Ajker Patrika

ভানুগাছার রাসমেলায় এক দিন

সুমন্ত গুপ্ত
ভানুগাছার রাসমেলায় এক দিন

সকাল ৭টা। ভেন্টিলেটরের ফাঁক দিয়ে মিষ্টি হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। আর এদিকে আমি কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছি। হঠাৎ মায়ের ডাকাডাকি আর মোবাইল ফোনের রিঙের অত্যাচার শুরু হয়ে গেল। মোদ্দা বিষয় হলো, ট্রেন ছাড়ার বাকি আছে মাত্র ২০ মিনিট। দ্রুত প্রস্তুত হয়ে নিচে নেমে দেখি, রাস্তা একেবারে নীরব। এই নীরবতার মাঝে হঠাৎ একটা সিএনজিচালিত অটোরিকশা আমার সামনে এসে দাঁড়াল। ছিনতাইকারী কি না ভাবতে ভাবতে দেখলাম, কর্মসূত্রে পরিচিত এক ভাই। জানালেন, তিনিও স্টেশনে যাবেন।

স্নিগ্ধ সকাল। দূষণমুক্ত পরিবেশে আমরা এগিয়ে চলছি। মোবাইল ফোনে খবর এল, ট্রেন হুইসেল দিয়ে দিয়েছে। স্টেশনের কাছাকাছি আসতেই দেখলাম, ট্রেন চলতেও শুরু করেছে। অবশেষে দৌড়েই ধরতে হলো জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস।

ট্রেন ছুটে চলেছে। আমাদের গন্তব্য হলো কমলগঞ্জের ভানুগাছ। সেখানে আমরা ঐতিহ্যবাহী মণিপুরি রাসনৃত্য দেখব। আমাদের পথপ্রদর্শক ডেনি শর্মা। তাঁর বাড়ি ভানুগাছে।

নগরজীবনের ব্যস্ততাকে পাশ কাটিয়ে আমরা চলছি কার্তিকের মিষ্টি সকালে। ট্রেনে আমাদের সঙ্গে মণিপুরি সম্প্রদায়ের অনেকে আছেন। আমাদের সবারই গন্তব্য এক। মাইজগাঁও স্টেশন পেরিয়ে এগিয়ে চলেছি। গরম-গরম শিঙাড়া আর সমুচা খেতে খেতেই আমরা ভানুগাছ এসে পৌঁছালাম। ট্রেন থেকে নেমে চলে গেলাম ডেনির বাড়িতে। ওদের বাসা থেকে রাসনৃত্যের মণ্ডপ খুব কাছে। সেই বাসায় খাওয়াদাওয়ার বিশাল আয়োজন, সব অবশ্য নিমেষে শেষও হলো।

দুপুর ১২টা। রাসনৃত্যে এখন রাখাল নৃত্যের সময়। পথে দেখা হলো অবনী সিংহের সঙ্গে।

তিনি আমাদের জানালেন, প্রথম রাসনৃত্যানুষ্ঠানে মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র নিজেই ছিলেন মুখ্য মৃদঙ্গবাদক এবং মহারানি হীরামতি ছিলেন গোপী প্রধানা ললিতার ভূমিকায়। আর রাজকন্যা বিম্বাবতী রাধার ভূমিকায়। রাসলীলা অনুষ্ঠিত হয় রাতের বেলায়। দিনে হয় রাখাল নৃত্য। রাখাল নৃত্যে ছেলেরা অংশ নেয়। রাসনৃত্যের পোশাক পরিকল্পনাও করেছিলেন মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র। ছেলেদের পোশাক সবারই এক রকম—পরনে ধুতি, খালি গা, মাথায় ময়ূর পালকের চূড়া। তার মধ্যে ছোট ছোট আরশি বসানো জরির কারুকাজ, কপালে চন্দনের তিলক, গলায় মালা, হাতে বাঁশি, কোমরের কাপড়ের ওপর জরি বসানো, মাথায় লম্বা কৃত্রিম চুল ও পায়ে নূপুর। মেয়েদের মুখের ওপর পাতলা সাদা বসনের আবরণ। ঘন সবুজ রঙের ভেলভেটের ব্লাউজ এবং পরনে সবুজ সাটিনের পেটিকোট, যার জমিনে অসংখ্য চুমকি এবং এর নিম্নাংশে পিতলের তবক মোড়া বিভিন্ন গোলাকার আয়না সমান্তরালভাবে বসানো থাকে।

বর্ণাঢ্য এই বিচিত্র পোশাকের নাম কুমিন। কুমিনের ওপর রুপালি কাজ করা আয়না বসানো সাদা স্বচ্ছ ঘাগরাটির নাম ‘পশুরাল’। কাঁধের ওপর থেকে পাশে ঝোলানো সোনালি ও রুপালি জরির কাজ করা অংশটিকে ‘খওল’ বলে। এ পোশাকের আরও অনেক অনুষঙ্গ থাকে। আমরা মণ্ডপে গিয়ে দেখলাম, রাখাল নৃত্য চলছে। যারা রাখাল নৃত্য করে, তারা প্রথমে মণ্ডপে গোল হয়ে গোপীভোজন করে। গোপীভোজন হলো বিভিন্ন সবজি দিয়ে রান্না করা তরকারি ও ভাত। এ খাবার খেয়েই রাখাল নৃত্য শুরু করেন শিল্পীরা।

শিশুদের এই নৃত্য দেখে আমাদের মন জুড়িয়ে যায়। সকালে শুরু হওয়া রাখাল নৃত্য একটানা চলে বিকেল পর্যন্ত। এই নৃত্যে শ্রীকৃষ্ণের বাল্যকালের কাহিনিই মূলত বর্ণনা করা হয়। রাখাল নৃত্য দেখে আমরা আবার এলাম ডেনির বাসায়। দুপুরের খাওয়ার জন্য বিশেষ আয়োজন করা হয়েছে।

এই প্রথম দেখলাম মণিপুরি খাবার ইরল পা বা ইরম্বা। এটি মূলত আলু, বরবটি, টমেটো, বেগুন, চ্যাপা শুঁটকি এবং কাঁচা মরিচ দিয়ে তৈরি সুস্বাদু খাবার। পেট পুরে খেয়ে সবাই রাত জাগার প্রস্তুতি নিতে শুরু করল। কিন্তু আশপাশে ঘুরে দেখার জন্য আমি বেরিয়ে গেলাম।

10

ঘড়ির কাঁটায় রাত ১১টা। রাতের খাবার খেয়ে আমরা চলে গেলাম মণ্ডপে। সেখানে তখন চলছে রাসনৃত্য। মণ্ডপটি সাজানো কাগজের ফুল ও কাপড় দিয়ে। মণ্ডপের চারপাশে আলো জ্বলছে। মণ্ডপ ঘিরে বসে আছেন নানা বয়সের নারী-পুরুষ। তাঁদের সবার চোখ মণ্ডপের মাঝখানে নৃত্যশিল্পীদের ওপর নিবদ্ধ। সেখানে নাচছে ১৫ থেকে ২০ জনের মণিপুরি কুমারী মেয়ে। মণ্ডপের এক কোণে বসে ৫ থেকে ৬ জন বৃদ্ধ নারী-পুরুষ বিশেষ বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গান গাইছেন। সেই গান ও বাজনার তালে তালে চলে নাচ।

এ এক অপূর্ব দৃশ্য! চারপাশের মানুষজন একাগ্রচিত্তে মগ্ন হয়ে আছেন রাধা-কৃষ্ণের লীলাকীর্তনে। নৃত্য উপভোগ করছেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে অনেকে মাঝেমধ্যে নৃত্যশিল্পীদের দিকে বাতাসাসহ শুকনো মিষ্টিজাতীয় খাবার ছুড়ে দিচ্ছেন। কেউ কেউ নৃত্যশিল্পীদের পায়ে প্রণাম করে টাকাও দিচ্ছেন। কেউ আবার টাকার মালা বানিয়ে নৃত্যশিল্পীদের গলায় পরিয়ে দিচ্ছেন।

বলে রাখা ভালো, রস থেকে রাস শব্দের উৎপত্তি। রাস হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের সর্বোত্তম মধুর রস। আর লীলা মানে খেলা। অর্থাৎ রাসলীলার মানে শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীরাধা ও তাঁদের সখা-সাথিদের লীলাখেলা। মণিপুরি সমাজে রাসনৃত্য ছয়টি ভাগে বিভক্ত। এগুলো মহারাস, বসন্তরাস, নিত্যরাস, কুঞ্জরাস, গোপীরাস ও উদখুলরাস। এগুলোর মধ্যে মহারাস হচ্ছে বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ।

রাস-নৃত্য-চলছে

রাসলীলার আক্ষরিক অর্থ হলো ‘ঐশ্বরিক আনন্দের নৃত্য’ বা ‘দিব্য প্রেমের খেলা’। বৈষ্ণব দর্শনে, গোপীদের (জীবাত্মা) সঙ্গে কৃষ্ণের (পরমাত্মা) এই নৃত্য জাগতিক কামনা-বাসনাহীন বিশুদ্ধ আধ্যাত্মিক প্রেমের চূড়ান্ত রূপের প্রকাশ। মণিপুরি শাস্ত্রীয় নৃত্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো রাসলীলা। ১৭৭৯ সালে মণিপুরের রাজা ভাগ্যচন্দ্র চালু করেছিলেন রাসনৃত্য।

যাবেন কীভাবে

ঢাকা থেকে সরাসরি কমলগঞ্জে ট্রেনে যাওয়া যায়। সিলেটগামী পারাবত ও জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস কমলগঞ্জ (ভানুগাছ) স্টেশনে থামে। এ ছাড়া অন্যান্য ট্রেনে শ্রীমঙ্গলে নামতে হবে। এরপর সেখান থেকে সহজে কমলগঞ্জে যাওয়া যায়। ঢাকার কমলাপুর থেকে মঙ্গলবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে ছেড়ে যায় আন্তনগর

ট্রেন পারাবত এক্সপ্রেস। বেলা ২টায় প্রতিদিন ছাড়ে জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস।

এ ছাড়া ঢাকার ফকিরাপুল ও সায়েদাবাদ থেকে হানিফ এন্টারপ্রাইজ, শ্যামলী পরিবহন, সিলেট এক্সপ্রেস ইত্যাদি পরিবহনের নন-এসি বাস যায় শ্রীমঙ্গল। ভাড়া ৪০০ থেকে ৮০০ টাকা। শ্রীমঙ্গল থেকে কমলগঞ্জে যাওয়া যায় বাস কিংবা অটোরিকশায়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...