Ajker Patrika

‘হীরকরাজ্যের’ শিক্ষা ও ইতিহাস

সুমন আহসানুল ইসলাম
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

‘লেখাপড়া করে যেই, অনাহারে মরে সেই।’

‘জানার কোনো শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই।’

হীরকরাজের এস শ্লোক আপনারা জানেন। যেটা জানেন না তা হলো, হীরকের রাজ্যটি কোথায়? এর অক্ষাংশ, দ্রাঘিমাংশ কত? আমিও জানি না। তবে হীরকরাজ্যের ইতিহাস আর তারে চেনার কিছু লক্ষণ জানি। সেগুলোই আপনাদের জানাব।

আজ থেকে খুব বেশি দিন না, এই ধরেন, বারো-সাড়ে বারো শ বছর আগের কথা। হীরকরাজ্যে তখনো জ্ঞান-বিজ্ঞান, বিদ্যা-শিক্ষার চর্চা হতো। রীতিমতো বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। ৩০০ বছর ধরে শুধু উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকেই নয়, বরং চীন, তিব্বত, ব্রহ্মদেশ (মিয়ানমার), শ্যামদেশ (থাইল্যান্ড), মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়াসহ নানা দেশ থেকে মানুষ শিক্ষা নিতে, জ্ঞান লাভ করতে আসতেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান নামে বিশ্ববিখ্যাত এক পণ্ডিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আচার্য্যের দায়িত্ব পালন করেছেন। বোঝেন, কী একটা অবস্থা! হীরকরাজ্যে কী চলছিল তখন? ২৫° ০´ উত্তর থেকে ২৫° ১৫´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮° ৫০´ পূর্ব থেকে ৮৯° ১০´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত ‘সোমপুর বিহার’ সেই বিশ্ববিদ্যালয়—এখন আপনারা যারে ‘পাহাড়পুরের ডিবি’ নামে চেনেন।

যা হোক, এই অবস্থা বেশি দিন চলেনি। শিগগির হীরকরাজের মন্ত্র ‘বিদ‍্যা লাভে লোকসান, নাই অর্থ, নাই মান’ পাঠ করতে করতে কৈবর্তরা চলে এলেন দক্ষিণ ভারত থেকে। সোমপুর বিহার ধ্বংস করে হীরকরাজ্যের ‘গর্ভগৃহ’র গোড়াপত্তন করলেন হাজার বছর আগে। হীরকরাজ্যে যখন বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করা হচ্ছিল, বেকুব বিলাতিরা তখন প্রতিষ্ঠা করছিল অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। তারও শ তিনেক বছর পর শুরু হয় হীরকরাজ্যের স্বর্ণযুগ। যখন দোয়া-দরুদ জপতে জপতে, মাহী-সওয়ার হয়ে, দরিয়া পাড়ি দিয়ে, ঘোড়ায় চড়ে, ঝান্ডা হাতে আরব থেকে, তুর্কি থেকে চলে এলেন শেখেরা, মিয়াঁরা–তারপর আর পেছন ফিরে দেখতে হয়নি। হীরকরাজ্যের বিস্তৃতি চলছে আজও।

আসেন দেখি এই হাজার বছরে হীরকরাজের ‘শ্লোকগুলো’ এই রাজ্যে কীভাবে গ্রথিত হয়েছে। মাত্র চার শ বছর আগে। হীরকরাজ্য তখন শাসন করেন বিলাদ-ই-হিন্দুস্তানের পাঁচ নম্বর শাহানশাহ্-এ-সালতানাত আল হিন্দিয়া, পাদিশাহ-এ-হিন্দোস্তান মির্জা শাহাবুদ্দিন মুহাম্মাদ খুররাম–আপনারা তাঁরে চেনেন প্রেমের বাদশাহ শাহজাহান নামে। চার বিবি ছিলেন তাঁর মহলে। আর আরও এগারো খাদেমা থাকতেন হেরেমে। কিন্তু একজন বিবির প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল ভারত মহাসাগরের পানির সমান। মাসনা-বিবি আরজুমান্দ বানু বেগমের গোরস্থানের ওপর ২০ বছর ধরে, আজকের হিসাবে বিলিয়ন ডলার খরচ করে আলপনা তৈরি করেন ‘তাজমহল’। হীরকরাজ্যে যখন এই মহান কৃতি চলছিল, বুরবক আম্রিকানরা তখন বানিয়েছে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়।

হীরকরাজের মন্ত্রে মশগুল রাজ্য ভালোই চলছিল। কিঞ্চিৎ সমস্যা দেখা দিল, আংরেজদের কারণে। আজ থেকে প্রায় দশ কম দুই শ বছর আগে, কিছু অতি পাকনা পাবলিক ইংরেজি-টিংরেজি শিখে ফেলল। তারপর যা হয়, বিবিধ বই-পুস্তক পড়ে হীরকরাজ্যের ‘জানার কোনো শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই’ বিরোধিতা করতে লাগলেন। রাজ্যে বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে কেউ দিলেন বিধবার বিয়ে, তো কেউ বসে পড়লেন চামারের সঙ্গে এক পাতে। এসব করলে কি আর হীরকরাজ্যের খুছুসিয়াত থাকে?

