Ajker Patrika

সরকারি সহায়তার চাল

ভুয়াদের হাতে বরাদ্দের কার্ড, তালিকায় নেই ৩০% জেলে

  • ভিজিএফের চাল বরাদ্দে অনিয়ম
  • সহায়তা না পেয়ে কষ্টে জেলেরা
  • তালিকা সংশোধন ও হালনাগাদের তাগিদ
  • নির্ধারিত প্যাকেটে সহায়তা দেওয়ার পরামর্শ
সাইফুল মাসুম, ঢাকা 
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

দেশের মৎস্যজীবীদের বড় অংশকে জেলে হিসেবে নিবন্ধনের আওতায় এনেছে সরকার। অভিযোগ রয়েছে, নিবন্ধিত জেলেদের তালিকায় অনিয়ম-প্রতারণার মাধ্যমে অন্য পেশাজীবীরা ঢুকে পড়েছেন। এতে মাছ ধরা বন্ধ থাকার সময় সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় দেওয়া বিভিন্ন সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন অনেক প্রকৃত জেলে। প্রজনন মৌসুমে বছরের বিভিন্ন সময় মাছ ধরার ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকে। উপার্জন বন্ধ থাকার সময় সঞ্চয় না থাকলে বা ফুরিয়ে গেলে পরিবার নিয়ে কষ্টে দিন কাটাতে হয় দরিদ্র মৎস্যজীবীদের।

দেশের প্রায় ১ কোটি ৮৫ লাখ লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মৎস্য খাতের ওপর নির্ভরশীল। এর মধ্যে জেলে হচ্ছেন যাঁরা পেশাগতভাবে নদী, সাগরসহ বিভিন্ন জলাশয়ে জাল ও অন্যান্য সরঞ্জাম দিয়ে মৎস্য আহরণ করেন। মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের মে পর্যন্ত দেশে নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ১৮ লাখ ১৮ হাজার ৯২০ জন। তবে এ খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রায় ৩০ শতাংশ প্রকৃত জেলে নিবন্ধনের আওতায় আসেনি। উপকূলের বিভিন্ন জেলায় খোঁজ নিয়ে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

বঙ্গোপসাগরের মাছের গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতির প্রধান প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে জুলাই মাস। মাছের সুষ্ঠু প্রজনন ও সংরক্ষণের জন্য প্রতিবছর ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত মোট ৬৫ দিন দেশের সমুদ্রসীমায় মাছ ধরা বন্ধ থাকত। তবে এ বছর তা পরিবর্তন করে ১৫ এপ্রিল থেকে ১১ জুন পর্যন্ত ৫৮ দিন মাছ ধরা বন্ধ রাখা হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিবছর অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে ২২ দিন সারা দেশে ইলিশ মাছ আহরণ, পরিবহন, মজুত, বিপণন নিষিদ্ধ থাকে। ১ নভেম্বর থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ৮ মাস সারা দেশে জাটকা ধরা নিষিদ্ধ থাকে। এর বাইরে জাটকা সংরক্ষণে ইলিশের অভয়াশ্রমগুলোয় আলাদা করে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এভাবে বছরজুড়ে বিধিনিষেধের জালে আটকে থাকেন দেশের জেলেরা। মাছ ধরা বন্ধ থাকার সময় নিবন্ধিত জেলেদের একাংশকে মাসে ৪০ কেজি করে ভিজিএফের চাল দিয়ে থাকে সরকার। গভীর সমুদ্রে ৫৮ দিন মাছ ধরা বন্ধ থাকায় প্রথম ৪২ দিনের জন্য ৫৬ কেজি চাল বরাদ্দ করা হয়।

নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার সোনাদিয়া ইউনিয়নের চরচেঙ্গা স্লুইসগেটসংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা জেলে শাহাদাত হোসেন (৩৫)। বছরের বড় অংশ তিনি ট্রলারে করে নদী ও সাগরে মাছ ধরেন। মাছ ধরা বন্ধ থাকার সময় বেকার থাকেন কিংবা অন্যের জমিতে মজুরের কাজ করেন। এতে টেনেটুনে চলে অসুস্থ মা, স্ত্রী, তিন ছেলে ও এক মেয়ের সংসার। শৈশব থেকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করলেও সরকারের জেলের তালিকায় শাহাদাতের নাম নেই। ফলে তিনি কর্মহীন সময়ে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় কোনো সহযোগিতা পান না। শাহাদাত বলেন, ‘বেকার সময়ে ঘরে খোরাকির চাল থাকে না। বউ-বাচ্চা লই কষ্ট করি।’ শাহাদাতের অভিযোগ, জীবনে কখনো মাছ ধরেননি এমনও অনেকে জেলে হিসেবে নিবন্ধন নিয়ে সরকারি সুবিধা নিচ্ছেন।

সোনাদিয়া ইউনিয়নের নিবন্ধিত জেলে তালিকা যাচাই করে শাহাদাতের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। এই ইউনিয়নে নিবন্ধিত জেলে ২ হাজার ৭১ জন। এর উল্লেখযোগ্য একটি অংশ অন্য পেশাজীবী হয়েও জেলে হিসেবে তালিকভুক্ত হয়েছেন। এমন ব্যক্তিদের একজন চরচেঙ্গা বাজারের কাপড় ব্যবসায়ী হোসেন আলী। আর্থিকভাবে সচ্ছল এই ব্যক্তি মৎস্যজীবী না হয়েও নিয়মিত জেলেদের জন্য সরকারের বরাদ্দকৃত ভিজিএফ চালসহ সব সুবিধা পান। ব্যবসায়ী হোসেন আলী মুঠোফোনে আজকের পত্রিকার কাছে জেলে কার্ড থাকার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘স্যারেরা (মৎস্য কর্মকর্তা) অনেক আগে করে দিয়েছেন।’

হাতিয়া পৌরসভার চৌমুহনী বাজারের সার ও কীটনাশক ব্যবসায়ী ওবায়দুল হক মৎস্যজীবী না হয়েও জেলে হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছেন। আবার উপজেলার দক্ষিণ রাজেরহাওলা জেলে গ্রামের মৎস্যজীবী প্রাণকৃষ্ণ জলদাসকে জেলে হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হননি। প্রাণকৃষ্ণ বলেন, ‘আন্ডা জন্মের থেকে জ্যাইল্লা। আঁর জ্যাইল্লা কার্ড নাই। মাছ ধরন বন্ধ থাইকলে বউ-মাইয়া লই কষ্ট করন লাগে।’

মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, হাতিয়া উপজেলায় ২৬ হাজার জেলে রয়েছে। তবে বেসরকারি হিসাবে মৎস্যজীবীর সংখ্যা ৫০ হাজারের বেশি। দ্বীপ উপজেলাটির বিভিন্ন জেলেপাড়ার অন্তত ৫০ জন জেলের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়েছে। তাঁরা বলেছেন, ভুয়ার ভিড়ে প্রকৃত জেলেদের তালিকায় জায়গা হচ্ছে না।

অন্য পেশার লোকদের জেলে হিসেবে নিবন্ধন দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে হাতিয়ার উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফাহাদ হাসান বলেন, ‘আমরা যাচাই করে ব্যবস্থা নেব।’

পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালি উপজেলার চরমোন্তাজ ইউনিয়নে নিবন্ধিত প্রায় সাড়ে ৩ হাজার জেলে রয়েছেন। নিবন্ধনের বাইরে রয়েছে অন্তত আড়াই হাজার প্রকৃত জেলে। দক্ষিণ চরমোন্তাজে মান্তা জনগোষ্ঠীর প্রায় দেড় শ মৎস্যজীবী পরিবার আছে। এ জনগোষ্ঠীর জেলেদের বড় অংশ নিবন্ধনের বাইরে। মান্তা গোষ্ঠীর জেলে মো. হারুন সরদার জানান, তাঁরা নৌকাতেই বাস করেন। মাছ ধরে পেট চালান। কিন্তু তাঁকে জেলে হিসেবে নিবন্ধিত করা হয়নি।

নিবন্ধিত জেলের তালিকায় নাম রয়েছে রাঙ্গাবালি উপজেলার মধ্য চরমোন্তাজের বাসিন্দা মো. হারেজ খানের। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনি সারের ডিলার ও গ্রামের অবস্থাসম্পন্ন ব্যক্তি। উপজেলার দক্ষিণ চরমোন্তাজ গ্রামের মো. হারুন ফরাজী ও আলমাস ফরাজী নিবন্ধিত জেলে হিসেবে তালিকাভূক্ত। তারাও গ্রামের অবস্থাপন্ন ব্যক্তি। এর মধ্যে আলমাস ফরাজীর স্ত্রী সাবেক ইউপি মেম্বার।

তালিকায় নাম না ওঠা মৎস্যজীবীদের দেখা মিলল কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের জলদাসপাড়াতেও। গভীর সমুদ্রে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করলেও এখানকার স্বল্পসংখ্যক জেলেই নিবন্ধিত। জলদাসপাড়ার জেলে কৃষ্ণদুলাল জলদাস ও কৃষ্ণদাস মাঝি জানালেন, তালিকায় নাম না থাকায় তাঁরা সরকারি বরাদ্দ পান না।

উপকূলের মৎস্যজীবীদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা কোস্ট ফাউন্ডেশনের সহকারী পরিচালক জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘আইনে ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীর কোনো সংজ্ঞা নেই। এখনো ৩০ শতাংশ জেলে নিবন্ধিত নয়। আবার তালিকায় অন্য পেশার লোকও ঢুকেছেন। কোনো কোনো জেলে নিবন্ধনের পরে পেশা বদল করেছেন। এ জন্য নিবন্ধিত জেলেদের তালিকা প্রতিবছর হালনাগাদ করা উচিত।’

চাল বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ

মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জাটকা নিধন প্রতিরোধ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে ১২ লাখ ২৭ হাজার জেলে পরিবারকে খাদ্য সহযোগিতা (ভিজিএফ চাল) দেওয়া হয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে খাদ্য সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে ১২ লাখ ৩৮ হাজার জেলে পরিবারকে। এর ভিত্তিতে বলা যায়, সরকারি হিসাবে নিবন্ধিত হয়েও কয়েক লাখ জেলে এ সহযোগিতা পাননি।

জানতে চাইলে ‘খাদ্যনিরাপত্তা নেটওয়ার্ক’ (খানি) বাংলাদেশের সভাপতি রেজাউল করিম সিদ্দিক বলেন, ‘অনেক প্রকৃত জেলে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় নেই। যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের প্রাপ্ত সহায়তাও প্রয়োজনের তুলনায় কম। সুরক্ষা কর্মসূচির স্বচ্ছতা ও পরিধিও বাড়াতে হবে।’

সম্প্রতি ঈদুল আজহার আগে উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় জেলেদের চাল কম দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। জাটকা ধরা বন্ধে প্রতি দুই মাসের জন্য ৮০ কেজি চাল বরাদ্দ হলেও জেলেরা পেয়েছেন ৪০ কেজি। সাগরে ৫৮ দিন মাছ ধরা বন্ধ থাকায় প্রথম ৪২ দিনের জন্য ৫৬ কেজি চাল বরাদ্দ দেওয়া হলেও নিবন্ধিত নির্দিষ্ট সংখ্যক জেলে ৪০ কেজি করে চাল পেয়েছেন।

হাতিয়া উপজেলার মৎস্য অফিসসংশ্লিষ্ট একজন বলেন, বরাদ্দ কম থাকায় বেশিসংখ্যক জেলেকে চাল দেওয়ার জন্য পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া হয়। এতে তালিকায় না থাকা অনেক জেলেও চাল পেয়েছেন।

বরগুনার তালতলীতে ৮০ কেজি চালের জায়গায় জেলেরা ৭৫ কেজি করে পেয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকুয়াকালচার বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও মৎস্য গবেষক মীর মোহাম্মদ আলী এ বিষয়ে বলেন, বিভিন্ন ছুতায় কম দিয়ে জেলেদের ঠকানো হয়। এ জন্য নির্ধারিত প্যাকেটে নির্দিষ্ট পরিমাণ সহায়তা দিতে হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. আবদুর রউফ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘তথ্য হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া চলছে। প্রকৃত জেলেরা তালিকায় আসবে। অন্য পেশাজীবীরা বাদ পড়বে। আর জেলেরা বরাদ্দ অনুযায়ী চাল পাবে। একজনের চাল দুজনকে ভাগ করে দেওয়ার সুযোগ নেই।’

(প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন আজকের পত্রিকার রাঙ্গাবালি ও চকরিয়া উপজেলা প্রতিনিধি)

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ভারতে পোশাকের অর্ডার স্থগিত করছে মার্কিন ক্রেতারা, বাংলাদেশ-ভিয়েতনামে কারখানা স্থানান্তরের পরামর্শ

মোবাইল-টাকা ছিনতাইয়ের পর দুই তরুণীকে তুলে নিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, গ্রেপ্তার ৩

১১ বছর বয়সেই যৌন সম্পর্ক, ১৩-তে ছয় নারীর শয্যাসঙ্গী হন এই ব্রিটিশ রাজপুত্র

যুক্তরাষ্ট্র থেকে সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্রক্রয় চুক্তি স্থগিত করেছে ভারত

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ওপর ‘দমন-পীড়নে’ ২০২ শিক্ষকের উদ্বেগ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত