Ajker Patrika

গল্পটি প্রেমের নয়

রজত কান্তি রায়, ঢাকা
গল্পটি প্রেমের নয়

‘রেডিও বাংলাদেশ। এখন সকাল সাতটা। খবর পড়ছি…।’ 

সে অনেক কাল আগের কথা। তখন বাংলাদেশ বেতারের নাম ছিল রেডিও বাংলাদেশ আর আমাদের ছিল ছোটকাল। আমাদের শুক্রবারগুলো শুরু হতো সেই সকাল সাতটায়। তারপর শিশিরভেজা ঘাসে খানিক হাঁটাহাঁটি করে সরিষার তেলে মেখে নাশতা হিসেবে খাওয়া হতো বাড়িতে ভাজা মুড়ি। তারপর পড়তে বসা। প্রতিদিন যে একই নিয়মে আমরা চলতাম, তেমন বলা যায় না। তবে তখন মোটামুটি রেওয়াজটা সে রকমই ছিল।

তারপর কেটে গেছে অনেক কাল। ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছে গেছি রাজধানী ঢাকায়। তত দিনে নাশতা খাওয়ার ধরন গেছে বদলে। পরোটা-ডাল-ডিম ভাজি বা সবজি। কিন্তু তখন ঢাকার বন্ধুদের কাছে শুনেছি এক দারুণ গল্প। গল্পটা ছিল প্রেমের। সে গল্পের নায়িকা ছিলেন নর্তকী খনি বেগম। নায়ক আগা বাকের আর ভিলেন উজিরপুত্র নগর কোতোয়াল জয়নাল খান। প্রেমের সে সম্পর্ক ছিল ত্রিমুখী। ফলে লড়াইটাও ছিল সে রকমই। আগা বাকের ভালোবাসতেন খনি বেগমকে। কোতোয়াল জয়নাল খানের ভালোবাসাও ছিল খনি বেগমকে ঘিরে। ফলে বাদশাহি সে প্রেমের গল্পে যুদ্ধ ছিল অবশ্যম্ভাবী। আগা বাকের ও জয়নালের যুদ্ধে জয়নাল হেরে যান। প্রতিশোধ নিতে জয়নাল প্রেমিকা খনি বেগমকে হত্যা করেন। প্রাচীন চন্দ্রদ্বীপ বা পরের বাকেরগঞ্জ কিংবা বর্তমানের বরিশালের কোথাও সমাধিস্থ করা হয় খনি বেগমকে। শোনা যায়, পরে আগা বাকের সুবেদার মুর্শিদ কুলি খানের জামাই হয়েছিলেন। তিনি থাকতেন ঢাকায়। 
এই আগা বাকের সাহেব নিজের প্রেমের গল্পকে অমরত্ব দিতে ঢাকায় চালু করেন বাকরখনি রুটি। পরে যা মানুষের মুখে মুখে বাকরখানি হয়ে যায়। পুরান ঢাকার বিখ্যাত বাকরখানি নিয়ে এমন অন্তত দুখানা গল্পের সন্ধান পেয়েছি। কিন্তু হাকিম সাহেব অর্থাৎ হাকিম হাবিবুর রহমান নিষ্ঠুরভাবে বলে দিয়েছেন, এগুলো স্রেফ গল্প, কিংবদন্তি। পুরান ঢাকার গলির গলি তস্য গলি ছাড়িয়ে নতুন ঢাকা, এমনকি উত্তরায়ও বাকরখানির দোকান দেখা যায় এখনো। এসব দোকান প্রমাণ করে, বেরসিক হাকিম সাহেব যাই বলুন না কেন, বাকরখানি এক ভালোবাসার নাম।

হাকিম হাবিবুর রহমান নিজেই জানিয়েছেন, ‘আমি চোখ মেলেই এই দেখেছি যে, সমগ্র ঢাকা সকালে নাশতায় বাকরখানি খাচ্ছে।’ এখন এ অবস্থা যে অনেকখানিই বদলে গেছে, সেটা না বললেও চলে। এখন বরং বাকরখানি যুদ্ধ করছে বিরিয়ানি, পরোটা বা তন্দুর রুটি আর নেহারির সঙ্গে।

পুরান ঢাকার বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে এবং নিজেও পরখ করে দেখেছি, চায়ে ডুবিয়ে বাকরখানি খেতে বেশ লাগে। তন্দুর থেকে নামানো গরম আর মুচমুচে বাকরখানি এমনিতেও খাওয়া যায়। খাওয়া যায় রসগোল্লার শিরায় ডুবিয়ে। কিন্তু নাম ভুলে যাওয়া পুরান ঢাকার এক ইরানি পরিবারে মাংসের ঝোলে ডুবিয়ে যে বাকরখানি খেয়েছিলাম, তার স্বাদ এখনো ভুলতে পারিনি। হাকিম সাহেব বলেছেন, তাঁদের সময় কাবাব, কোপ্তা ও পনিরের সঙ্গে খাওয়া হতো বাকরখানি। আর লক্ষ্মৌতে সেটা খাওয়া হতো নাকি চা অথবা কাবাবের সঙ্গে।

কিন্তু বাকরখানির গায়ে যে তিল থাকত, এখনকার মানুষ সেটা কি কেউ দেখেছেন? অথবা তন্দুরের ভেতর সেঁকা হতে থাকা বাকরখানির ওপর অন্তত দুবার দুধ ছিটানোর দৃশ্য? মনে হয় কেউ দেখেননি। বাকরখানির রুটি বেলা হলে তন্দুরে দেওয়ার আগে তার ওপর ছিটানো হতো পরিষ্কার তিল। আর তন্দুরে সেঁকার সময় অন্তত দুবার বাকরখানির গায়ে ছিটানো হতো দুধ। এই ছিল আসল বাকরখানির স্বাদের রহস্য। এখন ওপরে পনির দেওয়া যে বাকরখানির খুব সুনাম, সেটা আগেও হতো।

বাকরখানি নিয়ে কিছু ঘাঁটাঘাঁটি করেও আগা বাকের আর খনি বেগমের হদিস পাওয়া গেল না। কিন্তু জানা গেল, ঢাকার বাকরখানির শিকড় কাশ্মীরে। জানা যায়, ঢাকার নবাব পরিবারের খান বাহাদুর খাজা আ’যম বাকরখানি বানিয়ে আনাতেন কাশ্মীর থেকে। তবে কাশ্মীরি বাকরখানি ঢাকায় এসে বেশ খানিক উন্নতি সাধন করে। এখন যে বাকরখানি আমরা খাই, তা মুঘল যুগের অতি উৎকৃষ্ট বাকরখানির অপভ্রংশ মাত্র, প্রেমের গল্পকে আঁকড়ে ধরে যা এখন বাঁচার চেষ্টা করে চলেছে। 

সূত্র: হাকিম হাবিবুর রহমান, ‘ঢাকা পঞ্চাশ বছর আগে’। 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

৬১৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ: এক্সিম ব্যাংকের নজরুল ইসলাম মজুমদারসহ ৩০ জনের নামে মামলা

‘কথিত আওয়ামী লীগ সদস্যদের’ বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতার বিষয়ে ভারত অবহিত নয়: মুখপাত্র

কলকাতার নিউটাউনে বসে আয়েশ করছেন আওয়ামী লীগ নেতারা

চাকরি না ছেড়েই বিদেশে পাড়ি, ৪৮ শিক্ষক বরখাস্ত

ভিসা ছাড়া পাকিস্তান সফরের চুক্তি হতে পারে শিগগির

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত