
বাংলাদেশের সামনে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। ২০২৪ সালে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর গণতান্ত্রিক রূপান্তরের পথে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে দেশ। দেশের মানুষ একদিকে যেমন বড় রকমের পরিবর্তনের মুখোমুখি, অন্যদিকে রাজনৈতিক রূপান্তর নিয়ে রয়েছে তীব্র উৎকণ্ঠা। সামনের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনাগুলো নিয়ে যুক্তরাজ্যের থিংকট্যাংক চ্যাথাম হাউসের পরিচালক ব্রনওয়েন ম্যাডক্সের সঙ্গে কথা বলেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সাক্ষাৎকারটির হুবহু বাংলা অনুবাদ আজকের পত্রিকার পাঠকদের সামনে তুলে ধরা হলো—
হুসাইন আহমদ

ব্রনওয়েন ম্যাডক্স: আপনাদের সবাইকে চ্যাথাম হাউসে স্বাগত জানাচ্ছি। বিশেষভাবে স্বাগত জানাই বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে।
আমি ব্রনওয়েন ম্যাডক্স, চ্যাথাম হাউসের পরিচালক। দর্শকদের ভিড় এবং আগ্রহ দেখে বোঝা যায়, ইউনূস সাহেবকে আলাদাভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার খুব একটা প্রয়োজন নেই।
আপনারা জানেন, অধ্যাপক ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা। এই উদ্যোগের জন্য তিনি এবং তাঁর প্রতিষ্ঠান ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান। এরপর তিনি ৫০টির বেশি সামাজিক ব্যবসা উদ্যোগ গড়ে তুলেছেন।
২০২৪ সালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট ও দীর্ঘদিনের শাসনামলের অবসানের পর আন্দোলনকারীরা তাঁকে অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব দেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি সেই দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং এখন বাংলাদেশের নতুন যাত্রার নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
আজকের আলোচনায় থাকছে নির্বাচন, গণমাধ্যম, অর্থনীতি, জলবায়ু পরিবর্তন, যুব উন্নয়ন, রোহিঙ্গা সংকট ও আন্তর্জাতিক কূটনীতি—সবকিছু।
এই অনুষ্ঠান চ্যাথাম হাউস রুল বা চ্যাথাম হাউসের নীতিসংশ্লিষ্ট নয়। এটি সরাসরি সম্প্রচারিত হচ্ছে এবং সম্পূর্ণ অন দ্য রেকর্ড।
অধ্যাপক ইউনূস: আমাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য অনেক ধন্যবাদ।
আমি বহুবার লন্ডনে এসেছি—বিভিন্ন ভূমিকায়। প্রথম এসেছিলাম ১৯৫৫ সালে, কানাডায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব স্কাউট জাম্বুরি শেষে। সেবার বিবিসির একটি বাংলা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে দুই গিনি সম্মানী পেয়েছিলাম, এখনো মনে আছে!
এরপর বহুবার এসেছি মাইক্রোক্রেডিট, সামাজিক ব্যবসা, তরুণদের নেতৃত্ব এবং আমার তিনটি শূন্যের দর্শন প্রচারে—শূন্য কার্বন নির্গমন, শূন্য সম্পদের কেন্দ্রীকরণ, শূন্য বেকারত্ব।
আমার বিশ্বাস, বর্তমান সভ্যতা ভুল পথে হাঁটছে—এটি আত্মবিনাশী। আমাদের টিকে থাকতে হলে নতুন এক সভ্যতা গড়ে তুলতে হবে এই তিন শূন্যের ভিত্তিতে।
এটি নিছক তাত্ত্বিক নয়, আমার জীবনের অভিজ্ঞতা ও বাস্তব কাজের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে।
তবে এবার এসেছি এক ভিন্ন ভূমিকায়—সরকারপ্রধান হিসেবে। এটি আমার জীবনে এক অনাকাঙ্ক্ষিত অধ্যায়, যা আমি কখনো ভাবিনি। কিন্তু এখন সেই দায়িত্বেই আছি। তাই আজকের আলোচনা সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই হবে।
ব্রনওয়েন ম্যাডক্স: ধন্যবাদ। আমরা জানি, আপনি ব্রিটেনের রাজা চার্লসের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছেন পরিবেশ ও সামাজিক উদ্যোগ নিয়ে। আবার বর্তমান দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবেও সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আপনার বৈঠক হয়েছে।
চলুন, আমরা মূল আলোচনায় যাই, শুরুতেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্বাচন। আপনি সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছেন, আগামী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২০২৫ সালের এপ্রিলে। কিন্তু সেনাবাহিনী ও কিছু রাজনৈতিক মহল চায়, নির্বাচন হোক চলতি বছরের মধ্যেই। অন্যদিকে আপনার সরকার আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ দিচ্ছে না, যা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচনা শুরু হয়েছে। আপনার জবাব কী?
অধ্যাপক ইউনূস: আমি বারবার বলেছি, এটি হবে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সুন্দর নির্বাচন। সময় উপযোগী নির্বাচন। দীর্ঘ ১৭ বছর পর আমরা একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক নির্বাচন করতে যাচ্ছি। এটি শুধু রাজনৈতিক ঘটনা নয়, এটি এক ঐতিহাসিক সুযোগ।
ধরুন, এক তরুণ ১৭ বছর আগে ভোটার হতে পেরেছে, কিন্তু কখনো ভোট দিতে পারেনি। এমন হাজারো তরুণ এখন প্রথমবারের মতো ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবে। তারা বলছে, ‘এবার আমার সিদ্ধান্তই মুখ্য। আমার ভোটেই গঠিত হবে বাংলাদেশ।’
এই তারুণ্যের শক্তি কাজে লাগাতে চাই আমরা। নির্বাচন শুধু সরকার গঠনের জন্য নয়, এটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার রেফারেন্ডাম। তরুণদের রক্ত আর আত্মত্যাগে আমরা ঋণী। আমরা সেই আত্মত্যাগকে সম্মান জানাতে চাই।
এই নতুন বাংলাদেশের ভিত্তি স্থাপিত হচ্ছে তিনটি মূল স্তম্ভে—
১. সংস্থার সংস্কার: যেসব প্রতিষ্ঠান সংকট তৈরি করেছে, সেগুলোর কাঠামোগত রূপান্তর দরকার। আমরা এর জন্য আলাদা আলাদা কমিশন গঠন করেছি—সংবিধান, সংসদ, নির্বাচন ব্যবস্থা, সিভিল সার্ভিসসহ প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সংস্কারের জন্য। কমিশনগুলোর সুপারিশ হাতে এসেছে। এগুলো শুধু সামান্য সংস্কার নয়, গভীর পরিবর্তনের প্রস্তাব রয়েছে।
২. আলোচনা ও ঐকমত্য: সংস্কারের আগে দরকার সর্বদলীয় ঐকমত্য। এ জন্যই আমরা গঠন করেছি ‘ঐকমত্য কমিশন’। এই কমিশনের কাজ হলো বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে বাস্তবসম্মত ও গ্রহণযোগ্য সংস্কার প্রস্তাব চূড়ান্ত করা। হয়তো বিশ্বের কোথাও এ ধরনের উদ্যোগ খুব একটা দেখা যায় না। তবে বাংলাদেশের মতো জটিল রাজনৈতিক বাস্তবতায় এটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
৩. নতুন ভবিষ্যৎ নির্মাণ: আমরা চাই একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই গণতন্ত্র। অবশ্যই এটি সহজ নয়—বাংলাদেশের রাজনীতিকদের মধ্যে ঐকমত্য গড়ে তোলা কঠিন কাজ। কিন্তু আমরা যদি সত্যিই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই, তাহলে এটাই পথ।
ব্রনউইন ম্যাডক্স: আমি বলতে চাই, এটি অনেক রাজনীতিকের জন্যই কঠিন বিষয়, এটি আমি কোনো রকম ঠাট্টা করে বলছি না। কেউ কেউ বলতেই পারেন, ‘আপনার এই প্রক্রিয়া তো গণতন্ত্রের মৌলিক উপাদানকেই বাদ দিচ্ছে। ভোটারদের বিশ্বাস করুন। জনগণকে স্বাধীনভাবে সব দল ও মতবাদের মধ্যে থেকে বেছে নেওয়ার সুযোগ দিন। তাদের বিচার–বুদ্ধির ওপর আস্থা রাখুন। তাঁরা নিজেরাই ঠিক পথটি খুঁজে নেবেন।
অধ্যাপক ইউনূস: আমি নিজেও চাই, সবকিছু যদি শুধু ভোটারদের সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দেওয়া যেত! কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ যদি রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক কাঠামোর জটিল বিষয়গুলো—দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ কিংবা অনুপাতভিত্তিক ভোটব্যবস্থার মতো ধারণা পুরোপুরি বুঝত! উল্টো তারা বলবে, ‘আমরা এসব বুঝি না! আমি তোমাকে ভোট দেব, কয় টাকা দেবে?’—সহজ ভাষায় বললে বিষয়টি তা-ই—‘তুমি টাকা দাও, আমি ভোট দেব।’ দেশে ভোটের চর্চা সেটাই।
আমরা বলেছি, আমরা সেই চর্চায় ফিরতে চাই না। তাই আমরা ভিন্ন পথে হেঁটেছি। আমরা সবকিছু জনসমক্ষে করছি। এই সব বিতর্ক, সুপারিশ, সংলাপ প্রতিদিন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। মানুষ নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছে—কী আলোচনা হচ্ছে, কী ঝুঁকি আছে, কী সম্ভাবনা আছে।
আমাদের লক্ষ্য একদম স্পষ্ট—যেসব সংস্কার প্রস্তাবে সব রাজনৈতিক দলের সম্মতি রয়েছে, সেগুলো একত্র করে একটি ঐক্যমতের দলিল তৈরি করা। আমরা এটির নাম দিয়েছি ‘জুলাই সনদ’।
এই সনদ আগামী মাসে জাতির সামনে উপস্থাপন করব। এটি যখন চূড়ান্ত হবে এবং সব রাজনৈতিক দল স্বাক্ষর করবে, তখন আমরা এটিকে উদ্যাপন করব একটি জাতীয় ঐকমত্য হিসেবে। এর ভিত্তিতেই পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
তাই নির্বাচন আসলে আমাদের বৃহত্তর কর্মসূচির একটি অংশ। সেই বৃহৎ কর্মসূচির প্রথম স্তম্ভ হলো সংস্কার। আমাদের সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে পুরোনো প্রতিষ্ঠানগুলোই। তাই প্রতিটি প্রতিষ্ঠান নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে।
আমরা প্রধান প্রধান প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য পৃথক কমিশন গঠন করেছি। তারা যে সুপারিশগুলো করেছে, তা অনেক ক্ষেত্রে কঠিন, কিছুটা নাটকীয়ও। নির্বাচন কমিশন, সংসদ, সংবিধান, প্রশাসন—সবকিছু নিয়ে আমরা গভীরভাবে কাজ করছি।
পরবর্তী ধাপ হলো ঐকমত্যের ভিত্তি তৈরি। আমরা সব দলকে নিয়ে ঐকমত্য গঠনে কমিশন তৈরি করেছি। এ রকম কিছুর নাম হয়তো আপনি এর আগে শোনেননি। এই কমিশনের কাজ হলো সব দলের অংশগ্রহণে প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনা করে সেই সংস্কারগুলো খুঁজে বের করা, যেগুলো নিয়ে সমঝোতা সম্ভব।
হ্যাঁ, এটা সহজ নয়; বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরে ঐক্য তৈরি করা কঠিন কাজ। কিন্তু আমরা যদি সত্যিকার অর্থেই একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, স্থিতিশীল গণতন্ত্র গড়তে চাই, তাহলে এটাই প্রয়োজন।
ব্রনউইন ম্যাডক্স: আমি বিচারপ্রক্রিয়ার বিষয়ে পরে আসছি, তবে ‘জুলাই সনদ’ নিয়ে একটু কথা আছে। সমালোচকদের মতে, এই সনদ নিয়ে ঐকমত্য বাধ্যতামূলক করে আপনি কার্যত কিছু রাজনৈতিক দলকে—যেমন আওয়ামী লীগকে গোটা প্রক্রিয়া থেকেই বাদ দিয়ে দিচ্ছেন। তারা বলছে, আপনি জনগণের সামনে প্রকৃত কোনো বিকল্প তুলে ধরছেন না। তাদের চোখে, এই পুরো প্রক্রিয়া ‘ঐকমত্যের’ ভাষায় মোড়ানো একধরনের কর্তৃত্ববাদ।
অধ্যাপক ইউনূস: প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ। তবে আওয়ামী লীগকে এখন আর রাজনৈতিক দল হিসেবে গণ্য করা যায় কি না, সেই বিতর্ক তৈরি হয়েছে। যদি কোনো দল রাস্তায় তরুণদের গুলি করে মারে, মানুষকে গুম করে, রাষ্ট্রীয় অর্থ চুরি করে, তাহলে সেটিকে কি রাজনৈতিক দল বলা যায়? আমি কোনো ব্যক্তিগত রায় দিচ্ছি না, এটি একটি জাতীয় বিতর্ক।
গত ৫ আগস্ট যখন সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান, তখনই এই প্রশ্ন তীব্র হয়ে ওঠে। সেদিন পুরো বাংলাদেশে মানুষ রাস্তায় নেমে উৎসব করেছিল—তাদের মনে হয়েছিল, তারা মুক্ত। আমরা ভেবেছিলাম, ওই দিনই একটি অধ্যায়ের শেষ। সেই সাথে একটি অন্ধকার যুগও শেষ।
কিন্তু যারা পালিয়ে গেছে, তারা থামেনি। বিদেশ থেকে তারা সহিংসতা উসকে দিচ্ছে, বিশৃঙ্খলা ছড়াচ্ছে। এ প্রক্রিয়া এখনো চলছে। এই পুরো সময়জুড়ে দলটির কোনো সদস্য একটিবারও অনুশোচনা প্রকাশ করেনি; কেউ বলেনি, ‘আমার কষ্ট লাগছে কিংবা আমরা ভুল করেছি।’ তাই আমাদের জন্য অধ্যায়টি শেষ হলেও তাদের জন্য শেষ হয়নি।
এখনো তারা মাঠে-ময়দানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে, সেই তরুণদের ওপর হামলা করছে, যারা এই গণ-আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে। এ কারণেই জননিরাপত্তার স্বার্থে রাষ্ট্র আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে।
আমি স্পষ্ট করে বলছি, আমরা দলটিকে নিষিদ্ধ করিনি। কোনো স্থায়ী সিদ্ধান্ত নিইনি। আমরা শুধু বিচারপ্রক্রিয়ার ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করছি।
ব্রনউইন ম্যাডক্স: বিচারপ্রক্রিয়া মানে এই দলের নেতা-কর্মীদের বিচার?
অধ্যাপক ইউনূস: যেসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, তাদের সবার।
ব্রনউইন ম্যাডক্স: শেখ হাসিনা বর্তমানে ভারতের আশ্রয়ে একটি নিরাপদ স্থানে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। প্রশ্ন হলো—এই বিচারপর্ব কি নির্বাচিত সরকার আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারত না? অন্তর্বর্তী সরকার কেন এখনই এটি সম্পন্ন করতে চাইছে?
অধ্যাপক ইউনূস: এই সিদ্ধান্ত আমি একা নিইনি। যখন আমরা দায়িত্ব নিই, তখন গণ-আন্দোলনের নেতারা আমাদের তিনটি কাজের দায়িত্ব দেয়, আমরা সেটি গ্রহণ করি। এটা সেই দায়িত্বেরই একটি অংশ। আমরা শুধু আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করছি; আর কিছু না।
ব্রনউইন ম্যাডক্স: এই সময়কাল নিয়ে আরেকটি প্রশ্ন। আমি সংবাদমাধ্যমে দেখেছি, এই সময়ে বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হ্রাস পেয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আপনার জবাব কী?
অধ্যাপক ইউনূস: এই অভিযোগ মিথ্যা। সংবাদমাধ্যম আগে কখনো এত স্বাধীন ছিল না। তারা প্রতিদিন স্বাধীনভাবে সব কথা বলছে, তাদের কেউ থামাচ্ছে না।
ব্রনউইন ম্যাডক্স: এখন আমি আসতে চাই আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে—অর্থনীতি। যেকোনো সরকারের জন্যই অর্থনীতি পরিচালনা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। জটিল বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আপনি এই দায়িত্ব নিয়েছেন। তার মধ্যে এসেছে শুল্কযুদ্ধ, এই পরিবর্তন বাংলাদেশের ওপর কী প্রভাব ফেলেছে?
অধ্যাপক ইউনূস: আমাদের জন্য এটি সত্যিই কঠিন এক সময়। যখন বিশ্ব বাণিজ্য, শুল্ক ও সরবরাহব্যবস্থার সংকটে জর্জরিত, তখন আমরা একেবারে অন্য রকম সংকটে পড়েছি।
আমরা বলতে গেলে শূন্য থেকে নয়, ঋণাত্মক জায়গা থেকে শুরু করেছি। শূন্য হলে অন্তত কিছু থাকে; কিন্তু আমরা এমন একটি অবস্থায় ছিলাম, যেখানে কিছুই ছিল না।
এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে পূর্ববর্তী সরকারের তথাকথিত ‘মেগা প্রকল্প’ থেকে। প্রকল্পগুলোর বেশির ভাগই জনগণের উপকারের জন্য নয়, ব্যক্তিগত লাভের উদ্দেশ্যে তৈরি। এখন এসব প্রকল্পের অর্থায়ন চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে—দেনা পরিশোধের সময় হয়েছে। কিন্তু সরকারি কোষাগারে অর্থ নেই।
আমরা একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছি, যেখানে বলা হয়েছে, প্রায় ২৩৪ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে, যা ব্যাংক ও ব্যাংকের বাইরের বিভিন্ন উৎস থেকে আত্মসাৎ করা হয়েছে। এই অর্থ পাচারের ফলে ব্যাংকিং ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। রাজনৈতিক চাপ ও ভয়ভীতির মাধ্যমে ব্যাংকের পরিচালকেরা পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন, আর তাঁদের জায়গায় বসানো হয়েছে অনুগতদের। অনেকে কোনো জামানত ছাড়াই ঋণ পেয়েছেন এমন এক বোঝাপড়ায় যে এই ঋণ ফেরত দিতে হবে না।
এখন সেই ঋণদাতারা, ঠিকাদারেরা দাবি তুলেছে, তাদের অর্থ ফেরত দিতে হবে। না দিলে তারা আন্তর্জাতিক আদালতে যাবে, এটি সত্যিই এক ভয়াবহ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি।
তবুও এই সংকটের মধ্যেও একটি আশার আলো আছে—প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। বিশ্বজুড়ে, বিশেষ করে যুক্তরাজ্য, মধ্যপ্রাচ্য এবং আরও অনেক দেশে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশিরা টাকা পাঠিয়ে যাচ্ছেন। এই রেমিট্যান্স আমাদের দেশের অর্থনীতিকে এখনো টিকিয়ে রেখেছে। তাঁদের কারণেই আমাদের ব্যালান্স অব পেমেন্ট কিছুটা স্থিতিশীল হয়েছে।
ব্রনউইন ম্যাডক্স: আপনি ঠিকই বললেন, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স আমাদের জন্য জীবনরেখা হয়ে উঠেছে। কিন্তু আরেকটি বড় আন্তর্জাতিক অংশীদার আইএমএফ, এই মুহূর্তে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত। তারা স্পষ্টভাবে বলেছে, এই অন্তর্বর্তী সরকারকেই অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু করতে হবে।
বিশেষ করে তারা কর ব্যবস্থার সংস্কার চায়; কর-ভিত্তি প্রসার, রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি ও কর-ফাঁকি রোধ। আপনার কি মনে হয়, এই অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে এসব করা সম্ভব?
অধ্যাপক ইউনূস: প্রথমেই আমি যে বিষয়টি বলব, তা হলো বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সরকার আমাদের যে সমর্থন দিয়েছে, তা অভাবনীয়। অনেক দেশ থেকেই বলা হয়েছে, ‘আপনারা যা প্রয়োজন, জানিয়ে দিন, আমরা সাহায্য করতে প্রস্তুত।’
এটি আমাদের জন্য এক বিশাল নৈতিক অনুপ্রেরণা। এটি আমাদের আশ্বস্ত করেছে যে আমরা একা নই। যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, চীন—প্রতিটি বড় দেশের পক্ষ থেকেই আমাদের প্রতি সহানুভূতি জানানো হয়েছে। এই সংহতি আমাদের মনোবল বাড়িয়েছে।
আপনি আইএমএফের কথা বললেন—হ্যাঁ, তারা আমাদের পাশে রয়েছে, ঠিক যেমন বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও রয়েছে।
ব্রনওয়েন ম্যাডক্স: সবাই মনে হয় এমন প্রশংসামূলক শব্দ ব্যবহার করছে না, তাই আমি একটু...
অধ্যাপক ইউনূস: না, আমি বাস্তব অভিজ্ঞতার কথাই বলছি। আইএমএফ তখন যুক্ত হয়, যখন তারা অর্থ ছাড়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল। তারা জোর দিয়ে বলল, আমাদের অবশ্যই মুদ্রার বিনিময় হার বাজারে ছেড়ে দিতে হবে। আমরা এতে শঙ্কিত ছিলাম; কারণ, এত দিন ধরে সরকার-নিয়ন্ত্রিত বিনিময় হার বজায় রেখেছিলাম, যাতে বৈদেশিক মুদ্রা দ্রুত বেরিয়ে না যায়। এটিকে বাজারে ছেড়ে দেওয়া একটি বড় সিদ্ধান্ত ছিল।
আমরা অনেক আলোচনা করেছি। কিন্তু আইএমএফ বলল, ‘আমরা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেছি, আপনি এই ঝুঁকি নিতে পারেন।’ তখন আমরা একটি শর্তে সম্মত হই, যদি পরিস্থিতি খারাপ হয়, আমরা আবার আগের ব্যবস্থায় ফিরতে পারব। আইএমএফ এতে সম্মত হয় এবং আমরা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করি।
এরপর দেখা গেল পরিস্থিতি খুব বেশি খারাপ হয়নি। বিনিময় হার কিছুটা ওঠানামা করেছে, তবে সেটি স্বাভাবিক পর্যায়েই থেকেছে। এখন আমরা এটিকে একধরনের সাফল্য হিসেবে দেখছি। এটি প্রমাণ করে, আমাদের অর্থনীতি একেবারে ধ্বংসপ্রাপ্ত নয়।
তাই আমি বলব, আইএমএফ আমাদের বিপদে ফেলতে নয়, বরং সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়েছে। তারা বলেছে, ‘আপনারা পারবেন’,— আমরাও তা প্রমাণ করেছি। এ জন্য আমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।
ব্রনওয়েন ম্যাডক্স: আচ্ছা, এখন আমি জানতে চাই ভারত ও চীনের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে। শেখ হাসিনার আমলে ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, দিল্লির সঙ্গে আপনার সরকারের সম্পর্ক কিছুটা শীতল। আর চীনের সঙ্গে সম্পর্ক যেন একটু উষ্ণতর। আপনার মূল্যায়ন কী?
অধ্যাপক ইউনূস: আমরা সবার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাই। আমি আগেই বলেছি, পৃথিবীর সব দেশই আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, আমরা এ জন্য কৃতজ্ঞ। আমরা যেটা করছি, তা হলো—যেসব সহযোগিতা অতীতে পাওয়া যায়নি, এখন আমরা তা চাচ্ছি।
সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি আমরা মোকাবিলা করছি, তা হলো দুর্নীতি। বাংলাদেশ একটি দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। প্রশাসনের অনেক স্তর এতে জড়িত। এখন প্রশ্ন হলো, আমরা কীভাবে এই ব্যবস্থা পরিষ্কার করব? কী ধরনের সংস্কার আনতে হবে, যাতে সরকার দুর্নীতিমুক্ত হয়?
গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বৈঠকে এ বিষয়ে আমি বিশ্বের বিভিন্ন নেতার সঙ্গে আলোচনা করেছি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লেনের সঙ্গেও আমার কথা হয়েছিল। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আমাদের মতো দেশে এই দুর্নীতির দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী হতে পারে?’ তিনি হেসে বললেন, ‘আপনারা বিশ্বাস করবেন না, ইউরোপে এমন অনেক দেশ ছিল, যেখানে দুর্নীতি এর চেয়েও খারাপ ছিল।’
তাঁরা ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের লক্ষ্যে নিজেদের পরিষ্কার করতে বাধ্য হয়েছিল। এ জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল—সিস্টেম গড়ে তোলা হয়েছিল। আমরা সেখান থেকেই শিক্ষা নিচ্ছি—দুর্নীতি দমন করতে কীভাবে একটি কার্যকর ব্যবস্থাপনা কাঠামো গড়ে তোলা যায়।
ব্রনওয়েন ম্যাডক্স: তবে ইউরোপের দেশগুলোর ক্ষেত্রে চাপটা এসেছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের ইচ্ছা থেকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এমন কোনো চাপ আছে কি—রাজনীতি বা সমাজের পক্ষ থেকে?
অধ্যাপক ইউনূস: এই মুহূর্ত আমাদের জন্য ঐতিহাসিক। আমরা যদি এখন এটি না করতে পারি, তাহলে আর কোনো দিন পারব না। আমরা বিশ্বাস করি, এই মুহূর্ত আমাদের সামনে ইতিহাসের একটি জানালা খুলে দিয়েছে। অন্য কোনো সরকার এমন সুযোগ পায়নি; কারণ, তাদের ভোটের রাজনীতি আছে, পছন্দ-অপছন্দ আছে। আমাদের তেমন কিছু নেই। আমরা কারও ভোটে নির্বাচিত হইনি, কাউকে তুষ্ট করার দরকার নেই। এই নিরপেক্ষতা থেকেই আমাদের নৈতিক শক্তি আসে।

ব্রনওয়েন ম্যাডক্স: এই অল্প সময় ৯ বা ১০ মাসে আপনারা কীভাবে এটি করবেন? আমি জানি, দুর্নীতি আছে নাইজেরিয়ায়, দুর্নীতি প্রায় সব দেশেই সমস্যা। আপনি কী করছেন—একটু বলুন।
অধ্যাপক ইউনূস: আমি একটি উদাহরণ দিচ্ছি। ধরুন, কেউ পাসপোর্ট বানাতে গেল। তখন কেউ একজন বলে, ‘সরকারি প্রক্রিয়ায় গেলে কয়েক বছর লেগে যাবে—হয়তো পাবেনই না। আমাকে কিছু টাকা দিন, বাসায় পৌঁছে দেব।’ এই লোক আসলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার ‘মানুষ’।
মানে অফিশিয়াল ব্যবস্থা আসলে নিয়ন্ত্রিত হয় দালালদের মাধ্যমে। কর্মকর্তারা এই টাকার ভাগ পান। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এখন থেকে পাসপোর্ট অনলাইনে দেওয়া হবে। মানুষ খুশি—ভাবল, এবার বুঝি সত্যি সেবা মিলবে। কিন্তু দেখা গেল, অনলাইন ফর্ম খোলে না, সার্ভার ডাউন, কেউ ইচ্ছা করে জটিলতা তৈরি করে রেখেছে। ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত...
ব্রনওয়েন ম্যাডক্স: হ্যাঁ... অনেক দেশ প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে দালালনির্ভরতা কমাতে সফল হয়েছে...
অধ্যাপক ইউনূস: আমরাও সে পথেই এগোচ্ছি। আমরা ‘সরকারি’ শব্দটি ব্যবহার না করে ‘বাংলাদেশ সেবা কেন্দ্র’ নামে নতুন একটি উদ্যোগ চালু করেছি। এখানে প্রশিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা বসে থাকেন, কম্পিউটারে নানা ধরনের সরকারি সেবা দিয়ে থাকেন। গত কয়েক মাসে আমরা সব মন্ত্রণালয়কে প্রস্তুত করেছি, যাতে কর পরিশোধ, ড্রাইভিং লাইসেন্স, পাসপোর্ট নবায়ন, এমনকি জটিল ভূমি করের মতো বিষয়গুলো অনলাইনে করা যায়।
এই সেবাকেন্দ্রগুলো আমরা গত মাসে শুরু করেছি। কেউ কেন্দ্রে এলে স্পষ্টভাবে নির্ধারিত মূল্যের তালিকা দেখতে পাবেন। যত দ্রুত সেবা চান, তার ভিত্তিতে হয়তো আপনার বাসায় ডেলিভারি হবে, অথবা মেসেজ পেয়ে আপনি এসে নিয়ে যাবেন। এই মুহূর্তে আমাদের তিনটি কেন্দ্র চালু রয়েছে এবং আগামী এক মাসে অনেকগুলো চালু করার পরিকল্পনা আছে।
আমরা প্রতিটি মন্ত্রণালয়কে চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি—তোমরা কতগুলো সেবা অনলাইনে দিতে পারবে? কেউ বলছে ৫টি, কেউ ১০টি, কেউ আরও বেশি। আমরা বলি, যতগুলো পারো, দাও, আর আমরা স্টাফদের প্রশিক্ষণ দেব। কোথাও কোনো সমস্যা হলে আমরা একসঙ্গে বসে সমাধান করি। এটাই আমাদের কাজ।
এই অন্তর্বর্তী সরকারের লক্ষ্য হলো, আমাদের মেয়াদ শেষে দেশের সব নাগরিক যেন ঘরে বসেই সরকারি সেবা পেতে পারেন। গ্রামের গৃহিণী বা দূরের কোনো নারীর শহরে আসার দরকার পড়বে না। কম্পিউটার বা মোবাইল ফোন দিয়েই তিনি সেবা নিতে পারবেন।
আমরা এই যাত্রাপথ সম্পন্ন করতে চাই।
ব্রনওয়েন ম্যাডক্স: এই ব্যাখ্যার জন্য ধন্যবাদ—বলা যায়, এটি সত্যিই অনুপ্রেরণাদায়ক। এবার আমি আরও কঠিন একটি বিষয়ে আসতে চাই—রোহিঙ্গা সংকট। লাখ লাখ রোহিঙ্গা এখন শিবিরে বসবাস করছে। এখন কী পরিকল্পনা? কী হবে ভবিষ্যতে?
অধ্যাপক ইউনূস: এই প্রশ্নই আমি প্রথমে তুলেছিলাম দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই। রোহিঙ্গা নিয়ে আলোচনা বলতে গেলে কে খাবার দিচ্ছে, কারা শিশুদের পড়ালেখার খরচ দিচ্ছে—এ পর্যন্তই সীমিত। কিন্তু আমি বলেছি, তাদের ভবিষ্যৎ কী? কবে তারা ফিরবে? এই প্রশ্নই কেউ করছে না।
আন্তর্জাতিক কিছু সংস্থা সহায়তা দিচ্ছে বটে, কিন্তু প্রত্যাবাসনের জন্য কোনো রোডম্যাপ নেই।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে আমি সংশ্লিষ্ট দাতাদেশগুলোর সঙ্গে বিশেষ বৈঠক করেছিলাম। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনাদের কি কোনো রোডম্যাপ আছে? তারা বলল, না, এখনো কোনো পরিকল্পনা হয়নি। তখন আমি বলি, প্ল্যান করেন, সেটা ১০ বছর লাগুক, ২০ বছর লাগুক, একটা তারিখ অন্তত থাকুক। প্রতিবছর পার হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কোনো অগ্রগতি নেই।
আমরা এখন চেষ্টা করছি যেন নিরাপদে প্রত্যাবাসন সম্ভব হয়। তার মাঝেই হঠাৎ করে যুক্তরাষ্ট্র ইউএসএইডের সব অর্থ সহায়তা বন্ধ করে দিল। যেমন খাদ্য বাবদ মাথাপিছু ১২ ডলার দেওয়া হতো—সেটা বন্ধ। কেউ বলল ৬ ডলার করা হোক, কেউ বলল ৩ ডলার—কিন্তু ৩ ডলারে মাসে কী খাওয়ানো যায় কাউকে? আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বারবার বলেছি, ‘আপনারা বলেছিলেন রাখুন, আমরা রেখেছি। কিন্তু তাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব আপনাদের। একে আমাদের একক দায়িত্ব ভাববেন না।’
যুক্তরাজ্য এখনো আমাদের অন্যতম প্রধান সহায়ক, বিশেষ করে এই সংকটকালে।
আমরা সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের অধিবেশনের সঙ্গে মিলিয়ে রোহিঙ্গা ইস্যুতে একটি বৈশ্বিক সম্মেলন করার জন্য চাপ দিচ্ছি।

এদিকে মিয়ানমারে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটেছে। রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি এখন নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে, এটাই মূল রোহিঙ্গা-অধ্যুষিত এলাকা। ফলে সেখান থেকে প্রায় ২ লাখ নতুন রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে, ১২ লাখের বেশি হয়ে গেছে শরণার্থীর সংখ্যা।
সবচেয়ে বড় বিপদের বিষয় যেটা আমি তুলে ধরছি, তা হলো এই নতুন প্রজন্ম। যারা এসেছিল, তাদের বয়স তখন পাঁচ কিংবা এর কম ছিল—এখন সাত বছর পর তারা বারো বছর বয়সে পৌঁছেছে। প্রতিবছর শিবিরে প্রায় ৩৫ হাজার শিশু জন্ম নিচ্ছে। এই প্রজন্ম বেড়ে উঠছে কোনো পরিচয় ছাড়াই, আশাহীন অবস্থায়। তারা যেন একপ্রকার কারাগারে বাস করছে, অথচ তাদের হাতে মোবাইল, কম্পিউটার আছে—বিশ্ব দেখছে তারা।
এই অবস্থায় এমন এক প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে, যারা হতাশ, ক্ষুব্ধ এবং তাদের ভবিষ্যৎ নেই।
এই ক্ষোভ কোন পথে যাবে, সেটা এখনো বোঝা যাচ্ছে না। তবে এটা নিশ্চিত, যদি কিছু করা না হয়, তাহলে একদিন এর পরিণতি ভয়ংকর হবে।
আমি সবাইকে বলছি, আমাদের এই চূড়ান্ত বিস্ফোরণ থেকে বাঁচাতে সাহায্য করুন। এই শিশুরা প্রতিভাবান, সৃষ্টিশীল, কিন্তু তারা বন্দী অবস্থায় আছে। তাদের মা-বাবার কথা শুনে বড় হচ্ছে, কিন্তু নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতেই হবে।
ব্রনওয়েন ম্যাডক্স: তাহলে আপনার পরিকল্পনা এখনো প্রত্যাবাসনের দিকেই, তা-ই তো? তাদের বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে রাখার কোনো পরিকল্পনা নেই?
অধ্যাপক ইউনূস: না, সেটা একেবারেই অসম্ভব। শিবিরসংলগ্ন এলাকার মানুষ খুব বিরূপ এবং তাদের ক্ষোভটা কিছুটা যৌক্তিক। তারা দেখে, রোহিঙ্গারা সব কিছু বিনা মূল্যে পাচ্ছে, আর তারা নিজেরাই টিকে থাকার লড়াই করছে। তারা বলে, ‘তোমরা আমাদের চাকরি নিচ্ছ, খাবার নিচ্ছ, আমাদের জীবন কেড়ে নিচ্ছ। তোমরা নিজের দেশে যাও, আমাদের জীবনে হস্তক্ষেপ কোরো না।’
রোহিঙ্গাদের অনেকের কাছে শিবিরজীবন হয়তো মজার, অলস সময় কাটানোর মতো; কিন্তু স্থানীয় শিশুদের কঠিন বাস্তবতা আছে, যাদের কোনো সুযোগ নেই। এর ফলে একধরনের ক্ষোভ ও উত্তেজনা তৈরি হচ্ছে। সরকার এই মর্মে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে—রোহিঙ্গারা ফিরবে। তারা সেটা বোঝে। বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দল বা সরকার স্থায়ী বসবাসের পক্ষে নয়।
ব্রনওয়েন ম্যাডক্স: আপনার বক্তব্য পরিষ্কার। এখন অনলাইনে অনেকেই প্রশ্ন পাঠাচ্ছেন—আমি প্রশ্ন পর্বে যাচ্ছি।
ব্রনওয়েন ম্যাডক্স: আপনাদের সবাইকে চ্যাথাম হাউসে স্বাগত জানাচ্ছি। বিশেষভাবে স্বাগত জানাই বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে।
আমি ব্রনওয়েন ম্যাডক্স, চ্যাথাম হাউসের পরিচালক। দর্শকদের ভিড় এবং আগ্রহ দেখে বোঝা যায়, ইউনূস সাহেবকে আলাদাভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার খুব একটা প্রয়োজন নেই।
আপনারা জানেন, অধ্যাপক ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা। এই উদ্যোগের জন্য তিনি এবং তাঁর প্রতিষ্ঠান ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান। এরপর তিনি ৫০টির বেশি সামাজিক ব্যবসা উদ্যোগ গড়ে তুলেছেন।
২০২৪ সালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট ও দীর্ঘদিনের শাসনামলের অবসানের পর আন্দোলনকারীরা তাঁকে অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব দেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি সেই দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং এখন বাংলাদেশের নতুন যাত্রার নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
আজকের আলোচনায় থাকছে নির্বাচন, গণমাধ্যম, অর্থনীতি, জলবায়ু পরিবর্তন, যুব উন্নয়ন, রোহিঙ্গা সংকট ও আন্তর্জাতিক কূটনীতি—সবকিছু।
এই অনুষ্ঠান চ্যাথাম হাউস রুল বা চ্যাথাম হাউসের নীতিসংশ্লিষ্ট নয়। এটি সরাসরি সম্প্রচারিত হচ্ছে এবং সম্পূর্ণ অন দ্য রেকর্ড।
অধ্যাপক ইউনূস: আমাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য অনেক ধন্যবাদ।
আমি বহুবার লন্ডনে এসেছি—বিভিন্ন ভূমিকায়। প্রথম এসেছিলাম ১৯৫৫ সালে, কানাডায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব স্কাউট জাম্বুরি শেষে। সেবার বিবিসির একটি বাংলা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে দুই গিনি সম্মানী পেয়েছিলাম, এখনো মনে আছে!
এরপর বহুবার এসেছি মাইক্রোক্রেডিট, সামাজিক ব্যবসা, তরুণদের নেতৃত্ব এবং আমার তিনটি শূন্যের দর্শন প্রচারে—শূন্য কার্বন নির্গমন, শূন্য সম্পদের কেন্দ্রীকরণ, শূন্য বেকারত্ব।
আমার বিশ্বাস, বর্তমান সভ্যতা ভুল পথে হাঁটছে—এটি আত্মবিনাশী। আমাদের টিকে থাকতে হলে নতুন এক সভ্যতা গড়ে তুলতে হবে এই তিন শূন্যের ভিত্তিতে।
এটি নিছক তাত্ত্বিক নয়, আমার জীবনের অভিজ্ঞতা ও বাস্তব কাজের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে।
তবে এবার এসেছি এক ভিন্ন ভূমিকায়—সরকারপ্রধান হিসেবে। এটি আমার জীবনে এক অনাকাