Ajker Patrika

মসজিদের মাইক ব্যবহারের সীমারেখা

মুফতি আবু আবদুল্লাহ আহমদ
মসজিদের মাইক ব্যবহারের সীমারেখা

প্রশ্ন: মসজিদের মাইক ব্যবহারে ইসলামের নির্দেশনা কী? অতিরিক্ত উঁচু আওয়াজে আজান দেওয়া বা মসজিদ থেকে লাইন টেনে দূর-দূরান্ত পর্যন্ত বাসাবাড়ির ছাদে মাইক লাগানো যাবে কি? মসজিদের মাইকে আজান ছাড়া আর কী কী প্রচার করা যাবে? 
নওয়াজ উদ্দিন, ঢাকা

উত্তর: আজানের মাধ্যমে মূলত মুসলমানদের নামাজের জন্য আহ্বান করা হয়। তাই ইসলামি শরিয়ত উচ্চ স্বরে আজান দেওয়ার প্রতি উৎসাহিত করে। বিভিন্ন হাদিস থেকে তা প্রমাণিত হয়। যেমন তিরমিজি ছাড়া সিহাহ সিত্তার সব কিতাবে বর্ণিত আছে, রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘মুয়াজ্জিনের আওয়াজের দূরত্ব পরিমাণ তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে এবং প্রতিটি শুকনো ও ভেজা বস্তু (অর্থাৎ, জীবন্ত ও মৃত বস্তু) তার (ইমানের) পক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করবে।’ অন্য হাদিসে এসেছে, ‘তুমি উঁচু আওয়াজে আজান দেবে। কেননা, মুসলিমের আজানের ধ্বনি যত দূর পৌঁছাবে, তত দূর পর্যন্ত জিন, মানুষ ও অন্যান্য—যারাই তা শুনবে, প্রত্যেকে তার পক্ষে সাক্ষ্য দেবে।’ (বুখারি ও নাসায়ি) 
এসব হাদিসের আলোকে ফকিহগণ লাউড স্পিকার সিস্টেম আবিষ্কার হওয়ার পর আজানের জন্য তা ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছেন।

তবে একটা সময় পর্যন্ত, যখন মসজিদের সংখ্যা কম ছিল, তখন দূর-দূরান্তে আজানের ধ্বনি পৌঁছে দেওয়ার জন্য বেশি বেশি মাইক লাগিয়ে উঁচু স্বরে আজান দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। বর্তমানে যেহেতু আলহামদুলিল্লাহ মসজিদের সংখ্যা বেড়ে গেছে এবং প্রতিটি মসজিদে আজান দেওয়া হয়, তাই দূর-দূরান্তে মাইক লাগানো এবং অতিরিক্ত উঁচু স্বরে আজান দেওয়া অপ্রয়োজনীয়, বরং অনুচিত। কারণ ফকিহদের মতে, উচ্চ স্বরে আজান দেওয়া মুসতাহাব হওয়ার কারণ হলো কর্মব্যস্ত মানুষকে নামাজের সময় সম্পর্কে অবহিত করা। (ফাতহুল কাদির)

অল্প কয়েকটি মাইক ব্যবহার করে, পরিমিত ভলিয়মে, মসজিদের আশপাশের যাঁরা সেই মসজিদে নামাজ আদায় করবেন, তাঁদের কানে আজানের ধ্বনি পৌঁছে দিলেই যথেষ্ট হয়ে যায়। এভাবে যে যার মসজিদের আজান শুনে মসজিদে যেতে পারবেন। সুতরাং, প্রশ্নের বর্ণনামতে, মসজিদ থেকে লাইন টেনে দূর-দূরান্তে বাসাবাড়ির ছাদে মাইক লাগানো এবং অতি উচ্চ ভলিউমে আজান দেওয়া শরয়ি দৃষ্টিকোণ থেকে অপ্রয়োজনীয় ও অনুচিত কাজ। এটা কোরআনে নিষিদ্ধ ইতিদার (বাড়াবাড়ি ও সীমালঙ্ঘন) আওতায় পড়ে। কোরআনে সীমালঙ্ঘনকে নিষেধ করে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা সীমালঙ্ঘন কোরো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদের ভালোবাসেন না।’ 
(সুরা মায়িদা: ৮৭)

মুফাসসিরগণ বলেন, অবৈধভাবে কিংবা বৈধ সীমা অতিক্রম করে কারও ক্ষতি করা কোরআনে নিষেধকৃত সীমালঙ্ঘনের অন্তর্ভুক্ত। (শাবাকাতুল আলুকাহ) এ জন্য আলিমগণ মুয়াজ্জিন অথবা অন্য কারও ক্ষতি হয় এমন উচ্চ স্বরে আজান দিতে নিষেধ করেছেন। শাইখ সালেহ আল মুনাজ্জিদ তাঁর একটি ফতোয়ায় বলেন, ‘উঁচু স্বরে আজান দেওয়ার উদ্দেশ্য এটা নয় যে, এর মাধ্যমে কান ফাটিয়ে দেবে অথবা আজানদাতা বা শ্রোতাদের ক্ষতি করে বসবে। বরং কারও ক্ষতি হয় এমন ভলিয়মে আজান দিতে মুয়াজ্জিনকে নিষেধ করা বাঞ্ছনীয়। (ইসলামকিউএডটকম) শায়েখ সালেহ আল উসাইমিন বলেন, যাদের জন্য আজান দেওয়া হচ্ছে, তাদের শোনা অনুপাতে আজান দেওয়া উচিত। অন্যদের শোনানোর প্রয়োজন নেই। (আশ শারহুল মুমাত্তি আলা জাদিল মুসতানকি)

তবে দুঃখজনকভাবে আমাদের দেশে দেখা যায়, মসজিদের পাশের বাড়ি, সংলগ্ন ফ্ল্যাট, লাগোয়া জানালা—কোনো কিছু চিন্তা না করে ফুল ভলিউমে আজান দেওয়া হয়। এখানে হার্টের রোগী, মুমূর্ষু বর্ষীয়ান নারী-পুরুষ, নবজাত ও অল্প বয়সী শিশু থাকে। সংলগ্ন হাসপাতাল, শিক্ষালয়, গবেষণাগার, সংবেদনশীল ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠীর অবস্থান থাকে। তাদের ভয় পাওয়া, চমকে ওঠা, ব্লাডপ্রেশার, হাইপারটেনশন বৃদ্ধি ইত্যাদি নিয়ে ভাবা হয় না।

আর মসজিদের বাইরের মাইকে আজান ছাড়া জুমার বয়ান, তারাবির তিলাওয়াত, নামাজ ইত্যাদি প্রচার করা জায়েজ নয়। কোরআনে বেশি উঁচু স্বরে নামাজ আদায় করতে নিষেধ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তুমি নামাজে স্বর বেশি উঁচু কোরো না এবং ক্ষীণও কোরো না, বরং দুইয়ের মধ্যপথ অবলম্বন করো।’ (সুরা বনি ইসরাইল: ১১০) তদুপরি এতে বাড়িতে নামাজ আদায়কারী নারীদের নামাজ ও তাসবিহ-তাহলিলে ব্যাঘাত ঘটে। এ সম্পর্কে ইবনে রজব (রহ.) বলেন, ‘যেসব ইবাদত উঁচু স্বরে করার প্রয়োজন নেই, সেগুলো উঁচু স্বরে করতে গিয়ে যদি কারও ইবাদত বিঘ্নিত হয়, তা নিষিদ্ধ। একদিন রাতে রাসুল (সা.) মসজিদে নামাজরত সাহাবিদের উঁচু স্বরে কোরআন তিলাওয়াত করতে দেখে বললেন, ‘তোমরা প্রত্যেকেই আল্লাহর সঙ্গে একান্ত আলাপে লিপ্ত, সুতরাং একে অন্যকে কষ্ট দিয়ো না।’ (ফাতহুল বারি) 

উত্তর দিয়েছেন, মুফতি আবু আবদুল্লাহ আহমদ, শিক্ষক ও ফতোয়া গবেষক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত