Ajker Patrika

একজন নীরব আলোকবর্তিকা

আপডেট : ১৮ জুলাই ২০২৫, ০৭: ২১
বদিউর রহমান।
বদিউর রহমান।

জীবনের যাত্রাপথে আমরা অনেক মানুষের সান্নিধ্যে আসি। কেউ কেউ কেবল সহযাত্রী, কেউ কেউ হয়ে ওঠেন বাতিঘর। অধ্যাপক বদিউর রহমান ছিলেন তেমন একজন—নিঃশব্দ আলোকবর্তিকা, যিনি নিজের আলোয় নিজেকে পোড়াতে জানতেন, কিন্তু কখনো আলো জ্বালাতে চেষ্টার ভান করতেন না। এমন আলাভোলা, নিরহংকার অথচ প্রজ্ঞাবান মানুষের স্মৃতি দীর্ঘদিন মনে থেকে যায়, তাঁর অনুপস্থিতি ব্যথার মতো বাজে।

বদিউর রহমান জন্মেছিলেন ১৯৪৭ সালে বৃহত্তর বরিশালে। দেশভাগের সেই অস্থির সময়ের ভেতর জন্ম নেওয়া এই মানুষটি চিন্তা, মনন আর জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে গড়ে তুলেছিলেন নিজের স্বতন্ত্র পরিচয়। ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন এবং সে বছরই কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন। শিক্ষকতা তাঁর প্রধান পেশা হলেও, প্রকৃত অর্থে তিনি ছিলেন এক নিরলস গবেষক, অনুবাদক, সম্পাদনানির্ভর সাহিত্যসাধক।

২০০৪ সালে সরকারি কলেজ থেকে অবসর গ্রহণ করলেও তাঁর চিন্তার জগতে কোনো অবসর ছিল না। বরং তখন থেকেই যেন আরও নিবিষ্ট হয়ে কাজ করতে থাকেন তিনি সাহিত্যতত্ত্ব, ইতিহাস, জনগণের সংস্কৃতি ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক ভাবনার বিভিন্ন দিক নিয়ে।

বদিউর রহমানের রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা অর্ধশতাধিক। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি—‘সাহিত্য স্বরূপ’, ‘সাহিত্য সংজ্ঞা অভিধান’, ‘ধ্রুপদী সাহিত্যতত্ত্ব’, ‘বাংলার চারণ মুকুন্দদাস’, ‘সত্যেন সমীক্ষণ’, ‘দ্য প্রিন্স’, ‘গণনাট্য’, ‘উপন্যাস ও জনগণ’, ‘সত্যেন সেন রচনাবলি (৯ খণ্ড)’ ইত্যাদি। নজরুল ও রবীন্দ্রনাথের অনুবাদ ও পত্রাবলি নিয়েও তাঁর কাজ স্বতন্ত্র গুরুত্বের দাবি রাখে। তাঁর কাজগুলো ছিল নিঃশব্দ কিন্তু গভীর, আড়াল থেকে আলো ছড়ানো।

আমি সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত আছি বহু বছর ধরে। সাপ্তাহিক একতায় কাজ করার সুবাদে শুধু ঢাকায় নয়, বরিশালসহ সারা দেশের প্রগতিশীল ও বামপন্থী মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছিল। সেভাবেই আমার পরিচয় অধ্যাপক বদিউর রহমানের সঙ্গে বরিশালে। সেই পরিচয় ধীরে ধীরে রূপ নেয় শ্রদ্ধা, মুগ্ধতা এবং ভাবনাচিন্তা আদান-প্রদানের এক নির্ভরযোগ্য স্থানে।

বদিউর রহমান ছিলেন স্বল্পভাষী এবং বিনয়ী একজন মানুষ। অথচ জ্ঞানে, পাঠে, বিশ্লেষণে ছিলেন অনন্য। আমরা অনেককে দেখি, যাঁরা কম জানেন কিন্তু বেশি বলেন। নিজেকে বড় করে তুলে ধরতে সদা তৎপর থাকেন। বদি ভাই ছিলেন তার বিপরীত। তিনি জানতেন অনেক বেশি, পড়তেন আরও বেশি, কিন্তু বলতেন কম। শুনতেন মনোযোগ দিয়ে। সেই নীরব শোনা ও গভীর পড়াশোনাই তাঁকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করেছিল। তাঁর চিন্তার গভীরতা ছিল পরিমিতির মধ্যে নির্মিত এক সৌন্দর্য।

আজিজ সুপার মার্কেটের প্যাপিরাস প্রকাশনীর মালিক মোতাহার হোসেনের দোকানে তাঁর সঙ্গে বহুবার দেখা হয়েছে। সেখানে বসেই সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, সাংবাদিকতা—বহু বিষয়ে কথা হয়েছে। তিনি শুধু পাণ্ডিত্যের জগতে সীমাবদ্ধ ছিলেন না, বরং জনজীবনের, সমাজের ও সংস্কৃতির স্রোতোধারার সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি স্বপ্ন দেখতেন চিন্তার দারিদ্র্য থেকে মুক্ত এক সমাজের, যেখানে সাম্প্রদায়িকতা, বৈষম্য, মিথ্যাচার ও হীনম্মন্যতার স্থান থাকবে না।

প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচীর সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা ছিল দীর্ঘদিনের। সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন। উদীচীর মতো একটি বৃহৎ ও বহুস্বরের সংগঠনে নানা মত ও পথের মানুষ একসঙ্গে কাজ করেন। বদি ভাই ছিলেন সেই মিলেমিশে চলার অনন্য দৃষ্টান্ত। তিনি কারও সঙ্গে বিরোধে যেতেন না; তিনি চাইতেন আলোচনার মাধ্যমে মতপার্থক্য দূর করতে।

তাঁর স্বপ্ন ছিল একটি মুক্ত, মানবিক ও বিবেকবান সমাজের। কিন্তু স্বপ্ন একা দেখা যায়, বাস্তবায়ন করতে হয় সম্মিলিতভাবে। একজন মানুষের সাধনা অনেক দূর পর্যন্ত যেতে পারে, কিন্তু পরিবর্তনের জন্য দরকার বৃহৎ জনমানসের অংশগ্রহণ। এই জায়গাতেই হয়তো তাঁর ব্যথা ছিল। নিজে জানতেন, ভাবতেন, কাজ করতেন—কিন্তু এই কাজের স্বীকৃতি ও মূল্যায়ন তিনি তেমন পাননি।

১৭ জুলাই বদিউর রহমান চিরতরে চলে গেলেন। মৃত্যুর পর কিছু মানুষ স্মরণ করেন, কিছু লেখা ছাপা হয়, কিছু শোকবার্তা উচ্চারিত হয়। কিন্তু সেসব তাৎক্ষণিক—অন্তর্গত মূল্যায়ন খুব কম মানুষই করে থাকেন। বদি ভাইও হয়তো তেমনই এক ‘অমূল্যায়িত’ মণি হয়ে থাকবেন, যাঁকে চিন্তাশীল মানুষেরা জানতেন, শ্রদ্ধা করতেন, কিন্তু বৃহত্তর সমাজ তাঁকে সেভাবে জানল না, চিনল না। তিনি যেভাবে নীরবে জীবন কাটিয়েছেন, সেই জীবনের ভেতরেই নিহিত আছে তাঁর প্রকৃত কীর্তি। তাঁর লেখা, তাঁর চিন্তা, তাঁর ছাত্রছাত্রী, সহকর্মী ও সহযোদ্ধাদের ভেতর দিয়ে তিনি বেঁচে থাকবেন। তবে বেঁচে থাকা মানে শুধু স্মৃতিতে থাকা নয়—তাঁর কাজগুলোকে সামনে আনা, প্রচার করা, নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া, সেটাই হবে তাঁর প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা।

আমার নিজের সাংবাদিকজীবনের অভিজ্ঞতায় আমি জানি, প্রগতিশীল চিন্তাশীল সৎ মানুষেরা কম জায়গা পান আমাদের প্রচারমাধ্যমে, আমাদের সমাজে। কিন্তু ইতিহাস নীরবের কাছে ঋণী থাকে। বদিউর রহমান ছিলেন তেমনই একজন নীরব নির্মাতা, যাঁর চিন্তার দীপ্তি আমরা নিকটজনেরা বুঝেছি, অনুধাবন করেছি, ভালোবেসেছি।

তাঁর প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। হয়তো সমাজ তাঁকে তেমনভাবে মূল্যায়ন করেনি, কিন্তু যাঁরা তাঁকে চেনেন, জানেন, তাঁরা জানেন, কতখানি অভাব তৈরি হলো তাঁর চলে যাওয়ায়।

লেখক: সাংবাদিক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

স্ত্রী রাজি নন, সাবেক সেনাপ্রধান হারুনের মরদেহের ময়নাতদন্ত হবে না: পুলিশ

বাকৃবির ৫৭ শিক্ষকসহ ১৫৪ জনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা

বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে পারে সরকার, ভয়ে কলকাতায় দিলীপ কুমারের আত্মহত্যা

সাবেক সেনাপ্রধান হারুন ছিলেন চট্টগ্রাম ক্লাবের গেস্ট হাউসে, দরজা ভেঙে বিছানায় মিলল তাঁর লাশ

শাহজালালের তৃতীয় টার্মিনালে অবতরণ করল প্রথম ফ্লাইট

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত