Ajker Patrika

বিশ্বশক্তির মেরুকরণ ও আমাদের ভবিষ্যৎ

অজয় দাশগুপ্ত
এসসিও সম্মেলনে পুতিন, মোদি এবং সি। ছবি: সংগৃহীত
এসসিও সম্মেলনে পুতিন, মোদি এবং সি। ছবি: সংগৃহীত

‘গ্লোবাল সাউথ’ আজ একটি শক্তিশালী ধারণা—যেখানে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, পরিবেশগত, সাংস্কৃতিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতার মাধ্যমে দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলো নতুন সংহতি গড়ে তুলছে। এটিকে সাউথ-সাউথ কো-অপারেশন বলা হয়। একসময় যেখানে বিশ্বরাজনীতির নিয়ন্ত্রণ ছিল মূলত উত্তর গোলার্ধের উন্নত দেশগুলোর হাতে, আজ সেখানে গ্লোবাল সাউথ বিকল্প শক্তি হিসেবে নিজেদের পরিচয় তুলে ধরছে। চীন বিশ্বব্যাপী এখন এই প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে, যা ব্রিকস সম্প্রসারণের মতো উদ্যোগ থেকে শুরু করে এসসিওর আঞ্চলিক নিরাপত্তা ফোরামের মধ্যে আবর্তিত। সবই মূলত আমেরিকার নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে গড়ে তোলার অংশ।

ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পশ্চিমা দেশগুলো পুতিনকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন করেছে। কিন্তু গ্লোবাল সাউথের জোটগুলো রাশিয়াকে কূটনৈতিক মঞ্চে আবারও ফিরিয়ে আনছে। এসসিও সম্মেলনে পুতিন, সি এবং মোদির একসঙ্গে থাকা রাশিয়ার জন্য একটি বড় কূটনৈতিক সাফল্য। রুশ দূতাবাস ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে, তারা শিগগির চীন-ভারত-রাশিয়া ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের আয়োজন করতে চায়। এটি বাস্তবায়িত হলে বৈশ্বিক শক্তির ভারসাম্যে তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলবে।

হঠাৎ করে নতুন মেরুকরণের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। আমরা যখন বড় হচ্ছিলাম, তখন ভারতের সঙ্গে আমেরিকার মুখ দেখাদেখিও বন্ধ। বিশেষ করে একাত্তরে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বাজে ব্যবহার করেছিল নিক্সন প্রশাসন। তাঁকে উপযুক্ত প্রটোকল দেওয়া হয়নি। তাঁকে বসিয়ে রাখা হয়েছিল। দেখা দিলেও সেই কথোপকথন ছিল তির্যক আর উপহাসের।

আমেরিকার ধারণা ছিল, ভারত কোনোভাবেই যুদ্ধে যাবে না। আর গেলেও পাকিস্তানের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারবে না। ভারত ও আমেরিকার সম্পর্কের কাঁটা ছিল পাকিস্তান। অন্যদিকে পাকিস্তানের তখন রমরমা অবস্থা। চীন তাদের ইয়ার, আমেরিকা তাদের দোস্ত। পায় কে আর!

কিন্তু ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ও ভারত-বাংলাদেশের বিজয় অনেক হিসাবনিকাশ পাল্টে দেয়। কিসিঞ্জারের মতো যুদ্ধাপরাধী নিক্সন সরকারের কফিনে শেষ পেরেক মারলে তাদের ভরাডুবি হয়। এরপর অনেক পানি গড়িয়েছে। সেই পানির স্রোতে ভারতেও পরিবর্তন হয়েছে।

কংগ্রেস ক্ষমতায় নেই। সহজে গদিতে আসতে পারবে বলেও মনে হয় না। গান্ধী, বুদ্ধ, অশোকের দেশে বিজেপি এসেছে ক্ষমতায়। সে কারণে বহু দেশের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে। আবার কোনো কোনো দেশের সঙ্গে হয়েছে গভীর। ভারতকে আমেরিকার দরকার পড়েছে বিশাল বাজারের জন্য। অর্থনীতিতে বিশাল হওয়ার পর ক্রয়ক্ষমতা বেড়ে যাওয়া মধ্যবিত্ত আমেরিকামুখী হয়েছে। এর ওপর আছে যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয়দের উত্থান।

একসময় মনে হয়েছিল ভারত-আমেরিকা জোট হবে, মোদি ও ট্রাম্প চলবেন সমান তালে। না, সেটা হয়নি। আনপ্রেডিক্টেবল আমেরিকার কৌতুকপ্রবণ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তাঁকে ‘পাগলা রাজা’ বলে অনেকে। এই পাগলা রাজা হঠাৎ ট্যারিফ বা শুল্ক নিয়ে এমন সব কাণ্ড করছেন, যা রীতিমতো ভয়ংকর। ভয় হচ্ছে, আমেরিকার না আবার কাঠামো নড়ে ওঠে!

যে কথা বলছিলাম—এই সব কারণে পুতিন, সি চিন পিং, মোদি হাত মিলিয়েছেন। ভোজবাজির মতো ভারত-চীন ঐক্য বা সখ্য গড়ে উঠছে। খবরে দেখলাম, চীনা প্রেসিডেন্ট নাকি মোদিকে গাড়িও উপহার দিয়েছেন। তা দিক বা না দিক, সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো শাহবাজ শরিফের অবস্থান। বেচারা একা দাঁড়িয়ে হজম করছেন এসব। একটা ভিডিওতে তাঁকে পুতিনের কাছে সম্পর্ক ভিক্ষা করতেও শোনা গেছে। পাকিস্তানের এই নাজুক অবস্থান আমাদের কি কিছু শিক্ষা দেবে?

উপমহাদেশে, এমনকি পৃথিবীতে এই মেরুকরণ বহু পরিবর্তন এনে দেবে। বাংলাদেশ এখন কীভাবে চলছে, তা সবারই জানা। যে পজিটিভ পরিবর্তন করার জন্য যুবসমাজের অনেকে প্রাণ দিয়েছিল, তাদের অনুসারীরা এখন হতাশ। অনেকে এমন গ্যাঁড়াকলে পড়েছে যে, তাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। তাদের তো নেই-ই, উল্টো দেশও পড়েছে ঘোর সংকটে।

এই টালমাটাল অবস্থায় পাকিস্তানপ্রীতির রমরমা। ‘পিন্ডি-ঢাকা ভাই-ভাই’ টাইপের এই বাস্তবতা উত্তেজনা হিসেবে চমৎকার হলেও দেশের জন্য মন্দ। এবার যেটা যোগ হলো, সেটাও ভাবার মতো। এতিমের মতো অসহায় পাকিস্তান ঋণের বোঝায় কাহিল। আন্তর্জাতিক মহলে তার জায়গা শূন্যের কোঠায়। এমন দেশটির সঙ্গে গলাগলি করে কী হবে আমাদের?

আমেরিকার কথায় আসি। ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া বা উত্তর কোরিয়া—কেউই তার তোয়াক্কা করে না। সম্প্রতি আমেরিকার মদদের পরও ইরানের কিছুই করতে পারেনি দখলদার ইসরায়েল। দীর্ঘ সময় আমেরিকার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই স্থির আছে ইরান। ওরা জানিয়ে দিয়েছে, বহিঃশত্রু ততক্ষণ অচল, যতক্ষণ জনগণ ঠিক আছে। ইরান থেকেও শিক্ষা নিতে পারি আমরা।

আমেরিকা মুখে যা-ই বলুক, বাস্তবে তার একচ্ছত্র আধিপত্য এখন মুখের কথা। তার চেয়ে ঢের শক্তিশালী চীন ও রাশিয়া। ট্রাম্প মূলত রেগেছে ভারত-রাশিয়া বাণিজ্যের কারণে। তাঁদের ধারণা, এই টাকা না পেলে পুতিন নাকি ইউক্রেনে যুদ্ধ করতে পারতেন না।

এ জন্যই বলা হয়, আমেরিকা জনগণ ও গণতন্ত্রে চমৎকার দেশ হলেও তার শাসকেরা হন জনবিরোধী, নয়তো পাগলা রাজা! এককালের মোড়ল কখনো নিজের পরাজয় মানতে পারে না। দেশে দেশে যুদ্ধ লাগানো অস্ত্র ব্যবসার জন্য যুদ্ধ লম্বা করা আমেরিকার স্বভাব। কেন জানি মনে হচ্ছে, এবার তার অবসান হতে চলেছে।

অন্যদের কথা থাক। বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল। তার গায়ে লেগেছিল উন্নয়নের হাওয়া। আশপাশের দেশগুলো চোখ বড় বড় করে দেখত তার অগ্রযাত্রা। শুনতে পাই, এই দৌড় থামানোতে নাকি আমেরিকার হাত ছিল। আমেরিকার এই স্বভাব পৃথিবীর বহু ক্ষতি করেছে।

ভারতের আধিপত্যবাদ ও অপ্রতিবেশীসুলভ আচরণ নিন্দনীয়। কিন্তু তার অগ্রগতি ও অগ্রযাত্রা মানতে হবে। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে আমরা একসঙ্গে চলতে না পারলে ক্ষতি হবে। তারা আমাদের কোলে তুলে নেবে—এমনটি নয়। কিন্তু কাঁধে কাঁধ রাখার জন্য চাই পরিশ্রম, চাই দেশপ্রেম। এই দেশপ্রেম যে একটি জাতিকে কতটুকু এগিয়ে দেয়, চীন-রাশিয়াই তার প্রমাণ। ভারতও সে পথের যাত্রী। তাদের ঐক্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। খেয়াল করবেন, এখন ইন্দোনেশিয়াও জ্বলছে। শুরু হয়ে গেছে ধ্বংস ও মারামারি। এই লেখা প্রকাশকালে সে দেশে কী ঘটতে পারে, অনুমান করা কঠিন।

দুটো ধারাই এখন চলমান—একদিকে এগিয়ে যাওয়া, অন্যদিকে ধ্বংসলীলা। কোন দিকে যাব আমরা?

লেখক: অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী কলামিস্ট

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত