Ajker Patrika

পোস্টপার্টাম সাইকোসিস মা ও শিশুর জন্য কতটা ঝুঁকিপূর্ণ

অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া
আপডেট : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৭: ০৩
ছবি: পেক্সেলস
ছবি: পেক্সেলস

সম্প্রতি রংপুরের তারাগঞ্জে পাঁচ মাসের এক শিশুকে গলা কেটে হত্যার অভিযোগ উঠেছে তার মায়ের বিরুদ্ধে। সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন পেজ ও গ্রুপ ভেসে যাচ্ছে সে মায়ের ছবিসহ পোস্টে। কেন নিজের সন্তানকে হত্যা করেছেন—এ প্রশ্ন করায় শিশুর মা পুলিশকে উত্তর দেন, ‘বাচ্চার জন্য কোনো কাজ ঠিকভাবে করতে পারতাম না। আর কাজ ঠিকমতো না করলে আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন গালমন্দ করতেন ও মারধর করতেন।’ এই মা তাঁর সন্তানকে হত্যার কথা স্বীকার করেছেন। স্বজনেরাও জানিয়েছেন, তিনি নাকি মানসিক সমস্যায় ভুগছেন।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কোনো মা কি মানসিক সমস্যার কারণে সন্তানকে হত্য়া করতে পারেন? উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ পারেন। কোনো মা যদি সন্তান জন্মদানের পর পোস্টপার্টাম সাইকোসিসে বা প্রসবপরবর্তী মনোব্যাধিতে ভোগেন, তাহলে সন্তানকে অবহেলা থেকে শুরু করে হত্যা পর্যন্ত করতে পারেন।

ছবি: পেক্সেলস
ছবি: পেক্সেলস

‘পোস্টপার্টাম সাইকোসিস’ বা ‘প্রসবপরবর্তী মনোব্যাধি’ কোনো সাধারণ ‘বেবি ব্লুজ’ বা প্রসবোত্তর বিষণ্নতা নয়; এটি একটি মারাত্মক মেডিকেল ইমার্জেন্সি, যা চিকিৎসা না করলে মা ও শিশু উভয়ের জন্যই বিপজ্জনক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের সমাজে এই অবস্থাটি অজানা, উপেক্ষিত ও কলঙ্কিত।

পোস্টপার্টাম সাইকোসিস কী

পোস্টপার্টাম সাইকোসিস হলো সন্তান প্রসবের পরবর্তী সময়ে (সাধারণত প্রথম কয়েক সপ্তাহে) হওয়া একটি গুরুতর মানসিক অসুস্থতা। এটি একপ্রকারের সাইকোটিক ডিসঅর্ডার, যেখানে আক্রান্ত মা বাস্তবতা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তাচেতনা ও আবেগপূর্ণ অনুভূতিগুলো মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়। এতে সাধারণত কিছু উপসর্গ দেখা দেয়। উপসর্গগুলো হলো–

ছবি: পেক্সেলস
ছবি: পেক্সেলস

হ্যালুসিনেশন: এমন কিছু দেখা, শোনা বা অনুভব করা, যা বাস্তবে নেই। যেমন: শিশু কাঁদছে—এমন আওয়াজ শোনা, যদিও শিশু ঘুমিয়ে আছে।

ডিলিউশন বা ভ্রান্ত বিশ্বাস: এমন কিছু বিশ্বাস করা, যা সম্পূর্ণ অবাস্তব ও অযৌক্তিক। যেমন: এই বিশ্বাস যে শিশুটিতে ভূত আছে, শিশুটি শয়তান, শিশুটিকে কেউ হত্যা করতে আসবে বা নিজেকে এই পরিস্থিতি থেকে মুক্ত করার একমাত্র উপায় হলো তাকে মেরে ফেলা ইত্যাদি।

ছবি: পেক্সেলস
ছবি: পেক্সেলস

তীব্র অস্থিরতা বা উত্তেজনা: যেখানে মা অস্থির, উত্তেজিত ও বিরক্ত হয়ে পড়েন।

সুস্থিরভাবে চিন্তা করতে না পারা: চিন্তাভাবনা এলোমেলো হয়ে যায়, কথা যুক্তিহীন হয়ে পড়ে, অযৌক্তিক আচরণ করতে থাকেন মা।

পোস্টপার্টাম সাইকোসিস কেন হয়?

এ রোগের সঠিক কারণ এখনো খুব সুস্পষ্ট নয়। তবে এটি প্রধানত বায়োলজিক্যাল বা জৈবিক সমস্যা। বিশেষ করে, সন্তান প্রসবের পর মায়ের দেহে তারতম্যের কারণে মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব, ঘুমের অভাব, পূর্ববর্তী মানসিক রোগের ইতিহাস (যেমন বিষণ্নতা, বাইপোলার ইত্যাদি রোগের প্রাদুর্ভাব) এই রোগের জন্য প্রধানত রিস্ক ফ্যাক্টর হিসেবে বিবেচিত হয়।

ছবি: পেক্সেলস
ছবি: পেক্সেলস

এক হিসেবে দেখা গেছে, প্রতি এক হাজার জন প্রসূতি মায়ের মধ্যে এক থেকে দুজন এতে আক্রান্ত হন। কিন্তু সংখ্যা কম হলেও কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যায় না। অনেক সময় জিন-ভূতের আসর বলে অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা পদ্ধতিও প্রসূতি মায়ের শিশুর নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে।

কখন সতর্ক হতে হবে

  • প্রসবের ২৪ সপ্তাহের মধ্যে মায়ের আচরণে মারাত্মক পরিবর্তন এলে।
  • অযৌক্তিক, এলোমেলো ও ভয়ংকর সব কথা বলা, যেমন বলতে পারেন যে শিশুটি শয়তান বা ভয়ংকরভাবে ক্ষতিকারক।
  • অতিরিক্ত সন্দেহ করা বা সন্দেহপ্রবণ হয়ে পড়া অথবা মনে করা সবাই তাঁর শিশুটির অথবা তাঁর ক্ষতি করতে আসবে।
  • খাদ্যাভ্যাসে বড় ধরনের পরিবর্তন বা অরুচি।
  • বাচ্চার প্রতি অস্বাভাবিক আচরণ (যেমন নবজাতকের প্রতি অতিরিক্ত স্নেহ অথবা একদম দেখতে না পারা বা সহ্য করতে না পারা)।

চিকিৎসা ও প্রতিকার

জেনে রাখা ভালো, এই রোগ চিকিৎসাযোগ্য। নতুন মায়ের ওপর পরিবারের অন্য সদস্যদের বিরক্ত না হয়ে তাঁদের উচিত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে তাঁকে সাহায্য করা। সে সঙ্গে এটাও মনে রাখা প্রয়োজন যে—এটি একটি মেডিকেল ইমার্জেন্সি। তাই যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া প্রয়োজন। কাল দেখাব, পরশু দেখাব করে সময়ক্ষেপণ বিপজ্জনক। দেরি করলে চরম মাশুল দিতে হতে পারে।

ছবি: পেক্সেলস
ছবি: পেক্সেলস

চিকিৎসক প্রয়োজনে ওষুধ দেবেন। তবে নিয়মিত ওষুধ ও সাইকোথেরাপির সঙ্গে পরিবারকেও নতুন মায়ের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হবে। সন্তানের দেখভালসহ বাড়ির কাজকর্মে তাঁকে সহায়তা করতে হবে। এ ছাড়া তাঁর কী করলে মন ভালো লাগবে বা তিনি একটু আরাম পাবেন, সেদিকেও নজর দেওয়া জরুরি।

ভুক্তভোগীকে দোষ না দিয়ে অথবা তুমি কেমন মা ইত্যাদি বলে আরও বিব্রত না করে তাঁর প্রতি মমতাময় আচরণ করে তাঁকে বলতে হবে যে, এই সমস্যা সাময়িক। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেরে যাবে।

এমন পরিস্থিতিতে আমাদের দেশে অনেকেই মনে করেন যে, কাউন্সেলিং নেওয়ার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি কাউন্সিলিং ভালো কাজে দেয়।

পরিবারকে যা করতে হবে

প্রথমত, মনে রাখা জরুরি, মা এমন আচরণ স্বেচ্ছায় করছেন না। এটি একটি অসুস্থতা, তাই তাঁকে দোষারোপ করা যাবে না।

দ্বিতীয়ত, দ্রুত পরিকল্পনা করুন কীভাবে মায়ের চিকিৎসা করাবেন। আস্তে আস্তে নিজ থেকে সেরে যাবেন—এ ধরনের চিন্তাভাবনা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।

তৃতীয়ত, মা ও শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিন্ত করুন। মা ও শিশুকে একা রাখবেন না।

এসবের পাশাপাশি মায়ের পর্যাপ্ত খাওয়া, ঘুম ও বিশ্রাম নিশ্চিত করুন। মা যেন বুঝতে পারেন যে তাঁকে তাঁর পরিবার ভালোবাসে ও বোঝে।

মনে রাখবেন, যাঁদের মানসিক টানাপোড়েন আগে থেকে রয়েছে, তাঁরা যদি গর্ভধারণের আগে মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করে গর্ভ পরিকল্পনা করেন, তবে এই ঝুঁকি অনেকটাই কমানো যায়।

লেখক: চিকিৎসক, কাউন্সেলর, সাইকোথেরাপি প্র্যাকটিশনার, ফিনিক্স ওয়েলনেস সেন্টার বিডি

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত