Ajker Patrika

প্রাণহীন এ দেশেতে গানহীন যেথা চারিধার

তাপস মজুমদার 
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

কয়েক সপ্তাহ থেকে ফেসবুক খুললে কম বয়সী দুটি ছেলের গান শুনতে পাচ্ছি। একজন গাইছে আর একজন তবলা বাজাচ্ছে। তারা দুই ভাই হবে—চেহারা দেখে সেটা অনুমান করা যায়। বড় ভাই গাইছে। কী অসম্ভব ভালো গলা! ভালো মানে, কণ্ঠে যেমন সুর আছে, তেমনি কণ্ঠের চর্চা আছে। উফ্! তৃপ্ত না হয়ে কোনো উপায় নেই। প্রধানত নজরুলের গান শুনছি তার কণ্ঠে। অপূর্ব গায়কি! একসময় নজরুলের গান গেয়ে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছিলেন। মানবেন্দ্র নজরুলের গানকে নতুনভাবে উপস্থাপন করেছিলেন। নজরুলের গানের ক্ল্যাসিকাল ঢং মানবেন্দ্র নবতর এক ধারণায় শ্রোতাদের কাছে উপস্থাপন করেছিলেন। এই উপস্থাপনে অনেকের দ্বিমত থাকলেও থাকতে পারে।

কিন্তু সেটা যে ভীষণ শ্রুতিমধুর এবং তাতে যে শিল্পীর গায়ন-শক্তির অপরিসীম দক্ষতার প্রকাশ রয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সে জন্যই তা জনপ্রিয় হয়েছিল। আমাদের আলোচ্য কিশোরের কণ্ঠে নজরুলের গানগুলো শুনলে সহসা মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কথা মনে পড়ে যায়। আর যে শিশুটি, শিশুই বলব, তবলায় সংগত করছে সে আরেক প্রতিশ্রুতিশীল ওস্তাদ। কী বিস্ময়কর এক গাম্ভীর্য নিয়ে দক্ষতার সঙ্গে তবলায় তার হাত খেলিয়ে যাচ্ছে, দেখলে আপনি মোহিত না হয়ে পারবেন না। যেমন শিল্পীর তাল-লয়-সুর-রাগের ওপর দখল, তেমনি বাদকের অবাক করা ঠেকা। এই দুই সহোদরের নাম ষঢ়জ ও ঋষভ। এত জল ও কাজল চোখে, নয়নভরা জল গো তোমার আঁচল ভরা ফুল, আজো মধুর বাঁশরী বাজে—এইসব পুরোনো বিখ্যাত গান নতুন করে হাজার মানুষকে মাতিয়ে তুলছে। মোল্লা মাসুদ রহমান নামে একজন এই গানগুলো শেয়ার করছেন। তাঁকে আমি বিশেষ ধন্যবাদ জানাই। আমি এই তিনজনের কাউকেই চিনি না। তবে গানগুলো শুনে মুগ্ধ হচ্ছি। চঞ্চল হচ্ছে মন। মাঝে মাঝে স্থির হয়ে ভাবছি।

কী ভাবছি? ভাবছি এককালে এই দেশে গান ছিল। আমাদের মাটি গানেরই মাটি। এ দেশের মাটি থেকেই এসেছে বাংলা গানের আদি ও মৌলিক সুর লোকসুর। কীর্তন, বাউল, শ্যামাসংগীত, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া—এসব আমাদের লোকসুরের নিদর্শন। চর্যাপদ থেকে শুরু করে, পঞ্চকবির গান, লালনগীতি, আধুনিক গান—বাঙালির গানের ধারাকে উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ করেছে। এই মাটিতে সৃষ্ট গানে যেমন রয়েছে কাব্যের গতিশীলতা, তেমনি আছে নাট্যরস। রয়েছে বিভিন্ন চরিত্রের উপাদান এবং তাদের মধ্যের ঘাত-প্রতিঘাত, রাগ-দ্বেষ, বাগ্‌বিতণ্ডা, প্রেম-প্রীতি প্রভৃতি। প্রকৃতিও বাংলা গানে একটা বড় জায়গা দখল করে আছে।

বাংলা গানে যে বৈচিত্র্যপূর্ণ সমৃদ্ধ সুর, ছন্দলীলা, তাল, উদ্দীপনা, নবীনতা, স্বদেশ চেতনা, প্রকৃতি বন্দনা, নান্দনিক রসসম্ভার রয়েছে, তা অভিনব। এসব উপাদান মানুষকে তৃপ্তি দিয়েছে। বাংলার মানুষ গায়েহলুদ, বিয়ে এমনকি ঢেঁকি পাড়াতেও গান গায়, মনে আনন্দ হলে গান গেয়ে ওঠে, এমনকি ভয় পেলেও গান গায়।

আমি কিছুমাত্র গানের বোদ্ধা নই। ছোটবেলা থেকে গান শুনতে ভালোবাসি। একজন নিতান্তই ক্ষুদ্র শ্রোতা। ছোটবেলায় আব্দুল আলীম, আব্বাসউদ্দিন, নীনা হামিদ—রেডিওতে এইসব মহৎ শিল্পীর দুখানা গান শুনে সকালে স্কুলের পথে রওনা হতাম। গ্রামের মাঠে চিৎকার করে সেসব গান বন্ধুদের সঙ্গে গেয়ে উঠতাম। স্কুলে যাওয়ার পথে বা স্কুল থেকে ফিরতে গাঁয়ের মাঠে মুখে মুখে ছিল পল্লিগীতি, লোকগীতি, ভাটিয়ালি। সেসব গান মানুষের মনকে সহজ আনন্দে ভরে দিত। সুরের উত্তাপ, কথার মাধুর্য এবং গভীরতা মানুষের হৃদয়কে কোমলতায় ভরে দিত। কখনোবা হৃদয়কে ভক্তিরসে আচ্ছাদিত করে ফেলত। পরবর্তীকালে, তারুণ্যে, রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-লালনসহ পঞ্চকবির এবং আধুনিক গান উপভোগে সেসব ঘটনার বিস্তর প্রভাব রয়েছে।

যে ভাবনার কথা একটু আগে বলছিলাম তা এই যে, এখন আর আমাদের অন্তরে গান নেই। সমাজে গানের স্থান নিতান্তই গৌণ হয়ে গেছে। গান শেখা, গান গাওয়ার স্বতঃস্ফূর্ততা নষ্ট হয়ে গেছে। সংগীত সৃজনের এই পুণ্যভূমিতে সংগীতের যে বিকাশ ঘটার কথা ছিল, দুর্ভাগ্যবশত সেটাতে ছেদ পড়েছে। নতুনত্বকে বরণ করার গোঁড়ামিকে অস্বীকার করেও বলা যায় অন্য এক ধরনের সংগীত বিকাশ লাভ করেছে বটে—তবে তাতে শান্ততা, স্নিগ্ধতা প্রায় অনুপস্থিত।

উল্লিখিত মোল্লা মাসুদ রহমান ফেসবুকে তাঁর একটি লেখায় লিখেছেন—

‘গান-বাজনা তথা সংগীত একটি শান্তিপ্রিয় শিল্প। একে চর্চা করতে হলে মন ও পরিবেশ, দুই-ই চাই শান্ত ও স্নিগ্ধ। সংগীতচর্চা আয়েশি জীবনের দাবি রাখে। যেখানে দুশ্চিন্তা, দায়িত্ব ও দৌড়ঝাঁপের চাপ কম থাকে। আমাদের সমাজে সেই আয়েশি পরিবেশ সাধারণত যৌথ পরিবারে পাওয়া যেত। যেখানে পরিবারের অনেক সদস্য মিলে সংসারের দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নিতেন, আর কেউ কেউ সেই সুযোগে শিল্প-সংস্কৃতির সাধনায় আত্মনিবেদন করতে পারতেন। কিন্তু আজকের দিনে সেই চিত্র আর নেই।’

এ কথা ঠিক যে, গানের চর্চা করতে হলে একই সঙ্গে মন এবং পরিবেশ চাই। তবে যৌথ পরিবার নেই বলে অথবা আয়েশি জীবনের অভাব ঘটেছে বলে গান থাকবে না, সেটা হতে পারে না! পরিবেশের ঘাটতি, শিক্ষার সঙ্গে মনন চর্চার সম্পর্কহীনতা, ভোগবাদী চিন্তা, পুঁজিতন্ত্র এবং মুক্তবাজার অর্থনীতির জাঁতাকলে পড়ে মানুষ যেভাবে অর্থ, প্রতিপত্তি এবং ক্ষমতার পেছনে ছুটছে, তাতে করে গান হারিয়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, এই হারানোর ফলে মানুষের স্থিরতা কমছে, সুস্থতা কমছে, অসুখ বাড়ছে এবং যা কিছু জীবনে তার আকাঙ্ক্ষিত ছিল তার অনেক কিছু পেয়েও মানুষ শেষ পর্যন্ত স্বস্তি ও শান্তি পাচ্ছে না। তার অপরিসীম ব্যস্ততার পাশাপাশি দুশ্চিন্তা বাড়ছে।

আমেরিকার ডেমোক্রেটিক-রিপাবলিকান, ইংল্যান্ডের টোরি-লেবার, ভারতের কংগ্রেস-বিজেপি—এদের মতো আমাদের দেশের ভালো হোক, মন্দ হোক, আওয়ামী লীগ-বিএনপি একরকম ধারা চলছিল। এখন আমরা এমন একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি, যেখানে কিছুই ঠিক বুঝে ওঠার উপায় নেই। এর মধ্যে গানের স্থান কোথায়, যে গান মানুষকে শান্তির বার্তা শোনাবে, মাটির কাছাকাছি রাখবে, নির্লোভ করে গড়ে তুলবে, উঁচু-নিচুর বৈষম্য ঘোচাবে, পরস্পরকে ভালোবাসতে শেখাবে! যুগ যুগ ধরে দেখছি আমাদের দেশে একদল রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে এক দল অন্য দলকে নিষ্ক্রিয় বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধ্বংস করে দিতে চায়। দেখছি ক্রমাগত দলগুলো তথা মানুষের মধ্যে সহিষ্ণুতা কমছে। আশির দশকের চেয়ে নব্বইয়ের দশকে খানিকটা কমেছে। তারপর চলমান শতাব্দীর প্রথম দশকে আরও কমেছে। তারপর আরও কমেছে...। গানের অনুষ্ঠানে বোমা, যাত্রা বন্ধ, নাটক অনুষ্ঠান বা মুক্তচিন্তার লেখালেখিতে বাধা—এসব অনেক ঘটনার দু-একটি নমুনা মাত্র।

সংগীতের একটা ভাষা আছে। সে ভাষা মানুষের অন্তরে নান্দনিক সৌন্দর্য সৃষ্টি করে। সুর মানুষকে কাঁদায়। সত্যজিতের পথের পাঁচালী ছবিতে রবিশঙ্করের বাজানোটুকু শুনলে আজও মানুষ কেঁদে ওঠে দুর্গার মৃত্যুবেদনায়। একটি গানের একটি কথাতেও কখনো কখনো মানুষের জীবনের মোড় ঘুরে যায়। কিন্তু সেই মহার্ঘ গানের যত্ন নেই আমাদের সমাজে। কেননা, পরিসরের অভাবসহ একদিকে রয়েছে একজন শিশু-কিশোরের পড়াশোনা নিয়ে অষ্টপ্রহর মানসিক চাপ, অপরদিকে লেখাপড়া শেখার প্রধান উদ্দেশ্য যে অর্থ উপার্জন ও ক্ষমতাবান মানুষ হওয়া—এইরকম মননহীন দর্শন।

যদি বলি সুরহীন, তালহীন পাঠ্যবই আমাদের মধ্যে অন্যকে ক্রমাগত ছোট করার বা নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার উল্লিখিত প্রবৃত্তিকে বৃদ্ধি করে তাহলে খুব কি ভুল বলা হবে? অথচ গান এবং গানের মাধ্যমে সামাজিক সম্মিলন মানুষকে প্রশংসা করতে উদ্বুদ্ধ করে, মনকে নির্মল করে, অশালীনতাকে বর্জনে উৎসাহিত করে, মাটি ও মানুষের নিকটবর্তী হতে সহায়তা করে, সর্বোপরি মানসিক উৎকর্ষের সীমারেখা বাড়িয়ে তোলে। এমনকি নতুন চিন্তা নির্মাণেও গান ভূমিকা রাখতে পারে। তবু কেন আমরা একাডেমিক শিক্ষা এবং সামাজিক শিক্ষা থেকে ক্রমাগত গানকে বর্জন করে চলেছি? এটা মোটেও ভালো করছি না। এমতাবস্থায়, সংবেদনশীল সমাজ গঠনে গানকে সঙ্গে রেখে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ভাবতে হবে।

তাপস মজুমদার, সাংস্কৃতিক সংগঠক, লেখক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

৬৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ: ডেলটা গ্রুপের চেয়ারম্যান ফারুকসহ ১৫ জনের নামে মামলা

১ লাখ ৮২২ শিক্ষক নিয়োগ: যোগ্য প্রার্থীদের প্রাথমিক তালিকা চলতি সপ্তাহে

‘মুসলিম ফ্রন্টগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করুন, ইন্টেরিম ভেঙে দিন’

সিলেটে পাথর লুটে জড়িত দুই দলের ৩৫ নেতা

‘বউ আমাকে মিথ্যা ভালোবাসত, টাকা না থাকলে ছেড়ে যাবে, তাই মরে গেলাম’

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত