Ajker Patrika

জাপানি কারাআগে কি বিশ্বের সেরা ফ্রায়েড চিকেন

ফিচার ডেস্ক, ঢাকা 
জাপানের জনপ্রিয় হালকা খাবারগুলোর মধ্যে কারাআগে বিশেষ স্থান দখল করে আছে। ছবি: কুকিং
জাপানের জনপ্রিয় হালকা খাবারগুলোর মধ্যে কারাআগে বিশেষ স্থান দখল করে আছে। ছবি: কুকিং

১৯৯০ সালের ঝকঝকে এক শরতের দিন। বিখ্যাত আমেরিকান ফাস্ট ফুড চেইন কেনটাকি ফ্রায়েড চিকেন বা কেএফসি তাদের একটি শাখা খোলে জাপানের নাকাৎসু শহরের নাকাৎসু রেলস্টেশন থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে। কিন্তু পাঁচ বছর পরে ১৯৯৫ সালের মে মাসের মধ্যে কেএফসির সেই শাখা বন্ধ হয়ে যায়। কারণ ছিল বিক্রি কম হওয়া। এই অবাক করা ঘটনার পেছনে ছিল জাপানের নিজস্ব ফ্রায়েড চিকেন কারাআগে।

প্রচলিত এই স্থানীয় গল্প সেখানকার মানুষ গর্বের সঙ্গে যুগ যুগ ধরে বলে আসছেন। তবে কেএফসি যখন প্রথম সেখানে শাখা খুলেছিল, তখন স্থানীয় কারাআগে দোকানমালিকেরা ভয় পেয়েছিলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন, এবার দোকানের ঝাঁপ ফেলতে হবে। কিন্তু তাঁদের মিথ্যা প্রমাণ করে বরং উল্টো নিজেদেরই গুটিয়ে নেয় কেএফসির মতো একটি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড!

নাকাৎসু শহরের এই প্রতীকী জয় ছাড়াও জাপানিজ ফ্রায়েড চিকেনের এই ব্র্যান্ড বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত। ২০০৭ সালে কেএফসি আবারও নাকাৎসুতে ফিরে এসেছিল। সেবার তারা নিজেদের আউটলেট খুলেছিল স্টেশনের কাছাকাছি। তবে সেবারে তারা নিজেদের স্থানীয় কারাআগের প্রতিযোগী হিসেবে নয়, বরং সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি খাবারের ব্র্যান্ড হিসেবে ফিরে আসে। এর মাধ্যমে তারা এই অঞ্চলের কারাআগে দোকানগুলোর সঙ্গে একধরনের বোঝাপড়া বা সমঝোতা তৈরি করে নেয়। প্রয়াত শেফ ও খাদ্য সমালোচক অ্যান্টনি বোর্দেইন ২০১৬ সালে বলেছিলেন, জাপানের একটি কনভেনিয়েন্স স্টোর চেইনের কারাআগে ছিল তার ‘গিল্ট প্লেজার’-এর মধ্যে একটি। সহজভাবে বলতে গেলে, তিনি ‘কারাআগে’ না খেয়ে কখনো প্লেনে উঠতেন না।

কোথায় থেকে এল কারাআগে

নিজস্ব গোপন উপাদান ও ম্যারিনেশন পদ্ধতি কারাআগেকে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ দেয়। ছবি: ক্রিস্টি অ্যাট হোম
নিজস্ব গোপন উপাদান ও ম্যারিনেশন পদ্ধতি কারাআগেকে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ দেয়। ছবি: ক্রিস্টি অ্যাট হোম

পর্তুগিজ মিশনারিরা নাগাসাকি বন্দরে আসার সময় ভাজা রান্নার পদ্ধতি নিয়ে আসেন। এটি ধীরে ধীরে জাপানিদের মধ্যে টেম্পুরা পদ্ধতির জন্ম দেয়। কিউশুতে ১৭০০ সালের দিকে কিওহো দুর্ভিক্ষের সময় ব্যাপক ফসলহানি ঘটে। খাদ্যের অভাব মেটাতে কৃষকদের মুরগি পালন করতে উৎসাহিত করা হয় এবং ডিম দেওয়া বন্ধ হয়ে গেলে মুরগি খাওয়া শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর খাদ্যের ঘাটতি ছিল মারাত্মক। যুক্তরাষ্ট্র থেকে তারা গম এবং বিশেষ জাতের মুরগি (ব্রয়লার) আমদানি শুরু করে। কিউশু আগে থেকেই জাপানে পোলট্রি উৎপাদনের কেন্দ্রে ছিল। তাই সেখানে দ্রুত বেড়ে ওঠা এই মুরগি দিয়ে নতুন নতুন রান্নার পদ্ধতি শুরু হয়। সেসব খাবারই দ্রুত একটি ক্ষুধার্ত দেশকে পুষ্টি জুগিয়েছিল। কারাআগের জন্ম হয়েছিল ১৯৫০ সালের প্রথম দশকের শেষের দিকে প্রতিবেশী উসা শহরের রাইরাইকেন নামের একটি চায়নিজ রেস্তোরাঁয়। কিন্তু এই খাবারকে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিচিতি এনে দেয় নাকাৎসু শহর। শহরটির দুই শেফ আরাতা হোসোকায়া ও শোজি মোরিয়ামা, ১৯৭০ সালে তাঁদের নিজস্ব দোকান খোলেন। তাঁরা কারাআগের স্বাদ আরও বাড়ানোর জন্য ম্যারিনেশন প্রক্রিয়াকে আরও সূক্ষ্ম করেন। তাতে যোগ করেন আপেলের টুকরা। এই উদ্ভাবন নাকাৎসুকে কারাআগের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত করে।

কারাআগের একাল-সেকাল

জাপানের জনপ্রিয় হালকা খাবারগুলোর মধ্যে কারাআগে বিশেষ জায়গা দখল করে আছে। এটি শুধু একটি খাবার নয়, এটি দীর্ঘদিনের সাংস্কৃতিক ইতিহাস, সংগ্রাম ও উদ্ভাবনের ফসল। নাকাৎসু শহরে ৫০টির মতো কারাআগে দোকান আছে। আর তাই শহরটি জাপানের ফ্রায়েড চিকেন রাজধানী হিসেবে পরিচিত। অনেকেই একে বিশ্বের সেরা ফ্রায়েড চিকেন বলেও মনে করেন। কিন্তু এই ৫০টি দোকানেই নিজস্ব গোপন উপাদান এবং ম্যারিনেশন পদ্ধতি রয়েছে, যা তাদের কারাআগেকে অন্যদের থেকে আলাদা করে তোলে।

কারাআগে একটি খাবার নয়, এটি দীর্ঘদিনের সাংস্কৃতিক ইতিহাস, সংগ্রাম এবং উদ্ভাবনের ফসল। কারাআগে তৈরির উপকরণ। ছবি: ক্রিস্টি অ্যাট হোম
কারাআগে একটি খাবার নয়, এটি দীর্ঘদিনের সাংস্কৃতিক ইতিহাস, সংগ্রাম এবং উদ্ভাবনের ফসল। কারাআগে তৈরির উপকরণ। ছবি: ক্রিস্টি অ্যাট হোম

জাপানে প্রতিবছর শরৎকালে কারাআগে গ্র্যান্ড প্রিক্স নামে এক বার্ষিক প্রতিযোগিতা হয়। সেখানে হাজার হাজার দোকান অংশ নেয় সেরা স্বাদের খেতাব জয় করার জন্য। বারবার এই প্রতিযোগিতায় বেশি পুরস্কার জিতে নেয় ওওইতা অঞ্চলের নাকাৎসু শহরের দোকানগুলো। কারাআগে গ্র্যান্ড প্রিক্স ছিল একটি জনপ্রিয়তার ভোটভিত্তিক প্রতিযোগিতা। কিন্তু ২০২৩ সাল থেকে এর নিয়মে পরিবর্তন এনেছে জাপানের কারাআগে অ্যাসোসিয়েশন। সে বছর থেকে স্বাদ পরীক্ষার জন্য বিচারকদের আনা হচ্ছে।

যে খাবারের স্বাদ সহজ কিন্তু গভীর

কারাআগে নামের এই খাবারকে প্রায়ই ফ্রায়েড চিকেনের জাপানি সংস্করণ বলা হয়। কিন্তু এর স্বাদ ও প্রক্রিয়া একেবারেই ভিন্ন। এর মূল বৈশিষ্ট্য হলো, সরল রেসিপির জটিল স্বাদ। সাধারণত মুরগির ঊরু, ব্রেস্ট, নেক বা উইংস ব্যবহার করা হয় এটি তৈরিতে। এটি রান্নার আগে মাংস সয়া সস, আদা, লবণ, রসুন, ফল এবং অন্যান্য ‘অতি গোপনীয়’ উপাদানের মিশ্রণে দীর্ঘ সময় মেখে রাখা হয়। এর বাইরের প্রলেপের ব্যাটার হালকা। মূলত আলুর স্টার্চ বা ময়দা দিয়ে এই আবরণ দেওয়া হয়। এই হালকা আবরণই মচমচে বাইরের অংশ এবং ভেতরে রসাল মাংসের চমৎকার বৈসাদৃশ্য তৈরি করে। এর প্রতিটি কামড়ে মুখের ভেতরে রসাল ও তীব্র স্বাদের অনুরণন ওঠে।

কেন জাপানের সোল ফুড কারাআগে

কারাআগে শুধু একটি খাবার নয়, এটি নাকাৎসু শহরের সম্পূর্ণ পরিচয় এবং জাপানিদের কাছে এটি গভীর আবেগের জায়গা। এই খাবার দারিদ্র্য থেকে উঠে এসেছে। ক্ষুধার্ত জনগণের পেট ভরিয়েছে, পুষ্টি জুগিয়েছে। আর এখন এটি জাপানের বিয়ে, জন্মদিন, এমনকি বড়দিনের মতো প্রধান উদ্‌যাপনেরও অংশ। প্রতিবছর বড়দিনে লাখ লাখ মানুষ কারাআগে খায়। এ ঘটনায় প্রমাণ হয়, জাপানে কারাআগে ঠিক কতটা জনপ্রিয়।

সূত্র: বিবিসি, সাকুরাকো, বাই ফুড

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...