রাজ্যের স্থিতাবস্থা ফিরিয়ে আনতে তাই হীরকরাজের শ্লোকমূলে ‘লেখাপড়া করে যে, গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সে’ ক্যাম্পেইন শুরু হয়। মূল বার্তা হলো লেখাপড়া করো, কিন্তু জ্ঞান, বিজ্ঞান, দর্শন, নীতি-নৈতিকতা—এসব শেখার দরকার নাই। শুধু দেখো অনাহারে যেন মরতে না হয়। টাকাপয়সা কামানোর জন্য কিছু পড়াশোনা করো। গাড়ি-ঘোড়া কেনার জন্য, চড়ার জন্য লেখাপড়া করো। কিন্তু কোনো কিছু জানতে চেয়ো না। ‘জানার কোনো শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই’ মুখস্থ করো, উগলে দাও, পরীক্ষা পাস দাও, টাকা কামাও। প্রশ্ন করার দরকার নাই, প্রশ্ন করা বেয়াদবি। জ্যোতির্বিদ্যা পড়ো, কিন্তু জ্যোতিষবিদ্যা বিশ্বাস করো। চিকিৎসাবিদ্যা পড়ো, হিপোক্রেটিক শপথ ভুলে যাও। নীতি-নৈতিকতা পড়ো, সেটার ওয়াজ-নসিহত করো, টাকা কামাও। ভুলেও ওসব নীতি-নৈতিকতার চর্চা করতে যেয়ো না। ওসব শিখলে টাকা কামানো যাবে না।

না। এর পরে হীরকরাজ্যে শিক্ষাটিক্ষা নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সমস্যা হয় নাই। একটা সম্ভাবনা যদিও দেখা দিয়েছে, এই মাত্র অর্ধশতক বছর আগে, ১৯৭১ সালে। আট শ দশ বছর পর হীরকরাজ্যের জনগণ আবার নিজেরা নিজেদের শাসন ফিরে পায়। সবাই ভাবছিল ‘সোমপুর’-এর সেই দিন ফিরে আসবে। কিন্তু না, তা হয়নি। খুবই সাফল্যের সঙ্গে হীরকরাজ্যের শিক্ষা-ঐতিহ্য ধরে রাখা গেছে। বরং হীরকরাজের মন্ত্রের সঙ্গে আংরাজ আমলের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে প্রায় পৌনে দুই শ ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করা গেছে। ব্যাপক বাণিজ্য হচ্ছে। সেই সঙ্গে জ্ঞান-বিজ্ঞানের, নীতি-নৈতিকতা, দর্শন-চিন্তাকে সযত্নে সরিয়ে রাখতে পেরেছে।

হীরকরাজ্যের শিক্ষা-শ্লোক বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে, এই শেষ চুয়ান্ন বছরে অর্জন, স্বয়ং হীরকরাজের চেয়ে বেশি। গদিনশিনগণ হীরকরাজ্যের শিক্ষাকে সমৃদ্ধ করেছেন, যুক্ত করেছেন নতুন মাত্রা। এই সময়ে শিক্ষার মাধ্যমে পুরো জাতিকে বিভাজিত-বিভক্ত করা গেছে সফলভাবে। একটা সহজ উদাহরণ দিই—হীরকরাজ্যে শিক্ষিতজনদের মধ্যে এখন তিনটা দল। একদল মনে করে, রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বরের কাছাকাছি এক মহামানব। আরেক দল রবীন্দ্রনাথকে দেখে শয়তানের দোসর হিসেবে। তৃতীয় দল রবীন্দ্রনাথকে চেনেই না, চেনে টেগোরকে। এই রকম বিভক্তি আংরেজরাও করতে পারেনি হীরকরাজ্যে।

হীরকরাজ ‘যন্তরমন্তর’ ঘরে ঢুকিয়ে ‘মগজ ধোলাই’ করতেন। বর্তমান সময়ে প্রাচীন সেই যন্তরমন্তর ঘর আর নাই। শিক্ষার মাধ্যমেই ‘মগজ ধোলাই’ দেওয়া হয়। শিক্ষার মূলমন্ত্র জ্ঞান নয়, ‘ইয়াকিন’, বিশ্বাস—প্রশ্নহীন বিশ্বাস। নিজেকে ভুলে গিয়ে কেউ বিশ্বাস করেন প্রাচ্যে, কেউবা পাশ্চাত্যে। গত চুয়ান্ন বছরে হীরকরাজ্যে এ এক বিশাল অর্জন। অভিনন্দন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত