Ajker Patrika

ইউনূস-আনোয়ার বৈঠক

সহযোগিতা-অংশীদারত্ব গভীর করার অঙ্গীকার

বাসস, কুয়ালালামপুর
আপডেট : ১৩ আগস্ট ২০২৫, ০০: ২২
মঙ্গলবার বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া বিভিন্ন খাতে সহযোগিতা বাড়াতে পাঁচটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) এবং তিনটি নোট বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ছবি : প্রধান উপদেষ্টার ফেসবুক
মঙ্গলবার বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া বিভিন্ন খাতে সহযোগিতা বাড়াতে পাঁচটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) এবং তিনটি নোট বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ছবি : প্রধান উপদেষ্টার ফেসবুক

বাংলাদেশ-মালয়েশিয়ার অংশীদারত্ব গভীর করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম। পুত্রজায়ায় পার্দানা পুত্রা ভবনে গতকাল মঙ্গলবার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে এ প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন দুই নেতা। বৈঠকে দুই নেতার উপস্থিতিতে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে বিভিন্ন খাতে সহযোগিতা বাড়াতে পাঁচটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) এবং তিনটি নোট বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে।

প্রধান উপদেষ্টার মালয়েশিয়া সফরের দ্বিতীয় দিনে গতকাল সকাল ৯টায় তিনি মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পৌঁছালে আনোয়ার ইব্রাহিম তাঁকে লালগালিচা অভ্যর্থনা জানান। সেখানে প্রধান উপদেষ্টাকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। পরে ড. ইউনূস প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসেন। প্রথমে দুই নেতা একান্ত বৈঠক করেন। এর আগে সীমিতসংখ্যক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে একটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হয়। পরে তাঁরা দ্বিপক্ষীয় বিষয় নিয়ে প্রতিনিধি পর্যায়ের বৈঠকে আলোচনা করেন। পরে প্রধান উপদেষ্টার সম্মানে প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম নিজ বাসভবনে মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করেন।

আলোচনার শুরুতে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের দুই দেশের মধ্যে ইতিহাস, ধর্ম ও সাংস্কৃতিক সহানুভূতির ভিত্তিতে গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। মানবসম্পদ, বাণিজ্য ও জনগণের পারস্পরিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে মালয়েশিয়া বাংলাদেশের অনন্য অংশীদার।’

প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম অধ্যাপক ইউনূসকে ‘মালয়েশিয়ার বন্ধু’ হিসেবে বর্ণনা করেন এবং গত এক বছরে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তাঁর প্রশংসা করেন। তিনি বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং প্রবাসী শ্রমিকদের কল্যাণ, শিক্ষা এবং রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সহযোগিতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।

একান্ত বৈঠকে অধ্যাপক ইউনূস প্রটোকল জটিলতার আওতায় আটকে পড়া ৮ হাজার বাংলাদেশি শ্রমিককে মালয়েশিয়ায় প্রবেশের সুযোগ প্রদান এবং মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা চালুর জন্য মালয়েশিয়াকে ধন্যবাদ জানান। দুই পক্ষই নিয়োগপ্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করার ওপর জোর দেয়, যাতে খরচ কমে এবং শ্রমিকদের কল্যাণ সুরক্ষিত হয়।

প্রতিনিধি পর্যায়ের আলোচনায় মালয়েশিয়াকে সরকার টু সরকার কাঠামোর মাধ্যমে আরও বেশিসংখ্যক দক্ষ বাংলাদেশি পেশাজীবী নিয়োগের আহ্বান জানায়। মালয়েশিয়ার কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেন, বাংলাদেশি শ্রমিকেরা এখন মালয়েশিয়ার শ্রমিকদের সমান সামাজিক সুরক্ষা সুবিধা পাবেন এবং বাংলা ভাষায় অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন। বাংলাদেশ হাজারো শিক্ষার্থীর জন্য ‘গ্র্যাজুয়েট পাস’ ভিসা চালুর অনুরোধ জানায়, যাঁরা বর্তমানে মালয়েশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন।

উভয় নেতা বাংলাদেশকে আসিয়ানের সঙ্গে সম্পৃক্ততা গভীর করার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আলোচনা করেন, যার মধ্যে রয়েছে সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনার মর্যাদা পাওয়ার প্রচেষ্টা। এ বিষয়ে ড. ইউনূস আসিয়ানের চেয়ার হিসেবে মালয়েশিয়ার সমর্থন কামনা করেন।

অধ্যাপক ইউনূস মালয়েশিয়াকে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক রোহিঙ্গা সম্মেলনে অংশ নেওয়ার আমন্ত্রণ জানান। তিনি রোহিঙ্গা জনগণের প্রতি মালয়েশিয়ার একের পর এক সমর্থনের জন্য ধন্যবাদ জানান।

অর্থনৈতিক বিষয়ে দুই পক্ষ মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির আলোচনাকে ত্বরান্বিত করা, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের মাধ্যমে বিনিয়োগ সহযোগিতা জোরদার করা এবং মালয়েশিয়া-বাংলাদেশ যৌথ ব্যবসা পরিষদ সক্রিয় করার বিষয়ে একমত হয়। দুই বন্ধুত্বপূর্ণ দেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ঘাটতির কথা উল্লেখ করে ঢাকা বাংলাদেশের ওষুধ, ব্যাটারি, জুতা, সিরামিক ও পাটজাত পণ্যের জন্য মালয়েশিয়ার বাজারে আরও প্রবেশাধিকার চেয়েছে। বাংলাদেশ নীল অর্থনীতি ও হালাল শিল্প উন্নয়নে মালয়েশিয়ার সহায়তা কামনা করে, যার মধ্যে ঢাকার বাইরে একটি হালাল অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন অন্তর্ভুক্ত। এ ছাড়া আঞ্চলিক বিস্তৃত অর্থনৈতিক অংশীদারত্বে (আরসিইপি) যোগদানের আগ্রহ প্রকাশ করে বাংলাদেশ।

দুই নেতার যৌথ সংবাদ সম্মেলন

বৈঠকের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশের ওপর যে চাপ তৈরি হয়েছে, তা নিয়ে মালয়েশিয়া উদ্বিগ্ন। মিয়ানমারে শান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়টি অবশ্যই একটা বড় বিষয়। একই সঙ্গে দুর্ভোগে থাকা শরণার্থী ও ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য জরুরি মানবিক সহায়তাও প্রয়োজন। তিনি জানান, মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও থাইল্যান্ডের সঙ্গে একটি দল গঠন করে আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে মিয়ানমার সফর করবেন। এর উদ্দেশ্য হলো, সেখানে শান্তি নিশ্চিত করা এবং জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর যে নৃশংসতা চলছে, তার একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করা।

আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, মালয়েশিয়া বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা সুবিধা চালু করতে সম্মত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা পেট্রোনাসের সঙ্গে জ্বালানি খাতে এবং আজিয়াটার সঙ্গে টেলিযোগাযোগ খাতে সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছি। পাশাপাশি এখন আমরা এই সহযোগিতাকে হালাল, এসটিইএম (বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত), গবেষণা এবং সেমিকন্ডাক্টর খাতে জোরদার করতে চাই।’

সংবাদ সম্মেলনে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে আরও অধিকসংখ্যক বাংলাদেশি কাজ করার সুযোগ পাবেন বলে আশা প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি মালয়েশিয়ার ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগেরও আহ্বান জানান।

যেসব চুক্তি হলো

প্রধান উপদেষ্টা ও মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে গতকাল পাঁচটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) এবং তিনটি নোট বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম নোট বিনিময়টি উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সহযোগিতার জন্য স্বাক্ষরিত হয়। দ্বিতীয় নোট বিনিময়টি কূটনৈতিক প্রশিক্ষণ বিষয়ে সহযোগিতার জন্য স্বাক্ষরিত হয়। তৃতীয় নোট বিনিময়টি হালাল ইকোসিস্টেমে সহযোগিতা বিষয়ে।

বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে প্রথম এমওইউটি হয় প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বিষয়ে। দ্বিতীয় এমওইউটি হলো তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহ, এলএনজি অবকাঠামো, পেট্রোলিয়াম পণ্য ও সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো ক্ষেত্রে সহযোগিতা বিষয়ে। তৃতীয় এমওইউটি মালয়েশিয়ার ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের মধ্যে সহযোগিতা বিষয়ে। চতুর্থ এমওইউটি মালয়েশিয়ার মাইমস সার্ভিসেস এসডিএন বিএইচডি (এমএসএসবি) এবং বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিএমসিসিআই) মধ্যে সহযোগিতা বিষয়ে। পঞ্চম এমওইউটি মালয়েশিয়ার ন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এনসিসিআইএম) এবং বাংলাদেশের এফবিসিসিআইয়ের মধ্যে স্বাক্ষর হয়।

আজিয়াটাকে ফোর-জি সেবা সম্প্রসারণের আহ্বান

প্রধান উপদেষ্টা মালয়েশিয়ার শীর্ষ টেলিকম প্রতিষ্ঠান আজিয়াটাকে বাংলাদেশে ফাইভ-জি সেবা চালু এবং দেশের ডেটা সেন্টারে বিনিয়োগ করার আহ্বান জানিয়েছেন। কুয়ালালামপুরে প্রধান উপদেষ্টার অবস্থান করা হোটেলে আজিয়াটা প্রতিনিধিদলের সঙ্গে এক বৈঠকে তিনি এ আহ্বান জানান। সেলুলার অপারেটর রবির প্যারেন্ট কোম্পানি আজিয়াটা প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন আজিয়াটা গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং ইনডিপেনডেন্ট নন-এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর শাহরিল রিদজা রিদজুয়ান। আরও উপস্থিত ছিলেন আজিয়াটার সিইও বিবেক সুদ।

মালয়েশিয়ার ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগের আহ্বান

মালয়েশিয়ার ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন ড. ইউনূস। তিনি বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার দেশকে ব্যবসাবান্ধব করতে নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কুয়ালালামপুরে গতকাল বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সুযোগ নিয়ে আয়োজিত এক ব্যবসায়িক ফোরামে এ আহ্বান জানান তিনি।

প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিতে কাজ চলছে

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় মালয়েশিয়ার প্রবাসী বাংলাদেশিদের কৃতজ্ঞতা জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘আপনারা অর্থনীতিতে মস্ত বড় অবদান রাখছেন। আপনাদের এই অবদানের স্বীকৃতি আমাদের দিতে হবে। আগামী নির্বাচনে প্রবাসীদের ভোটাধিকার আমাদের নিশ্চিত করতে হবে।’ গতকাল কুয়ালালামপুরে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা।

বাংলাদেশ দূতাবাসের নৈশভোজে ড. ইউনূস

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস গতকাল কুয়ালালামপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস আয়োজিত নৈশভোজে যোগ দেন। কুয়ালালামপুরে হোটেল শাংরিলায় এই নৈশভোজের আয়োজন করা হয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মৌচাকে গাড়িতে লাশ: ২৫ লাখ টাকায় যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলে জাকিরকে শ্রীলঙ্কায় নিয়েছিল দালাল

যেভাবে শেখ হাসিনাকে ফেরানোর পরিকল্পনা চলছিল, স্বীকারোক্তিতে জানালেন মেজর সাদিকের স্ত্রী জাফরিন

পুলিশের এডিসিকে ছুরি মেরে পালিয়ে গেল ছিনতাইকারী

টেলিটক এখন গলার কাঁটা পর্যায়ে চলে এসেছে: ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব

সিন্ধু পানিবণ্টন নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতের রায় পাকিস্তানের বড় জয়: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত