Ajker Patrika

বিমানে খাবারের ইতিহাস: রাজকীয় ভোজ থেকে সাশ্রয়ী স্ন্যাকস

ফিচার ডেস্ক
বিমানে খাবারের ইতিহাস: রাজকীয় ভোজ থেকে সাশ্রয়ী স্ন্যাকস

সাধারণত ধনী ও ফ্যাশনেবল ব্যক্তিদের একটি সামাজিক গোষ্ঠীকে বলা হয় জেট সেট। এরা ভ্রমণ করে বিশ্বজুড়ে এবং বেশির ভাগ সময় ব্যক্তিগত বিমান ব্যবহার করে সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দেয় বা অবসর কাটায়। এই শব্দ ১৯৪৯ সালে চালু হয়েছিল এবং এটি ক্যাফে সোসাইটির একটি প্রতিস্থাপন হিসেবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, বিশেষ করে ১৯৫০ ও ৬০-এর দশকে আন্তর্জাতিক জেট সেটের সদস্যরা বিশ্বজুড়ে ভ্রমণের ক্ষেত্রে নতুন স্টাইল ও আরামের প্রচলন করেছিলেন। বিমানের স্বর্ণযুগে পরিবেশিত ইন-ফ্লাইট খাবারের ছবি দেখলে চক্ষু চড়কগাছ হওয়া স্বাভাবিক। ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্টরা সাদা লিনেনের টেবিলক্লথের ওপর হর্স ডি’ওভ্রস পরিবেশন করছেন। হর্স ডি’ওভ্রস হলো এমন খাবার, যা প্রধান খাবারের আগে ছোট অংশে পরিবেশন করা হয়। প্রচলিত ভাষায় আমরা যাকে বলি অ্যাপেটাইজার। হয়তোবা যাত্রীরা গরম রোস্ট বা শর্ট রিবসে ছুরি চালিয়ে দিচ্ছেন। মিষ্টির পর যাত্রীরা ককটেলের জন্য লাউঞ্জে যাচ্ছেন। আজকের বাণিজ্যিক ফ্লাইটে এমন খাবার বিরল। ফলে ‘জেট সেট’ শব্দটি তার জৌলুশ হারানোর এটিই প্রধান কারণ।

আজকে আপনি বিমানে যা খাচ্ছেন বা বাণিজ্যিক ফ্লাইটের একজন যাত্রী যা খাচ্ছেন, তা কি শুরু থেকেই এমন ছিল? সুস্বাদু ও স্মরণীয় খাবারের সুযোগ এখনো আছে। আকাশেও আছে, আবার বিমানবন্দরের টার্মিনালেও আছে। ধীরে ধীরে বিমানবন্দরগুলো বৈশ্বিক খাদ্যের গন্তব্যে পরিণত হচ্ছে; যা যাত্রীদের জন্য স্বাগতিক শহরের সেরা খাবার উপভোগের সুযোগ। জানতে চান, কেমন ছিল সেই খাবারের যাত্রা?

শুরুতে খাবার ছিল ঠান্ডা

১৯১০-২০ সালের দিকে বিমানযাত্রা অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় যাত্রীসংখ্যা ছিল কম। ধরুন, ৪-১৫ জন। সে সময় তাই খাবার ছিল হালকা ও ঠান্ডা। ১৯১৯ সালে লন্ডন থেকে প্যারিস ফ্লাইটে প্রথম ৩ শিলিং মূল্যের বক্সড লাঞ্চ পরিবেশিত হয়। ১৯২৯ ফরাসি এয়ার ইউনিয়ন বিমানের কেবিনে ডাইনিং টেবিল চালু করে; যা মূলত ছিল রেলওয়ে ডাইনিংয়ের আদলে একটি রেস্তোরাঁ। ১৯২৭ এয়ার ইউনিয়ন ফ্লাইটে প্রথম সাত-কোর্সের পূর্ণাঙ্গ খাবার পরিবেশিত হয়। কিন্তু খাবারটি ছিল ঠান্ডা। ১৯২৮ সালে বার্লিন থেকে প্যারিস ফ্লাইটে প্রথম গরম খাবার পরিবেশন করে জার্মানির বৃহত্তম ও ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিমান সংস্থা লুফথানসা।

Biman-Flyght-2

ত্রিশের দশক প্রথম ফ্লাইট কিচেন প্রতিষ্ঠা

১৯৩০ সালের দিকে কিছুটা বিলাসিতার আগমন ঘটে। আমেরিকান এয়ারওয়েজ ‘টেস্টি লাঞ্চ অন আ পার্সোনাল ট্রে’ বলে একধরনের খাবার প্রচার করে। তবে তখন প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে খাবার পরিবেশন ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। ১৯৩৫ সালে প্যান আমেরিকান এয়ারওয়েজের মার্টিন এম-১৩০ ‘ক্লিপার’-এ উড়ানের মধ্যে মাংস রোস্ট করার ওভেন এবং পৃথক ডাইনিং এরিয়া ছিল। ১৯৩৭ সালে ইউনাইটেড এয়ারলাইনসের খাদ্য পরামর্শদাতা হিসেবে ডোনাল্ড এফ মাগারেলা ক্যালিফোর্নিয়ার অকল্যান্ডে বিমানশিল্পে প্রথম ফ্লাইট কিচেন প্রতিষ্ঠা করেন। এই উদ্যোগের ফলে যাত্রীরা তাঁদের খাবারে স্ক্র্যাম্বল্ড ডিম অথবা ফ্রাইড চিকেন বেছে নেওয়ার সুযোগ পান। বিষয়টি সেই সময়ে বিমানযাত্রায় খাবারের মানের একটি উল্লেখযোগ্য উন্নতি ছিল। এই কিচেন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিমানের জন্য খাবার প্রস্তুত ও সরবরাহ করার একটি সুসংগঠিত ব্যবস্থার সূচনা হয়েছিল, যা পরে এয়ারলাইনস ক্যাটারিং শিল্পের ভিত্তি তৈরি করে।

Biman-Flyght-3

যখন এল গরম খাবার

১৯৪০ সালে যাত্রীদের সুবিধার দিকে মনোযোগ দেয় বিভিন্ন এয়ারলাইনস। লম্বা ফ্লাইটে একঘেয়েমি দূর করতে খাবারকে আকর্ষণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রচলিত আমেরিকান সামরিক প্রযুক্তি অনুসরণ করে ফ্রোজেন খাবার চালু করা হয়। ১৯৫০ সালকে স্বর্ণযুগ ধরা যেতে পারে। এই সময় আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে প্রথম শ্রেণির যাত্রীদের জন্য ককটেলসহ ফরাসি বা থিমেটিক খাবার (গন্তব্য অনুযায়ী) চালু হয়। ১৯৫৪ সালে বিমানে প্রথম ব্যবহার উপযোগী মাইক্রোওয়েভ ওভেন স্থাপন করা হয়। ১৯৫৮ সালে প্যান আমেরিকান এয়ারওয়েজ ‘পাঁচ মিনিটের ওভেন’-এর (টোস্টার ওভেন) প্রচার করে, যা গরম খাবারের যুগ নিয়ে আসে।

Biman-Flyght-4

স্বাদের দিকে নজর এল যখন

১৯৬০ সালের দিকে দক্ষতা বৃদ্ধিতে নজর দেওয়া শুরু করে এয়ারলাইনসগুলো। বড় জেট বিমান চলা শুরু করার কারণে ফ্লাইটের সময় কমে। তাই বড় সার্ভিসের চেয়ে দ্রুততা বাড়ে। ১৯৬১ সালে দ্রুত পরিবেশনের জন্য ইনসুলেটেড ট্রলি কার্ট এবং ডিসপোজেবল প্লাস্টিক সামগ্রীর ব্যবহার শুরু হয়। ১৯৭০ সালের দিকে বোয়িং ৭৪৭-এর আগমন ঘটে। শিল্পকে সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত করায় টিকিটের দাম কমে, ফলে সাধারণ মানুষের জন্য আকাশযাত্রা সহজ হয়। ১৯৭১ সালে সাউথওয়েস্ট এয়ারলাইনস মাঝ-ফ্লাইটে স্ন্যাকস হিসেবে প্যাকেটজাত চিনাবাদাম পরিবেশন শুরু করে। ১৯৭৩ সালের দিকে ফরাসি এয়ারলাইনস ইউনিয়ন ডি ট্রান্সপোর্টস এরিয়েনস আবিষ্কার করে যে উচ্চতা, আর্দ্রতা ও চাপের কারণে স্বাদকোরকগুলো ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত নষ্ট হয়ে যায়। ফলে শেফ রেমন্ড অলিভার স্বাদ বাড়াতে লবণ, চিনি ও ফ্যাট বেশি দিয়ে রেসিপি তৈরি করেন। ১৯৮০ সালের দিকে বাজেট এয়ারলাইনস রায়ানএয়ার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮৭ সালে আমেরিকান এয়ারলাইনসের শেফ রবার্ট ক্র্যান্ডাল প্রতিটি প্রথম শ্রেণির স্যালাড থেকে একটি করে জলপাই বাদ দিয়ে ৮০ হাজার ডলার সাশ্রয় করেন।

Biman-Flyght-5

খাবার ও ইন্টারনেট

২০০০-২০২০ সালের দিকে চলে আসে ইন্টারনেট। নাইন-ইলেভেনের পর নিরাপত্তা বাড়াতে প্লাস্টিক ছুরি-কাটার ব্যবহার বাধ্যতামূলক হয়। খরচ কমাতে অনেক এয়ারলাইনস খাবার পরিবেশন বন্ধ করে দেয়। ২০০১ সালে এয়ারলাইনস মিল ডটনেট ওয়েবসাইট চালু করা হয়। যেখানে যাত্রীরা খাবারের মান নিয়ে আলোচনা এবং ছবি পোস্ট করেন। এভাবেই দিনে দিনে পরিবর্তিত হয়েছে খাবারগুলো। বদলেছে খাবারের ধরন ও প্রযুক্তির ব্যবহার। ২০০০ সালে জেট ব্লু যাত্রা শুরু করে বিনা মূল্যে চিপস দিয়ে, যা আকাশযাত্রাকে সাশ্রয়ী করে। একই বছরে এলএসজি স্কাই সেফ ওয়াশিংটন ডালাসের বিশাল কিচেনের দায়িত্ব নিয়ে আধুনিক ক্যাটারিংয়ের ভিত্তি গড়ে। তবে ২০০৩ সালে কিংবদন্তি কনকর্ড তার শেষ উড়ানে বিদায় জানায়। যার শেষ মেনুতেও ছিল লবস্টারের মতো রাজকীয় খাবার। এরই মধ্যে খরচ কমাতে ২০০৯ সালে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ স্বল্প দূরত্বের ফ্লাইটে খাবার বন্ধ করে দেয়। কিন্তু গুণগত মান বজায় রাখতে তারা সে বছরই সু-ভিড প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করে। ২০১১ সালে হেস্টন ব্লুমেন্থালের মতো তারকা শেফদের যুক্ত করে ফার্স্ট ক্লাসের মেনু আরও আকর্ষণীয় করা হলো। মজার ব্যাপার হলো, ২০১২ সালে জাপান এয়ারলাইনস ক্রিসমাসে ফ্লাইটে কেএফসি পরিবেশন করে নতুন মেনু যোগ করে। যদিও ২০১৮ সালে অ্যালার্জির কারণে সাউথওয়েস্ট এয়ারলাইনস তাদের বিখ্যাত চিনাবাদামের প্যাকেট বাতিল করে দেয়, ২০১৯ সালে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনস ‘ফার্ম-টু-প্লেন’ অংশীদারত্ব করে খাবারের গুণমান ও টাটকা ভাবকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়। আকাশযাত্রার খাবার এখন বিলাসিতা ছেড়ে দক্ষতা ও সতেজতার দিকে ঝুঁকছে।

সূত্র: মেট্রোপলিটন ওয়াশিংটন এয়ারপোর্টস অথরিটি

ছবি সূত্র: মেট্রোপলিটন ওয়াশিংটন এয়ারপোর্টস অথরিটি

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

জাতিসংঘে নেতানিয়াহুর ভাষণের সময় ওয়াকআউট করল কোন কোন দেশ, বাংলাদেশও কি ছিল

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও ফার্স্টলেডির সঙ্গে ড. ইউনূস, পাশে মেয়ে দীনা

বাগমারা উপজেলা বিএনপি: বেপরোয়া বহিষ্কৃত নেতারা

বিএনপির চোখ জামায়াত ও চরমোনাইয়ের দিকে

ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি: হাইব্রিড পদ্ধতির বিশ্ববিদ্যালয় চলবে দুপুর থেকে সন্ধ্যা

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত