Ajker Patrika

ভর্তি রোগীর ৮০ ভাগেরই অক্সিজেন লাগছে

আজাদুল আদনান, ঢাকা
ভর্তি রোগীর ৮০ ভাগেরই অক্সিজেন লাগছে

করোনায় আক্রান্ত হওয়ার তিন দিনের মাথায় চরম শ্বাসকষ্টে ভুগতে থাকেন আফিল উদ্দিন (৭০)। অবস্থা সংকটাপন্ন হলে গত রোববার তাঁকে রাজধানীর উত্তরার বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

আক্রান্ত হওয়ার সাত দিনের মাথায় দ্রুত অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৫০-এ নামে চুয়াডাঙ্গার আশরাফুল ইসলামের (৬১)। প্রথমে জেলা সদর হাসপাতালে নেওয়া হলেও পর্যাপ্ত অক্সিজেন সহায়তা না পাওয়ায় ক্রমেই খারাপ অবস্থা হতে থাকে তাঁর। পরে গত রোববার রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হন। শুধু রাজধানীর এই দুই হাসপাতাল নয়, দেশের অধিকাংশ বিভাগীয় ও জেলা সদর হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগীদের চাপ বেড়েছে। যাদের ৮০ শতাংশেরই অক্সিজেন সহায়তা প্রয়োজন হচ্ছে বলে হাসপাতালগুলো জানিয়েছে। শুধু কোভিড রোগীই নয়, শ্বাসকষ্টের রোগীও আগের তুলনায় বেড়েছে।

সম্প্রতি দক্ষিণের জেলা সাতক্ষীরা ও উত্তরের বগুড়ায় অক্সিজেনের সংকটে ১৪ রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ ওঠে। ওই ঘটনার পর সারা দেশের হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন, সিলিন্ডার অক্সিজেন, হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা ও অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটর বা এইচডিইউ সমতুল্য শয্যাসংকটের বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি ১২৮টি হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে ৩৫ জেলায় আইসিইউর পাশাপাশি আটটি জেলায় হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা ও ছয় জেলায় সেন্ট্রাল অক্সিজেন সুবিধা নেই। এসব জেলার রোগীরা ভিড় করছেন বিভাগীয় ও পার্শ্ববর্তী জেলায়। সেখানে জায়গা না পেয়ে রাজধানীতে আসতে বাধ্য হচ্ছেন।

এ ছাড়া সংক্রমণের হার উচ্চমুখী হলেও এখনো জরুরি চিকিৎসা ও রোগী ব্যবস্থাপনায় পিছিয়ে দেশের ৩০ জেলা। এসব জেলার রোগীরা নিজ জেলায় চাহিদামতো সেবা পাচ্ছেন না। গত রোববার রাজধানীর কুয়েত মৈত্রী, কুর্মিটোলা জেনারেল ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, এক সপ্তাহ আগে দৈনিক অক্সিজেন প্রয়োজন–এমন রোগী আসার সংখ্যা ছিল ২৫-৩০ জন। তা এখন দ্বিগুণ হয়েছে। এসব হাসপাতালে অতি জরুরি ছাড়া কোনো রোগী ভর্তি নেওয়া হচ্ছে না।কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে বর্তমানে ১৬৯ রোগী আছেন, এদের সবাই অক্সিজেন সহায়তায় রয়েছেন।

নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) খালি না থাকায় সংকটাপন্ন রোগীদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোহাম্মদ শিহাব উদ্দিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ঢাকার বাইরে থেকে রোগী আসার সংখ্যা আগের তুলনায় দ্বিগুণ হয়েছে। বর্তমানে করোনা রোগী ও যাঁদের অক্সিজেন সহায়তার প্রয়োজন হচ্ছে, তাঁদেরই ভর্তি করা হচ্ছে। রোগীর সংখ্যা এখন যা আছে, এর চেয়ে বেড়ে গেলে পরিস্থিতি ধরে রাখা কঠিন হবে।

ধারণক্ষমতার চেয়ে ৪০ জনের বেশি রোগী নিয়ে চলছে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল। ৩০০ শয্যার এই হাসপাতালে গত রোববার দুপুর পর্যন্ত নতুন করে ৪০ জনকে ভর্তি করা হয়েছে। তবে আইসিইউ দিতে পারছে না হাসপাতালটি। যার জন্য অপেক্ষায় সংকটাপন্ন আরও অন্তত ১০ রোগী। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে গিয়েও দেখা যায়, হাসপাতালের সামনে অন্তত ১০ জন অ্যাম্বুলেন্সে অক্সিজেন সহায়তায় ভর্তির অপেক্ষায় ছিলেন। যাঁদের সবাই পঞ্চাশোর্ধ্ব।

দেশের আট বিভাগেই সংক্রমণ ও মৃত্যু আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। এখন সংক্রমণ ২৯ শতাংশ ছুঁয়েছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক অবস্থা দক্ষিণের বিভাগ খুলনায়। ওই বিভাগে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, যশোর, চুয়াডাঙ্গা ও বাগেরহাটে। সংক্রমণ ও মৃত্যু ঊর্ধ্বমুখী হলেও আইসিইউ নেই চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, মাগুরা ও নড়াইলে। এসব জেলার জটিল রোগীরা ভিড় করছেন পার্শ্ববর্তী জেলা ও রাজধানীতে।

করোনায় বিপজ্জনক অবস্থায় রাজশাহী বিভাগও। রাজশাহী ও বগুড়া ছাড়া বিভাগের বাকি ছয় জেলায় নেই আইসিইউ। আছে অক্সিজেনের সংকটও। চাঁপাইনবাবগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. জাহিদ নজরুল ইসলাম চৌধুরী আজকের পত্রিকাকে বলেন, রোগীদের চাপ থাকায় কোনো শয্যা খালি থাকছে না। নতুন করে যাঁরা আসছেন রেড ও ইয়েলো জোন করে রাখা হচ্ছে। আইসিইউ রোগীদের পাঠানো হচ্ছে রাজশাহীতে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, করোনার আগে দেশে অক্সিজেনের চাহিদা ছিল দিনে ১০০ থেকে ১২০ টন। করোনা সংক্রমণ বাড়লে এপ্রিলে চাহিদার পরিমাণ ২০০ থেকে ২২০ টন পর্যন্ত ওঠে। বর্তমানে দৈনিক ২০০ থেকে ২১০ টন পর্যন্ত অক্সিজেনের প্রয়োজন হচ্ছে। পরিস্থিতি জটিল হলে ২৩৫ টন পর্যন্ত অক্সিজেন সরবরাহের সক্ষমতা আছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লিন্ডে, এক্সপেক্ট্রা ও ইসলাম অক্সিজেনের পাশাপাশি নতুন করে দুটি প্রতিষ্ঠানকে মেডিকেল অক্সিজেন তৈরির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এগুলো হলো এ কে অক্সিজেন ও আবুল খায়ের স্টিল মেলিং। বর্তমানে দৈনিক ১১০ টন অক্সিজেন সরবরাহ করছে লিন্ডে। এক্সপেক্ট্রা করছে ৫৫ টন। আবুল খায়ের স্টিল মেলিংয়ের দৈনিক উৎপাদন সক্ষমতা ২৫০ টন। তবে মেডিকেল গ্রেডে তাদের সক্ষমতা ১৫ টন। ইসলাম অক্সিজেনের উৎপাদন ক্ষমতা ৭০ টন। এর মধ্যে ৪০ টনই তরল। বাকি দুটির মধ্যে এ কে অক্সিজেন ২০ টন ও আবুল খায়ের প্রতিদিন জোগান দিতে পারছে ৭ টন করে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, লিন্ডে ও এক্সপেক্ট্রা মিলে ১৬৫ টন এবং আবুল খায়ের, এ কে ও ইসলাম তিনটি মিলে দৈনিক ৫৭ টন অক্সিজেন সরবরাহ করছে। এ ছাড়া লিন্ডে ১৩ টন সিলিন্ডার সরবরাহ করছে। এর বাহিরে অক্সিজেন মজুত আছে ৯০০ টন। অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, দেশে যে পরিমাণ অক্সিজেন আছে, তাতে সমস্যা হবে না। কিন্তু সংক্রমণের মাত্রা ছাড়ালে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া চ্যালেঞ্জের হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে–নজির আহমেদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, যে পরিস্থিতি চলছে, বর্তমানে আক্রান্ত ও মৃতদের বড় অংশই গ্রামের। কিন্তু মফস্বলে অক্সিজেনের সক্ষমতা খুব একটা নেই। অনেক জেলায় আইসিইউও নেই। আবার আক্রান্তদের অনেকে দরিদ্র, ভালো চিকিৎসা পেতে শহরে আসার মতো অবস্থা তাঁদের নেই। দ্রুত সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে সামনে পরিস্থিতি শুধু জটিল নয়, একেবারে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত