ডয়চে ভেলে
জুলাই-আগস্টে ছাত্র জনতার গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নির্দেশদাতা উল্লেখ করে তার বিরুদ্ধে আনা ৫টি অভিযোগ আমলে নিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
শেখ হাসিনার পাশাপাশি এই মামলায় আর যে দুজনকে আসামি করা হয়েছে, তারা হলেন— সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। তাঁদের মধ্যে চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন কারাগারে আছেন। শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে আদালত।
আইনজ্ঞদের অনেকেই মনে করেন, এই বিচার নিয়ে ভবিষ্যতে প্রশ্ন উঠতে পারে। কেউ কেউ এটাকে ‘পলিটিক্যাল ট্রাইব্যুনাল’ বলছেন। তবে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের দাবি, যে কোনো বিচার নিয়ে হাজারো প্রশ্ন তোলা সম্ভব, কিন্তু আইনগতভাবে কোনো প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই।
সুপ্রিমকোর্টের প্রবীণ আইনজীবী জেড আই খান পান্নাও মনে করেন, এই বিচার নিয়ে ভবিষ্যতে প্রশ্ন উঠতে পারে। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘এই বিচার তো প্রচলিত কোনো আইনের বিধানের দ্বারা হচ্ছে না। এই বিচার তো স্বাভাবিক না, অস্বাভাবিক। এই আইনটা করা হয়েছিল একাত্তরের জন্য। এখন ২০২৪ সালে এই আইনে বিচার হচ্ছে। ভবিষ্যতে তো যারা ২০২৫ বা ২০২৬ সালে থাকবে, তাঁদের বেলাও হতে পারে।’
আইনের ব্যাখার বিষয়ে জানতে চাইলে জনাব পান্না বলেন, ‘এখানে অনেকগুলো সেলফ কন্ট্রাডিক্টরি বিষয় আছে। ১৯৭১ সালের কয়েকজন অভিযুক্ত আছেন যাদের বিচার এখানে চলছিল। সেগুলোও তো করতে হবে। এখন ৭১-এর বিচার বাদ দিয়ে ২৪ সালের মামলা নিয়ে তাড়াহুড়ো করে হোক, আর যেভাবেই হোক, সেটা করতে হবে কেন? এটা তো ঠিক না। আমি মনে করি, এটা পলিটিক্যাল ট্রাইব্যুনাল।
এই বিচার নিয়ে ভবিষ্যতে প্রশ্ন উঠতে পারে কিনা জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘ভবিষ্যতে কে কী বলবে সেটা কি আর এখন আমরা বলতে পারবো? হাজারটা প্রশ্ন আপনি এমনিতেই করতে পারেন। কিন্তু আইনগতভাবে প্রশ্ন তোলার কি সুযোগ আছে?’
একই হত্যার দুইটা বিচার হয়ে যাচ্ছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে জনাব ইসলাম বলেন, ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ভিন্ন জিনিস। এখন পর্যন্ত তো কোন হত্যার বিচার তো হয়নি। এখানে কোনো ডাবল জিও পার্টি হচ্ছে না। যাদের বিরুদ্ধে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ আছে, এখানে শুধু তাঁদের বিচার হচ্ছে। আলাদা কোর্টে যেটা হচ্ছে, সেটা মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত না হলে বিচার চলতে বাধা নেই।’
বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে থেকে যারা অপরাধ করেছেন, তাঁদের জন্য এই ট্রাইব্যুনালটা করা: সিনিয়র আইনজীবী সাইদ আহমেদ রাজা
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ৫ অভিযোগ
অভিযোগ-১
২০২৪ সালের ১৪ জুলাই গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আসামি শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়া এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে আসামি আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায় তাঁদের অধীনস্ত ও নিয়ন্ত্রনাধীন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও সশস্ত্র আওয়ামী সন্ত্রাসীদের দ্বারা ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে নিরীহ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণের অংশ হিসেবে হত্যা, হত্যার চেষ্টা, নির্যাতন এবং অন্যান্য অমানবিক আচরণ করার অপরাধগুলো সংঘটনের প্ররোচনা, উষ্কানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা, অপরাধ সংঘটন প্রতিরোধে ব্যর্থতা, অপরাধ সংঘটনের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শান্তি প্রদান না করা এবং ষড়যন্ত্র করার অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।
অভিযোগ-২
শেখ হাসিনা কর্তৃক ছাত্র জনতার ওপর হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের হত্যা করে নির্মূলের নির্দেশ এবং তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তৎকালীন আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন কর্তৃক আসামি শেখ হাসিনার ওই নির্দেশ বাস্তবায়নে তাঁদের নিয়ন্ত্রণাধীন এবং অধীনস্ত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নির্দেশনা দিয়ে কার্যকর করার মাধ্যমে অপরাধ সংঘটনের নির্দেশ প্রদান, সহায়তা, সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করেছে যা তাঁদের জ্ঞাতসারে কার্যকর করা হয়েছে।
অভিযোগ-৩
শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য এবং মারণাস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনরত ছাত্র জনতাকে হত্যার নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায় তাঁদের অধীনস্থ ও নিয়ন্ত্রণাধীন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও সশস্ত্র আওয়ামী সন্ত্রাসীদের দ্বারা ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে নিরীহ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণের অংশ হিসেবে ১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে স্বল্প দূরত্ব থেকে সরাসরি নিরীহ নিরস্ত্র আন্দোলনকারী ছাত্র আবু সাঈদের বুক লক্ষ্য করে বিনা উষ্কানিতে একাধিক গুলি চালিয়ে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করার মাধ্যমে উল্লিখিত আসামিদের জ্ঞাতসারে এবং তাঁদের দ্বারা অপরাধ সংঘটনের নির্দেশ, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্রসহ অন্যান্য অমানবিক আচরণ করার মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন।
অভিযোগ-৪
শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য এবং মারণাস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনরত ছাত্র জনতাকে হত্যার নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায় তাঁদের অধীনস্ত ও নিয়ন্ত্রণাধীন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও সশস্ত্র আওয়ামী সন্ত্রাসীদেও দ্বারা ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে নিরীহ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণের অংশ হিসেবে ৫ আগস্ট ২০২৪ ঢাকা মহানগরীর চাঁনখারপুল এলাকায় আন্দোলনরত নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর তৎকালীন সরকারের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা নিরীহ নিরস্ত্র ৬ জন ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যা করার মাধ্যমে উল্লিখিত আসামীদের জ্ঞাতসারে এবং তাঁদের কর্তৃক হত্যার নির্দেশ, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্র করার মাধ্যমে মানবতা বিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।
অভিযোগ-৫
শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য এবং মারণাস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনরত ছাত্র জনতাকে হত্যার নির্দেশনার প্রেক্ষিতে আসামী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও আসামী চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায় তাঁদের অধীনস্ত ও নিয়ন্ত্রণাধীন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও সশস্ত্র আওয়ামী সন্ত্রাসীদের দ্বারা ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে নিরীহ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণের অংশ হিসেবে ৫ আগস্ট ২০২৪ ঢাকা জেলার আশুলিয়া থানার সামনে এবং আশপাশ এলাকায় আন্দোলনরত নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর তৎকালীন সরকারের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা নিরীহ নিরস্ত্র ৬ ছাত্র-জনতাকে গুলি করে তাঁদের মধ্যে ৫ জনের মরদেহ এবং ০১ জনকে জীবিত ও গুরুতর আহত অবস্থায় আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। এ ধরনের হত্যার নির্দেশ, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্রসহ অন্যান্য অমানবিক আচরণ করার মাধ্যমে মানবতা বিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।
প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ উপস্থাপনের পর বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্র্যাইব্যুনাল-১ শেখ হাসিনাসহ অপর দুই আসামীর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ আমলে নেয়ার আদেশ দেন এবং সেই সাথে আনুষ্ঠানিক অভিযোগের বিষয়ে পরবর্তী আদেশের জন্য আগামী ১৬ জুন দিন ধার্য করেন। এই মামলার আসামিদের গ্রেপ্তার করে সেদিন আদালতে হাজির করতে নির্দেশ দেয়া হয়।
চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম ট্র্যাইব্যুনালকে বলেন, মোট ৮ হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হয়েছে, যেখানে আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্রটি ১৩৫ পৃষ্ঠার। এই মামলায় সাক্ষী করা হয়েছে ৮১ জনকে। ট্র্যাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম ও প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও মো. আব্দুস সোবহান তরফদার শুনানি করেন। এ সময় অন্য প্রসিকিউটররা উপস্থিত ছিলেন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যে বিচার শুরু হলো, তা নিয়ে ভবিষ্যতে প্রশ্ন উঠতে পারে কিনা জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী সাইদ আহমেদ রাজা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘অবশ্যই উঠতে পারে। কারণ, এখানে যে চার্জগুলো আনা হচ্ছে সেটা এই আইনের আওতায় আসে কিনা সেইটা একটা অনেক বড় বিষয়। আমাদের বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে থেকে যারা অপরাধ করেছেন, তাঁদের জন্য এই ট্রাইব্যুনালটা করা। এরপর ৫ আগস্ট বা তার আগের ঘটনা নিয়ে যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে, সেখানে খণ্ড আকৃতির সংজ্ঞা নিয়ে ওই আইনের আন্ডারে বিচার করছে সেটা সব সময় একটা প্রশ্নবিদ্ধ অবস্থায় থাকতে পারে। পুরো বিষয়টা বোঝা যাবে চার্জ গঠন হলে। বাংলাদেশের প্রচলিত আইন ও এই আইনের সংমিশ্রনে যখন ট্রায়াল শুরু হবে, তখন বুঝতে পারবো ওনারা আইনসিদ্ধভাবে বিচার করছেন, নাকি করেনি। এটা অবশ্যই বলে রাখা উচিত হত্যার জন্য ট্রাইব্যুনালে বিচার হচ্ছে। আবার একই হত্যার ঘটনায় আলাদাভাবে একটা মামলা প্রেন্ডিং আছে। যেমন, ধরেন চানখারপুলে একজনকে হত্যা করা হয়েছে, সেই ঘটনায় মামলা হয়েছে। আবার গণহত্যার জন্য এখানে বিচার করা হচ্ছে। ফলে শুরু থেকেই একই ঘটনায় দুই আইন ব্যবহার করে প্যারালাল প্রোসেডিং চলছে। এটা তো সবাই দেখতে পাচ্ছি। ফলে এক পর্যায়ে দু’টোই আইনের চোখে ভুল বিচার হিসেবে গণ্য হবে।’
উদাহরণ দিয়ে এই আইনজীবী বলেন, ‘যেমন ধরেন আপনি আমার চেম্বারে আসলেন এবং যাওয়ার সময় একটা মোবাইল ও দুইটা ঘড়ি চুরি করে নিয়ে গেছেন। এই ঘটনায় আমি আপনার বিরুদ্ধে প্রথমে ঘড়ি চুরির জন্য একটা মামলা দিলাম এবং পরে ঘড়ি ও মোবাইল চুরির জন্য আরেকটা মামলা দিলাম। কিন্তু দুইটা মামলা তো একসঙ্গে কোনোভাবেই চলতে পারে না। যে কোনো একটা চলছে। কিন্তু এখানে যখন আপনি সংবিধানের বাইরে বিচার করে ফেলছেন, তখন দুইটাই বাতিল হয়ে যাবে। কারণ এক বিচারের জন্য দুইটা সাজা হতে পারে না। যেটাকে আমরা ডাবল জিও পার্টি বলি। আপনি পুরো আইনটাকে কমপ্লিট করছেন না। দুইটা শব্দ নিয়ে বলছেন, এইটা ওই আইনে আসে সেটা তো ভুল। আপনি তো ওই আইনের উদ্দেশ্য কি ছিল পড়েননি।’
এ পর্যন্ত মোট ৩৩৯টি অভিযোগ
জুলাই-আগস্টে ছাত্র জনতার গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মোট ৩৩৯টি অভিযোগ দাখিল হয়েছে। যেখানে ৩৯টির তদন্ত কার্যক্রম (কমপ্লেইন্ট রেজিস্টার অনুসারে) চলমান। তদন্তের প্রাথমিক সত্যতার আলোকে মিস কেস হয়েছে ২২টি। এসব মিস কেসে সর্বমোট অভিযুক্ত ব্যক্তি ১৪১ জন। যাদের মধ্যে গ্রেপ্তার রয়েছেন ৫৪ জন, আর ওয়ারেন্টভুক্ত পলাতক আসামি ৮৭ জন।
সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আইনজীবী সমিতির সভাপতি হিসেবে বলেন, বিএনপি নেতা হিসেবে বলেন আর বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে বলেন, আমি মনে করি, যে কোনো বিচার সুষ্ঠু ও স্বচ্ছভাবে হওয়া উচিত। এখন ট্রাইব্যুনালে বিচার শুরু হয়েছে। কিন্তু বিচার তো এখনো হয়নি। ফলে বিচার হলে বলা যাবে, বিচারটা সঠিকভাবে হয়েছে, নাকি হয়নি। আর একই ঘটনায় দুইটা বিচার হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। একটা হত্যাকাণ্ডের একটাই বিচার হবে।”
ট্রাইব্যুনালের আইন সংশোধন
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন-১৯৭৩ অধিকতর সংশোধন করে গত বছরের ২৪ নভেম্বর গেজেট প্রকাশ করে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩ সংশোধন করে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’ করা হয়। অধ্যাদেশে বলা হয়, এখন থেকে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা মামলার বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশ নিতে পারবে।
ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার আদেশ দিতে পারবে ট্রাইব্যুনাল। বার কাউন্সিলের অনুমতি সাপেক্ষে বিদেশি আইনজীবী নিয়োগ করা যাবে বলেও গেজেটে জানানো হয়। প্রথম দফায় ট্রাইব্যুনাল আইনে রাজনৈতিক দলকে বিচারের আওতায় আনার যে ধারাটি খসড়ায় রাখা হয়েছিল, তা বাদ দেয়া হয়েছে। উপদেষ্টা পরিষদ তখন মনে করেছিল, এই বিচারের সঙ্গে অন্য কোনো বিষয়কে জড়ানো ঠিক হবে না। রাজনৈতিক দল বা সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার বিষয় যুক্ত করা হলে এই আইনকে অযথাই প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
কিন্তু নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির আন্দোলনের মুখে গত ১১ মে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন সংশোধন করে অধ্যাদেশ জারি করে সরকার। এতে ট্রাইব্যুনাল কোনো রাজনৈতিক দল, তার অঙ্গসংগঠন বা সমর্থক গোষ্ঠীকে শাস্তি দিতে পারবেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর (প্রশাসন) গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামীম বলেন, সংশোধনীর পরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সংগঠনের বিরুদ্ধে শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা রাখা হয়েছে। প্রসিকিউশন (রাষ্ট্রপক্ষ) মনে করে, এটি একটি যথোপযোগী উদ্যোগ।
গাজী মোনাওয়ার হুসাইন আরো বলেন, ‘যদিও বাংলাদেশে প্রচলিত অন্যান্য আইনেও সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার বা সংগঠনের বিরুদ্ধে শাস্তি নেওয়ার বিধান আছে, তারপরও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মতো একটি আন্তর্জাতিক মানের আইন বা ট্রাইব্যুনালে সংগঠন বা ব্যক্তির বিচার হলে তা মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।’
স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ার অভিযোগও ট্রাইব্যুনালে
কেবলমাত্র মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পারিবারিক কলহ, জায়গা-জমির বিরোধ ও চাকরি সংক্রান্ত বিষয়সহ অপ্রাসঙ্গিক কিছু অভিযোগও জমা পড়েছে। ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার-বহির্ভূত অভিযোগও নিয়ে আসেন বিচার প্রার্থীরা। ট্রাইব্যুনালের প্রতি মানুষের আস্থা থেকেই হয়তো তারা এমনটি করেছেন।’
তামিম আরো বলেন, ‘সাধারণ মানুষ অনেকেই জানে না যে, এখানে (আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে) কোন ধরনের বিচার হয়। এজন্য অনেকেই তাঁদের সব ধরনের অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করে। আমরা ইতোমধ্যে পারিবারিক কলহ, স্বামী-স্ত্রী’র বিভেদ, জায়গা-জমির বিরোধ, চাকরি সংক্রান্ত অভিযোগসহ নানা ধরনের অভিযোগ পেয়েছি, যেগুলো মানবতাবিরোধী অপরাধের আওতায় পড়ে না বলে সেগুলো আমরা আর তদন্তে পাঠাই না।’
প্রসঙ্গত, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১০ সালে। এই ট্রাইব্যুনালের অধীনে ইতোমধ্যে বিচার শেষে একাধিক ব্যক্তির রায় কার্যকরও হয়েছে।
জুলাই-আগস্টে ছাত্র জনতার গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নির্দেশদাতা উল্লেখ করে তার বিরুদ্ধে আনা ৫টি অভিযোগ আমলে নিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
শেখ হাসিনার পাশাপাশি এই মামলায় আর যে দুজনকে আসামি করা হয়েছে, তারা হলেন— সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। তাঁদের মধ্যে চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন কারাগারে আছেন। শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে আদালত।
আইনজ্ঞদের অনেকেই মনে করেন, এই বিচার নিয়ে ভবিষ্যতে প্রশ্ন উঠতে পারে। কেউ কেউ এটাকে ‘পলিটিক্যাল ট্রাইব্যুনাল’ বলছেন। তবে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের দাবি, যে কোনো বিচার নিয়ে হাজারো প্রশ্ন তোলা সম্ভব, কিন্তু আইনগতভাবে কোনো প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই।
সুপ্রিমকোর্টের প্রবীণ আইনজীবী জেড আই খান পান্নাও মনে করেন, এই বিচার নিয়ে ভবিষ্যতে প্রশ্ন উঠতে পারে। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘এই বিচার তো প্রচলিত কোনো আইনের বিধানের দ্বারা হচ্ছে না। এই বিচার তো স্বাভাবিক না, অস্বাভাবিক। এই আইনটা করা হয়েছিল একাত্তরের জন্য। এখন ২০২৪ সালে এই আইনে বিচার হচ্ছে। ভবিষ্যতে তো যারা ২০২৫ বা ২০২৬ সালে থাকবে, তাঁদের বেলাও হতে পারে।’
আইনের ব্যাখার বিষয়ে জানতে চাইলে জনাব পান্না বলেন, ‘এখানে অনেকগুলো সেলফ কন্ট্রাডিক্টরি বিষয় আছে। ১৯৭১ সালের কয়েকজন অভিযুক্ত আছেন যাদের বিচার এখানে চলছিল। সেগুলোও তো করতে হবে। এখন ৭১-এর বিচার বাদ দিয়ে ২৪ সালের মামলা নিয়ে তাড়াহুড়ো করে হোক, আর যেভাবেই হোক, সেটা করতে হবে কেন? এটা তো ঠিক না। আমি মনে করি, এটা পলিটিক্যাল ট্রাইব্যুনাল।
এই বিচার নিয়ে ভবিষ্যতে প্রশ্ন উঠতে পারে কিনা জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘ভবিষ্যতে কে কী বলবে সেটা কি আর এখন আমরা বলতে পারবো? হাজারটা প্রশ্ন আপনি এমনিতেই করতে পারেন। কিন্তু আইনগতভাবে প্রশ্ন তোলার কি সুযোগ আছে?’
একই হত্যার দুইটা বিচার হয়ে যাচ্ছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে জনাব ইসলাম বলেন, ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ভিন্ন জিনিস। এখন পর্যন্ত তো কোন হত্যার বিচার তো হয়নি। এখানে কোনো ডাবল জিও পার্টি হচ্ছে না। যাদের বিরুদ্ধে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ আছে, এখানে শুধু তাঁদের বিচার হচ্ছে। আলাদা কোর্টে যেটা হচ্ছে, সেটা মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত না হলে বিচার চলতে বাধা নেই।’
বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে থেকে যারা অপরাধ করেছেন, তাঁদের জন্য এই ট্রাইব্যুনালটা করা: সিনিয়র আইনজীবী সাইদ আহমেদ রাজা
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ৫ অভিযোগ
অভিযোগ-১
২০২৪ সালের ১৪ জুলাই গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আসামি শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়া এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে আসামি আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায় তাঁদের অধীনস্ত ও নিয়ন্ত্রনাধীন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও সশস্ত্র আওয়ামী সন্ত্রাসীদের দ্বারা ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে নিরীহ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণের অংশ হিসেবে হত্যা, হত্যার চেষ্টা, নির্যাতন এবং অন্যান্য অমানবিক আচরণ করার অপরাধগুলো সংঘটনের প্ররোচনা, উষ্কানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা, অপরাধ সংঘটন প্রতিরোধে ব্যর্থতা, অপরাধ সংঘটনের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শান্তি প্রদান না করা এবং ষড়যন্ত্র করার অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।
অভিযোগ-২
শেখ হাসিনা কর্তৃক ছাত্র জনতার ওপর হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের হত্যা করে নির্মূলের নির্দেশ এবং তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তৎকালীন আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন কর্তৃক আসামি শেখ হাসিনার ওই নির্দেশ বাস্তবায়নে তাঁদের নিয়ন্ত্রণাধীন এবং অধীনস্ত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নির্দেশনা দিয়ে কার্যকর করার মাধ্যমে অপরাধ সংঘটনের নির্দেশ প্রদান, সহায়তা, সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করেছে যা তাঁদের জ্ঞাতসারে কার্যকর করা হয়েছে।
অভিযোগ-৩
শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য এবং মারণাস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনরত ছাত্র জনতাকে হত্যার নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায় তাঁদের অধীনস্থ ও নিয়ন্ত্রণাধীন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও সশস্ত্র আওয়ামী সন্ত্রাসীদের দ্বারা ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে নিরীহ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণের অংশ হিসেবে ১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে স্বল্প দূরত্ব থেকে সরাসরি নিরীহ নিরস্ত্র আন্দোলনকারী ছাত্র আবু সাঈদের বুক লক্ষ্য করে বিনা উষ্কানিতে একাধিক গুলি চালিয়ে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করার মাধ্যমে উল্লিখিত আসামিদের জ্ঞাতসারে এবং তাঁদের দ্বারা অপরাধ সংঘটনের নির্দেশ, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্রসহ অন্যান্য অমানবিক আচরণ করার মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন।
অভিযোগ-৪
শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য এবং মারণাস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনরত ছাত্র জনতাকে হত্যার নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায় তাঁদের অধীনস্ত ও নিয়ন্ত্রণাধীন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও সশস্ত্র আওয়ামী সন্ত্রাসীদেও দ্বারা ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে নিরীহ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণের অংশ হিসেবে ৫ আগস্ট ২০২৪ ঢাকা মহানগরীর চাঁনখারপুল এলাকায় আন্দোলনরত নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর তৎকালীন সরকারের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা নিরীহ নিরস্ত্র ৬ জন ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যা করার মাধ্যমে উল্লিখিত আসামীদের জ্ঞাতসারে এবং তাঁদের কর্তৃক হত্যার নির্দেশ, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্র করার মাধ্যমে মানবতা বিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।
অভিযোগ-৫
শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য এবং মারণাস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনরত ছাত্র জনতাকে হত্যার নির্দেশনার প্রেক্ষিতে আসামী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও আসামী চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায় তাঁদের অধীনস্ত ও নিয়ন্ত্রণাধীন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও সশস্ত্র আওয়ামী সন্ত্রাসীদের দ্বারা ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে নিরীহ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণের অংশ হিসেবে ৫ আগস্ট ২০২৪ ঢাকা জেলার আশুলিয়া থানার সামনে এবং আশপাশ এলাকায় আন্দোলনরত নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর তৎকালীন সরকারের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা নিরীহ নিরস্ত্র ৬ ছাত্র-জনতাকে গুলি করে তাঁদের মধ্যে ৫ জনের মরদেহ এবং ০১ জনকে জীবিত ও গুরুতর আহত অবস্থায় আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। এ ধরনের হত্যার নির্দেশ, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্রসহ অন্যান্য অমানবিক আচরণ করার মাধ্যমে মানবতা বিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।
প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ উপস্থাপনের পর বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্র্যাইব্যুনাল-১ শেখ হাসিনাসহ অপর দুই আসামীর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ আমলে নেয়ার আদেশ দেন এবং সেই সাথে আনুষ্ঠানিক অভিযোগের বিষয়ে পরবর্তী আদেশের জন্য আগামী ১৬ জুন দিন ধার্য করেন। এই মামলার আসামিদের গ্রেপ্তার করে সেদিন আদালতে হাজির করতে নির্দেশ দেয়া হয়।
চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম ট্র্যাইব্যুনালকে বলেন, মোট ৮ হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হয়েছে, যেখানে আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্রটি ১৩৫ পৃষ্ঠার। এই মামলায় সাক্ষী করা হয়েছে ৮১ জনকে। ট্র্যাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম ও প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও মো. আব্দুস সোবহান তরফদার শুনানি করেন। এ সময় অন্য প্রসিকিউটররা উপস্থিত ছিলেন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যে বিচার শুরু হলো, তা নিয়ে ভবিষ্যতে প্রশ্ন উঠতে পারে কিনা জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী সাইদ আহমেদ রাজা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘অবশ্যই উঠতে পারে। কারণ, এখানে যে চার্জগুলো আনা হচ্ছে সেটা এই আইনের আওতায় আসে কিনা সেইটা একটা অনেক বড় বিষয়। আমাদের বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে থেকে যারা অপরাধ করেছেন, তাঁদের জন্য এই ট্রাইব্যুনালটা করা। এরপর ৫ আগস্ট বা তার আগের ঘটনা নিয়ে যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে, সেখানে খণ্ড আকৃতির সংজ্ঞা নিয়ে ওই আইনের আন্ডারে বিচার করছে সেটা সব সময় একটা প্রশ্নবিদ্ধ অবস্থায় থাকতে পারে। পুরো বিষয়টা বোঝা যাবে চার্জ গঠন হলে। বাংলাদেশের প্রচলিত আইন ও এই আইনের সংমিশ্রনে যখন ট্রায়াল শুরু হবে, তখন বুঝতে পারবো ওনারা আইনসিদ্ধভাবে বিচার করছেন, নাকি করেনি। এটা অবশ্যই বলে রাখা উচিত হত্যার জন্য ট্রাইব্যুনালে বিচার হচ্ছে। আবার একই হত্যার ঘটনায় আলাদাভাবে একটা মামলা প্রেন্ডিং আছে। যেমন, ধরেন চানখারপুলে একজনকে হত্যা করা হয়েছে, সেই ঘটনায় মামলা হয়েছে। আবার গণহত্যার জন্য এখানে বিচার করা হচ্ছে। ফলে শুরু থেকেই একই ঘটনায় দুই আইন ব্যবহার করে প্যারালাল প্রোসেডিং চলছে। এটা তো সবাই দেখতে পাচ্ছি। ফলে এক পর্যায়ে দু’টোই আইনের চোখে ভুল বিচার হিসেবে গণ্য হবে।’
উদাহরণ দিয়ে এই আইনজীবী বলেন, ‘যেমন ধরেন আপনি আমার চেম্বারে আসলেন এবং যাওয়ার সময় একটা মোবাইল ও দুইটা ঘড়ি চুরি করে নিয়ে গেছেন। এই ঘটনায় আমি আপনার বিরুদ্ধে প্রথমে ঘড়ি চুরির জন্য একটা মামলা দিলাম এবং পরে ঘড়ি ও মোবাইল চুরির জন্য আরেকটা মামলা দিলাম। কিন্তু দুইটা মামলা তো একসঙ্গে কোনোভাবেই চলতে পারে না। যে কোনো একটা চলছে। কিন্তু এখানে যখন আপনি সংবিধানের বাইরে বিচার করে ফেলছেন, তখন দুইটাই বাতিল হয়ে যাবে। কারণ এক বিচারের জন্য দুইটা সাজা হতে পারে না। যেটাকে আমরা ডাবল জিও পার্টি বলি। আপনি পুরো আইনটাকে কমপ্লিট করছেন না। দুইটা শব্দ নিয়ে বলছেন, এইটা ওই আইনে আসে সেটা তো ভুল। আপনি তো ওই আইনের উদ্দেশ্য কি ছিল পড়েননি।’
এ পর্যন্ত মোট ৩৩৯টি অভিযোগ
জুলাই-আগস্টে ছাত্র জনতার গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মোট ৩৩৯টি অভিযোগ দাখিল হয়েছে। যেখানে ৩৯টির তদন্ত কার্যক্রম (কমপ্লেইন্ট রেজিস্টার অনুসারে) চলমান। তদন্তের প্রাথমিক সত্যতার আলোকে মিস কেস হয়েছে ২২টি। এসব মিস কেসে সর্বমোট অভিযুক্ত ব্যক্তি ১৪১ জন। যাদের মধ্যে গ্রেপ্তার রয়েছেন ৫৪ জন, আর ওয়ারেন্টভুক্ত পলাতক আসামি ৮৭ জন।
সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আইনজীবী সমিতির সভাপতি হিসেবে বলেন, বিএনপি নেতা হিসেবে বলেন আর বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে বলেন, আমি মনে করি, যে কোনো বিচার সুষ্ঠু ও স্বচ্ছভাবে হওয়া উচিত। এখন ট্রাইব্যুনালে বিচার শুরু হয়েছে। কিন্তু বিচার তো এখনো হয়নি। ফলে বিচার হলে বলা যাবে, বিচারটা সঠিকভাবে হয়েছে, নাকি হয়নি। আর একই ঘটনায় দুইটা বিচার হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। একটা হত্যাকাণ্ডের একটাই বিচার হবে।”
ট্রাইব্যুনালের আইন সংশোধন
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন-১৯৭৩ অধিকতর সংশোধন করে গত বছরের ২৪ নভেম্বর গেজেট প্রকাশ করে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩ সংশোধন করে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’ করা হয়। অধ্যাদেশে বলা হয়, এখন থেকে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা মামলার বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশ নিতে পারবে।
ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার আদেশ দিতে পারবে ট্রাইব্যুনাল। বার কাউন্সিলের অনুমতি সাপেক্ষে বিদেশি আইনজীবী নিয়োগ করা যাবে বলেও গেজেটে জানানো হয়। প্রথম দফায় ট্রাইব্যুনাল আইনে রাজনৈতিক দলকে বিচারের আওতায় আনার যে ধারাটি খসড়ায় রাখা হয়েছিল, তা বাদ দেয়া হয়েছে। উপদেষ্টা পরিষদ তখন মনে করেছিল, এই বিচারের সঙ্গে অন্য কোনো বিষয়কে জড়ানো ঠিক হবে না। রাজনৈতিক দল বা সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার বিষয় যুক্ত করা হলে এই আইনকে অযথাই প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
কিন্তু নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির আন্দোলনের মুখে গত ১১ মে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন সংশোধন করে অধ্যাদেশ জারি করে সরকার। এতে ট্রাইব্যুনাল কোনো রাজনৈতিক দল, তার অঙ্গসংগঠন বা সমর্থক গোষ্ঠীকে শাস্তি দিতে পারবেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর (প্রশাসন) গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামীম বলেন, সংশোধনীর পরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সংগঠনের বিরুদ্ধে শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা রাখা হয়েছে। প্রসিকিউশন (রাষ্ট্রপক্ষ) মনে করে, এটি একটি যথোপযোগী উদ্যোগ।
গাজী মোনাওয়ার হুসাইন আরো বলেন, ‘যদিও বাংলাদেশে প্রচলিত অন্যান্য আইনেও সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার বা সংগঠনের বিরুদ্ধে শাস্তি নেওয়ার বিধান আছে, তারপরও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মতো একটি আন্তর্জাতিক মানের আইন বা ট্রাইব্যুনালে সংগঠন বা ব্যক্তির বিচার হলে তা মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।’
স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ার অভিযোগও ট্রাইব্যুনালে
কেবলমাত্র মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পারিবারিক কলহ, জায়গা-জমির বিরোধ ও চাকরি সংক্রান্ত বিষয়সহ অপ্রাসঙ্গিক কিছু অভিযোগও জমা পড়েছে। ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার-বহির্ভূত অভিযোগও নিয়ে আসেন বিচার প্রার্থীরা। ট্রাইব্যুনালের প্রতি মানুষের আস্থা থেকেই হয়তো তারা এমনটি করেছেন।’
তামিম আরো বলেন, ‘সাধারণ মানুষ অনেকেই জানে না যে, এখানে (আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে) কোন ধরনের বিচার হয়। এজন্য অনেকেই তাঁদের সব ধরনের অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করে। আমরা ইতোমধ্যে পারিবারিক কলহ, স্বামী-স্ত্রী’র বিভেদ, জায়গা-জমির বিরোধ, চাকরি সংক্রান্ত অভিযোগসহ নানা ধরনের অভিযোগ পেয়েছি, যেগুলো মানবতাবিরোধী অপরাধের আওতায় পড়ে না বলে সেগুলো আমরা আর তদন্তে পাঠাই না।’
প্রসঙ্গত, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১০ সালে। এই ট্রাইব্যুনালের অধীনে ইতোমধ্যে বিচার শেষে একাধিক ব্যক্তির রায় কার্যকরও হয়েছে।
আগামী ৫ দিন পর্যন্ত গঙ্গা ও পদ্মা নদীর পানি সমতল বাড়তে পারে, তবে বিপদসীমার নীচ দিয়ে তা প্রবাহিত হতে পারে। আজ শনিবার গঙ্গা নদীর পানি সমতল স্থিতিশীল আছে ও পদ্মা নদীর পানি সমতল বাড়ছে ।
৭ ঘণ্টা আগেছবিতে দেখা যায়, সেনাপ্রধান ও তাঁর স্ত্রী সারাহনাজ কমলিকা রহমানকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন ও বঙ্গবভনের কর্মকর্তারা। তাঁরা শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। সেনাপ্রধান রাষ্ট্রপতির সঙ্গে করমর্দন ও উষ্ণ আলিঙ্গন করেন।
৮ ঘণ্টা আগেস্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.) তাঁর মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে পবিত্র ঈদুল আজহার শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন।
৮ ঘণ্টা আগেমিয়ানমারকে করিডোর দেওয়ার খবরটি ‘চিলে কান নিয়ে যাওয়ার গল্প’ বলে উল্লেখ করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস। গতকাল শুক্রবার (৬ জুন) সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি এ কথা বলেন।
১০ ঘণ্টা আগে