Ajker Patrika

যেখানে যা কিছু দরকার, প্রকৃতি সেভাবেই সজ্জিত

আব্দুর রাজ্জাক প্রকৌশলী
নির্দিষ্ট জায়গায়, নির্দিষ্ট প্রকৃতির খাবারদাবার জন্মায়—এটাই প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য। ফাইল ছবি
নির্দিষ্ট জায়গায়, নির্দিষ্ট প্রকৃতির খাবারদাবার জন্মায়—এটাই প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য। ফাইল ছবি

কিছুদিন আগে ভোলাগঞ্জের পাথর নিয়ে সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে—পাথর অপসারণ করা হয়েছে। দৃষ্টিনন্দন সাদাপাথর, যেখানে পর্যটকেরা এই পাথর দেখার টানে ভ্রমণে যেতেন। পাথর সরানোর পরে সেখানে গেলে দেখতে পাবেন মাটি ও বালুর বিছানা পাতা। যা হোক, প্রশাসনের উদ্যোগ ও সচেতন জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে বিষয়টি, পাথর আবার সাবেক জায়গায় পুনঃস্থাপনের কাজ চলছে ত্বরিতগতিতে। যত তাড়াতাড়ি অঞ্চলটি আগের মতো হবে, আবার পর্যটকেরা যথারীতি ওখানে যাতায়াত শুরু করবেন, সেই আশা করছি। প্রকৃতির গঠনের সঙ্গে কৃত্রিমভাবে বেশি জোরাজুরি করতে নেই। প্রকৃতির মূল বৈশিষ্ট্য ঠিক রেখে বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে পরিবর্তন অবশ্যই করা যেতে পারে, সেটা হতে হবে পরিকল্পিতভাবে।

এখন আসি প্রকৃতির কথায়। একেক অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য একেক রকম। স্থানভেদে জলবায়ুর তারতম্য আছে, মাটির গুণাগুণ, পারিপার্শ্বিক আবহাওয়া, ভৌগোলিক অবস্থানসহ অন্য সবকিছু বিশ্লেষণ করেই হাজার হাজার বছরের বিবর্তনের ফলে নির্দিষ্ট একটি অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে আমাদের এই সুন্দর পৃথিবী। পৃথিবীর কোনো অঞ্চল পাহাড়-পর্বতে ঘেরা, কোনো অঞ্চল জঙ্গলে আচ্ছাদিত, কোনো অঞ্চল মরুভূমি, কোনো অঞ্চল জলাশয় ও পানিতে প্লাবিত থাকে সারা বছরই। নানান বৈশিষ্ট্যে নানান আবহাওয়ার কারণেই এইসব ঘটে। বড় কোনো বিপর্যয় না ঘটিয়ে সাধারণ কিছু পরিবর্তন করা যায় মানুষের বসবাস ও চলাফেরার জন্য, সৌন্দর্যবর্ধনের জন্যও কিছু পরিবর্তন করা যায়। তাই বলে একেবারেই মূল বৈশিষ্ট্য থেকে আমূল পরিবর্তন করলে সেই অঞ্চল বেশি দিন টিকবে না, সেখানে দৈবদুর্বিপাক নেমে আসতে বাধ্য, সেটা আজ হোক বা কিছুদিন পরে হোক।

একেক অঞ্চলের বন-জঙ্গল, গাছ, পাতা, তরুলতা একেক বৈশিষ্ট্যের। সাদা চোখে দেখলে মনে হবে এখানে এই জঙ্গল, এই প্রকৃতির গাছ, এই প্রকৃতির লতাপাতার পরিবর্তে দৃষ্টিনন্দন গাছ, সুন্দর লতাপাতা—যেটা ওখানকার বৈশিষ্ট্য না—মনের মতো অন্য অঞ্চল থেকে আমদানি করা, দেখতে সুন্দর বৃক্ষ, লতা, গুল্ম দিয়ে সুশোভিত বাগান করলে বোধ হয় ভালো হতো। মানুষ চেষ্টাও করছে, যেসব বৈশিষ্ট্যের বনাঞ্চল, লতাপাতা, প্রাকৃতিক জঙ্গল তাদের মনঃপূত নয়, সেগুলো অপসারণ করে কৃত্রিম উপায়ে নতুন করে বনাঞ্চল তৈরির চেষ্টা করছে। যেমন, বেশ কয়েক বছর যাবৎ আমাদের দেশে ইউক্যালিপটাসগাছ দিয়ে ভরে গিয়েছিল। এখন গবেষণায় দেখা গেছে এটা পানিখেকো গাছ, প্রকৃতি ধ্বংস করে অন্যান্য গাছের বর্ধন রহিত করে। এখন এটার রোপণ কিছুটা বন্ধ হয়েছে। এ রকম আরও উদাহরণ আছে।

যে অঞ্চলের জলবায়ুর জন্য যে ধরনের বনাঞ্চল থাকার দরকার বা প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার জন্য যে ধরনের লতাগুল্মসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদান থাকার দরকার, সেটা সেভাবেই তৈরি হয়েছে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন।

পৃথিবীর অঞ্চলভেদে মানুষের শারীরিক গঠন, জিনগত বৈশিষ্ট্য, শারীরিক সহনশীলতা অঞ্চলভেদে ভিন্ন। তাই প্রাকৃতিকভাবে এইসব অঞ্চলের জন্য কৃষিপণ্য, ফলমূলসহ প্রধান খাদ্যের বৈশিষ্ট্য আলাদা। গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চল, শীতপ্রধান অঞ্চল, নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চল, পাহাড়ি অঞ্চল, জলাভূমি অঞ্চলের মানুষের জন্য উপযোগী করে খাদ্যের উপকরণসহ ফলমূল, শাকসবজি সেই অঞ্চলের মতো করে উৎপাদিত হয়; যেটা নির্দিষ্ট অঞ্চলের মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য অতিপ্রয়োজনীয়। এটা সাধারণভাবেই হয়ে আসছে হাজার বছর ধরে।

পৃথিবীর এমন অঞ্চল আছে যেখানে প্রচুর আঙুর, আপেল, নাশপাতি উৎপাদিত হয়। খুবই সুস্বাদু আঙুর, আপেল। ওই অঞ্চলের মানুষের জন্য হয়তো ওই ফলটাই দরকার। সেই রকম আপেল, নাশপাতি, স্ট্রবেরি, চেরি ফল যেসব জায়গায় উৎপন্ন হয়, সেইসব স্থানের মানুষের শারীরিক গঠন ও জিনগত বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে এইসব ফলমূল ও প্রধান খাদ্য জন্মায়। একটা কথা বলে রাখি, এইসব লোভনীয় ফলের ওপর আমাদের যে আকাঙ্ক্ষা, সেটা ফলগুলোর জন্মস্থানের বাসিন্দাদের নেই। যেসব জায়গায় এসব ফলমূল উৎপন্ন হয়, সেখানকার মানুষ কিন্তু তেমন একটা উৎসাহ নিয়ে খায় না, স্বাভাবিকভাবে খায় আরকি।

আমাদের দেশে যেসব ফল উৎপন্ন হয়—যেমন আম, জাম, কাঁঠাল, আনারস, লিচু, পেয়ারা, আমড়া, চালতা, বরই—হয়তো এ দেশের আবহাওয়া, ভৌগোলিক অবস্থান ও মানুষের জিনগত বৈশিষ্ট্য, সবকিছু মিলিয়ে রোগ প্রতিরোধ ও শারীরিক গঠনের জন্য এই ধরনের ফলমূল ও দেশীয় খাদ্য দরকার। আমাদের প্রধান খাদ্য চালসহ যেসব তরকারি, মাছ, মাংস, ফলফলাদি আমরা নিয়মিত খাই, সেটাই হয়তো আমাদের শরীরের বৈশিষ্ট্যের জন্য দরকারি। অন্যান্য দেশের জন্যও সেই জায়গায় উৎপাদিত ফলমূল ও প্রধান খাদ্য তাদের উপযোগী করে সেখানে উৎপন্ন হয়। যেখানে যেটা উপযোগীভাবে উৎপাদিত হয়, তাদের সেভাবেই সেটা ব্যবহার করা উচিত।

ওপরের এতকিছু আলোচনা করলাম এই কারণে যে, বেশ কয়েক বছর যাবৎ, হয়তো ৬০ থেকে ৬৫ বছর যাবৎ, আমাদের দেশের মানুষের আঙুর, আপেল, নাশপাতি, কমলা ও মাল্টাসহ আমদানি করা ফলের ওপর নজর পড়েছে। বাজারে প্রচুর দাম, তবু আমরা সেগুলো কিনি—কোনো আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে গেলে, রোগী দেখতে গেলে সেগুলো নিয়ে যাই। খেতে মজা, দেখতে ভালো। নিজের ইজ্জত বাড়ে এইসব ফল খেলে এবং অন্যের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার সময় নিয়ে গেলে!

কিন্তু আমাদের এই আবহাওয়া ও এই অঞ্চলের মানুষের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখে যেসব ফল উৎপন্ন হয়—আগেই বলেছি আম, জাম, কাঁঠাল, আনারস, পেঁপে, কুল—যেসব ঋতুতে উৎপন্ন হয়, সেই সময় হয়তো এই ধরনের ফলমূল আমাদের শরীরের জন্য প্রয়োজন। তাই ঋতুভেদে যেসব ফলমূল আমাদের এখানে পাওয়া যায়, সেগুলো খাওয়া উচিত, বাচ্চাদের খাওয়ানোর অভ্যাস করানো উচিত। এটা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য, রোগ প্রতিরোধের জন্য, শারীরিক গঠনের জন্য, চোখের দৃষ্টি অথবা অন্য কোনো শারীরিক উপকারের জন্যই এগুলো খাওয়া উচিত। এটাই প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য—নির্দিষ্ট জায়গায়, নির্দিষ্ট প্রকৃতির খাবারদাবার জন্মায়—বেঁচে থাকার জন্য, ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত