Ajker Patrika

কোটি টাকার নিচে কথাই বলে না

সাধারণ মানুষ কি সবাই চোখ বন্ধ করে আছে? তারা কি দেখছে না। পরিবর্তনগুলো চোখে পড়ছে না? আগে যে উবারে উঠতে পারত না, কোন জাদুবলে এখন বিজনেস ক্লাসে করে পরিবার নিয়ে বিদেশ ভ্রমণে যায়? এসব প্রশ্ন উঠছে। কিন্তু জবাব মিলছে না। আবার অনেকে ট্যাগ আর মবের ভয়ে প্রশ্নও করতে সাহস পাচ্ছেন না।

মাসুদ কামাল
কোটি টাকার নিচে কথাই বলে না

‘এরা দেখি কোটি টাকার নিচে কথাই বলে না!’—পরিচিত এক ব্যবসায়ী হতাশ কণ্ঠে বললেন। বুঝলাম—রিয়াদ ইস্যুতে এমন প্রতিক্রিয়া তাঁর। রিয়াদ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতা। এনসিপি বা সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা। তাঁর ফেসবুকে সেসব নেতার সঙ্গে ছবিও দেখা যায়। গুলশানে আওয়ামী লীগের এক সাবেক নারী এমপির বাসায় চাঁদাবাজির ঘটনায় এখন গ্রেপ্তার হয়ে পুলিশের হাতে। আদালত থেকে এরই মধ্যে রিয়াদ ও তাঁর সঙ্গীদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে মিলছে অনেক তথ্য। এরই মধ্যে তাঁর বাসায় তল্লাশি চালিয়ে সোয়া দুই কোটি টাকার চেক উদ্ধার করা হয়েছে। এসব চেক তাঁরা জোর করে নিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাবেক এক এমপি আবুল কালাম আজাদের কাছ থেকে।

এই আবুল কালাম আজাদ ২০০৯-এ রংপুরের পীরগঞ্জ থেকে উপনির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এর পরে আর কখনো নির্বাচন করেননি। রাজনীতি থেকেও দূরে ছিলেন। এখন পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী। এমন লোক রিয়াদকে এত বড় অঙ্কের চেক দিলেন কেন? রিয়াদদের টেকনিকটা চমকপ্রদ। তাঁরা ওই সাবেক এমপির অফিসে গেছেন। প্রথমেই সবার মোবাইল ফোন নিয়ে নিয়েছেন। সঙ্গে করে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার ছবি নিয়ে গেছেন। সেসব আবুল কালাম আজাদের পেছনে রেখে ছবি তুলেছেন। তারপর হুমকি দেন জুতার মালা পরিয়ে হেনস্তা করার। বলেন, অফিসের নিচে শ দুয়েক লোক আছে। তাদের ডেকে এনে তাণ্ডব ঘটাবেন। এরপর জোর করে তাঁকে দিয়ে কয়েকটি চেকে স্বাক্ষর করিয়ে নেন।

দেশের বর্তমান বাস্তবতায় চাঁদা আদায়ের এই পদ্ধতিটি বেশ কার্যকর। ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’—এই ট্যাগ দিয়ে মানুষকে হেনস্তা করার ঘটনা তো গত এক বছরে কম ঘটেনি আমাদের এই মাতৃভূমিতে। কোনো সত্যতা বা তথ্য-প্রমাণের দরকার নেই, কতগুলো স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র যদি আপনার গায়ে ওই ট্যাগ লাগিয়ে দেয়, তাহলে ওটাই সত্য। আপনাকে যদি তখন চড়-থাপ্পড় মারা হয়, গলায় জুতার মালা পরিয়ে দেওয়া হয়, কেউ প্রতিবাদ করবে না। আশপাশে যদি পুলিশও থাকে, তারাও দর্শক হয়ে যাবে, কিছু বলবে না। কারণ, ট্যাগিংয়ের ভয় সাধারণ মানুষের পাশাপাশি পুলিশের মধ্যেও ক্রমেই ভর করেছে। পটিয়ার ঘটনার কথা মনে আছে? সেখানে থানার মধ্যে নিয়ে একজনকে পেটানো হয়েছে। যাঁকে পেটানো হয়েছে, তিনি এই এলাকার লোকও নন। তাঁর বিরুদ্ধে কোনো মামলাও নেই। এখন ওই ‘ছাত্র’ নামধারীদের কাছে তাঁকে ছাত্রলীগ বলে সন্দেহ হয়েছে, তাই তাঁকে পেটানো জায়েজ হয়ে গেছে! এই মব কালচার তো অহরহই হচ্ছে। সবাই মেনেও নিচ্ছে। কিন্তু পটিয়ার ওসি সেটা মেনে নেননি। তাই হইচই, থানায় ভাঙচুর। এই যে একটা ঘটনা, এর প্রতিকার কী হলো? মব সৃষ্টিকারীদের কোনো বিচার হয়েছে? না, হয়নি। বরং উল্টো ওসি সাহেবকেই প্রত্যাহার করা হয়েছে। কী মেসেজ গেল সবার কাছে। এরপর আর কোনো পুলিশ কর্মকর্তা, নিতান্ত পাগল না হলে, মবের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর আগ্রহ অনুভব করবেন? এই অরাজকতার শেষ কবে—জানে না কেউই।

এবার বরং কোটি টাকার কথাটা বলি। চাঁদা হিসেবে তাঁরা কোটি টাকার নিচে কেন কথাই বলেন না? এঁরা কি খুবই ধনীর ঘরের ছেলে যে কোটি টাকা দেখে দেখে খুবই অভ্যস্ত? তাঁদের ড্রয়ারে বা বিছানার নিচে এমন পরিমাণ টাকা অবহেলায় পড়ে থাকে? আমি বুঝি না। আসলে বুঝবই-বা কীভাবে? আমার এই জীবনে কখনো তো এক কোটি টাকা একসঙ্গে আমি দেখিইনি। রিয়াদের পরিবারের যে পরিচয় পেলাম, তাতে বিস্ময়ের মাত্রা আরও বাড়ল। তাঁর পিতা নাকি একজন রিকশাচালক। রিকশাচালক বলে অবজ্ঞা করছি না, বরং তিনি একজন খেটে খাওয়া মানুষ হিসেবে আমার কাছে কিছুটা বাড়তি সম্মানই পাবেন। কিন্তু এমন একজন সম্মানিত শ্রমজীবী মানুষের ঘরে কুপুত্রের বিচরণ কীভাবে হয়? শুনলাম, এই রিয়াদ নাকি গত ঈদে আড়াই লাখ টাকা দিয়ে কোরবানি দিয়েছেন! তাঁর বাবা কিংবা পরিবারের সদস্যরা এ নিয়ে প্রশ্ন করেননি? করেননি যে, সেটা বুঝতে পারি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—এমন পরিবার থেকে উঠে আসা একটা ছেলে, যাঁর দাড়ি-গোঁফও ঠিকমতো গজায়নি, হুট করে কোটি টাকা দাবি করে বসে কীভাবে? আমার কেন যেন মনে হয়, শুরুতে তাঁরা এমন অঙ্কের টাকা দাবি করতে কিছুটা দ্বিধা করতেন। কিন্তু ধীরে ধীরে রেট বাড়াতে বাড়াতে এখন কোটি টাকা তাঁদের কাছে আর কোনো ফিগার বলেই মনে হয় না। তা ছাড়া আরও একটা ব্যাপার আছে, এঁদের পেছনে কেউ না কেউ বড় চাঁই আছে। তারাই বিভিন্ন জনকে দিয়ে এসব করায়। রিয়াদ ধরা পড়েছেন, অন্যরা এখনো ধরা পড়েনি।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা এ প্রসঙ্গে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তাঁর মতে, এই চাঁদাবাজির শিকড় নাকি অনেক গভীরে। তাঁর এমন মন্তব্যের কারণে এনসিপির কোনো নেতার দিকেই এখন আর সন্দেহ ছাড়া তাকাতে পারি না। এদের চালচলন, পোশাক-আশাকের পরিবর্তন দেখে প্রশ্নগুলো আগেই জাগত। কিন্তু সেটা এখন রীতিমতো সন্দেহে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের একটা পোস্ট সেই সন্দেহকে আরও দৃঢ় করেছে। গভীর রাতে ফেসবুকে দেওয়া পোস্টে তিনি ইঙ্গিত দিয়ে বললেন, ‘একটা সার্কেলের প্রায় সবাই দুর্নীতিবাজ!’ পুরো পোস্টটা পড়লে যে কারও কাছেই মনে হবে তিনি আসলে কাদেরকে ইঙ্গিত করছেন। এই সন্দেহটা আরও দৃঢ় হয় তখনই, যখন দেখা যায় মাত্র দেড় ঘণ্টার মধ্যে, ভোররাতে তিনি সেই পোস্টটা আবার সংশোধন করলেন। সংশোধিত পোস্টে ইঙ্গিতপূর্ণ শব্দ ও বাক্যগুলো তুলে নিলেন।

আসলে মাহফুজ বা উমামা কী বললেন, সেসবই যে একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তা নয়। সাধারণ মানুষ কি সবাই চোখ বন্ধ করে আছে? তারা কি দেখছে না। পরিবর্তনগুলো চোখে পড়ছে না? আগে যে উবারে উঠতে পারত না, কোন জাদুবলে এখন বিজনেস ক্লাসে করে পরিবার নিয়ে বিদেশ ভ্রমণে যায়? এসব প্রশ্ন উঠছে। কিন্তু জবাব মিলছে না। আবার অনেকে ট্যাগ আর মবের ভয়ে প্রশ্নও করতে সাহস পাচ্ছেন না।

গত বুধবার একটা অনুষ্ঠানে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে তাদের এক্সিট প্ল্যান করে রাখার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। বিষয়টা আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী বলে মনে হয়েছে। সরকার নিশ্চয়ই তাদের সেই পরিকল্পনা করছে। আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে—এই তরুণ নায়কেরাও (নাকি খলনায়ক?) কি তাঁদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবছেন? তাঁদের অভিভাবক হিসেবে পরিচিত এই সরকার তো আর অনন্তকাল থাকবে না। নতুন যে সরকার আসবে, তারা নিশ্চয়ই তাঁদেরকে বর্তমানের মতো প্রটেকশন দেবে না। সে ক্ষেত্রে তখন কী হবে?

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত