Ajker Patrika

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া ঋণ অপরিশোধ্য

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের দেওয়া ‘কনসেশন’ হিসেবে। ফাইল ছবি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের দেওয়া ‘কনসেশন’ হিসেবে। ফাইল ছবি

দেশে যেমন, বিশ্ববিদ্যালয়েও তেমনি—গণতন্ত্র শক্তিশালী হয়নি। আমরা আশা করছিলাম গণতন্ত্রের চর্চার ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় হবে অগ্রপথিক, সেটা ঘটল না। অভিযোগ আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা বড় বেশি দলাদলি করেন। কথাটা অর্ধসত্য মাত্র। নির্বাচনী ব্যবস্থা আছে, একা একা নির্বাচন করা যায় না, তাই নির্বাচনী জোট তৈরি করতে হয়েছে; ভিত্তিটা ছিল মতাদর্শগত ভিন্নতা। সেটা কোনো খারাপ ব্যাপার নয়। শিক্ষকেরা কখনোই তাঁদের রাজনৈতিক অবস্থানকে ছাত্রদের মধ্যে নিয়ে যেতে সচেষ্ট হননি। নির্বাচনী ব্যবস্থার ফলে দুটি ভালো জিনিস পাওয়া গিয়েছিল, একটি হলো শিক্ষকদের ভেতর পরিচিতি গড়ে তোলা। দ্বিতীয়টি এই বোধ তৈরি হচ্ছিল যে, শিক্ষকদের ভেতর জ্ঞান ও বয়সের পার্থক্য অবশ্যই সত্য, কিন্তু এটাও সত্য যে শিক্ষক হিসেবে তাঁরা একই সমতলে রয়েছেন। এককথায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন অধ্যাদেশ আমাদের সামন্তবাদী সংস্কৃতির বলয় থেকে বের হয়ে গণতন্ত্রের প্রশস্ত ক্ষেত্রে আসার সুযোগ করে দিয়েছিল। গণতন্ত্রের সুফল যে পুরোপুরি পাওয়া যায়নি, তার দায় গণতন্ত্রের নয়, দায় রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের। ঘটনাটা আমরা ঘটতে দেখলাম, কিন্তু থামাতে পারলাম না। একসময় দেখা গেল সাদা ও নীল উভয় গোষ্ঠীর কিছু শিক্ষক বড় দুই রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। রাজনৈতিক নেতাদেরও আগ্রহ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভেতরে সমর্থক জোগাড় করার। এভাবেই বাইরের দলীয় রাজনীতিটা চলে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভেতরে। ক্ষুণ্ন হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের দেওয়া ‘কনসেশন’ হিসেবে; শাসক বদল হয়েছে কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় স্বাধীন হয়নি।

রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ আরেকভাবে ঘটছিল। সেটা হলো মেধাবী তরুণদের সরকারি চাকরিতে টেনে নিয়ে যাওয়া। সরকারি চাকরিতে ক্ষমতা, উন্নতি ও অর্থ—তিনটিরই প্রাপ্তির যে সুযোগ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায়, তা ছিল না। যে তরুণেরা শিক্ষক হলে তাঁদের নিজেদের জন্য এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের জন্য উপকার হতো, তাঁরা অনেকেই সরকারি চাকরিতে চলে গেছেন। এটা ব্রিটিশ আমলে ঘটেছে, পাকিস্তান আমলে তো কমেইনি, বরং বেড়েছে। দেখা যেত বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় যাঁরা ভালো ফল করেছেন, তাঁরা সরাসরি সিভিল সার্ভিসে যাওয়ার লক্ষ্যে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতেন প্রস্তুতিকালীন সময়টা কাটাবার জন্য। আমি যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পেয়েছিলাম, সেটা অত দ্রুত সম্ভব হতো না, যদি না আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ সিভিল সার্ভিসে চলে যেতেন। সেকালে পদ খালি না হলে নতুন নিয়োগের কোনো সুযোগ ছিল না; আর পদ সৃষ্টি ছিল প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। আমার পিতা সরকারি চাকরি করতেন, তিনিও চেয়েছিলেন আমি সিভিল সার্ভিসমুখো হই এবং না হওয়াতে যে মনঃক্ষুণ্ন হননি—এমন নয়। রাষ্ট্র টানত, বিশ্ববিদ্যালয়ও ঠেলে দিত, কেননা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিতে সুযোগ-সুবিধাগুলো ছিল অত্যন্ত সীমিত।

বায়ান্নতে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করি, তখন আমাদের বিভাগে শিক্ষক ছিলেন অল্প কয়েকজন। অমলেন্দু বসু গিয়েছিলেন অক্সফোর্ডে, ডক্টরেট শেষ করে তিনি আর ঢাকায় ফেরত আসেননি, দেশভাগের কারণে। প্রফেসর এ জি স্টক এসেছিলেন অক্সফোর্ড থেকে, সাতচল্লিশের আগস্টের অল্পকিছু আগে। শিক্ষক হিসেবে তিনি অত্যন্ত খ্যাতিমান ছিলেন, পণ্ডিত হিসেবেও; এবং ঔপনিবেশবাদবিরোধী ছিলেন দৃষ্টিভঙ্গিতে, যে জন্য তাঁর ঢাকায় আসা। সাতচল্লিশের পর থেকেই ছাত্রবিক্ষোভে বিশ্ববিদ্যালয় তপ্ত হয়ে উঠছিল, প্রফেসর স্টক টের পাচ্ছিলেন যে তাঁকেও সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে; তাঁর চিঠিপত্র গোয়েন্দারা নাড়াচাড়া করছে। এমন পরিস্থিতিতে তিনি ভাবলেন সম্মানের সঙ্গে বিদায় নেওয়া ভালো। সেটাই তিনি করেছেন, চলে গেছেন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের আগেই। আমরা তাঁকে পাইনি। তবে আমাদের অনার্সের মৌখিক পরীক্ষা নিতে তিনি এসেছিলেন।

প্রফেসর স্টক কিন্তু আবারও এলেন এবং এবারও স্বেচ্ছায়; একাত্তরের পরে। ড. মুরশিদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল, ব্যবস্থাটা তিনিই করেছিলেন। একান্নতে প্রফেসর স্টক চলে গিয়েছিলেন যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ দেখে, বায়াত্তরে এসে তারই বিজয় দেখতে পেলেন। কিন্তু নতুন রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পরিস্থিতি যে তাঁকে সন্তুষ্ট করতে পেরেছিল, এমনটা মনে হয়নি। এক বছর থাকার পর তিনি চলে গেলেন। যাওয়ার আগে অবশ্য একটি বই লিখে গেছেন, ‘মেময়ার্স অব ঢাকা ইউনিভার্সিটি নাইনটিন ফরটি সেভেন-ফিফটিওয়ান’ নামে। চমৎকার বই। উপন্যাসের মতো।

স্টকের পরে আরেকজন ইংরেজ এসেছিলেন, প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে। নাম জে এস টার্নার। তাঁর সময়ে আমরা ছাত্র। তিনি ছিলেন অনেকটা দার্শনিকের মতো।

তাঁর প্রিয় কবি ছিলেন মিল্টন ও ওয়ার্ডসওয়ার্থ; তিনি ওই দুই কবির কবিতা পড়াতেন, এবং আমরা টের পেতাম খুব আনন্দ পাচ্ছেন পড়িয়ে এবং সচেষ্ট রয়েছেন নিজের আনন্দকে আমাদের কাছে পৌঁছে দিতে। ১৯৭২-এ তিনিও একবার এসেছিলেন তাঁর প্রিয় ঢাকা ও পূর্ববঙ্গকে দেখতে। তখন তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। তাঁর সঙ্গে দেখা কলকাতার এক সেমিনারে, যেখানে আমি বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রের ওপর একটি প্রবন্ধ পড়েছিলাম; তিনি শুনলেন এবং শুনে বললেন, ‘তা ভালোই লিখেছ হে, কিন্তু বেশ পলিটিক্যাল’। মন্তব্যটা মনে আছে।

সাহিত্যে পাঠদানের আরেকটি ধরন ছিল, সেটি ব্যাখ্যা করা, শব্দের অর্থ স্পষ্ট করা, উপমাগুলোর তাৎপর্য তুলে ধরা। এই রীতিতে পড়াতেন বি সি রায়। পড়তেন; এবং পড়াতে ভালোবাসতেন। ছিলেন অকৃতদার। ছাত্রজীবনে তো বটেই, যখন শিক্ষক হয়েছি তখনো টের পেয়েছি ভেতরে ভেতরে ছিলেন অত্যন্ত স্নেহপ্রবণ। ধুতি পরে আসতেন; কিন্তু সে পরিধেয়তে থাকতে পারলেন না, ১৯৬৪-এর দাঙ্গার পরে নিরাপত্তার স্বার্থে তাঁর শুভার্থীরা তাঁকে পোশাক বদলানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন; বদলানো পোশাকে কয়েক দিন এসেছেনও; কিন্তু কাজটা তাঁর কাছে কতটা অপমানজনক মনে হয়েছে জানি না, আমরা কিন্তু অপরাধী মনে করেছি নিজেদের। আমি তো চোখ তুলে তাঁর দিকে তাকাতেই পারিনি লজ্জায় ও অপরাধবোধে। এর পরে অবশ্য তিনি বেশি দিন আমাদের সঙ্গে থাকেননি, অবসর গ্রহণ করে কলকাতায় চলে গেছেন।

শিক্ষা-ছুটি নিয়ে কেমব্রিজ গিয়েছিলেন সৈয়দ আলী আশরাফ, তিনি ফিরে এসেছিলেন আমরা যখন প্রথম বর্ষের ছাত্র তখনই। সাহিত্যপাঠে তখন নতুন একটি রীতির প্রবর্তন ঘটছিল; সেটা ছিল টেক্সটের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ; বৈজ্ঞানিকভাবে নয়, নান্দনিকভাবেই। এই পদ্ধতিতে সাহিত্যপাঠ ও সাহিত্যের মর্মোদ্ধার আরও গভীর হতো। সৈয়দ আলী আশরাফ ওই রীতির সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি বেশি দিন রইলেন না, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গেলেন।

জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার উপস্থিতিটা ছিল খুবই উজ্জ্বল। আমরা জানতাম তিনি এম এন রায়ের রাজনৈতিক মতাদর্শে আস্থাবান ছিলেন; যে আস্থার প্রতিফলন ঘটেছিল মুক্তি নামে একটি সাহিত্য পত্রিকার মধ্যে। পত্রিকাটি তিনি যে সম্পাদনা করতেন, তা নয়। তবে তিনি ছিলেন পেছনের অনুপ্রেরণা। মুক্তি কেবল যে নামের ওই বানানের জন্য বিশিষ্ট ছিল তা নয়, সেখানে যে আলোচনাগুলো বের হতো, সেগুলোও ছিল মনোযোগ দিয়ে পড়বার মতো। কিন্তু পত্রিকাটি টেকেনি। জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ও তাঁর স্ত্রী বাসন্তী গুহঠাকুরতা ছিলেন মনেপ্রাণে শিক্ষক; তাঁরা দেশ ছেড়ে যাবেন—এমনটা কখনো ভাবেননি; যাকে বলে মাটি কামড়ে পড়ে থাকা, অনেকটা সেভাবেই রয়ে গেলেন এবং আমাদের এই শিক্ষক, যাঁর উপস্থিতিতে আমরা অনুপ্রাণিত বোধ করতাম তিনি চলে গেলেন একাত্তরে, পাকিস্তানি হানাদারদের আক্রমণে।

একাত্তর আমাদের জন্য কেমন অভিজ্ঞতা ছিল, তা বর্ণনা করা কঠিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল আক্রমণের প্রাথমিক কেন্দ্রগুলোর একটি। ওই আক্রমণে ছাত্র, শিক্ষক, কর্মচারী, কোনো বাছবিচার করা হয়নি। পরে ১৪ ডিসেম্বরে ঘটেছে ‘নির্বাচিত হত্যাকাণ্ড’। পঁচিশে মার্চ আমরা বেঁচে গেছি আমাদের আবাসিক এলাকাটিতে হানাদারেরা ঢোকেনি বলে, পরে আমি বাঁচলাম পলাতক থাকার দরুন। আলবদর যাঁদের খুঁজেছিল, আমিও তাঁদের একজন ছিলাম। সামরিক প্রশাসক টিক্কা খান বিদায় নেওয়ার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ছয়জন শিক্ষককে সতর্ক করে দিয়ে গিয়েছিল, তাঁদের মধ্যেও আমি ছিলাম। ওই প্রথম ও শেষবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পরিচয়টা হয়ে দাঁড়িয়েছিল অনিরাপদ।

বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের ছাত্রকালের বিভাগীয় পাঠ্যসূচি সম্পর্কে একটু বলি। পাঠ্যসূচি ছিল খুবই সংকীর্ণ, বলা যায় দরিদ্র। ধরা যাক, আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যের তিনজন প্রধান ঔপন্যাসিক—কনরাড, ফরস্টার ও লরেন্সের কথা; তাঁরা কেউই কিন্তু আমাদের সময়কার পাঠ্যসূচিতে স্থান পাননি। কারণ হতে পারে দুটো; একটি ভিক্টরীয় নীতিবোধের অবশেষের উপস্থিতি; অন্যটি হয়তো মফস্বলের শিক্ষার্থীদের প্রতি কর্তৃপক্ষের করুণা। তা শিক্ষার্থীদের অবমূল্যায়ন কর্মক্ষেত্রেও ঘটেছে। প্রথম দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের তেমন একটা পাত্তা দেওয়া হতো না, বিশেষভাবে চাকরিবাকরির ক্ষেত্রে; পরে অবশ্য সেটা কেটে গেছে। তবে আমার মনে পড়ে ফুলব্রাইট স্কলার হিসেবে একজন অধ্যাপিকার পড়ানোর কথা। তিনি আমাদের পড়িয়েছেন ‘দি রেইপ অব লক্’ নামের দীর্ঘ কবিতাটি। এমনভাবে পড়ালেন যেন আমরা স্কুলের ছাত্রছাত্রী।

আমরা টের পাচ্ছিলাম যে আমেরিকার চোখ পড়েছে পূর্ব বাংলার ওপরে। তাদের ভয় ছিল কমিউনিজমের। শুরুতে পাঠ্যসূচিতে কোনো আমেরিকান লেখকের উপস্থিতি ছিল না; কিছুদিন পরে দেখা গেল আমেরিকান সাহিত্য বলে একটি বিকল্প পত্র এসে গেছে। বইপত্র সব আমেরিকার দূতাবাস থেকে আসছে। বৃত্তিও দেওয়া হচ্ছে আমেরিকায় যাওয়ার। আরও পরে দেখেছি বরিস পাস্তারনেকের ড. জিভাগো উপন্যাসটির কপি বিনা মূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে শিক্ষকদের মধ্যে, কংগ্রেস ফর কালচারাল ফ্রিডমের বেনামিতে।

আগে বৃত্তি পাওয়া যেত ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে, উচ্চশিক্ষার জন্য আমি যে বিদেশে গিয়েছিলাম, সেটা ব্রিটিশ বৃত্তিতেই; পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে যুক্ত হলো আমেরিকায় যাওয়ার সুযোগ। তত দিনে রাষ্ট্রীয়ভাবে আমেরিকা পাকিস্তানের ঘাড়ে বেশ ভালোভাবেই সওয়ার হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাদের চোখ তো পড়বেই। মুনীর চৌধুরীকে নিয়ে যাওয়া হলো আমেরিকায়, ভাষাতত্ত্ব পড়বার জন্য। তিন মাসের লিডারশিপ এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে শিক্ষকদের কেউ কেউ গেলেন শিক্ষাভ্রমণে। সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েনও গিয়েছিলেন এবং আমেরিকা থেকে কয়েকটি চিঠি লিখেছিলেন পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায়। ১৯৫৮ সালে রকফেলার ফাউন্ডেশন আমাদের ইংরেজি বিভাগকে বেশ বড় অঙ্কের একটা অনুদান দিয়েছিল সাম্প্রতিক বাংলা সাহিত্যের ওপর আটটি সেমিনার করার জন্য। ওদিকে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরে ইংরেজদের দৃষ্টিভঙ্গিতে একটা পরিবর্তন দেখা গেল, তারা সাহিত্যপাঠের জন্য বৃত্তি না দিয়ে ভাষার পঠন-পাঠন শেখার জন্য বৃত্তি দেওয়াতে আগ্রহী হয়ে উঠল। ধারণাটা হয়তো এই ছিল যে, সাহিত্য হলো গিয়ে উপরকাঠামোর ব্যাপার, ভাষা শেখাতে পারলে সংস্কৃতির গভীরে প্রবেশ করা যাবে এবং বাণিজ্যিকভাবেও ওই শিক্ষাদান লাভজনক হবে।

আজ ১ জুলাই, ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এই প্রতিষ্ঠানের কাছে আমার ঋণ অপরিশোধ্য; সে ঋণ যত বেড়েছে, বহন করে ততই আমি সাবালক হয়েছি।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

ত্রিভুজ সম্পর্কের অনিবার্য পরিণতির অপেক্ষায়

মাসুদ কামাল
নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় নিয়ে সংকট কাটেনি। ছবি: সংগৃহীত
নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় নিয়ে সংকট কাটেনি। ছবি: সংগৃহীত

ত্রিমুখী সম্পর্ক নিয়ে অনেক মুভি হয়েছে। এ রকম মুভি দেখেননি, এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। কেবল মুভিতেই কেন, বাস্তবেও ত্রিমুখী সম্পর্কের অনেক ঘটনা আমরা দেখে থাকি। সব ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ত্রিভুজ সম্পর্কের শেষ পরিণতি সাধারণত ভালো হয় না।

গত বছরের এ সময়ে আমাদের রাজনীতিতে খুব শক্ত একটা ত্রিভুজ সম্পর্ক দেখা গিয়েছিল। বিএনপি-অন্তর্বর্তী সরকার-জামায়াত—এই তিন পক্ষের দহরম-মহরম। তাদের সবারই লক্ষ্য তখন ছিল রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করা। এর প্রাথমিক ধাপ, কদিন আগে অর্থাৎ ২০২৪-এর অক্টোবরে অর্জিত হয়েছে। সে দিন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে এই সরকার একটা নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ করেছে। এরপর বাকি ছিল মূল দল আওয়ামী লীগকে অকার্যকর ও অপ্রাসঙ্গিক করা। গত বছরের এ সময়ে সেই চেষ্টা আমরা দেখেছি। প্রশাসনিকভাবে যেমন, ঠিক তেমনি সামাজিকভাবেও স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিস্ট দল হিসেবে আওয়ামী লীগবিরোধী প্রচারণা বেশ জোরেশোরেই চলছিল। এ কাজে বিএনপি, জামায়াত, সরকার—সবাই বেশ আন্তরিকও ছিল। সে সময়ে মাঠের শক্তি হিসেবে বেশ বড় একটা ভূমিকা রেখেছে এনসিপি বা জাতীয় নাগরিক পার্টি। তারপর মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে যখন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলো, আমার বিবেচনায় ত্রিভুজ দহরম-মহরমের সেটাই ছিল পিক-টাইম। এর পর থেকে নিজ নিজ স্বার্থ নিয়ে ধীরে ধীরে সবাই মাঠে নেমে পড়ল। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকল দূরত্ব।

মে মাসের ১২ তারিখে আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলো, তার মাসখানেক পর জুনের ১৫ তারিখে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস লন্ডনে গিয়ে বৈঠক করলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে। বলতে গেলে ওই বৈঠকটাই যেন সম্পর্কে ভাঙনের ক্ষেত্রে একটা প্রকাশ্য কারণ হতে পারল। জামায়াত অভিযোগ তুলল সরকারের প্রতি—বলল, বিএনপির প্রতি পক্ষপাতিত্ব করছে সরকার। অভিযোগের পেছনের কারণটিও তারা প্রকাশ করল। বলল, ওই বৈঠকের পরই নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় হিসেবে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধের কথাটি বলা হয়েছে। একটিমাত্র দলের শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথার পরিপ্রেক্ষিতে যদি নির্বাচনের সময় নির্ধারিত হয়, তাহলে সেই দলের প্রতি সরকারের পক্ষপাতের বিষয়টি অস্বীকার করা তো সহজ হয় না।

জুনের পর থেকে যত দিন যেতে থাকল, সাধারণ মানুষের কাছেও বিএনপি-জামায়াতের মুখোমুখি অবস্থানটা পরিষ্কার হতে থাকল। ঐকমত্য কমিশনেও দেখা গেল দুই দলের এই বিরোধের প্রকাশ। সংস্কারের অনেক প্রস্তাবেই বিএনপি-জামায়াতকে পরস্পরবিরোধী অবস্থানে দেখা গেল। বিএনপির পক্ষ থেকে একের পর এক আসতে থাকল নোট অব ডিসেন্ট বা আপত্তি। এরপর আবার বিপত্তি দেখা গেল জুলাই সনদ বাস্তবায়নে যে ‘গণভোট’ করার কথা বলা হচ্ছে, সেটি অনুষ্ঠানের তারিখ নিয়ে। বিএনপি বলল, নির্বাচনের দিনই হোক গণভোট, বিপরীতে জামায়াত বলছে—নির্বাচনের আগে, সম্ভব হলে এই নভেম্বরেই গণভোট হতে হবে। গণভোটের রায় নিয়ে, সেটার ওপর ভিত্তি করেই হবে নির্বাচন। আবার জুলাই সনদ বাস্তবায়নের যে আদেশ, তার খসড়া নিয়েও বড় ধরনের আপত্তি তুলল বিএনপি। আপত্তির মাত্রাটা এতটাই প্রবল যে, তারা বলল—জুলাই সনদ নিয়ে ঐকমত্য কমিশন তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। খেলায় যে রেফারির ওপর সব পক্ষ ভরসা রাখে, সে রেফারিই এবার গোল দিয়ে বসে আছে। অর্থাৎ চরম পক্ষপাতের অভিযোগ। যে কমিশনের প্রধান হচ্ছেন খোদ সরকারপ্রধান ড. ইউনূস, তাঁরই বিরুদ্ধে পক্ষপাত ও প্রতারণার অভিযোগ! বিষয়টি কিন্তু এরপর আর হালকা থাকল না।

তাহলে এখন কী হবে? গণভোট কবে হবে? গণভোটে জনগণের সামনে প্রশ্ন কী থাকবে? এসব প্রশ্নের সমাধান কে দেবে? ঐকমত্য কমিশনের প্রধান ও সক্রিয় দুই ব্যক্তি ড. আলী রীয়াজ ও মনির হায়দার এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছেন। তড়িঘড়ি করে তাঁদের এই চলে যাওয়া নিয়েও নানা ধরনের সন্দেহ উচ্চারিত হতে থাকল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই দুজনকে নিয়ে দেখা গেল নানা ধরনের ট্রল। সমাধানের পথ হিসেবে বলা হলো, সরকারপ্রধান ড. ইউনূস এর সমাধান করবেন। এ প্রবণতা আমরা আগের সরকারের আমলেও দেখেছি। সবকিছুই যেন শেখ হাসিনা করতেন। যত সাফল্য, সব তাঁর। মন্ত্রীদের কিছু জিজ্ঞাসা করা হলে বলতেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় এ সাফল্য এসেছে।’ আবার যদি কোনো জটিলতা দেখা দিত, সবাই মিলে মিটিং করে শেষে সিদ্ধান্ত হতো ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’ এর সমাধান দেবেন। দল, অঙ্গসংগঠন, কিংবা ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের কোনো কমিটি করতে হবে—অবধারিতভাবেই দায়িত্ব চলে যাবে ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর’ কাছে। এভাবেই একজন ব্যক্তি স্বৈরাচারী হয়ে ওঠেন। একপর্যায়ে তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেন, তিনি ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত কেউ নিতে পারে না। সব কাজ তাঁকেই করতে হয়। তিনি আসলে অন্যদের মতো নয়, তিনি অনেকটা মহাপুরুষের মতো। আমার মতে, এই স্বৈরাচারী মনোভাবের শুরুটা হয় আশপাশে থাকা মোসাহেবদের কারণেই। এবারও তা-ই হয়েছে, মোসাহেবরা বলতে শুরু করেছেন—ড. ইউনূসই দেবেন শেষ সিদ্ধান্ত!

সরকার অবশ্য অদ্ভুত একটা কাজ করেছে। যখন তাদের ওপর দায়িত্ব এল সংকট নিরসনের, তারা একটা বৈঠক করল, আর বলে দিল—সাত দিনের সময় দেওয়া হলো, এর মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের বসে সমস্যার নিরসন করতে হবে। যে বিরোধের নিরসন টানা আট মাস রাজনৈতিক দলগুলো একসঙ্গে বসে সমাধান করতে পারেনি, সেটা সাত দিনে কীভাবে সম্ভব হবে? তা ছাড়া আরেকটি কথাও উচ্চারিত হচ্ছে। জুলাই সনদ নিয়ে এই বিরোধ, বাস্তবায়ন প্রস্তাবে নোট অব ডিসেন্টগুলোকে না রাখা, এটা আসলে কার দায়? এ অপকর্মটি করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। যে কমিশনের প্রধান আবার ড. ইউনূস নিজে। তাহলে যে ক্রাইসিস সৃষ্টি করেছে ড. ইউনূসের কমিশন, সেটির সমাধানের দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর দেওয়া কেন? এদিকে আবার সেই সাত দিনও শেষ হয়ে গেছে গতকাল রোববার। কোনো সমাধান কি হয়েছে? এখন কী হবে? যথারীতি সেই একই কথা বলা হচ্ছে—ড. ইউনূসই দেবেন সমাধান। কিন্তু কীভাবে? তিনি কি খুব বড় রাজনীতিবিদ? আবার যদি ড. ইউনূস কিংবা তাঁর পরিষদ যদি কোনো একটা সিদ্ধান্ত দেয়, তাহলে সেটাকে কি আর ঐকমত্যের সিদ্ধান্ত বলা যাবে? এটা তো তাঁর সরকারের সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে। সরকারই যদি সিদ্ধান্ত দেবে, তাহলে আর সংস্কার কমিশনের নামে এত নাটকের কী প্রয়োজন ছিল? এত সময়ক্ষেপণই বা কেন করা হলো?

এতসব প্রশ্নের জবাব আসলে কে দেবে, কী দেবে, কেউ জানে না। হয়তো জবাব কখনোই পাওয়া যাবে না। তবে বিএনপি কিন্তু এরই মধ্যে সরকারের দিকে আঙুল তুলতে শুরু করেছে। এর মধ্যে গত শনিবার দেখলাম বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ সরাসরি সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে বললেন—এভাবে সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়ার কোনো এখতিয়ার এই সরকারের নেই। এই সরকার যে কোনো নির্বাচিত সরকার নয়, এটাও তিনি তাদের স্মরণে রাখতে বলেছেন। জামায়াতে ইসলামী আবার এ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। তারা এরই মধ্যে আট দলের একটা জোট বানিয়ে নিয়েছে। এই আট দলকে নিয়ে রাস্তায়ও নেমে গেছে পাঁচ দফা দাবি আদায়ে। তাদের এক শীর্ষস্থানীয় নেতা প্রকাশ্যে বলেছেন—ঘি তাদের চাই। আর এই ঘি পেতে যদি আঙুল বাঁকা করতে হয়, তারা সেটাই করবে। এ বক্তব্য কি কেবলই রেটরিক, নাকি এর মধ্যে প্রচ্ছন্ন কোনো হুমকি আছে; সেটাও কিন্তু চিন্তার বিষয়। এসবের বিপরীতে বিএনপিও বসে নেই। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী শনিবার এক জায়গায় বললেন, বিএনপির মতো বড় দলের কর্মীরা যদি রাস্তায় নামে, তাহলে সংঘাত হতে পারে।

এ রকম পরিস্থিতিতে জনগণের অবস্থান কোথায়? আমরা এখন বসে আছি ক্লাইমেক্সের অপেক্ষায়! এরই মধ্যে পরস্পরের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ আমরা দেখতে পাচ্ছি।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

শহীদ নূর হোসেন দিবস

গণতন্ত্র কি মুক্তি পেয়েছে

নূর হোসেনের পিঠে লেখা ছিল এই স্লোগান। ছবি: সংগৃহীত
নূর হোসেনের পিঠে লেখা ছিল এই স্লোগান। ছবি: সংগৃহীত

আমরা চব্বিশের আন্দোলন দেখেছি—বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন থেকে যা রূপ নেয় স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে। এর আগপর্যন্ত স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সম্পর্কে জেনেছি নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান এবং নূর হোসেনের আত্মত্যাগের কথা। অনেকে দুটো ঘটনারই সাক্ষী। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর নূর হোসেন শহীদ হন পুলিশের গুলিতে। কারণটা শুধু তাঁর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেওয়া ছিল না, ছিল তাঁর বুকে-পিঠে লেখা স্লোগানও—‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। নূর হোসেনের এই অদম্য সাহসই যে পরবর্তী সময়ে চব্বিশের জুলাই-আগস্টে তরুণদের মাঝে ছড়িয়ে যায়, সেটা না বললেও চলে। কেননা, ইতিহাস সাক্ষী এবং শিক্ষক—দুটো ভূমিকা পালন করে। শহীদ নূর হোসেন দিবসের নেপথ্যে কী, কেন তিনি শহীদ হন? এসব প্রশ্নের উত্তর না পেলে হয়তো আজকের প্রজন্ম অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারত না। তাই নূর হোসেনকে ভুলে যাওয়া যায় না।

বেবিট্যাক্সিচালকের সন্তান নূর হোসেনের জন্ম ঢাকায়, নারিন্দায়, ১৯৬১ সালে। পড়ালেখার দৌড় বেশি দূর যায়নি, অষ্টম শ্রেণিতেই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। কিন্তু রাজনীতিতে সক্রিয়। আর মোটর ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। ছিলেন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের বনগ্রাম শাখার প্রচার সম্পাদক। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি না নিয়েও রাজনীতির শব্দ নিয়ে খেলায় মেধার পরিচয় দিয়েছিলেন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময়। জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনকালে নাখোশ হয়ে আর সবার সঙ্গে রাজনৈতিক মিছিলে যোগ দেওয়ার আগের দিন, অর্থাৎ ১৯৮৭ সালের ৯ নভেম্বর নূর হোসেন ঠিক করে ফেলেছিলেন কী হবে তাঁর স্লোগান। সেদিন পপুলার আর্ট নামের একটি দোকান থেকে সাদা রং দিয়ে নিজের বুকে লিখিয়ে নেন ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’। আর পিঠে লেখান ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। প্রচার সম্পাদকের কাজটা ভালোই জানতেন! এই কাজ করে বাড়ি গেলেন না। দুদিন আগেই ঘরছাড়া হয়েছিলেন যদিও। আশ্রয় নিয়েছিলেন একটি মসজিদে। পরিবার ১০ নভেম্বর সকালে তাঁকে খুঁজে পেলেও তিনি বাড়ি ফিরতে চাননি। গায়ে কাপড় টেনে ঢেকে দিয়েছিলেন সেই কঠোর স্লোগান।

কাজ শেষে বাড়ি ফিরবে বলে মা-বাবাকে বিদায় দিয়েছিলেন নূর হোসেন। কিন্তু ফেরা আর হলো কই? ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর জোটবদ্ধ বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহ ‘ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি’ গ্রহণ করে। কর্মসূচির লক্ষ্য ছিল সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি আদায়। সেদিন স্বৈরাচারবিরোধী যে মিছিলটি পল্টন এলাকার ‘জিরো পয়েন্ট’ অতিক্রম করছিল, সেখানে ছিলেন নূর। কাঁদানে গ্যাস ও গুলি ছুড়ে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ করে দেয় তৎকালীন সরকারের পালিত পুলিশ। নূর হোসেনকে তখন আলাদা করে চেনা যাচ্ছিল খুব সহজে, গায়ে লেখা শ্বেত স্লোগানের কারণে। গুলি এসে বিঁধেছিল সেই গায়ে। তাঁর সঙ্গে সেদিন নিহত হন যুবলীগ নেতা বাবুলও। কিন্তু অষ্টম শ্রেণি পাস নূর হোসেনের গায়ে লেখা স্লোগান তাঁকে আজও অমর করে রেখেছে।

কোঁকড়া চুলের নূর হোসেন তিন দশক পরেও তরুণ, প্রাসঙ্গিক। তাঁর আত্মত্যাগ পরবর্তীকালে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় পথ দেখায়। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পতন ঘটে এরশাদ সরকারের। যে গণতন্ত্রকে মুক্তি দিতে নূর প্রাণ দিয়েছিলেন, সেই গণতন্ত্র বন্দী হয়ে গিয়েছিল আবারও। আর আবারও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং সরকার পতন হলো, কিন্তু গণতন্ত্র কি আজও মুক্তি পেল? কখনো পাবে? এ প্রশ্ন হয়তো নূর হোসেন মনে মনে ভাবছেন, অন্য জগতে বসে। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা।

লেখক: সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

সম্ভাবনার জটিল পথ

মামুনুর রশীদ
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

গত এক বছরে আমাদের জাতি এক অভূতপূর্ব রাজনৈতিক প্রজ্ঞা লাভ করেছে। জাতীয় গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ঘরের ভেতর থেকে চায়ের দোকান, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়—সর্বত্রই রাজনৈতিক আলোচনা, পর্যালোচনা এবং সেই সঙ্গে যাঁর যাঁর সুচিন্তিত মন্তব্যও দিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিদিনই সকাল-বিকেল কিছু না কিছু ঘটনা ঘটছে, সেসবের ওপরও তাৎক্ষণিক মন্তব্য হয়ে যাচ্ছে। এবারের উচ্চমাধ্যমিকের ফলেও তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। শিক্ষার্থীরাও পড়াশোনায় তেমন মনোযোগী হতে পারছে না। সমগ্র আলোচনা ওই রাজনীতিতে। চায়ের কাপেই বড় বড় সিদ্ধান্ত হয়ে যাচ্ছে।

মধ্যবিত্তের বাজারঘাটে টান পড়লেও তা আলোচনায় খুব একটা জায়গা পাচ্ছে না। রাজনীতিই মুখ্য এবং মুখ্য আলোচনার বিষয়। একটা বিষয় অবশ্য দেখার আছে—ক্লান্তিহীন, আড্ডাবাজ বাঙালি যেকোনো বিষয়ের ওপর আলোচনা করতে এবং সিদ্ধান্ত দিতে বড়ই উৎসাহী। ক্রিকেট খেলা দেখতে দেখতে অবলীলায় বিশ্ববিখ্যাত ব্যাটার বা বোলারদের ভুল ধরতে একটুও বিলম্ব করে না।

বলা হয়ে থাকে, সম্মিলিতভাবে বাঙালি সব সময়ই সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। জাতি যে এত রাজনীতিসচেতন হয়ে পড়ল, সেও ভালো কথা। কিন্তু যখন দেখি কোথাও সড়ক দুর্ঘটনা হলো বা পুলিশের লাঠিপেটায় রক্তাক্ত দেহ পড়ে আছে, কোথাও কোনো নারীর অসম্মান হচ্ছে, তখন তার ফোনের ক্যামেরাটি গর্জে ওঠে বটে কিন্তু মানুষ আগায় না। সবকিছু যে ক্যামেরায় ধারণ করার বিষয় নয়, প্রতিবাদী হওয়া প্রয়োজন, তা বোঝার বোধ হয় এখন আর দরকার নেই।

আমাদের লেখাপড়ার সময়টা ছিল ষাটের দশক, যখন দেশে বিপুল পরিমাণে নানা জায়গায় আন্দোলন চলছিল। তার মধ্যে শিল্প-সাহিত্য, বিজ্ঞানচিন্তা এবং বড় বড় রাজনৈতিক তত্ত্ব নিয়েও কথাবার্তা হতো। মিছিলে যাওয়ার আগে ও পরে এসব বিষয় নিয়ে তর্কের ঝড় উঠত। এই তর্কাতর্কির ফলেই একটা বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু এখন এমন একটা সময় এসেছে, যখন রাজনীতিই একমাত্র আলোচনা, তর্কবিতর্কের বিষয়।

এই সময়ের মধ্যে যে কত মানবিক বিপর্যয় ঘটে গেল, দুর্নীতি সকল সময়ের রেকর্ড অতিক্রম করল। শিক্ষাব্যবস্থা নিম্নমুখী, কতিপয় দুর্বৃত্ত আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠল—তার আলোচনা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ করে না। অসহায় কিছু মানুষকে দেখা যায় কোর্ট-কাচারিতে, জেলখানায় দৌড়াদৌড়ি করতে। আবার থানায় প্রচুর মানুষের ভিড়। মানুষ ভেবেছিল একটা পরিবর্তন আসবে, দুর্নীতির কবর রচনা হবে, সরকার একটি কল্যাণমুখী প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবে, দুর্নীতি বিদায় করতে যেমন কমিশন গঠন করেছে, তা দিয়েই চিরতরে এই অসুখটি নির্মূল হয়ে যাবে। কিন্তু তা হলো না। নির্বাচনই এখন একমাত্র আলোচনার বিষয়। অধিকাংশ লোক ভাবছে নির্বাচন হবে না। এই অবিশ্বাসই-বা কেন? মানুষ একটা আস্থাহীনতা এবং অবিশ্বাসের জায়গায় দাঁড়িয়ে গেল কেন?

বাঙালি চিরকালই সরকারবিরোধী। কারণ আছে অনেক। কিন্তু আস্থাহীনতা যদি সংক্রামক হয়ে জাতির সর্বক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে যায়, তাহলে তার পরিণতি কী হবে? উত্তরের জন্য বহু দূর অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই। এখনই দেখা যাচ্ছে মানবিক মূল্যবোধে ধস নেমেছে, যার হাজার হাজার উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে। আরও বহুবার বলেছি, রাষ্ট্রকে আমরা মানবিক করতে পারিনি। সব দল মিলেই ব্যবস্থাটা এমন হয়েছে যে সরকার রাষ্ট্রকে অধিকার করে ফেলেছে, সমাজ কোনোমতে ধিকিধিকি জ্বলছে। তবে সমাজের শক্তি এখনো আছে। নইলে যে নৈরাজ্যকে আমরা দেখেছি, তাতে দেশে বিপুল পরিমাণে দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়ে অনেক কিছুই তছনছ হয়ে যেত। কোনো কোনো ওয়াজ-মাহফিল থেকে যেসব উসকানিমূলক বক্তব্য আসে, তাতে সব জায়গায় অগ্ন্যুৎপাত হওয়ার কথা। কিছু কিছু জায়গায় যে তা হয়নি, তা-ও সত্য নয়। অনেক জায়গায়ই ফেসবুকের একটি পোস্ট অনেক দাঙ্গাবাজির কারণ হয়েছে। সেসব ঘটনায় আমাদের সমাজ সত্যিই একটা ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এবার কোনো শক্তিই তেমন দুর্বার হয়ে উঠতে পারেনি। আর সমাজের সবচেয়ে বড় শক্তিটি এখনো সোচ্চার হতে পারেনি।

আমাদের অর্ধশতকের শিক্ষাব্যবস্থা মানুষকে সত্য বলতে শেখায়নি। রাজনীতিবিদ, আমলা, বিচারক, শিক্ষক ও শিক্ষাব্যবস্থার নিয়ন্ত্রকও সত্য ভাষাকে উৎসাহিত করেনি। একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা সর্বত্রই উৎসাহিত হয়েছে। আজকে যে শুধু রাজনীতিই একমাত্র আলোচ্য বিষয়, তার কারণও হচ্ছে সমাজের অন্য সমস্যাগুলোর সমাধান না করে একটি দুর্নীতির পথই বেছে নিয়েছে সবাই। যদি সব জায়গায়ই একটা সুস্থ-স্বাভাবিক ধারা অব্যাহত থাকত, তাহলে এ জায়গায় এসে দাঁড়াতাম না আমরা। সমাজের সর্বত্র সত্যকে মূল্যায়ন করার একটা ব্যবস্থাই পারত সমাজকে রক্ষা করতে। রাজনীতির বৃহত্তর অর্থে প্রয়োগটাও হয়নি।

মানুষের মহত্তম কল্যাণের পথটা রাজনীতিই খুলে দেয়। চীন, রাশিয়া, কিউবার বিপ্লবে সে দেশগুলোর জনগণ একটা মুক্তির পথ পেয়েছিল। তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক সব ধর্মান্ধতা এবং গোঁড়ামি থেকে একটা মুক্ত সমাজ গড়েছিলেন। আমাদের দেশেও লাখ লাখ মানুষ দেশের জন্য বড় বড় ত্যাগ স্বীকার করেছেন। কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্ব তা সমাজের কাজে ব্যবহার করতে পারেননি। একটাই বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা হলো ক্ষমতা। ক্ষমতার ব্যবহার এবং অপব্যবহার একটি সমাজের জন্য যে কত ভয়ংকর হতে পারে, তা আমরা দেখেছি। এটা সবাই স্বীকার করছেন, আমরা একটি সংকটকাল পার করছি। তার মধ্যেও মানুষের মনে আশা জাগে—একটা সুদিন আসবে। কীভাবে যে সে আশা পূর্ণ হবে আমি জানি না, কেউ জানে কি না জানি না, তবে কেউ না কেউ নিশ্চয়ই জানেন। জেনে থাকলে আমাদের খবর দেবেন।

লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

নদীপাড়ের মাটি লুট

সম্পাদকীয়
নদীপাড়ের মাটি লুট

দেশে এমনিতেই ফসলি জমি হ্রাস পাচ্ছে। সেটি কমে যাওয়া মানে খাদ্যের উৎপাদনও কমে যাওয়া। যে কারণে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়ে থাকে, কোনো আবাদি জমি যাতে পতিত না থাকে।

সেই ফসলি জমির মাটিই যদি কেটে নেওয়া হয়, তাহলে খাদ্য উৎপাদনের কী হবে! মাদারীপুর সদর উপজেলায় আড়িয়াল খাঁ ও কুমার নদের পাড়ের অন্তত ২০টি স্থান থেকে অবৈধভাবে মাটি কেটে বিক্রি করছেন স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি। তাঁদের একজন হলেন ইলিয়াস চৌকিদার। প্রতিদিন রাত থেকে ভোর পর্যন্ত ট্রলারে করে অবাধে মাটি কেটে নেওয়ার ফলে নদীপাড়ের গ্রামগুলোর মানুষের জীবনে এক বিশাল ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে।

বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০-এর ৪-এর খ ও গ ধারা অনুযায়ী সেতু, কালভার্ট, বাঁধ, সড়ক, রেললাইন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার ১ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে বালু বা মাটি তোলা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু যাঁরা মাটি কাটেন তাঁরা এই আইন মানেন না। আইন অমান্য করার জন্য তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। কিন্তু তাঁদের বিরুদ্ধে কম ক্ষেত্রেই ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়। প্রশাসন অবৈধভাবে মাটি কাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় না কেন, সেটা বোধগম্য নয়।

নদীর পাড় থেকে মাটি কাটার কারণে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হচ্ছে, যা ভাঙনে সহায়তা করবে। শুধু নদীভাঙনই নয়, এভাবে মাটি কাটার ফলে একজন কৃষকের সবজিখেত সরাসরি ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়েছে। কয়েকজন কৃষক অভিযোগ করেছেন, ফসলি জমির মাটি কেটে নেওয়ায় জমির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পাচ্ছে এবং ফলনও কমে গেছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ সত্ত্বেও ইলিয়াস চৌকিদার মাটি কাটা অব্যাহত রেখেছেন। এমনকি প্রতিবাদ করায় তিনি গ্রামের একজনকে ‘চোখ তুলে ফেলার’ হুমকিও দিয়েছেন। ভুক্তভোগী স্থানীয় বাসিন্দারা বহুবার প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দিলেও কোনো আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।

অবৈধভাবে এই মাটি কাটা রোধে নদের তীরবর্তী এলাকাগুলোতে নিয়মিত টহলের ব্যবস্থা চালু করা দরকার। কেবল দিনের বেলাতেই নয়, মাটি কাটার মূল সময় অর্থাৎ রাতে ও ভোরে কঠোর নজরদারি বাড়াতে হবে। পাশাপাশি যাঁরা রাজনৈতিক প্রভাবে এ ধরনের অপকর্ম করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। কেবল জরিমানা নয়, মাটি কাটার সরঞ্জাম জব্দ এবং কঠোর কারাদণ্ড নিশ্চিত করতে হবে, যাতে অন্যরা এমন কাজ করার সাহস না পান।

নদীর পাড়ের ফসলি জমি বাঁচানো না গেলে, পুরো গ্রামই একদিন মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে পারে। সে জন্য প্রশাসনকে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, যাতে এই দুই নদ স্বাভাবিকভাবে প্রবাহিত হতে পারে এবং নদের দুই পাড়ের স্থানীয় মানুষজন ভাঙন ও ভূমি হারানোর আতঙ্ক থেকে মুক্তি পান।

অবৈধভাবে মাটি কাটা প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। মাটি ব্যবস্থাপনা নিয়ে সরকারি যে আইন রয়েছে, আমরা সেই আইনের বাস্তবায়ন দেখতে চাই।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত