Ajker Patrika

তাদের ঈদ যাত্রার ভিন্ন গল্প

নাজমুল হাসান সাগর, ঢাকা
তাদের ঈদ যাত্রার ভিন্ন গল্প

পিঠে ও হাতে ঝোলানো ভারী ব্যাগ। মাথার ওপর কাঠ ফাটা রোদ আর চোখে-মুখে রাজ্যের ক্লান্তি। অনেকটা আশাহতের অভিব্যক্তি নিয়ে গাবতলী ব্রিজের মুখে দাঁড়িয়ে আছে ছয় তরুণ। ঢাকা থেকে রংপুর, নীলফামারী কিংবা দেবীগঞ্জের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া বিভিন্ন যানবাহন এসে এখানে কিছুটা গতি কমায়। দুই-একজন যাত্রী তুলে মাঝ রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে কিছু বাড়তি টাকা আয়ের আশায়। এমন কয়েকটি যানবাহনের চালক ও হেলপারের সঙ্গে কথা বলতে দেখা গেলো এই কিশোর দলটিকে। এক, দুই করে পাঁচটি যানবাহনের সঙ্গে কথা বলে যখন কাজের কাজ কিছু হলো না। তখন ব্রিজ ঘেঁষা জীর্ণ একটি টং দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালেন তারা। দীর্ঘ রোদের সিদ্ধ অবস্থা থেকে বাঁচতে টঙ্গের চালার ছায়ায় সাময়িক আশ্রয় তাদের। 

গন্তব্য কোথায়? এমন প্রশ্নে দলটির একজন জানালেন, নীলফামারীর জলঢাকায়। কীভাবে যাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বেড়াইছি যখন কোনো এক ভাবে যামোই।’ দলটিতে অপেক্ষাকৃত বয়সে বড়জনের নাম সিরাজুল ইসলাম। সকাল ১১টায় বেরিয়ে কল্যাণপুর, টেকনিক্যাল এবং গাবতলীর বিভিন্ন কাউন্টারে ঘুরেছেন তাঁরা। রংপুর কিংবা নীলফামারীগামী বিভিন্ন কোম্পানির বাসের টিকিট দাম তাদের কাছে চাওয়া হয়েছে ১৫০০ থেকে ২ হাজার টাকা। যত বড় ও নামী বাসের কাউন্টারে তাঁরা ঘুরেছেন, তাদের বাড়ি যাওয়ার স্বপ্ন তত ছোট আর অসম্ভব মনে হয়েছে। হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে শুষ্ক হাসি দিয়ে এমনটাই জানালেন সিরাজুল। 

এবার আলাপে যুক্ত হলেন রবিউল ইসলাম। ঢাকা-রংপুর-নীলফামারী সড়কে চলাচল করা তিনটি (হানিফ, নাবিল, বাবলু) পরিচিত পরিবহনের নাম উল্লেখ করে তিনি বললেন, ‘এমরার কাছে ১৫ শ থাকিয়া ২ হাজার টাহা দাম চাহেছে ভালো কথা। কিন্তু টাটা মিনি ট্রাক গিলা সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত নিয়া যাবার লাগি ১২ শ টাহা চায়! হামাক কী বলদ মনে করে অমরা? এই টাহাত তো হামরা এসি গাড়িত যাবার পারমো।’ 

কেবল দূরপাল্লার বাসেই বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে তা নয়। ঢাকার লোকাল বাস বা লেগুনার মতো পরিবহনেও তাদের গুনতে হয়েছে নির্ধারিত ভাড়ার অন্তত দশ টাকা বেশি। কথার ফাঁকে এসব নিয়েও অভিযোগ জানালেন তাঁরা। আলাপে আলাপে জানা গেলো তাঁরা মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যানে একটি নির্মাণাধীন ভবনে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করছিলেন গত তিন মাস থেকে। চৌদ্দ থেকে বিশ বছরের মধ্যে বয়স সবার। কেউ কেউ পড়াশোনাও চালিয়ে যাচ্ছেন। আবার কেউ অনেক আগেই পড়াশোনা ছেড়ে ধরেছেন সংসারের হাল। ছাত্রত্বের বয়স পার না হলেও তাদের কারোরই ঈদ যাত্রা অন্য আর দশজন ছাত্রের মতো নয়। 

দলটির সদস্য হাবিউল ইসলাম এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী। কিন্তু অভাবের সংসার চালিয়ে পরিবারের পক্ষে তার পড়াশোনার খরচ বহন করা সম্ভব না। পরীক্ষায় ভালো করতে হলে প্রাইভেট এবং কোচিংয়ের জন্য বাড়তি কিছু টাকা দরকার। কিন্তু যেখানে সাধারণ খরচই চালাতে পারে না পরিবার সেখানে প্রাইভেট, কোচিং বিলাসিতা। তাই সমবয়সী কয়েকজনের সঙ্গে পরামর্শ করে ঢাকায় এসেছিল নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করতে। উদ্দেশ্য কাজের টাকা জমিয়ে বাড়ি ফিরে সেটা দিয়ে কোচিং আর প্রাইভেটসহ পরীক্ষার অন্যান্য খরচ মেটানো। 

কিছু টাকা বাঁচানোর আশায় কাউন্টার থেকে কাউন্টারে ঘুরে ব্যর্থ হয়ে এখন খোলা ট্রাকে যাওয়ার চিন্তা করছেন অনেকে।

কিন্তু ঈদে তো বাড়ি ফিরতেই হবে। ঈদে বাড়ি ফেরার বাড়তি খরচে তার মতো দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে বাকিদের কপালে। ৫ শ টাকার ভাড়া যখন ২ হাজার টাকা হয়ে যায় তখন বাড়ি ফেরাটা তাদের জন্য পাহাড় সমান বোঝা মনে হয়। তাই ৫ থেকে ৭ শ টাকায় বাড়ি ফিরতে তাঁরা পথে পথে ঘুরছেন। হাবিউল বলেন, ‘ঈদে বাড়ি যাচ্ছি। বাবার জন্য একটা পাঞ্জাবি আর মায়ের জন্য একটা শাড়ি কিনব। কোচিং, প্রাইভেটের জন্য টাকা আলাদা করে রেখেছি। সেখানে হাত দেওয়া যাবে না। বাকি টাকা থেকে যাতায়াতসহ অন্যান্য খরচ করব। কিন্তু গাড়ি ভাড়ায় বাড়তি খরচ হয়ে গেলে বাবা-মায়ের জন্য ভালো কাপড় কিনতে পারব না। তাই শারীরিক কষ্ট হলেও অল্প টাকায় বাড়ি যেতে চাই। যেন বাবা-মাকে ভালো কাপড় দিতে পারি।’ 

নিজের জন্য কিছু কিনবে কিনা এমন প্রশ্নে হাবিউল লাজুক হাসি দিয়ে মাথা নিচু করে বললেন, ‘টাকা বাঁচলে আমার জন্যও কিনব।’ 

দলের সদস্য ছয়জন হলেও হাবিউলের মতো তমিজুল ইসলাম, সাদিকুল ইসলাম, শরিফুল ইসলাম, রবিউল ইসলাম এবং সিরাজুল ইসলামের গল্পটা প্রায় একইরকম। যে বয়সে তাঁরা অপেক্ষায় থাকবে বাবা-মায়ের এনে দেওয়া ঈদ পোশাক ও বাজারের, সেই বয়সে তাদের বাবা-মায়েরাই অপেক্ষায় আছেন কখন তাদের সন্তানেরা ঈদ পোশাক ও বাজার নিয়ে ফিরবে বাসায়। 

এমন আরেকটি দল পাওয়া গেলো গাবতলী বাস টার্মিনালে। পেশায় পোশাক শ্রমিক তাঁরা তিনজন। এসেছেন জিরানী থেকে। উদ্দেশ্য অল্প টাকায় বাসের সিট নিয়ে বাড়ি ফেরা। কারণ বাইপাইল, জিরানী এলাকা থেকে বাসের সিট পাওয়া যায় না। কিন্তু কোনোভাবেই ঢাকা থেকে রংপুর পীরগঞ্জে যাওয়ার জন্য অল্প টাকায় টিকিট করতে পারছেন না মনিরুজ্জামান, সাব্বির হোসেন ও লেবু মিয়া। উল্টো পুলিশের জেরা ও তল্লাশির মুখে পড়ে বারবার বিব্রত হয়েছেন। এমন অভিযোগ এনে দুঃখপ্রকাশ করেন ওই তিন তরুণ। 

সিরাজুল, হাবিউল কিংবা লেবু মিয়ার মতো এমন ছোট ছোট অনেক দলের দেখা পাওয়া গেছে গাবতলী বাস টার্মিনাল, গাবতলী ব্রিজ এবং আমিন বাজার এলাকায়। স্থান, কাল বা পাত্র আলাদা হলেও তাদের সবার জীবনের অভাবের গল্পটা প্রায় একইরকম। আর দশটা সাধারণ মানুষের ঈদ যাত্রার সঙ্গে তাদের ঈদ যাত্রার গল্পটা মেলে না। আসলেই তাদের ঈদ যাত্রার গল্পটা ভিন্ন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত