃষকের লাভ প্রাপ্তির বড় বাধা হচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগী।

আগস্টের প্রচণ্ড গরম। ঘামে ভিজে যাচ্ছি। জানা গেল এই অঞ্চলে এর চেয়েও বেশি গরম পড়ে। ওখানকার আবহাওয়াই ওরকম। বিশ্রাম নেওয়ার জন্য ছায়ায় দাঁড়ালাম। ফিলিপাইনে মোটরসাইকেলে বিশেষভাবে অতিরিক্ত একটা চাকা লাগিয়ে ট্রাইসাইকেল বানিয়ে সেটা দিয়ে পরিবহন ও ছোট ব্যবসা-বাণিজ্যের মোবাইল স্টোর হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আমাদের দেশে যেমন ভ্যান। ফিলিপাইনে তেমনই মোটোরাইজড ট্রাইসাইকেল। পণ্য বহনকারী ট্রাইসাইকেলকে বলা হয় ‘গারং’।

এক গ্রামের এক ছোট্ট দোকানে গেলাম। মুদিদোকান। দোকানের বেচাকেনা দেখে বোঝার চেষ্টা করলাম সেই এলাকার কৃষকদের অর্থনৈতিক অবস্থাটা। দিবা নামের মধ্যবয়সী এক নারী দোকানটি চালান। দোকানটি পণ্যে ঠাসা নয়। আবার কমও বলা যাচ্ছে না। কোল্ড ড্রিঙ্কসের কয়েকটি ক্যারেট আছে। জানতে চাইলাম, দিনে কয়টি কোল্ড ড্রিঙ্কস বিক্রি হয়? জানালেন, হাফ ক্যারেট। মানে ১২টার মতো। খুব একটা বেশি নয়। দিবা বললেন, এই অঞ্চলের বড় ও মাঝারি কৃষকেরা বেশ ভালো আছেন। কিন্তু প্রান্তিক কৃষকেরা শুধু কৃষি করে টিকে থাকতে পারছেন না। কৃষিকাজের পাশাপাশি শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে হচ্ছে। অথবা ছোটখাটো ব্যবসার ব্যবস্থা করতে হচ্ছে।

অ্যালভিস নামের এক কৃষকের সঙ্গে কথা হলো। তিনি খরাসহিষ্ণু ধান চাষ করেছেন দুই হেক্টর জমিতে। নিজের জমি দেখিয়ে বললেন, ‘দেখুন, এই ধানখেতে এখন পানি আছে। কারণ, দুই দিন আগে বৃষ্টি হয়েছে। অথচ এর আগে এক মাস ছিল বৃষ্টিহীন। কিন্তু সেচ ছাড়াই ধানগাছগুলো দিব্যি বেঁচে ছিল। এর আগে অনাবৃষ্টিতে ফসলহানি হতো।’ তিনিও বললেন, ধানে লাভ নেই। কিন্তু সরকার বীজ দিচ্ছে, সার দিচ্ছে। এমনকি নির্দিষ্ট দামে ফসল কিনেও নিচ্ছে। তাই তাঁরা ধান চাষ করছেন। তবে এখানকার কৃষকের মূল অর্থনৈতিক শক্তি রেমিট্যান্স। প্রতিটি পরিবারের কেউ না কেউ দেশের বাইরে আছেন। সেখান থেকে পাঠানো অর্থেই তাঁরা ভালো থাকছেন। তৈরি করছেন পাকা বাড়ি। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে ডিজেলের দাম বেড়েছে। সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে বলে রেহাই।

কথা হলো টেরাসিটা নামের একজন বর্গাচাষির সঙ্গে। এক হেক্টর জমিতে খরাসহিষ্ণু ধান চাষ করছেন। তিনি বললেন, ফিলরাইস তাঁকে বীজ দিয়েছে। একজন নিবন্ধিত কৃষক হওয়ার পরও কখনো ব্যাংক থেকে ঋণসুবিধা নেননি তিনি। তাঁর লাভের টাকাই আবার তাঁর জমিতে বিনিয়োগ করেন। যদি তিনি ঋণ নিতেনও, তাহলে তার শূন্য শতাংশ হারে সুদ হতো। অর্থাৎ ফিলিপাইনে কৃষককে নানা রকম সুযোগ-সুবিধা দেয় সরকার। তবে তাঁকে নিবন্ধিত হতে হয়। একজন নিবন্ধিত কৃষককে বিনা সুদে ঋণ দেয়, শস্যবিমার আওতায় আনে, সার-বীজ-কীটনাশক সব ফ্রি। কৃষিবিমার জন্য প্রতিবছর ১০০ পেসো, অর্থাৎ বাংলাদেশি মুদ্রায় মাত্র ১৬৭ টাকা প্রিমিয়াম দিতে হয় তাঁকে। বিনা মূল্যে চিকিৎসাসুবিধাও পাচ্ছেন তিনি।

যাই হোক এবার ফেরার পালা। ফেরার পথে আবার দেখা হলো কিষানি টেরেসিটার সঙ্গে। তিনি অনুরোধ করলেন তাঁর বাড়িতে যাওয়ার। খুব সুন্দর আর গোছানো একটি বাড়ি। ঘরগুলো শহরের বাড়ির মতো আসবাবে সাজানো। সোফা আছে। ফ্রিজ আর ওয়াশিং মেশিন আছে। তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, ‘দেশের বাইরে কে থাকে আপনার?’ বললেন, ‘কেউ থাকে না। কৃষিই একমাত্র আয়ের উৎস।’ বললাম, ‘অন্য কৃষকেরা যে বললেন শুধু কৃষি দিয়ে বাড়ি বানানো সম্ভব না!’ টেরেসিটা জানালেন, তিনি তাঁর উৎপাদিত কৃষিপণ্যকে প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে শিল্পপণ্য হিসেবে বিক্রি করেন। আমাদের কলার চিপস খেতে দিলেন। তিনি কলা বিক্রি না করে কলার চিপস বিক্রি করেন। তিনি একজন রাষ্ট্রীয় সম্মাননাপ্রাপ্ত কিষানি। বুঝলাম সৃজনশীল চিন্তার জন্যই হয়তো অন্যদের থেকে কিছুটা ভালো রয়েছেন তিনি।

কিষানি টেরেসিটা প্রমাণ করেছেন কৃষিতে উৎপাদন ও বিপণন দুই-ই জরুরি। এ বিষয়ে অত্যন্ত সজাগ হতে হবে কৃষককে। কৃষকের মধ্যে থাকতে হবে চিন্তার উদ্ভাবন, প্রযুক্তির ব্যবহার ও বাজারমুখী মনোভাব। এবং সেই কৃষককে রাষ্ট্রীয়ভাবে সুরক্ষার ছায়াতলে আনতে হবে।

ফিলিপাইনের সরকার সে কাজটাই করে যাচ্ছে—নিবন্ধিত কৃষকদের জন্য বিনা সুদে ঋণ, বিমা, বিনা মূল্যে উপকরণ, চিকিৎসাসুবিধা। এমন সহায়তা পেলে বাংলাদেশের কৃষকেরাও পিছিয়ে থাকবেন না।

আগামী দিনে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে খাদ্যনিরাপত্তা। আর সেই যুদ্ধের কান্ডারিরা হবেন কৃষক। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের উচিত, এই পরিশ্রমী মানুষের পাশে দাঁড়ানো। কারণ, যে জাতি তার কৃষকের মর্যাদা দেয় না, সে জাতি কখনো খাদ্যনির্ভরতায় স্বনির্ভর হতে পারে না।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

শেখ মুজিবকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ছাত্রদল নেতার পোস্ট, শোকজ পেয়ে নিলেন অব্যাহতি

সিলেটের ডিসি হলেন ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে শাস্তি পাওয়া সারওয়ার আলম

আলাস্কা বৈঠকে পুতিনের দেহরক্ষীর হাতে ‘মলমূত্রবাহী স্যুটকেস’ কেন

অপারেশন সিঁদুরে নিহত প্রায় দেড় শ সেনার তালিকা প্রকাশ করে মুছে ফেলল পাকিস্তানি টিভি

মুচলেকা দিয়ে ক্যাম্পাস ছাড়লেন আনন্দ মোহন কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত