Ajker Patrika

আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস

‘আমি সেই মেয়ে, আমিই পরিবর্তনের নেতৃত্ব দিই’

অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া
ছবি: পিক্সেল
ছবি: পিক্সেল

আজ আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস। প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্রগুলো ১১ অক্টোবর দিনটিকে আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস হিসেবে পালন করে। আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ‘দ্য গার্ল, আই অ্যাম দ্য চেঞ্জ লিড: গার্লস অন দ্য ফ্রন্টলাইনস অব ক্রাইসিস’ বা ‘আমি সেই মেয়ে, আমিই পরিবর্তনের নেতৃত্ব দিই: সংকটের সামনের সারিতে মেয়েরা’।

এই দিবসের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য মূলত লিঙ্গবৈষম্য দূর করা, শিক্ষার অধিকার, আইনি সহায়তা ও ন্যায় অধিকার, চিকিৎসা সুবিধা ও বৈষম্য থেকে সুরক্ষা, নারীর বিরুদ্ধে হিংসা ও বলপূর্বক তথা বাল্যবিবাহ রোধ করা।

দিবসটি যেভাবে এল

প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল নামে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতায় একটি প্রকল্প রূপে আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবসের জন্ম হয়েছিল। প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের ‘কারণ আমি একজন মেয়ে’ নামক আন্দোলনের ফলে এই দিবসের ধারণা জাগ্রত হয়েছিল। এই আন্দোলনের মূল কার্যসূচি হলো, গোটা বিশ্বজুড়ে কন্যার পরিপুষ্টি সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা।

এই সংস্থার কানাডার কর্মচারীরা এই আন্দোলনকে বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠা করতে কানাডা সরকারের সহায়তা নেয়।  

পরে জাতিসংঘের সাধারণ সভার মধ্যে কানাডায় আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস উদ্‌যাপনের প্রস্তাব শুরু হয়। ২০১১ সালের ১৯ ডিসেম্বর এই প্রস্তাব রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ সভায় গৃহীত হয় ও ২০১২ সালের ১১ অক্টোবর প্রথম আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস পালন করা হয়।

আমাদের দেশে কন্যাশিশুর নিরাপত্তা ও মানসিক স্বাস্থ্য

সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশে কন্যাশিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে চলেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘটছে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুসারে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত ২ হাজার ১৫৯টি শিশু নির্যাতনের অভিযোগে মামলা হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য অনুসারে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে ৯৯৩টি কন্যাশিশু নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ সংকলিত করে জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম জানিয়েছে, চলতি বছরের প্রথম আট মাসে দেশে ৩৯০ কন্যাশিশু ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে। যা গত বছরের তুলনায় বেশি। ২০২৪ সালের প্রথম আট মাসে ২২৪ কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়।  

ফলে নিরাপত্তা কন্যাশিশুর নিজের ও তাঁর পরিবারের মনোদৈহিক স্বাস্থ্যহানিও ঘটে। যা সব সময় চোখে দেখা যায় না। কিন্তু এই মানসিক চাপ অতিমাত্রায় শরীরের স্ট্রেস হরমোন নির্গত করে। ফলে শিশুকাল থেকে মেয়েদের নানা রকম শারীরিক উপসর্গ দেখা দিচ্ছে, যেমন মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, বুক ধড়ফড় করা, অতিরিক্ত ঘাম হওয়া ইত্যাদি। এই ভয় ও অতি সতর্কতা কন্যাশিশুর আত্মবিশ্বাসে এবং মানসিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

পরিবার যা করতে পারে

শারীরিক ও মানসিকভাবে পরিপক্ব হওয়ার আগে কন্যাশিশু যদি যৌন হয়রানির মতো ঘটনার সম্মুখীন হয়, তাহলে জীবনের প্রথম থেকে হীনম্মন্যতায় ভোগে। নিজেকে ধীরে ধীরে নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্য়ে নিয়ে আসে। মুক্তধারার চিন্তা করতে না পারার জন্য অনেক সময় কন্যাশিশুর পরিবারও দায়ী। পরিবারকে প্রথমে মনে রাখতে হবে, শিশু ছেলে হোক বা মেয়ে, তাদের শারীরিক গঠনে পার্থক্য থাকলেও মর্যাদায় যেন পার্থক্য না থাকে। মাছের বড় টুকরাটি যেন সপ্তাহে এক দিন ছেলে পেলেও আরেক দিন মেয়ে পায়। সেই সঙ্গে জমির বণ্টননামায় যেন কন্যাশিশুরা সমান অধিকার পায়। অর্থনৈতিক নিরাপত্তা এবং শিক্ষা দিয়ে যদি আমরা কন্যাশিশুকে স্বাবলম্বী করতে পারি, তবে কন্যাশিশুর মুক্ত ভবিষ্যৎ সম্ভব। তবে এ ক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার যে গত ২০ বছরে কন্যাশিশুকে স্বাবলম্বী করতে আমরা যতটুকু প্রয়াস নিয়েছি, সে অনুপাতে এসব কন্যার জন্য পুরুষদের মানসিকভাবে প্রগতিশীলতার চর্চায় কোথায় যেন কমতি থেকে গেছে। যার কারণে একই চাকরি করার পরও এখন অফিস থেকে ফিরে পুরুষটি যখন বিশ্রাম নেয়, তখন একই চাকরিজীবী নারী কর্মীকে ঘরের রান্না ও সন্তানের খাবার তৈরির পেছনে ছুটতে হয়।

সর্বোপরি সব শিশুকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা অভিভাবকের দায়িত্ব। তাহলে কন্যাশিশুর নিরাপত্তা নিয়ে আলাদা করে ভাবতে হবে না। কন্যাশিশু নিজেই নিজেকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নিরাপদ রাখার কাজকে সাবলীলভাবে নেবে। অন্যদিকে পুরুষও জানবে শক্তির আধার সেই কন্যাশিশু বা নারীকে চাইলে অসম্মান করা যায় না।

লেখক: বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও সাইকোথেরাপি প্র‍্যাকটিশনার, ফিনিক্স ওয়েলনেস সেন্টার, বাংলাদেশ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত