Ajker Patrika

নাগরিক সংলাপ

মানুষের অংশগ্রহণ না থাকায় সংস্কারকাজ গতি পেল না

  • দেশে এখন এক ভয়াবহ ঝড় বয়ে যাচ্ছে: দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য
  • অতীতে বিশেষজ্ঞদের সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়িত হয়নি: রেহমান সোবহান
  • যাদের জন্য সংস্কার, তাদের কোনো পাত্তা নেই: হোসেন জিল্লুর
নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
আপডেট : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০: ০৭
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

আমার দৃষ্টিতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো জুলাই অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে পাওয়া বৈষম্যবিরোধী চেতনা এবং সেই চেতনাকে বাস্তবায়নের প্রত্যাশা। যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা দেখে মনে হচ্ছে, কোথাও কোথাও তারা পথ হারিয়ে ফেলেছে। রাজনীতির নানা ঘটনা ও নির্বাচনের প্রস্তুতি আমাদের সে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাচ্ছে।

অন্তর্বর্তী সরকার ও চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রসঙ্গে এই পর্যবেক্ষণ বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এই সম্মানীয় ফেলো গতকাল সোমবার রাজধানীতে এক নাগরিক সংলাপে এ মন্তব্য করেন। এসডিজির লক্ষ্যগুলো এগিয়ে নেওয়ায় সহায়তা করতে গঠিত নাগরিক উদ্যোগ ‘সিটিজেনস প্ল্যাটফর্ম ফর এসডিজিস বাংলাদেশ’ হোটেল লেকশোরে এ সংলাপের আয়োজন করে। এ অনুষ্ঠানে ‘বাংলাদেশ রিফর্ম ওয়াচ’ নামে নাগরিক উদ্যোগটির একটি নতুন মঞ্চের আনুষ্ঠানিক সূচনার কথা জানানো হয়।

অনুষ্ঠানে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বাংলাদেশে এখন এক ভয়াবহ ঝড় বয়ে যাচ্ছে। এই ঝড় অর্থনীতি, রাজনীতি, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অনুভূত হচ্ছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কারপ্রক্রিয়া কেন অগ্রসর হতে পারছে না, সে প্রশ্ন তুলে দেবপ্রিয় এ বিষয়ে তাঁর পর্যবেক্ষণও দেন। তাঁর ভাষায়, ‘সরকারের পক্ষ থেকে যে কমিটি ও কমিশন করা হলো, সেখানে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, সংখ্যালঘু ও অসুবিধাগ্রস্ত মানুষের প্রতিনিধিত্ব যথাযথভাবে ছিল না। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, কেবল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে, কিন্তু সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়নি। ফলে সরকারের তৈরি কমিটি ও কমিশনের সংস্কার প্রস্তাব কোথাও গিয়ে আর অগ্রসর হতে পারল না।’

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘এটা কি তাদের আকাঙ্ক্ষার অভাব? এটা কি তাদের যোগ্যতার অভাব? এটা কি তাদের সক্ষমতার অভাব? নাকি এর ভেতরে আরও বড় কোনো স্বার্থের সংঘাত লুকিয়ে আছে—এই প্রশ্ন এখন সামনে এসেছে।’

জনগণের ভূমিকার ওপর গুরুত্বারোপ করে দেবপ্রিয় বলেন, ‘সরকার আসে সরকার যায়, জনগণ থাকে, দেশ থাকে। কারিগরি সমাধান অনেকে দিতে পারেন, কিন্তু বাস্তবায়নের জন্য নাগরিকদের জবাবদিহির চাহিদা অপরিহার্য। নাগরিকের কণ্ঠস্বর, রাজনীতির কণ্ঠস্বর ও সামাজিক আন্দোলনের কণ্ঠস্বর একত্রিত না হলে অন্যদের দোষ দিয়েও পার পাওয়া যাবে না।’

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের চেতনাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্র, সমাজ ও রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা করা আগামী দিনে সবচেয়ে বড় কাজ হবে বলে অভিমত দেন এ জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সিপিডির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান অনুষ্ঠান বলেন, নির্বাচনের আগে আগামী মাত্র ছয় মাসে কোন কোন সংস্কারে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে, তা স্পষ্ট নয়। শুধু একটি দলিলে রাজনৈতিক দলগুলো স্বাক্ষর করল, আর সংস্কার হয়ে গেল—বিষয়টি এমন নয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর গত ৫৪ বছরে কোনো গ্রহণযোগ্য সংস্কারপ্রক্রিয়া দেখা যায়নি। সংস্কার নিয়ে অনেক আলোচনা হয়, দলিল লিপিবদ্ধ হয় এবং বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করা হয়। কিন্তু একটি গ্রহণযোগ্য ও সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তার বাস্তবায়ন হয় না।

রেহমান সোবহান বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কারের তালিকার মধ্যে কোনটি নির্বাহী আদেশ জারি করে বাস্তবায়ন শুরু হবে এবং কোনটি আগামী সংসদে আইনের মাধ্যমে পাস হবে, তা সুনির্দিষ্ট করতে হবে।

রেহমান সোবহান অতীতের অভিজ্ঞতার উদাহরণ দিয়ে বলেন, ১৯৯১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা থাকার সময় তিনি দেশের ২৫০ জন বিশেষজ্ঞকে নিয়ে ২৯টি টাস্কফোর্স গঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বর্তমান প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসও একটি টাস্কফোর্সের প্রধান ছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সরকারগুলো এসব টাস্কফোর্সের প্রস্তাব আমলে নেয়নি।

অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, নাগরিক সমাজের কাজ শুধু কাগজপত্র তৈরি করা নয়। তাঁদের প্রতিনিয়ত প্রশ্ন তোলা উচিত ছিল, কিন্তু সেই দায়িত্ব তাঁরা পালন করেননি।

সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আগের অনেক সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয়নি। এবার কী হবে, সেটার জবাব জরুরি। তবে এবার আমরা সাফল্যের বিষয়ে আশাবাদী। তাই সবাইকে এ কার্যক্রমে যুক্ত করেছি।’

অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করা গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘সংস্কার কোন পথে তা আলোচনায় এসেছে। কিন্তু গভীর উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, যাদের জন্য সংস্কার প্রয়োজন, তাদের কোনো পাত্তা নেই। এটা সংস্কারের সঙ্গে যায় না।’

প্রশ্ন তুলে অর্থনীতিবিদ, আন্দোলনকর্মী আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ফলে কী পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি? কোনো কার্যকর পরিবর্তন হচ্ছে না। পুলিশের মনোভাবে কি পরিবর্তন হয়েছে? এখানে আগের চেয়ে বেশি শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এসব বিষয়ে সংস্কার জরুরি।’

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেম-এর নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ সেলিম রায়হান বলেন, ‘টাস্কফোর্স ও শ্বেতপত্রের সুপারিশগুলো নিয়ে আলোচনা চলমান রাখতে হবে। সংস্কার নিয়ে কথা বলতে হবে। সংস্কারের বাস্তবায়ন নির্ভর করবে সরকার কতটা চায় তার ওপর। আমলা, ব্যবসায়ী ও কিছু শক্তি বাধা দিতে চায়। কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানের সরকারকে অনেক কিছু করতে হবে। রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন করতে হবে।’

সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান রাজনৈতিক দলের প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন এবং তাদের ইশতেহারে সমাজে প্রতিফলন কম থাকে মন্তব্য করে জনগণের অধিকার নিয়ে ইশতেহার প্রস্তুত করার তাগিদ দেন। তিনি আরও বলেন, নতুন সংস্কারের ১০০ দিনের কর্মসূচি দরকার হবে।

অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে আরও বক্তব্য দেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক রওনক জাহান, স্থানীয় সরকারবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান তোফায়েল আহমেদ, নির্বাচন কমিশনবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার, শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান সুলতান আহমেদ, নাগরিক প্ল্যাটফর্মের কোর গ্রুপ সদস্য শাহীন আনাম, সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী, বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক, অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ ঐক্য পরিষদের সভাপতি কাজল দেবনাথ প্রমুখ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদে রদবদল

গাজীপুরে রাস্তা বন্ধ করে চলাচল করা সেই পুলিশ কমিশনারকে প্রত্যাহার

ধর্ষণে মেয়ে গর্ভবতী, বাবার আমৃত্যু কারাদণ্ড

ভারতসহ একসঙ্গে তিন দেশ সামলাবেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত, দিল্লিতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া

নারীর সঙ্গে ঝগড়ার পর রূপসা সেতু থেকে নিচে লাফ দেন সাংবাদিক বুলু: কোস্ট গার্ড

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত