অনলাইন ডেস্ক
ধর্ষণ একটি জঘন্য অপরাধ। এ ধরনের সহিংসতার শিকার ব্যক্তিরা দীর্ঘকাল শারীরিক ও মানসিক ট্রমায় ভোগেন। বাংলাদেশে ধর্ষণ মামলার বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা একটি উদ্বেগের বিষয়। ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার পেতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে বাধ্য হন। এটি এ ধরনের ভুক্তভোগীদের কষ্ট আরও বাড়িয়ে দেয়। এই প্রেক্ষাপট, ধর্ষণ মামলার বিচারের রায় ২১ দিনের মধ্যে সম্পন্ন হওয়াটা আশা দেখাচ্ছে।
বাংলাদেশে ধর্ষণ মামলার বিচার প্রক্রিয়া বেশ সময়সাপেক্ষ। তদন্ত, অভিযোগপত্র দাখিল, সাক্ষ্য গ্রহণ, যুক্তিতর্ক এবং রায় ঘোষণার প্রতিটি স্তরে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। মামলার আধিক্য, তদন্তে দুর্বলতা, সাক্ষীদের অনুপস্থিতি, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব, আইনজীবীদের অসহযোগিতা এবং বিচারকের স্বল্পতা—এসব কারণ বিচার প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হন এবং অপরাধীরা পার পেয়ে যায়।
তবে মাগুরার ঘটনার পর তীব্র বিক্ষোভের মুখে সরকার আইন পরিবর্তন করেছে। ধর্ষণের মামলায় তদন্তের সময় ৩০ থেকে কমিয়ে ১৫ দিন এবং অভিযোগ গঠনের পর বিচার শেষ করতে ৯০ দিন নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া উপযুক্ত ক্ষেত্রে বিচারক যদি মনে করেন ডিএনএ প্রতিবেদন ছাড়াই চিকিৎসা সনদের ভিত্তিতে এবং পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে মামলার বিচারকাজ চালাতে পারবেন—এমন বিধান রেখে আইন সংশোধন করা হয়েছে।
আজ শনিবার (১৭ মে) মাগুরার চাঞ্চল্যকর শিশু ধর্ষণ ও হত্যা মামলার রায় দিয়েছেন আদালত। এই মামলায় প্রধান আসামি হিটু শেখের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন বিচারক। এ ছাড়া বাকি তিন আসামিকে খালাস দেওয়া হয়েছে। মাগুরার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক এম জাহিদ হাসান এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। অভিযোগ গঠন বা বিচার শুরুর ২১ দিনের মাথায় এবং মাত্র ১২ কার্যদিবসের মধ্যে আলোচিত এই মামলার বিচার কার্যক্রম শেষ হলো। ঘটনার মাত্র দুই মাস ১১ দিনের মাথায় এই মামলার রায় হলো।
এর আগে ২০২০ সালে মোংলায় সাত বছর বয়সী এক শিশু ধর্ষণের ঘটনায় অভিযোগ গঠনের সাত কার্যদিবসের মধ্যে রায় ঘোষণা করা হয়েছিল। ওই বছরের অক্টোবরের গোড়ার দিকে বন্দর শহর মোংলায় ৭ বছর বয়সী একটি শিশুকে বিস্কুটের প্রলোভন দিয়ে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ ও নির্যাতন করেন তারই প্রতিবেশী ৫৩ বছর বয়সী আব্দুল মান্নান সরদার। ঘটনার রাতেই শিশুটির মামা বাদী হয়ে মামলা করলে অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ১১ অক্টোবর জুডিশিয়াল আদালত মামলাটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২-এ পাঠায়। পরদিন অভিযোগ গঠন করা হয়। ১৩ অক্টোবর বাদীপক্ষের সাক্ষ্য নেওয়া হয় এবং ১৪ অক্টোবর সাক্ষী, চিকিৎসক, জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ সদস্য ও তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য নেওয়া হয়। যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে রায় ঘোষণা করেন জেলা ও দায়রা জজ। মামলা দায়েরের মাত্র ছয় কার্যদিবসে বিচারকাজ শেষ করে সাত দিনের মাথায় রায় ঘোষণা করা হয়।
ধর্ষণ মামলার বিচার ২১ দিনের মধ্যে সম্পন্ন করার ধারণাটি নিঃসন্দেহে একটি সাহসী পদক্ষেপ। দ্রুত বিচার ভুক্তভোগীদের দ্রুত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে এবং অপরাধীদের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করবে। এর ফলে সমাজে ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ কমতে পারে এবং আইনি ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা বাড়বে।
এই মামলার বিচার সম্পন্ন করতে সরকার বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিল। জনগুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিশেষ কৌঁসুলি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় অ্যাটর্নি জেনারেলের সমমর্যাদাপ্রাপ্ত আইনজীবী এহসানুল হক সমাজীকে। তিনিও শুনানিতে অংশ নেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘এ মামলায় আসামির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, মেডিকেল অ্যাভিডেন্স ও সাক্ষীদের জবানবন্দিতে আসামিদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। আমরা আশা করছি, আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে। এ ধরনের অপরাধ যাতে আর না ঘটে, এ রায় সেটার একটা দৃষ্টান্ত তৈরি করবে।’
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী (পিপি) মনিরুল ইসলাম মুকুল বলেন, ‘এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ ২৯ জন সাক্ষী উপস্থাপন করেছে। আদালত ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় আসামিদের শনাক্ত করা ও তাঁদের বক্তব্য শুনেছেন।’
গত ১৩ এপ্রিল মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও মাগুরা সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আলাউদ্দিন আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। ১৭ এপ্রিল মামলাটি চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়। ২০ এপ্রিল অভিযোগপত্র গ্রহণ করা হয়। ২৩ এপ্রিল অভিযোগ গঠনের মধ্যে দিয়ে বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। গত ২৭ এপ্রিল মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। ছুটির দিন বাদে টানা শুনানি চলে। আদালতে আসামিদের উপস্থিতিতে এ শুনানি হয়।
মামলায় শিশুটির বোনের শ্বশুরকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯/ ২ ধারায় (ধর্ষণের ফলে মৃত্যুর অপরাধ), শিশুটির বোনের স্বামী ও ভাশুরকে দণ্ডবিধির ৫০৬ ধারার দ্বিতীয় অংশ (ভয়ভীতি প্রদর্শন) এবং বোনের শাশুড়ির বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ২০১ ধারায় (অপরাধের আলামত নষ্টের অভিযোগ) অভিযোগ গঠন করা হয়।
গত ১৫ মার্চ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সব্যসাচী রায়ের আদালতে শিশুটির বোনের শ্বশুর ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। ৬ মার্চ সকালে ছোট ছেলের কক্ষে (শিশুটির বোনের স্বামীর কক্ষে) শিশুটিকে একা পেয়ে ধর্ষণ ও হত্যার চেষ্টা করেন তিনি। শিশুটি বড় বোনের শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল। ৬ মার্চ বেলা সাড়ে ১১টার দিকে তাকে অচেতন অবস্থায় মাগুরার ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে ১৩ মার্চ ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শিশুটির মৃত্যু হয়। এর আগে ৮ মার্চ শিশুটির মা মাগুরা সদর থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলা করেন।
তবে, ২১ দিনের মধ্যে ধর্ষণ মামলার বিচার সম্পন্ন করা বেশ চ্যালেঞ্জিং। এর জন্য বিচার ব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে ব্যাপক পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। যেমন:
তদন্তকারী সংস্থাকে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে এবং নির্ভুলভাবে তদন্ত সম্পন্ন করতে হবে। এর জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক প্রশিক্ষিত পুলিশ কর্মকর্তা, আধুনিক ফরেনসিক ল্যাব এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। তদন্তের প্রতিটি ধাপে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বজায় রাখতে হবে।
অনেক ক্ষেত্রে সাক্ষীরা ভয় বা হুমকির কারণে সাক্ষ্য দিতে দ্বিধা করেন। দ্রুত বিচারের জন্য সাক্ষীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং তাঁদের আদালতে উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সাক্ষ্য গ্রহণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
দ্রুত বিচার প্রক্রিয়ায় সরকারি ও বেসরকারি উভয় পক্ষের আইনজীবীদের সক্রিয় ও আন্তরিক সহযোগিতা অপরিহার্য। মামলার প্রস্তুতি এবং শুনানিতে তাঁদের সময়ানুবর্তিতা এবং সহযোগিতা বিচার প্রক্রিয়াকে দ্রুততর করতে সহায়ক হবে। আইনজীবীদের দক্ষতাও বিবেচনায় নেওয়া দরকার।
দ্রুত বিচারের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিচারক এবং আদালতের অবকাঠামো নিশ্চিত করতে হবে। মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বিশেষ আদালত গঠন এবং বিদ্যমান আদালতগুলোতে অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগের বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। আদালতের দৈনন্দিন কার্যক্রমের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোও জরুরি।
এই লক্ষ্য অর্জন করতে হলে সরকার, বিচার বিভাগ, পুলিশ প্রশাসন, আইনজীবী এবং নাগরিক সমাজ—সবার সম্মিলিত ও সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। একটি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তার যথাযথ বাস্তবায়ন জরুরি।
মনে রাখতে হবে, দ্রুত বিচারের লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে কিছু ঝুঁকিও রয়েছে। তাড়াহুড়ো করে বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে গিয়ে ন্যায়বিচার যেন ব্যাহত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। অভিযুক্তের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ এবং নিরপেক্ষ বিচার নিশ্চিত করতে হবে। কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি যেন ভুলক্রমে শাস্তি না পায়, তা নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক।
পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশে ধর্ষণ মামলার বিচার ২১ দিনের মধ্যে সম্পন্ন হওয়া নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য। এই ধারা অব্যাহত রাখার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো উচিত। তবে, এই লক্ষ্য অর্জন করতে হলে বিচার ব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে গুণগত পরিবর্তন আনা এবং পর্যাপ্ত সম্পদ ও সহযোগিতা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। দ্রুত বিচার যেমন ভুক্তভোগীদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে, তেমনি একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচার প্রক্রিয়া আইনের শাসনের প্রতি জনগণের আস্থা বাড়াতে সহায়ক হবে। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দৃঢ় পদক্ষেপ নেবে–এটাই প্রত্যাশা।
লেখক: জাহাঙ্গীর আলম, জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
ধর্ষণ একটি জঘন্য অপরাধ। এ ধরনের সহিংসতার শিকার ব্যক্তিরা দীর্ঘকাল শারীরিক ও মানসিক ট্রমায় ভোগেন। বাংলাদেশে ধর্ষণ মামলার বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা একটি উদ্বেগের বিষয়। ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার পেতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে বাধ্য হন। এটি এ ধরনের ভুক্তভোগীদের কষ্ট আরও বাড়িয়ে দেয়। এই প্রেক্ষাপট, ধর্ষণ মামলার বিচারের রায় ২১ দিনের মধ্যে সম্পন্ন হওয়াটা আশা দেখাচ্ছে।
বাংলাদেশে ধর্ষণ মামলার বিচার প্রক্রিয়া বেশ সময়সাপেক্ষ। তদন্ত, অভিযোগপত্র দাখিল, সাক্ষ্য গ্রহণ, যুক্তিতর্ক এবং রায় ঘোষণার প্রতিটি স্তরে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। মামলার আধিক্য, তদন্তে দুর্বলতা, সাক্ষীদের অনুপস্থিতি, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব, আইনজীবীদের অসহযোগিতা এবং বিচারকের স্বল্পতা—এসব কারণ বিচার প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হন এবং অপরাধীরা পার পেয়ে যায়।
তবে মাগুরার ঘটনার পর তীব্র বিক্ষোভের মুখে সরকার আইন পরিবর্তন করেছে। ধর্ষণের মামলায় তদন্তের সময় ৩০ থেকে কমিয়ে ১৫ দিন এবং অভিযোগ গঠনের পর বিচার শেষ করতে ৯০ দিন নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া উপযুক্ত ক্ষেত্রে বিচারক যদি মনে করেন ডিএনএ প্রতিবেদন ছাড়াই চিকিৎসা সনদের ভিত্তিতে এবং পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে মামলার বিচারকাজ চালাতে পারবেন—এমন বিধান রেখে আইন সংশোধন করা হয়েছে।
আজ শনিবার (১৭ মে) মাগুরার চাঞ্চল্যকর শিশু ধর্ষণ ও হত্যা মামলার রায় দিয়েছেন আদালত। এই মামলায় প্রধান আসামি হিটু শেখের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন বিচারক। এ ছাড়া বাকি তিন আসামিকে খালাস দেওয়া হয়েছে। মাগুরার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক এম জাহিদ হাসান এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। অভিযোগ গঠন বা বিচার শুরুর ২১ দিনের মাথায় এবং মাত্র ১২ কার্যদিবসের মধ্যে আলোচিত এই মামলার বিচার কার্যক্রম শেষ হলো। ঘটনার মাত্র দুই মাস ১১ দিনের মাথায় এই মামলার রায় হলো।
এর আগে ২০২০ সালে মোংলায় সাত বছর বয়সী এক শিশু ধর্ষণের ঘটনায় অভিযোগ গঠনের সাত কার্যদিবসের মধ্যে রায় ঘোষণা করা হয়েছিল। ওই বছরের অক্টোবরের গোড়ার দিকে বন্দর শহর মোংলায় ৭ বছর বয়সী একটি শিশুকে বিস্কুটের প্রলোভন দিয়ে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ ও নির্যাতন করেন তারই প্রতিবেশী ৫৩ বছর বয়সী আব্দুল মান্নান সরদার। ঘটনার রাতেই শিশুটির মামা বাদী হয়ে মামলা করলে অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ১১ অক্টোবর জুডিশিয়াল আদালত মামলাটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২-এ পাঠায়। পরদিন অভিযোগ গঠন করা হয়। ১৩ অক্টোবর বাদীপক্ষের সাক্ষ্য নেওয়া হয় এবং ১৪ অক্টোবর সাক্ষী, চিকিৎসক, জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ সদস্য ও তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য নেওয়া হয়। যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে রায় ঘোষণা করেন জেলা ও দায়রা জজ। মামলা দায়েরের মাত্র ছয় কার্যদিবসে বিচারকাজ শেষ করে সাত দিনের মাথায় রায় ঘোষণা করা হয়।
ধর্ষণ মামলার বিচার ২১ দিনের মধ্যে সম্পন্ন করার ধারণাটি নিঃসন্দেহে একটি সাহসী পদক্ষেপ। দ্রুত বিচার ভুক্তভোগীদের দ্রুত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে এবং অপরাধীদের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করবে। এর ফলে সমাজে ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ কমতে পারে এবং আইনি ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা বাড়বে।
এই মামলার বিচার সম্পন্ন করতে সরকার বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিল। জনগুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিশেষ কৌঁসুলি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় অ্যাটর্নি জেনারেলের সমমর্যাদাপ্রাপ্ত আইনজীবী এহসানুল হক সমাজীকে। তিনিও শুনানিতে অংশ নেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘এ মামলায় আসামির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, মেডিকেল অ্যাভিডেন্স ও সাক্ষীদের জবানবন্দিতে আসামিদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। আমরা আশা করছি, আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে। এ ধরনের অপরাধ যাতে আর না ঘটে, এ রায় সেটার একটা দৃষ্টান্ত তৈরি করবে।’
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী (পিপি) মনিরুল ইসলাম মুকুল বলেন, ‘এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ ২৯ জন সাক্ষী উপস্থাপন করেছে। আদালত ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় আসামিদের শনাক্ত করা ও তাঁদের বক্তব্য শুনেছেন।’
গত ১৩ এপ্রিল মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও মাগুরা সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আলাউদ্দিন আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। ১৭ এপ্রিল মামলাটি চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়। ২০ এপ্রিল অভিযোগপত্র গ্রহণ করা হয়। ২৩ এপ্রিল অভিযোগ গঠনের মধ্যে দিয়ে বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। গত ২৭ এপ্রিল মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। ছুটির দিন বাদে টানা শুনানি চলে। আদালতে আসামিদের উপস্থিতিতে এ শুনানি হয়।
মামলায় শিশুটির বোনের শ্বশুরকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯/ ২ ধারায় (ধর্ষণের ফলে মৃত্যুর অপরাধ), শিশুটির বোনের স্বামী ও ভাশুরকে দণ্ডবিধির ৫০৬ ধারার দ্বিতীয় অংশ (ভয়ভীতি প্রদর্শন) এবং বোনের শাশুড়ির বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ২০১ ধারায় (অপরাধের আলামত নষ্টের অভিযোগ) অভিযোগ গঠন করা হয়।
গত ১৫ মার্চ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সব্যসাচী রায়ের আদালতে শিশুটির বোনের শ্বশুর ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। ৬ মার্চ সকালে ছোট ছেলের কক্ষে (শিশুটির বোনের স্বামীর কক্ষে) শিশুটিকে একা পেয়ে ধর্ষণ ও হত্যার চেষ্টা করেন তিনি। শিশুটি বড় বোনের শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল। ৬ মার্চ বেলা সাড়ে ১১টার দিকে তাকে অচেতন অবস্থায় মাগুরার ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে ১৩ মার্চ ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শিশুটির মৃত্যু হয়। এর আগে ৮ মার্চ শিশুটির মা মাগুরা সদর থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলা করেন।
তবে, ২১ দিনের মধ্যে ধর্ষণ মামলার বিচার সম্পন্ন করা বেশ চ্যালেঞ্জিং। এর জন্য বিচার ব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে ব্যাপক পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। যেমন:
তদন্তকারী সংস্থাকে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে এবং নির্ভুলভাবে তদন্ত সম্পন্ন করতে হবে। এর জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক প্রশিক্ষিত পুলিশ কর্মকর্তা, আধুনিক ফরেনসিক ল্যাব এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। তদন্তের প্রতিটি ধাপে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বজায় রাখতে হবে।
অনেক ক্ষেত্রে সাক্ষীরা ভয় বা হুমকির কারণে সাক্ষ্য দিতে দ্বিধা করেন। দ্রুত বিচারের জন্য সাক্ষীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং তাঁদের আদালতে উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সাক্ষ্য গ্রহণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
দ্রুত বিচার প্রক্রিয়ায় সরকারি ও বেসরকারি উভয় পক্ষের আইনজীবীদের সক্রিয় ও আন্তরিক সহযোগিতা অপরিহার্য। মামলার প্রস্তুতি এবং শুনানিতে তাঁদের সময়ানুবর্তিতা এবং সহযোগিতা বিচার প্রক্রিয়াকে দ্রুততর করতে সহায়ক হবে। আইনজীবীদের দক্ষতাও বিবেচনায় নেওয়া দরকার।
দ্রুত বিচারের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিচারক এবং আদালতের অবকাঠামো নিশ্চিত করতে হবে। মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বিশেষ আদালত গঠন এবং বিদ্যমান আদালতগুলোতে অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগের বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। আদালতের দৈনন্দিন কার্যক্রমের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোও জরুরি।
এই লক্ষ্য অর্জন করতে হলে সরকার, বিচার বিভাগ, পুলিশ প্রশাসন, আইনজীবী এবং নাগরিক সমাজ—সবার সম্মিলিত ও সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। একটি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তার যথাযথ বাস্তবায়ন জরুরি।
মনে রাখতে হবে, দ্রুত বিচারের লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে কিছু ঝুঁকিও রয়েছে। তাড়াহুড়ো করে বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে গিয়ে ন্যায়বিচার যেন ব্যাহত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। অভিযুক্তের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ এবং নিরপেক্ষ বিচার নিশ্চিত করতে হবে। কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি যেন ভুলক্রমে শাস্তি না পায়, তা নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক।
পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশে ধর্ষণ মামলার বিচার ২১ দিনের মধ্যে সম্পন্ন হওয়া নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য। এই ধারা অব্যাহত রাখার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো উচিত। তবে, এই লক্ষ্য অর্জন করতে হলে বিচার ব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে গুণগত পরিবর্তন আনা এবং পর্যাপ্ত সম্পদ ও সহযোগিতা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। দ্রুত বিচার যেমন ভুক্তভোগীদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে, তেমনি একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচার প্রক্রিয়া আইনের শাসনের প্রতি জনগণের আস্থা বাড়াতে সহায়ক হবে। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দৃঢ় পদক্ষেপ নেবে–এটাই প্রত্যাশা।
লেখক: জাহাঙ্গীর আলম, জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
দেশের মৎস্যজীবীদের বড় অংশকে জেলে হিসেবে নিবন্ধনের আওতায় এনেছে সরকার। অভিযোগ রয়েছে, নিবন্ধিত জেলেদের তালিকায় অনিয়ম-প্রতারণার মাধ্যমে অন্য পেশাজীবীরা ঢুকে পড়েছেন। এতে মাছ ধরা বন্ধ থাকার সময় সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় দেওয়া বিভিন্ন সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন অনেক প্রকৃত জেলে।
৩ ঘণ্টা আগেবিগত আওয়ামী লীগ আমলের শতাধিক সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) বর্তমানে কারাগারে। তাঁদের অধিকাংশই বিলুপ্ত দ্বাদশ জাতীয় সংসদের সদস্য ছিলেন। তাঁদের মধ্যে সাবেক মন্ত্রী, উপদেষ্টা, প্রতিমন্ত্রীও রয়েছেন। তাঁরা হত্যা, হত্যাচেষ্টা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, দুর্নীতি, অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন অভিযোগে বিচারের মুখে।
৯ ঘণ্টা আগেইসরায়েলকে জবাবদিহির আওতায় আনতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন আজ শনিবার তুরস্কের ইস্তাম্বুলে ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের ৫১তম সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্যে এই আহ্বান জানান।
১৩ ঘণ্টা আগেচীনের কুনমিংয়ে পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ে গত বৃহস্পতিবার এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বিনিয়োগ, অবকাঠামো, প্রযুক্তিসহ পাঁচটি ক্ষেত্রে সহযোগিতার কথা বলা হয়।
১৩ ঘণ্টা আগে