Ajker Patrika

শিক্ষক দিবস /বিধ্বস্ত হয়েও চলছে শিক্ষকদের সংগ্রাম

ফিচার ডেস্ক
আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবস। ছবি: পেক্সেলস
আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবস। ছবি: পেক্সেলস

এ বছরের জুলাই মাসে বাংলাদেশ দেখেছে একটি ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা। উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলের সেই অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতা আর কষ্ট যেন পৌঁছে গিয়েছিল দেশের প্রতিটি ঘরে। সেই সঙ্গে শিক্ষকদের আত্মত্যাগের মতো ঘটনাও দেখেছিল দেশ। দেখেছিল শিক্ষক কীভাবে নিজের জীবন দিয়েও আগলে রাখেন তাঁর শিক্ষার্থীদের। স্কুলটির ২০ শিক্ষার্থীকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন শিক্ষিকা মাসুকা বেগম। নিজে আঘাত সহ্য করে শিক্ষার্থীদের নিরাপদে বের করার চেষ্টা করেছিলেন আরেক শিক্ষিকা মাহরীন চৌধুরী। শেষমেশ দুজনের কেউই বেঁচে ফেরেননি। হাসপাতালে নেওয়ার পর দুজনই মারা যান। শিক্ষার্থীদের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে দেওয়ার ইতিহাস বাংলার মাটিতে নতুন নয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) রসায়ন বিভাগের শিক্ষক এবং তৎকালীন প্রক্টর ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা ছাত্রদের রক্ষা করতে গিয়ে নিজেই সেনাদের গুলিতে এবং পরে বেয়নেটের আঘাতে নির্মমভাবে শহীদ হন। আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবস।

আফগান শিক্ষকেরা লড়ে যাচ্ছেন শিক্ষার আলো সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে। ছবি: দ্য কাবুল টাইমস
আফগান শিক্ষকেরা লড়ে যাচ্ছেন শিক্ষার আলো সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে। ছবি: দ্য কাবুল টাইমস

তালেবানীয় কায়দায় নাজেহাল আফগান শিক্ষক

মার্কিন সেনা সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহারের মাধ্যমে শেষ হওয়া ২০ বছরের যুদ্ধের কারণে আফগানিস্তান এক ধ্বংসপুরিতে পরিণত হয়েছিল। স্কুল-কলেজের অবস্থা ও সংখ্যায় ছিল মহামারি দশা। ২০২২ সালে আফগানিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলীয় এক প্রদেশের বাসিন্দা নজিবুল্লাহ ইসহাক তাঁর নিজের বাড়িকে একটি স্কুলে রূপান্তরিত করেছিলেন। ২৯ বছর বয়সী সেই তরুণ শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার (২৪ মাইল) দূরে অবস্থিত তুলাকান গ্রামের বাসিন্দা। সেই সময় তিনি শিশুদের পড়ালেখায় সহায়তার জন্য স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে এগিয়ে এসেছেন। আফগান টিচার্স রাইট অবজারভেটরিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারগুলোতে ফুটে ওঠে আফগানিস্তানের শিক্ষকদের আর্থিক ও মানসিক অবস্থা। বালখ প্রদেশের একটি ইসলামিক স্কুলের শিক্ষক হামিদুল্লাহ বলছেন, ‘এখানে ছাত্র ও শিক্ষকদের পরিস্থিতি খুবই কঠিন, অসহনীয়। আমার এবং আমার পরিবারের জন্য জীবনটা খুবই তিক্ত।’ বালখ প্রদেশের একটি বালিকা বিদ্যালয়ের ১৫ বছরেরও বেশি সময়ের শিক্ষিকা শাকিলা শিক্ষক হিসেবে নিজে স্কুলে যেতে বাধ্য হলেও, তার মেয়ে শিক্ষার্থীরা বাড়িতে থাকছে। এরপর বদলেছে অনেক কিছুই। তালেবান ক্ষমতা নেওয়ার পর এমন অনেক শিক্ষক ছিলেন, যাঁরা বিভিন্নভাবে লুকিয়ে হলেও নারী শিক্ষাকে উজ্জীবিত রাখতে চেয়েছেন। এখনো চাইছেন অনেকেই। তারা কেউ সফল, কেউ নীরব হয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন।

সিরিয়ার ইতিহাস অক্ষত রেখে শেখানোর দায়িত্ব শিক্ষকদের ওপরেই। ছবি: এএফপি
সিরিয়ার ইতিহাস অক্ষত রেখে শেখানোর দায়িত্ব শিক্ষকদের ওপরেই। ছবি: এএফপি

সিরিয়ার ইতিহাস শেখানোর ভার শিক্ষকদের ওপর

সিরিয়ার দীর্ঘ বছরের যুদ্ধের কারণে দেশটির শিক্ষাব্যবস্থা এক ভয়াবহ সংকটের মুখে। সেখানে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক সবাই কঠিন সংগ্রাম করছেন। এই সংগ্রাম শুধু শিক্ষার জন্য নয় বরং একেবারে বেঁচে থাকার জন্যই লড়াই। সিরিয়ান মিনিস্ট্রি অব এডুকেশনের দেওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী সিরিয়ায় প্রায় ১৯ হাজার ৪০০ স্কুল রয়েছে।

ড্রোনের যন্ত্রণাদায়ক শব্দকে গানে রূপান্তরিত করেছেন সংগীতশিক্ষক আমশা। ছবি: ইউনাইটেড নেশনস
ড্রোনের যন্ত্রণাদায়ক শব্দকে গানে রূপান্তরিত করেছেন সংগীতশিক্ষক আমশা। ছবি: ইউনাইটেড নেশনস

ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত

এর মধ্যে প্রায় ৭ হাজার ৯০০ স্কুল সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় সেগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী। অর্থাৎ, মোট স্কুলের প্রায় ৪০ শতাংশ বন্ধ। শুধু দেইর এজ-জোর প্রদেশে ৬৩টি স্কুল সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়েছে এবং ২৩টি স্কুল সামরিক কাজে ব্যবহৃত হওয়ায় সেখানে মোট ৮৬টি বন্ধ। শিক্ষকদের কাঁধে নতুন দায়িত্ব এসে পড়েছে। গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইতিহাসের শিক্ষক মারওয়ান আবদুল করিম বলেন, তাঁর দায়িত্ব এখন দ্বিগুণ হয়েছে। আদর্শের জন্য ইতিহাসকে বিকৃত না করে বাস্তব তথ্য শেখানো এবং কৌতূহল জাগানো এখন তাঁর মূল দায়িত্ব। কিন্তু সেই বোমা আর আগ্নেয়াস্ত্রের ভয় থেকে এখনো পুরোপুরি বের হয়ে আসতে পারেননি অনেক শিক্ষক। বাস্তুচ্যুত শিক্ষকেরা বিমান বা গোলার শব্দ শুনলে শিশুদের জন্য ভয় পান। বোমা, বাস্তুচ্যুতি এবং আপনজন হারানোর ট্রমা শিক্ষার্থীদের মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

গাজায় আশার আলো জ্বালিয়ে রাখা শিক্ষকেরা

গাজার বাসিন্দাদের কাছে ইসরায়েলি ড্রোনের শব্দ একটি নতুন অভিজ্ঞতা নয়, এটি বহু বছর ধরেই তাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অংশ। গাজায় একজন সংগীতশিক্ষক ইসরায়েলের গণহত্যার মতো যুদ্ধের অবিরাম ও ভয়ংকর শব্দ এবং এর ভয়াবহ প্রভাব থেকে আশপাশে থাকা মানুষকে মুক্তি দিতে একটি উপায় খুঁজে বের করেছেন। গাজার সংগীতের শিক্ষক আহমেদ আবু আমশা বলেন, ‘গাজায় যুদ্ধের বাস্তবতা থেকে পালানোর কোনো পথ নেই।’ এই ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবিলায় তিনি ড্রোনের এই যন্ত্রণাদায়ক শব্দকে একটি গানে রূপান্তরিত করেছেন। আবু আমশা তাঁর ছাত্রদের নিয়ে ভিডিওগুলো তৈরি করে ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করেন। গাজার আর একজন শিক্ষক রুয়াইদা আমির লিখেছিলেন, ‘আমি নিতান্তই কোনো সংখ্যা হতে চাই না, আমি গাজার এক বাস্তব গল্প।’ এখনো তিনি লড়ে যাচ্ছেন। কাজ করে যাচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গত মাসেই নিজের কাজের একটি ছবি শেয়ার করে লিখেছিলেন, ‘আমি শিশুদের সঙ্গে কাজ করতে ভালোবাসি। কারণ আমার মনে হয় আমি তাদের বুঝি। আমি শুধু একজন সাংবাদিক নই, একজন শিক্ষকও।’ তিনি নিজের সাধ্যমতো শিশুদের শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন এখনো।

লড়াই শুধু যুদ্ধের বিপক্ষেই নয়

বিশ্বের অন্যান্য দেশে, যেখানে যুদ্ধ নেই, সেখানে শিক্ষকেরা কেমন আছেন? ইউনেসকো ইনস্টিটিউট ফর স্ট্যাটিসটিকস এবং টিচার টাস্কফোর্সের একটি নতুন তথ্যপত্র অনুসারে, নিম্ন আয়ের দেশগুলোর মধ্যে মাত্র ১৪ শতাংশ দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য ধারাবাহিক পেশাগত উন্নয়ন বাধ্যতামূলক করার নীতি রয়েছে। এই প্রবণতা নিম্নগামী। ২০০০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে সাবসাহারান আফ্রিকায় প্রশিক্ষিত প্রাথমিক শিক্ষকদের হার ৮৫ শতাংশ থেকে কমে ৬৯ শতাংশ এবং প্রশিক্ষিত মাধ্যমিক শিক্ষকদের হার ৭৯ শতাংশ থেকে কমে ৫৯ শতাংশ হয়েছে। শিক্ষকদের জন্য সমর্থনের এই অভাব শিক্ষার মান ও সমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, যা আরও বেশিসংখ্যক শিক্ষককে পেশা ছাড়তে উৎসাহিত করে। বৈশ্বিক শিক্ষকস্বল্পতা এই জরুরি অবস্থাকে তুলে ধরে যে ২০৩০ সালের মধ্যে সর্বজনীন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা অর্জনের জন্য ৪৪ মিলিয়ন অতিরিক্ত শিক্ষক প্রয়োজন। শিক্ষকদের লড়াই শুধু শিক্ষাদানেই থেমে নেই, তাঁদের নিজেদের অর্থনৈতিকভাবে টিকা থাকার লড়াইও ঠিক ততটাই বাস্তব।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

৭৯৩ মণ্ডপে অসুরের মুখে দাড়ি, দায়ীদের শনাক্ত করা হচ্ছে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বাড়িভাড়া ভাতা বাড়ল ৫০০ টাকা, প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলনের ডাক

ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেকর্ড করল বিটকয়েন

কোরআন অবমাননার অভিযোগে নর্থ সাউথে ছাত্রকে সহপাঠীদের পিটুনি, মধ্যরাতে উদ্ধার করল পুলিশ

ইউরোপের সুন্দর দেশ এস্তোনিয়ায় স্থায়ী বসবাসের আবেদন করবেন যেভাবে

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত