Ajker Patrika

শরৎকালে অ্যালোভেরা দিয়ে ত্বকের যত্ন: আর্দ্রতা ও সুরক্ষার প্রাকৃতিক উপায়

ফিচার ডেস্ক
আপডেট : ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৬: ১২
ছবি: ফ্রিপিক
ছবি: ফ্রিপিক

ঋতুভেদে ত্বকযত্নের উপকরণ বদলাতে হয়। নইলে সেই প্রবাদের মতো, সময়ের গান অসময়ে হয়ে যায়। তাতে ত্বকের উপকার হয় না।

শরৎকালের আবহাওয়া খানিক উদ্‌ভ্রান্তের মতো আচরণ করে। এই প্রচণ্ড গরম তো এই বৃষ্টি। এদিকে সারাক্ষণ বইছে ঝিরিঝিরি হওয়া। ভ্যাপসা গরমে ঘাম হচ্ছে প্রচুর। গ্লাসের পর গ্লাস পানি পান করেও তৃষ্ণা মিটছে না। বিভিন্নভাবে শরীর থেকে পানি বেরিয়ে যাওয়ায় পানির ভারসাম্যহীনতা তৈরি হচ্ছে শরীরে। ফলে ত্বক হয়ে পড়ছে নির্জীব। এসব কারণে শরতে ত্বকযত্নে আরও যত্নবান হওয়া জরুরি। এ ক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারে অ্যালোভেরা বা ঘৃতকুমারী।

ত্বকের যত্নে অ্যালোভেরা কেন

অ্যালোভেরা হলো সেই উদ্ভিদ, যা ত্বকযত্নে সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। প্রাচীনকাল থেকে আধুনিক ডু ইট ইয়োরসেলফ বা ডিআইওয়াই ট্রেন্ড পর্যন্ত এই প্রাকৃতিক উপাদান আমাদের বিমুখ করেনি। এর এক দারুণ বিজ্ঞান আছে। চলুন, সেটা জেনে নিই।

মুকোপলিস্যাকারাইডের উপস্থিতি

অ্যালোভেরা জেলের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান মুকোপলিস্যাকারাইড; বিশেষ করে অ্যাসেমাননান। এই লম্বা-শৃঙ্খলযুক্ত শর্করা অণুগুলো ত্বকের স্তরে স্তরে আটকে থেকে একটি অদৃশ্য আর্দ্রতা-অবরোধক স্তর বা ময়শ্চার ব্যারিয়ার তৈরি করে। এই স্তর ত্বক থেকে পানি বের হয়ে যেতে বাধা দেয় বা ট্রান্সপিডার্মাল ওয়াটার লস কমায়। এ ছাড়া এটি বাইরের শুষ্ক বাতাস থেকে ত্বক রক্ষা করে।

ছবি: ফ্রিপিক
ছবি: ফ্রিপিক

২০০৮ সালে প্রকাশিত ‘ইন্ডিয়ান জার্নাল অব ডারমাটোলজি’তে প্রকাশিত ‘অ্যালোভেরা: আ শর্ট রিভিউ’ নামে একটি প্রবন্ধে বলা হয়েছে, অ্যালোভেরা জেলের ৯৯ দশমিক ৫ শতাংশ পানি হলেও বাকি শুষ্ক পদার্থের মধ্যে মুকোপলিস্যাকারাইড (বিশেষ করে গ্লুকোমানান), লিগনিন, স্যাপোনিন, স্যালিসিলিক অ্যাসিডসহ বিভিন্ন অ্যামিনো অ্যাসিড থাকে। এগুলো ত্বকের আর্দ্রতা বজায় রাখতে সহায়ক।

অ্যামিনো অ্যাসিড

অ্যালোভেরায় গ্লুটামিক ও অ্যাস্পার্টিক অ্যাসিডের মতো প্রাকৃতিক অ্যামিনো অ্যাসিড পাওয়া যায়। এগুলো ত্বকের প্রাকৃতিক আর্দ্রতা রক্ষাকারী উপাদান বা ন্যাচারাল ময়শ্চারাইজিং ফ্যাক্টর কিংবা এনএমএফ গঠনে সহায়তা করে। এনএমএফ হলো ত্বকের শীর্ষ স্তরে থাকা একগুচ্ছ জল-আকর্ষণকারী যৌগ, যা বাতাস থেকে জলীয় বাষ্প শুষে নিয়ে ত্বকে আর্দ্রতা বজায় রাখে।

হিউমেকট্যান্ট বৈশিষ্ট্য

অ্যালোভেরা একটি প্রাকৃতিক হিউমেকট্যান্ট। এটি পরিবেশ থেকে জলীয় বাষ্প আকর্ষণ করে এবং ত্বকের কোষে ধরে রাখে। গ্লিসারিনের মতো এটি ত্বকে আঠালো অনুভূতি দেয় না, কিন্তু কার্যকরভাবে আর্দ্রতা বজায় রাখে।

২০০৬ সালে ‘স্কিন রিসার্চ অ্যান্ড টেকনোলজি’ জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, ক্লিনিক্যাল গবেষণায় দেখা গেছে, অ্যালোভেরা এক্সট্রাক্টযুক্ত ময়শ্চারাইজার ব্যবহার করলে ত্বকের বাইরের স্তরের আর্দ্রতা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ে এবং ত্বকের খসখসে ভাব কমে।

ত্বকের ব্যারিয়ার ফাংশন মজবুত করে

অ্যালোভেরায় থাকে ভিটামিন এ, সি, ই, জিংক, ম্যাগনেশিয়ামের মতো খনিজ ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। এগুলো ত্বকের প্রতিরক্ষা আবরণ মেরামত এবং শক্তিশালী করে। স্বাস্থ্যকর ও শক্তিশালী ত্বক প্রতিরক্ষা আবরণ ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রাখে।

এনজাইমেটিক ও অ্যান্টি-প্রদাহরোধী ক্রিয়া

অ্যালোভেরায় ব্র্যাডিকিনিনেজের মতো এনজাইম রয়েছে। এটি প্রদাহ কমায়। প্রদাহ বা জ্বালাপোড়া ত্বকের আর্দ্রতা হারানোর একটি বড় কারণ। প্রদাহ কমিয়ে অ্যালোভেরা ত্বক শান্ত ও স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে আসে। এটি আর্দ্রতা ধরে রাখার জন্য আদর্শ।

অ্যালোভেরা একই সঙ্গে দুটি উপায়ে ত্বকের আর্দ্রতা বজায় রাখে। এটি হিউমেকট্যান্ট হিসেবে বাতাস থেকে আর্দ্রতা ধরে রেখে ইমোলিয়েন্ট হিসেবে ত্বকের ওপর একটি মসৃণ স্তর তৈরি করে আর্দ্রতা আটকায়। এর সক্রিয় জৈব যৌগ ত্বকের প্রতিরক্ষা আবরণকে শক্তিশালী করে, যাতে ভেতরের আর্দ্রতা বের হতে না পারে। এই সমন্বিত প্রভাবই অ্যালোভেরাকে বিশ্বব্যাপী ত্বকের আর্দ্রতাকারী উপকরণ হিসেবে জনপ্রিয় ও কার্যকরী উপাদানে পরিণত করেছে।

অ্যালোভেরা কীভাবে ব্যবহার করবেন

অ্যালোভেরা ব্যবহারের অনেক উপায় আছে। সহজ উপায় হলো, এর জেল বের করে আইস কিউব হিসেবে ফ্রিজে জমিয়ে নিন। পরিষ্কার ও উজ্জ্বল ত্বকের জন্য এগুলো এখন ট্রেন্ডি।

অ্যালোভেরা কিউব কীভাবে বানাবেন

অ্যালোভেরা আইস কিউব তৈরির প্রক্রিয়া বেশ সহজ। তাজা অ্যালোভেরা জেল সংগ্রহ করে পরিষ্কার বরফের ট্রেতে ঢেলে নিন। অতিরিক্ত উজ্জ্বলতার জন্য ১ টেবিল চামচ গোলাপজল, শসার রস এবং যেকোনো এসেনশিয়াল অয়েল যোগ করুন। তারপর এগুলোকে রাতভর ফ্রিজে জমতে দিন। পরদিন কোনো ঝামেলা ছাড়াই ব্যবহার করুন।

ছবি: ফ্রিপিক
ছবি: ফ্রিপিক

ফলাফল কী পাওয়া যেতে পারে

অ্যালোভেরা আইস কিউব ফোলা মুখ ও প্যান্ডা আইজ বা আন্ডার-আই ডার্ক সার্কেলের জন্য আদর্শ। এক কিউব বিশুদ্ধ অ্যালোভেরা জেল চোখের নিচে ও পুরো মুখে ঘষে নিন ধীরে ধীরে। তাৎক্ষণিকভাবে এটি ত্বকের জ্বালাপোড়া কমিয়ে ত্বক ঠান্ডা করে ফোলাভাব কমাবে। এ ছাড়া অ্যালোভেরা জেল ত্বকে আর্দ্রতা জোগায় ত্বকের ছিদ্র বন্ধ না করেই।

থ্রেডিং বা ওয়্যাক্সিংয়ের পরে তীব্র ফেশিয়াল বাম্পস বা লাল দানা কিংবা ফোলা তাৎক্ষণিক কমাতে পারে অ্যালোভেরা কিউব। এটি লাল ভাব কমায়, শেভ করার পর বাম্পস প্রতিরোধ করে। সংবেদনশীল ত্বকের জন্য এটি আদর্শ।

আইস কিউব না করেও প্রাকৃতিক অ্যালোভেরা মুখে ঘষা যায়। এটিও জ্বালাপোড়া করা ত্বক থেকে তাৎক্ষণিক স্বস্তি দেবে।

একটি প্রাকৃতিক প্রাইমার হাতে হাতে

মসৃণ ও উজ্জ্বল ত্বক পেতে একটি কিউব পুরো মুখে বুলিয়ে শুকিয়ে নিন। তারপর ফাউন্ডেশন ব্যবহার করুন। এতে ফাউন্ডেশন মসৃণভাবে সেট হয়ে যাবে। এটি ত্বকের ছিদ্র সংকুচিত করে এবং ত্বক সারা দিন ধরে তরতাজা ও উজ্জ্বল দেখাতে সাহায্য করে।

সানস্ক্রিনের বিকল্প হতে পারে

সানস্ক্রিন ছাড়াই বাইরে যেতে চাইলে মুখে ও শরীরের উন্মুক্ত জায়গায় অ্যালোভেরা জেল আইস কিউব ঘষে নিন। এটি হালকা সানবার্ন থেকে ত্বক রক্ষা করবে এবং ট্যান মিলিয়ে যেতে সাহায্য করবে।

শরতে অ্যালোভেরা দিয়ে রূপচর্চার উপকারিতা আছে

শরৎকালে অ্যালোভেরা দিয়ে রূপচর্চা অত্যন্ত উপকারী। এই সময় আবহাওয়া থাকে পরিবর্তনশীল এবং ত্বক শুষ্ক, রুক্ষ ও সংবেদনশীল হয়ে উঠতে শুরু করে। এ ক্ষেত্রে অ্যালোভেরা আদর্শ প্রাকৃতিক সমাধান হিসেবে কাজ করবে।

আর্দ্রতা রক্ষা করে

শরৎকালে বাতাসে আর্দ্রতা কমে যায়। ফলে ত্বক শুষ্ক ও ডিহাইড্রেটেড হয়ে পড়ে। অ্যালোভেরা জেল ত্বকের গভীরে আর্দ্রতা ধরে রাখে এবং প্রাকৃতিকভাবে ত্বকে পানির ভারসাম্য রক্ষা করে।

ত্বকের সুরক্ষা ও মেরামতি

তীব্র রোদ থেকে তৈরি হওয়া সান ড্যামেজ বা সানবার্ন সরাতে অ্যালোভেরা কার্যকর। এর জ্বালাপোড়া দূর করার গুণাগুণ ত্বকের লাল ভাব ও অন্যান্য সমস্যা কমিয়ে শরৎকালে ত্বকে শান্তি ও স্বস্তি দেয়।

ত্বক ডিটক্স করে

অ্যালোভেরা জেল ত্বক থেকে বিষাক্ত পদার্থ ও ময়লা পরিষ্কার করতে সাহায্য করে। এটি ত্বকের পোর্স গভীরভাবে পরিষ্কার করে। ফলে শরৎকালেও ত্বক থাকে নির্মল।

প্রাকৃতিক ময়শ্চারাইজার

শরতের শুষ্ক বাতাসে ভারী ময়শ্চারাইজারের প্রয়োজন হয়। অ্যালোভেরা লাইটওয়েট, নন-স্টিকি প্রাকৃতিক ময়শ্চারাইজার হিসেবে কাজ করে এবং লোমকূপ বন্ধ হওয়া না করেই পুষ্টি জোগায়।

রুক্ষতা দূর করে

আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে ত্বক রুক্ষ হয়ে ওঠে। অ্যালোভেরার এনজাইম মরা চামড়া দূর করে ত্বক নরম, মসৃণ ও কোমল করে তোলে।

সেনসিটিভ ত্বক শান্ত করে

শরতে অনেকের ত্বক বেশি সংবেদনশীল হয়ে ওঠে। অ্যালোভেরার প্রশান্তিদায়ক বৈশিষ্ট্য এই সময়ে ত্বকের লাল ভাব, চুলকানি ও জ্বালা কমাতে দারুণ কাজ করে।

এ সময়ে অ্যালোভেরা ব্যবহারের উপায়

অ্যালোভেরা ফেস প্যাক: তাজা অ্যালোভেরা জেলের সঙ্গে এক চিমটি হলুদ বা এক চা-চামচ মধু মিশিয়ে মুখে মাখুন। ২০ মিনিট পর ধুয়ে ফেলুন। এটি ত্বক উজ্জ্বল এবং শুষ্কতা দূর করবে।

অ্যালোভেরা আইস কিউব: শরৎকালে সকালে মুখ ধোয়ার পর একটি অ্যালোভেরা আইস কিউব মুখে হালকা করে ঘষে নিন। এটি ত্বক টোনড ও পোর্স সংকুচিত করবে এবং প্রাকৃতিকভাবে উজ্জ্বলতা বাড়াবে।

সতর্কতা

যাঁদের অ্যালোভেরায় অ্যালার্জি আছে, তাঁরা ব্যবহারের আগে হাতে পরীক্ষা করে নেবেন।

শেষ কথা, অ্যালোভেরা বা ঘৃতকুমারী শুধু শরতে ত্বকযত্নে ব্যবহারের জন্য নয়, এটি পুরো বছর ব্যবহার করা যায়। এটি ত্বক শীতল, আর্দ্র ও সুস্থ রাখে। ফলে ঋতু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে ত্বক রক্ষা করা যায় প্রাকৃতিকভাবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত