Ajker Patrika

জীবনে ভোগ নাকি উপভোগ

অর্ণব সান্যাল, ঢাকা 
আপডেট : ২৬ মে ২০২২, ১৬: ১০
জীবনে ভোগ  নাকি উপভোগ

জীবন আসলে কতক্ষণের?
এর উত্তরে বছর-দিন-ঘণ্টা বা সেকেন্ডের—নানা কিসিমের হিসাব দেওয়া যায়। বছর ধরলে পরিমাণ কম দেখাবে, দিনে আরও বেশি, ঘণ্টা-সেকেন্ডের হিসাব ধরলে খুশিতে উথলে উঠতে পারে মন। কিন্তু কখনো কি মনে হয় না, জীবনের রূপ-রস-গন্ধ ন্যাপথলিনের মতো হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছে দ্রুত?
মির্জা গালিব বলেছিলেন,

‘উম্র হর চন্দ তে হ্যায় বর্কে খিরাম
দিল কে খুঁ করনে কি ফুরসত হি সহি’

জাভেদ হুসেনের তর্জমায় অর্থ দাঁড়ায়, ‘জীবন কেটে যায় যেন ক্ষণিক বজ্রশিখা, এই তো অনেক হৃদয়ের রক্ত ঝরানোর জন্য।’ দার্শনিক বোধে শুধু নয়, কখনো কখনো নিজের জীবনের দিকে তাকালেও অনুভব করা যায় তা। আচ্ছা, আজ থেকে ছয় মাস আগের বাস্তবতা কি আপনার জীবনে এখনো আছে? বা ছয় ঘণ্টার?
অথচ এই ক্ষণগণনার জীবন ঘিরেই আমাদের যত আয়োজন। সেই আয়োজনে যাপন থাকে উচ্চ স্বরে। যাপনের চাপে উদ্‌যাপনের হাহাকার বর্তমান আধুনিক কংক্রিটের জীবনে প্রায়ই শুনি। ভোগ যতটা দামামা বাজিয়ে যায়, উপভোগ কিন্তু থাকে ততটাই অনুচ্চারে। আর সে কারণেই জীবনে ভোগ আর উপভোগ দ্বন্দ্ব সমাস।

ভোগ ও উপভোগ
ভোগ-উপভোগ গুলিয়ে যায় প্রায়ই। কারণ এ দুইয়ের সঙ্গেই সুখ বা তৃপ্তি লাভের সম্পর্ক আছে। সব উপভোগ ভোগ হলেও, সব ভোগে উপভোগ হয় না। আর তাতেই এ দুইয়ে পার্থক্য হয়ে যায় সমুদ্র সমান।

অভিধান বলছে, ভোগ শব্দটি বিশেষ্য পদ। এর অর্থ সুখ বা দুঃখের অনুভূতি। হরিচরণ বন্দোপাধ্যায় তাঁর অভিধানে ‘ভোগ’ শব্দটির ছয় নম্বর অর্থে বলেছেন, অনুভব। তত্ত্বের ভাষায়, ভোগ আপনার প্রতি ঘটে, আপনাতে সৃষ্ট হয় না। ভোগ অনিচ্ছাকৃত হতে পারে, তাতে সুখের পাশাপাশি যন্ত্রণাও থাকতে পারে। ‘উপভোগ’ শব্দটির অনেকগুলো অর্থের মধ্যে একটি হলো তৃপ্তি বা আনন্দের সঙ্গে ভোগ। ‘উপ’- এই উপসর্গটি নৈকট্য, উৎকর্ষ, সাদৃশ্য ইত্যাদি অর্থ প্রকাশ করে। হরিচরণ বন্দোপাধ্যায় এর উনত্রিশটি অর্থের মধ্যে আট নম্বরে বলেছেন, ‘উপ’ এর অর্থ উদ্যোগ। উপভোগ তাই উপযুক্ত রূপে ভোগ অর্থের ব্যবহার করা হয়। আর সে জন্য উপভোগে নিজের চেষ্টা থাকতেই হয়, উদ্যোগী হতে হয়। উপযুক্ত ভোগে মানবিকতা মিশে থাকে এন্তার।

উপভোগের গ্যালারি বানিয়ে অন্যকে দেখালে সুখ কমে বই বাড়ে না।

জার্নাল অব কনজ্যুমার রিসার্চ, ২০১৮ 

ভোগের চেয়ে উপভোগ ভালো
১৯৯০ সালে একটি বই প্রকাশিত হয়েছিল। নাম ‘ফ্লো: দ্য সাইকোলজি অব অপটিমাল এক্সপেরিয়েন্স’। বইটিতে লেখক ও মনোবিদ মিহাই চিকসেন্তসমিহাই বলেছিলেন, উপভোগ মানুষকে সামনের দিকে এগিয়ে দেয়, দেয় অর্জনের আনন্দ। এতে যেমন আনন্দ-ফুর্তি মেলে, তেমনি পাওয়া যায় ইতিবাচক অনুভূতি। নিজেকে নিয়ে উদ্‌যাপনের ও উপলব্ধির ফুরসত মেলে তাতে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভোগের চেয়ে উপভোগ শত গুণে শ্রেয়। এর অন্যতম কারণ উপভোগ স্থায়ী, ভোগ ক্ষণস্থায়ী। খিদে লাগলে আমরা সবাই খাই। কিছু খাওয়া হয় শুধুই পেট ভরানোর জন্য, শরীরের জ্বালানি তৈরির নিমিত্তে। এই ভোগে মনের কোনো স্থান নেই। খাওয়া শেষ তো পেট ভরানোর আনন্দও শেষ। পেট ভরে গেলে খাওয়ার বিষয়টিরও আর আবেদন থাকে না কারও কাছে। কিন্তু কেউ যদি বন্ধু বা আপনজনদের সঙ্গে একসঙ্গে বসে খায়, তবে তা হয়ে যায় উপভোগ। কারণ ওই স্মৃতি আপনাকে সন্তুষ্টি দিতে পারে ১০০ দিন পরেও, হয়তো কোনো এক অছিলায় মনে পড়ে যাবে সেই দিনের কোনো এক মজার দৃশ্যপট!

সব উপভোগ ভোগ হলেও, সব ভোগে উপভোগ হয় নাসুখ পেতে চাইলে
সুখ পেতে চাইলে তাই শুধু ভোগের প্রতি নির্ভরশীল হওয়াটা ভুল। তবে জীবন উপভোগের পথে নিরন্তর হাঁটাটাও কঠিন। জীবনের অন্যান্য প্রতিবন্ধকতা তাতে বাধা দেয় বারে বারে। বর্তমান পুঁজির দুনিয়ায় নিজের জীবনের প্রতিটি ক্ষণ ফলাও করে প্রচারের বাধ্যবাধকতা আছে। এ কাজগুলো আগে অফলাইনে হতো, এখন অনলাইনে তা প্রবল রূপ নিয়েছে। আর তাতেই বাঁধছে গন্ডগোল। যেমন নিত্যকার জীবন থেকে ছুটি নিয়ে হয়তো ঘুরতে বের হলেন। এরপর ঘোরাঘুরির ছবি তুললেন এবং মার্ক জাকারবার্গকে পাঠিয়েও দিলেন। তাঁর কল্যাণে জেনে গেল গুষ্টির সবাই। তাদের মনে তখন, ‘ইশ্, কী সুন্দর জীবন’ বাক্যে হাহাকার। কিন্তু এই ট্রেন্ডে গা ভাসিয়ে কী সুখ পাওয়া যায়?

সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে
ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার শতাধিক শিক্ষার্থীর ওপর চালানো এই গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, যাঁরা উপভোগের মুহূর্তের ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে পোস্ট করেন নিয়মিত, তাঁরা উদ্‌যাপনের আনন্দ কম পান। যাঁরা ছবি তোলেন, কিন্তু তা অন্যকে দেখানোর বদলে নিজের সংগ্রহে রেখে দেন, তাঁদের তুলনায় দেখনদারির ট্রেন্ডে ভাসা ব্যক্তিরা মুহূর্ত উপভোগ করেন ৮ শতাংশ কম হারে। অর্থাৎ, তাঁদের সুখও যায় কমে।
আবার বিশ্বজুড়ে একটি সাধারণ ধারণা হলো, অবসর মানেই সময়ের অপচয়! ফলে উপভোগের বিষয়টিও প্রায়ই সেই ‘সময়ের অপচয়ের’ বৃত্তে বন্দী হয়ে পড়ে। কারণ যেসব কাজে অর্থের সংযোগ থাকে না, সেসব কাজকে বাতিলের খাতায় ফেলে দেওয়া বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার একটি স্বাভাবিক প্রবণতা। অথচ গবেষণায় দেখা গেছে, যাঁরা অবসরকে উৎপাদনক্ষম ভাবেন, তাঁরা জীবন উপভোগের দৌড়ে এগিয়ে থাকেন ১২ শতাংশ হারে। সেই সঙ্গে জীবনে সফলতার সম্ভাবনাও তাঁদেরই থাকে বেশি।

সিদ্ধান্ত নিন
এবার তবে চলুন সিদ্ধান্ত নেওয়া যাক, জীবন ভোগের হবে নাকি উপভোগের। স্বস্তির পথে হাঁটতে না পারলে কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতায় থাকা অস্বস্তি চলে আসবে মনে। সুনীল ‘পেয়েছো কি?’ শিরোনামে লিখেছিলেন,
…‘সবই তো উচ্ছিষ্ট করে রেখে গেলে
পেয়েছো কি
যা ছিল পাওয়ার?...’
এই দ্বিধার মুখোমুখি হওয়ার চেয়ে বরং ভোগের আগে একটা ‘উপ’ বসিয়েই ফেলুন। ঠকবেন না।

তথ্যসূত্র: দ্য আটলান্টিক, কোচিং লিডারস ডট কো ডট ইউকে, মিডিয়াম ডট কম, ভেরি ওয়েল মাইন্ড ডট কম, লাইভমিন্ট ও হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের ওয়েবসাইট

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের ‘সন্ত্রাসী খেল’ ফাঁস করে দিলেন জঙ্গিগোষ্ঠী জইশের সদস্য

বিদেশে চিকিৎসা নিয়ে আসিফ নজরুলের পুরোনো ফেসবুক পোস্ট নতুন করে ভাইরাল করলেন হাসনাত

বাংলাদেশসহ ৫ প্রতিবেশীকেই নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করছে ভারত

‘সোহরাব-রুস্তম’ সিনেমায় ইলিয়াস কাঞ্চনের নায়িকার জীবনের করুণ অবসান!

৫ ইসলামি ব্যাংকে বসছে প্রশাসক, একীভূতকরণে লাগবে দুই বছর: বাংলাদেশ ব্যাংক

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত