Ajker Patrika

মার্কিন পর্যটকেরা কানাডিয়ান পরিচয় দিচ্ছেন, কিন্তু কেন

ফিচার ডেস্ক
আপডেট : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০: ৫৪
ছবি: ফ্রিপিক
ছবি: ফ্রিপিক

ডোমিনিকান রিপাবলিকের এক সমুদ্রপাড়ের ছোট বারে কানাডিয়ান ও আমেরিকান দর্শকের ভিড়। হকি ম্যাচ চলছে কানাডা বনাম যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে। স্কোর করার সঙ্গে সঙ্গে ৩৩ বছর বয়সী নিউইয়র্কের বাসিন্দা চেলসি মেটজার খুশি হয়ে বলে উঠলেন, ‘ওউ, ইউএসএ!’

কিন্তু তাঁর এই চিৎকার ভালো লাগল না কানাডিয়ান দম্পতির। মুহূর্তে তাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়ে বললেন, আমেরিকা স্বার্থপর, কানাডার সবকিছু নষ্ট করছে। শুধু তা-ই নয়, তারা পুরো পৃথিবীও নষ্ট করে ফেলছে।’ কথাগুলো বলতে বলতে কানাডিয়ান তরুণীটি কেঁদেও ফেললেন।

মার্কিন নাগরিক মেটজার বোঝানোর চেষ্টা করলেন, তিনি ট্রাম্পকে ভোট দেননি। তিনি এসব নীতির সঙ্গে একমতও নন। কিন্তু ততক্ষণে সেখানকার পরিবেশ আরও গরম হয়ে ওঠে। শেষে কানাডিয়ান দম্পতি ক্ষমা চেয়ে মেটজারকে ড্রিংকস প্রস্তাব করে। তবে ঘটনা এখানেই শেষ হয়নি।

কিছুক্ষণ পর মেটজার যখন ট্যাক্সি ডাকলেন, চালক প্রথমে ভেবেছিলেন, তিনি কানাডিয়ান। কিন্তু আসল পরিচয় জানার পর মুচকি হাসি দিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন। অপমানিত মেটজার তখন সিদ্ধান্ত নিলেন, কয়েক সপ্তাহ তিনি নিজেকে কানাডিয়ান বলেই পরিচয় দেবেন।

পুরোনো অভ্যাসের ফিরে আসা

২০০০ সালের শুরুর দিকেও একই ঘটনা দেখা যেত। ইউরোপ ভ্রমণে বের হওয়া অনেক মার্কিন তরুণ নিজেদের ব্যাগে কানাডার পতাকা সেলাই করে নিতেন। উদ্দেশ্য ছিল একটাই—আমেরিকাবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বাঁচা। বিশ্বজুড়ে ইরাক যুদ্ধ, আফগানিস্তানে মার্কিন সেনা প্রেরণ, বিদেশ নীতিতে আমেরিকার আগ্রাসী ভূমিকা। এসব কারণে অনেক দেশে আমেরিকানদের ভালো চোখে দেখা হতো না। তখন থেকে আমেরিকানদের কানাডিয়ান সাজা শুরু।

২০২৪ সালে ট্রাম্প আবারও নির্বাচিত হওয়ার পর সেই প্রবণতা আরও বেড়ে গেছে। ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধ, কানাডাকে ‘৫১তম অঙ্গরাজ্য’ বানানোর হুমকি, সাবেক প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোকে নিয়ে উপহাস—এসব কারণে কানাডিয়ানদের ক্ষোভ আরও বেড়েছে। এরই মধ্যে কিছু আমেরিকান বারও নিজেদের কানাডিয়ান সাজাতে শুরু করেছে। এ ঘটনাকে বলা হচ্ছে ‘ফ্ল্যাগ জ্যাকিং’ অর্থাৎ কানাডার পতাকা ব্যবহার করে আমেরিকান পরিচয় লুকানো।

কানাডিয়ানদের ক্ষোভ ও জাতীয়তাবাদ

কানাডিয়ান সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব টড ম্যাফিন এই বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কড়া সমালোচনা করেছেন। তাঁর ভিডিও কয়েক লাখ মানুষ দেখেছে। তিনি বলেন, ‘আমেরিকানরা ভাবে, আমরা নাকি তাদের ব্যাকআপ পাসপোর্ট। কিন্তু কানাডিয়ান পতাকা কোনো সেফটি শিল্ড নয়।’

বিশ্লেষকেরা বলছেন, কানাডার জাতীয়তাবাদ সব সময় কিছুটা ‘আমেরিকাবিরোধী’ অনুভূতির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। কারণ, কানাডিয়ানরা নিজেদের পরিচয়কে আলাদা করে গড়ে তুলতে চায়। যেমন সাবেক প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো সম্প্রতি সিএনএনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমরা কানাডিয়ান, এটা আমাদের পরিচয়। আমরা আমেরিকান নই।’

এই মনোভাবের কারণে যখন কোনো আমেরিকান নিজেকে কানাডিয়ান হিসেবে পরিচয় দেয়, সেটি তখন কানাডিয়ানদের কাছে জাতীয় অবমাননার মতো মনে হয়।

মাঠে, বাজারে ও ভ্রমণে প্রতিক্রিয়া

কানাডার ভেতরেও এর প্রভাব পড়ছে। অনেকে আমেরিকান পণ্য কেনা বন্ধ করেছেন। কেউ কেউ আবার আমেরিকান পর্যটকদের সরাসরি অপমান করছেন। একজন কানাডিয়ান ভ্রমণকারী বললেন, ‘অনেক বিদেশি আমাদের পতাকা বহন করে নিজেকে কানাডিয়ান পরিচয় দিচ্ছে। এটি আমাদের জন্য অপমানজনক। আমাদের খুব হালকাভাবে নেওয়া হচ্ছে।’

ছবি: ফ্রিপিক
ছবি: ফ্রিপিক

কানাডার ঐতিহাসিক ভাবমূর্তি এবং বর্তমান ঝুঁকি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নেদারল্যান্ডসকে মুক্ত করার পর থেকে কানাডিয়ানদের প্রতি ইউরোপে একধরনের কৃতজ্ঞতাবোধ রয়েছে। অনেক দেশে কানাডিয়ানদের উষ্ণ অভ্যর্থনা দেওয়া হয়। কিন্তু আমেরিকানরা যদি নিজেদের কানাডিয়ান দাবি করতে থাকে, তাহলে সেই ইতিবাচক ভাবমূর্তিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

পতাকা শুধু কাপড় নয়

পতাকা কেবল কাপড়ের টুকরা নয়, এটি পরিচয়, ইতিহাস আর একটি দেশের মর্যাদার প্রতীক। আমেরিকানরা সেটি ব্যবহার করে নিজেদের বিপদ এড়ানোর চেষ্টা করছেন। আর এটি কানাডিয়ানদের কাছে প্রতারণা।

সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকে লিখেছেন, এটি সাংস্কৃতিক চুরি, পতাকার প্রতি অবমাননা, ভ্রমণের সুবিধা নেওয়ার প্রতারণা, কানাডার সুনাম নষ্ট করা।

কানাডিয়ানদের পরিচয় চুরি করে ‘ফ্ল্যাগ জ্যাকিং’ এখন দুই প্রতিবেশী দেশের সম্পর্ক, জাতীয়তাবাদ ও সংস্কৃতির জটিল এক দ্বন্দ্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সূত্র: সিএনএন ছবি: ফ্রিপিক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত