Ajker Patrika

ইলিশ কেন কমছে

ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র 
ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র। ছবি: সংগৃহীত
ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র। ছবি: সংগৃহীত

ইলিশ নিয়ে সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীর একটি মজার গল্প রয়েছে। একবার তিনি এক পাঞ্জাবি অধ্যাপকের সঙ্গে ইলিশ নিয়ে কথা বলছিলেন। অধ্যাপকের মতে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ খাবার হলো বিরিয়ানি। কিন্তু সৈয়দ মুজতবা আলী তা মানতে নারাজ। তাঁর মতে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ খাবার হলো সরু চালের ভাত আর ইলিশ। এ নিয়ে তাঁদের তর্ক। একপর্যায়ে রেগে যান সৈয়দ মুজতবা আলী। ওই পাঞ্জাবি অধ্যাপকের সঙ্গে নাকি এক সপ্তাহ কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ইলিশ নিয়ে আরও অনেকের মজার গল্প রয়েছে। শুধু গল্পে নয়, নানা সাংস্কৃতিক উৎসব এবং পূজাপার্বণেও ইলিশের অনেক প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। যেমন পয়লা বৈশাখে পান্তা-ইলিশের চলন রয়েছে।

আবার লক্ষ্মীপূজাতেও জোড়া ইলিশ কেনা শুভ লক্ষণ হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু এসব মজার গল্প আর মজার থাকছে না। ধীরে ধীরে বাঙালির কাছে হয়ে উঠছে দুঃখ-কষ্টের গল্প। কেননা এই ইলিশ এখন আর আগের মতো পাওয়া যাচ্ছে না।

ইলিশের দাম বেশি। গরিব মানুষ তো নয়ই, এখন মধ্যবিত্তেরও হাতের নাগালের বাইরে থাকছে ইলিশ। একটা সময় না হয় বলা হতো, ইলিশ রপ্তানি হচ্ছে। তাই দেশে ইলিশ কম। দাম বেশি। কিন্তু এখন তো ইলিশ রপ্তানি হচ্ছে না। তাহলে কেন বাড়ছে ইলিশের দাম? শুধু বাড়ছে না। পাওয়াই যাচ্ছে না। সমুদ্রে-নদীতে ইলিশ না পাওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে এখন প্রায় সবখানে। কিছুদিন আগে একটি পত্রিকা পটুয়াখালীর এক জেলের কথা লিখেছে। যে জেলে সমুদ্রে গিয়েও তেমন ইলিশ পাননি। আগে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় বড় ইলিশ পাওয়া গেলেও এখন আর পাওয়া যায় না। সেই ইলিশ পেতে এখন যেতে হয় গভীর সমুদ্রে। খুব বেশি দিন আগে নয়। ২০-৩০ বছর আগেও নৌকা ভরে ইলিশ নিয়ে আসতে পারতেন জেলেরা। এখন তা অকল্পনীয়। এই চিত্র ভোলা, কক্সবাজার প্রভৃতি জেলারও।

ইলিশ শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ওডিশা, ত্রিপুরা ও আসামে এই মাছ অনেক জনপ্রিয়। ২০১৭ সালে মাছটি বাংলাদেশের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ইলিশ সাধারণত বড় বড় নদী এবং মোহনার সংযুক্ত খালগুলোতে বেশি পাওয়া যায়। যেমন চাঁদপুর জেলার পদ্মা-মেঘনা নদীতে, ভোলা জেলার তজুমদ্দিনে মেঘনা ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় অসংখ্য ইলিশের দেখা মেলে। বাংলাদেশসহ মোট ১১টি দেশে ইলিশ পাওয়া যায়। বাংলাদেশ ইলিশ উৎপাদনে প্রথম।

মৎস্য বিভাগের তথ্যের দিকে একবার নজর দেওয়া যাক। ২০১৮-১৯ সালে সারা দেশে ইলিশ আহরণ করা হয়েছিল ৫.৩২ লাখ টন। ২০১৯-২০২০ সালে একটু বেড়েছিল, ৫.৫০ লাখ টন। ২০২০-২১ সালে আরেকটু বেড়েছে, ৫.৬৫ লাখ টন। ২০২১-২২ সালে সামান্য বেড়েছে, ৫.৬৬ লাখ টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫.৭১ লাখ টন হয়েছিল। কিন্তু ২০২২-২৩ সালের পর থেকে এর উৎপাদন কমতে শুরু করেছে। ২০২৩-২৪ সালে এর উৎপাদন হয়েছে মাত্র ৫.২৯ লাখ টন। গত অর্থবছরের তুলনায় এর প্রবৃদ্ধির হার কমে ৭.৩ শতাংশে নেমেছে।

বাংলাদেশে নানা কারণে ইলিশ কমে আসছে। অনেকের মতে চোরা শিকারিদের কারণে ইলিশের উৎপাদন কমে আসছে। বরিশাল জেলার মেঘনা নদীর হাইমচর, মালদ্বীপের চর, চর শেফালী এলাকায় ইলিশ ডিম ছাড়ে। এসব এলাকায় জাটকা বড় হয়। চোরা শিকারিরা এসব জাটকা ধরে ফেলে, তাই ইলিশের উৎপাদন কমে যায়। জলবায়ু পরিবর্তনও একটি কারণ। নানান প্রাকৃতিক কারণে জলবায়ু পরিবর্তিত হচ্ছে। বঙ্গোপসাগরের পানির তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। ফলে ইলিশের প্রজনন ও স্বাভাবিক চলাফেরা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সাধারণ ইলিশের প্রজনন ও বর্ধনের জন্য ২৬ থেকে ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ভালো। এর বেশি হলেই ডিম ফোটার হার কমে যায়। জাটকার মৃত্যুও বেড়ে যায়।

উপকূলীয় এলাকার শিল্পদূষণ হওয়ার কারণেও ইলিশের জীবন প্রভাবিত হচ্ছে। ইলিশের চলাচলের জায়গাগুলোতে ডুবোচর এবং চর ইলিশের যাতায়াত বাধাগ্রস্ত করায় এর উৎপাদন কমে যাচ্ছে। যেমন মেঘনা, চাঁদপুর, ভোলা, পটুয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরে এমন ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া পানিপ্রবাহের ওপর ইলিশের উৎপাদন নির্ভর করে। পানিপ্রবাহ কমে গেলে ইলিশের উৎপাদন ব্যাহত হয়।

সম্প্রতি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আকতার বলেছেন, ইলিশ আহরণের পরিমাণ ৪৮ শতাংশ কমে গেছে। এর প্রধান কারণ দূষণ বলে তিনি মনে করেন। তাঁর ভাষায়, প্লাস্টিক বর্জ্যসহ নানা ধরনের দূষণ বন্ধ না হলে দেশের প্রাণিজ চাহিদা মেটানো ভবিষ্যতে হুমকির মুখে পড়বে। নদী ও সাগরের পানিতে একদিকে প্লাস্টিকের বর্জ্য ও শিল্পবর্জ্য যেমন মিশছে, তেমনি কীটনাশক মিশেও পানি দূষিত করছে। ফলে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন কমে যাচ্ছে। শ্বাস-প্রশ্বাস ব্যাহত হয়ে নানাভাবে মাছের ক্ষতি করছে। পানিদূষণের কারণে মাছের খাবারও কমে যাচ্ছে। সম্প্রতি এক গবেষণায় ইলিশের শরীরে মাইক্রোপ্লাস্টিক থেকে শুরু করে সিসা, ক্যাডমিয়াম, পারদ, আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম প্রভৃতি ভারী ধাতুও পাওয়া গেছে। দূষণের কারণেই এমনটি ঘটছে।

বিশ্বে আহরিত মোট ইলিশের ৮৬ ভাগ উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতিবছর ৩০০ কোটি টাকা আয় করে। এ ছাড়া জিডিপিতে এর অবদান প্রায় ১ শতাংশ। অন্যান্য দেশের মতো দূষণ ও অন্যান্য কারণে এর উৎপাদন কমে যাক, তা আমরা চাই না।

তাই ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধিতে আমাদের দূষণ বন্ধসহ জলবায়ু ও পরিবেশ যথোপযুক্ত রাখতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ধর্ষণের আলামত নষ্ট, ধুনট থানার সাবেক ওসির বিরুদ্ধে পরোয়ানা

হিমাগারে ডেকে নির্যাতন: রাজশাহীতে আ.লীগ নেতার তিন ছেলে-মেয়ের জামিন, পুলিশের ‘দুর্বল’ ভূমিকা

ফার্মগেটে হলিক্রস কলেজ ও চার্চের সামনে ককটেল বিস্ফোরণ

যাদের একাধিক দেশের পাসপোর্ট আছে, তারাই অন্যদের সেফ এক্সিটের তালিকা করে: আসিফ

পাকিস্তানের ‘জাফর এক্সপ্রেস’ পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক ট্রেন!

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত