Ajker Patrika

অভিজাত ঢাকার খানদানি খাবার

রজত কান্তি রায়, ঢাকা
অভিজাত ঢাকার খানদানি খাবার

তারপর কড়াই থেকে যখন নামল, তখন সাদা সিরামিকের বোলের ওপর রুই মাছের পিস থেকে ধোঁয়া উঠছিল। সঙ্গে মতির মতো সুসেদ্ধ আস্ত দেশি পেঁয়াজ আক্ষরিক অর্থে মুখে দিতেই গলে যাওয়ার অপেক্ষায়। এক ছটাক পরিমাণ ঘি ও সমপরিমাণ সাদা তেলে জারিত জায়ফল-জয়ত্রী আর শুকনো মরিচের গুঁড়ো তখন ঝোলে খয়েরি রঙের মেলা বসিয়েছে। রেসিপিতে যে দই ব্যবহার করা হয়েছে, ছড়িয়ে পড়া গন্ধের পরমাণুতে তার ঘ্রাণ। আর সবটা মিলিয়ে সত্যিই অচেনা এক সুগন্ধে ভরে গেল পুরো খাবারঘর। নাক ভরে ঘ্রাণ নিয়ে আঙুলে খানিক ঝোল তুলে জিবে ছুঁইয়ে দেখলাম। আগে কোনো দিন খাওয়া হয়নি বলে স্বাদ চেনা নয়। সে জন্য কোনো বেঞ্চমার্ক তৈরি করা গেল না। কিন্তু স্বাদটা বেশ ভালোই লাগল।

 বলছি রুই মাছের কুরদাখের কথা। পুরান ঢাকার খাবার মানে মাংসের খাবার—এমন একটা কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। কিন্তু এখানে যে মাছ দিয়েও মহা সুস্বাদু খাবার তৈরি হতো, সে খবর অনেকের কাছেই নেই। রুই মাছের কুরদাখের নাম যখন শুনি, আমিও একটু হোঁচট খেয়েছিলাম।

 যাহোক, আজ থেকে দুদিন আগে ঠা-ঠা দুপুরবেলা পেটে যখন ছুঁচোয় ডন মারছে, তখন কুরদাখ নামে এই রেসিপির কথা শুনছিলাম ৯/১৬ ইকবাল রোডের একটি বাড়িতে বসে। শুনিয়েছেন সৈয়দ আফজাল হোসেন। তাঁর জন্ম ১ সেপ্টেম্বর ১৯৫৪। সেই সূত্রে তাঁর বয়স এখন ৬৭ বছর। খাস ‘ঢাকাইয়া’ বলতে যা বোঝায়, তিনি তাই। অর্থাৎ জন্ম ও বেড়ে ওঠা পুরান ঢাকার বেগমবাজারে। যদিও তাঁর অষ্টম পূর্বপুরুষ মক্কা থেকে ঢাকা এসেছিলেন বলে জানান সৈয়দ আফজাল হোসেন।

  ‘পঞ্চাশ বছর হলো জিবে কোনো স্বাদ পাই না।’ মনে মনে হিসাব করে নিলাম, আমার বয়স তাঁর স্বাদ হারিয়ে যাওয়া জিবের চেয়েও নয় বছর কম। ‘দাদা মারা যাওয়ার পর রান্না নিয়া আর কেউ ভাবলই না। এখন তো আরও ভাবে না কেউ। কিন্তু দ্যাখেন, বাটা মসলা, বাটা বাদাম-পেস্তা দিয়া রান্না করলে তার স্বাদটা কেমন হইবে? বাটা হইতে হইবো। ব্লেন্ডারে ঘুরাইলে চলব না। এই খাবার রান্না করবার কইলে বউ তো বাপের বাড়ি যাইব গা।’ এভাবেই শুরু হয়েছিল আমাদের আড্ডা। খোশগল্পের সে আড্ডাই একসময় আক্ষেপ আর হাহাকারে পরিণত হলো। এই আক্ষেপ আর হাহাকার শুনতে শুনতে আমি আরও একটু উসকে দিই তাঁকে। জানতে চাই, রইস ঢাকার খাবারের কথা। তিনি মুখের আগল খুলতে থাকেন। আর আমার কেবলই মনে হতে থাকে, এই ভরদুপুরে খালি পেটে একজন মানুষের সামনে বসে শুনতে হচ্ছে খাবারের গল্প আর রেসিপির কথা। পৃথিবী কত নিষ্ঠুর হলে আর পূর্বজন্মে কত পাপ করলে এমনটি হতে পারে?

 বাদশা হুমায়ুন যখন বাংলা দখলের জন্য পা বাড়ান, তখন তাঁর চলমান শাহি রসুইয়ে নাকি ৩২ মণ গরুর দুধে বানানো ঘি ছিল। আর ছিল ১০ মণ মহিষের দুধে বানানো ঘি। এ থেকেই বোঝা যায়, মোগলাই খাবারের মূল বৈশিষ্ট্য ঘিয়ের প্রচুর ব্যবহার। ঘি ছাড়া রান্না হবে না। সৈয়দ আফজাল হোসেনও ঘিয়ে রান্না করা খাবারের গল্প শোনালেন। ধরুন, এক কেজি বুটের হালুয়া রান্নার জন্য যদি দেড় কেজি ঘি আর দুই কেজি চিনি ব্যবহারের কথা কোনো সুস্থ মানুষ শোনে, তাহলে বিষয়টি কী দাঁড়াতে পারে, সেটা আমরা আন্দাজ করতে পারি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সৈয়দ আফজাল এখনো মাঝে মাঝে সেই রেসিপিতে বুটের হালুয়া রেঁধে তাঁর বিখ্যাত দাদা সৈয়দ শরফুল হোসাইনী শরাফকে স্মরণ করেন। কারণ, সৈয়দ আফজাল হোসেন তাঁর কাছেই খাওয়াদাওয়ার তালিম পেয়েছিলেন।

আর সিনিয়র সৈয়দ যা খেতেন, তার অনুপুঙ্খ বর্ণনা করা এই লেখায় সম্ভব নয়। শুধু একটি উদাহরণ দিয়ে রাখি।  সৈয়দ শরফুল হোসাইনী শরাফ সকালে নাশতা খেতেন না। তাঁর জন্য আগের দিন সন্ধ্যায় কেটে পরিষ্কার করে ঝুলিয়ে রাখা হতো একটি কচি মুরগি। পরদিন সকালে সেই মুরগি ঘিয়ে ভিজিয়ে কাবাব মসলা দিয়ে উত্তম করে মেখে মানে মেরিনেট করে কাবাব বানানো হতো। সেই কাবাব দিয়ে ঠিক বেলা ১১টায় তিনি খেতেন পোলাও। যদি কোনো কারণে আগের দিন না কেটে মুরগি পরের দিন কেটে কাবাব বানিয়ে দেওয়া হতো, সেটা ধরা পড়ত তাঁর জিবে। এমনই ছিল সেই রইস জিব আর তার আয়েশ মেটানোর খানদানি টেবিল। সেই টেবিলে বসার সুযোগ পেয়েছিলেন সৈয়দ শরফুল হোসাইনী শরাফের ছেলের ছেলে সৈয়দ আফজাল হোসাইন। আমি যাঁর সামনে বসে শুনেছি এসব গল্প এক ভরদুপুরে।

 পুরান ঢাকার এ গল্প ফুরোনোর নয়। কাজেই সময় নষ্ট করে লাভ নেই; বরং রুই মাছের কুরদাখের রেসিপি দিচ্ছি। বাড়িতে চেষ্টা করে দেখতে পারেন। তবে হ্যাঁ, মসলা হতে হবে পাথরের শিলপাটায় বাটা এবং কোনো পানির ব্যবহার করা যাবে না।

রুই মাছের কুরদাখ
এই রেসিপির কথা শুনে মনে হয়েছে রুইটা হতে হবে পাকা। পাকা রুই মাছের পেটির অংশ বাদে শুধু পিঠের অংশ পিস করে নিতে হবে। গোটা পেঁয়াজ মাছের দ্বিগুণ অর্থাৎ মাছ এক কেজি হলে পেঁয়াজ হবে দুই কেজি, জায়ফল, জয়ত্রীর মিহি গুঁড়ো, টকদইয়ের পানি, শুকনো মরিচের গুঁড়ো, এক ছটাক ঘি, এক ছটাক সয়াবিন তেল, লবণ স্বাদমতো।
 প্রণালিতে যাওয়ার আগে বলে রাখি, জায়ফল-জয়ত্রী পাটায় বেটে নিয়ে আবার চেলে নিতে হবে, যাতে তার মিহি অংশই মাছে পড়ে। আর টকদই সুতি কাপড়ে নিয়ে চিপে পানি বের করে দিতে হবে। দইয়ের পানি পাওয়া না গেলেও সবকিছুর গুঁড়ো পাওয়া যায় এখন বাজারে।
 চুলায় পাত্র বসিয়ে সব উপকরণ একসঙ্গে দিয়ে বেশি আঁচে রুই মাছ রান্না করতে হবে একটু সময়। তারপর নামিয়ে নিতে হবে। এবার চুলার ওপর রুটি বানানোর তাওয়া বসিয়ে সেটা গরম করে নিন। গরম হয়ে গেলে মাছের পাত্রটি তার ওপর বসিয়ে মুখ ঢেকে দিন। ভাপে আরও কিছুক্ষণ রান্না করুন। হয়ে গেলে নামিয়ে ফেলুন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত