Ajker Patrika

আইনশৃঙ্খলা নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে ভোটের আগে

  • ভোটের আগে মনোনয়নকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘাতের শঙ্কা।
  • রাজনৈতিক সহিংসতায় এক বছরে ১৩৫ জন নিহত।
  • অশান্ত হয়ে উঠেছে পাহাড়, প্রতিবেশী দেশের ইন্ধন দেখছে সরকার।
 শাহরিয়ার হাসান, ঢাকারাসেল মাহমুদ, ঢাকা
আপডেট : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০: ৪৮
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

জুলাই অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর রাতারাতি ভেঙে পড়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। একদিকে মব সৃষ্টি, মাজার ভাঙা, ছিনতাই-চাঁদাবাজির মতো অপরাধ বেড়ে যাওয়া, অন্যদিকে মনোবল ভেঙে পড়া পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা—সব মিলিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। এমন অবস্থায় আগামী বছরের মধ্য ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা রয়েছে। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, নির্বাচন সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে।

পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়িতে এক মারমা কিশোরীকে ধর্ষণের জেরে বিক্ষোভ, অবরোধ, আগুন ও হামলায় তিনজন নিহত হওয়ার ঘটনায় পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। এ ধরনের সহিংসতার জন্য পাহাড়ি সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টকে (ইউপিডিএফ) দায়ী করেছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)।

অন্যদিকে পাহাড়ে সহিংসতার পেছনে প্রতিবেশী দেশের ইন্ধন রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। খাগড়াছড়ির চলমান পরিস্থিতি ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার এমন মন্তব্য পাহাড় অশান্ত হয়ে ওঠার ইঙ্গিত বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

শুধু পাহাড় নয়, সমতলের আইনশৃঙ্খলাও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নেই। জুলাই অভ্যুত্থানের পর পরিস্থিতির অবনতির অন্যতম কারণ রাজনৈতিক সহিংসতা, যা নির্বাচন সামনে রেখে আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে ২ হাজার ৬১৩ জন খুন হয়েছে। অন্যদিকে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যমতে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে চলতি বছরের গত আগস্ট পর্যন্ত দেশে ৫১১টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এতে ১৩৫ জন নিহত ও ৫ হাজার ৭৭৫ জন আহত হয়েছে। এর মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ৯৪ জন নিহত ও ৪ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছে। আর প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংঘর্ষে নিহত হয়েছে ৪১ জন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, জাতীয় নির্বাচনের আগে মনোনয়নকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা নিজেদের মধ্যে কোন্দলে জড়াতে পারেন। এ ছাড়া নির্বাচনী এলাকাগুলোতেও বিভিন্ন দল বা জোটের প্রার্থীদের মধ্যেও সংঘাত-সংঘর্ষ হতে পারে। তৃতীয় কোনো শক্তিও নির্বাচনের আগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর মতো পদক্ষেপ নিতে পারে। অন্যদিকে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগও নির্বাচন বানচাল করতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে থাকবে বলে তথ্য পাচ্ছে তারা।

পরিসংখ্যান বলছে, গত এক বছরে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের মধ্যে ৩৪৭টি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এই সময়ে বিএনপি নেতা-কর্মীদের নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংঘর্ষে ৮৩ জন নিহত এবং চার হাজার নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন। একই সময়ে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের মধ্যে ১৮টি সহিংস ঘটনায় ১১ জন নিহত হয়েছেন। জামায়াতে ইসলামী ও এর অঙ্গসংগঠনের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন তিনজন। এ ছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে অন্তত ১০টি সহিংসতার ঘটনায় ৬৬ জন আহত হয়েছেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এসব সংঘাত-সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে বলে দলীয় নেতা-কর্মীরা জানিয়েছেন।

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চার অভাবেই সহিংসতা ঘটনা বাড়ছে বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, দলের ভেতরে গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব থেকেই সহিংসতা বাড়ছে। নেতৃত্ব ধরে রাখতে পেশিশক্তির প্রয়োগ এখন রাজনৈতিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। দল ও রাষ্ট্রে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না হলে এ সহিংসতা কমবে না, বরং ভোটের আগে আরও বাড়তে পারে।

এদিকে নির্বাচন সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করতে সব বাহিনী সমন্বিতভাবে কাজ করছে। স্থানীয় নাগরিক সমাজের সঙ্গে আলোচনা করে পরিস্থিতি উন্নয়নে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটকে নির্দেশ দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর।

র‍্যাবের মহাপরিচালক এ কে এম শহিদুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখা বড় চ্যালেঞ্জ। নির্বাচন সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নত করতে সব বাহিনী সমন্বিতভাবে কাজ করছে।

আর পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) খন্দকার রফিকুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে আলাদা কোনো বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তবে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটকে স্থানীয় নাগরিক সমাজের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে পরিস্থিতি উন্নয়নে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গত বছরের ৫ আগস্টের পর একধরনের আইন অমান্যের অবস্থা তৈরি হয়েছিল। মানুষকে সম্পৃক্ত না করলে ভবিষ্যতে সামাল দেওয়া আরও কঠিন হয়ে যাবে।

গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর গত আগস্টে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হামলায় গুরুতর আহত হন। ওই দিন জাতীয় পার্টির কার্যালয়ের সামনে দুই দফায় দুই দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। সে সময় বিএনপি নেতারা অভিযোগ করেছিলেন, নির্বাচন ব্যাহত করতে পরিকল্পিতভাবে রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে অস্থির করার চেষ্টা চলছে।

এসব বিষয়ে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, ‘বিএনপি সহিংসতার ঘটনায় জিরো টলারেন্স নীতি মেনে চলে। নেতা-কর্মীদের সংযম ও শান্তি বজায় রাখতে আহ্বান জানানো হয়েছে। তবুও যেসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে, তার জন্য আমরা দুঃখিত ও বিব্রত। দায়ীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’

আর এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন বলেন, ‘বিএনপি বা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সংস্কৃতি শক্তি প্রদর্শনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। হুট করে সেটা পরিবর্তন সম্ভব নয়। আমরা সেই ধারা থেকে বের হয়ে আসতে চাই।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, ‘সরকার রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় নিতে পারেনি। নির্বাচন ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অনেকে বলছেন, নির্বাচন ঠেকাতে ইচ্ছাকৃতভাবে আইনশৃঙ্খলার অবনতির চেষ্টা চলছে, যা ভবিষ্যতে আরও গুরুতর আকার নিতে পারে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বেসরকারি স্কুল-কলেজে কর্মচারী নিয়োগের কর্তৃত্ব হারাল পরিচালনা পর্ষদ

৪ দিন ধরে পুলিশ ফাঁড়িতে আটক যুবকের মৃত্যু, ইনচার্জ গ্রেপ্তার

টিকটকে পরিচয়, মোবাইল উপহার দিতে ডেকে দলবদ্ধ ধর্ষণ

খাগড়াছড়ি সহিংসতা: ‘ভুয়া ধর্ষণ’ মন্তব্যের জন্য ক্ষমা চাইলেন হান্নান মাসউদ

বিসিবিতে কাজ করতে আগ্রহী ওয়াসিম আকরাম, তবে...

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত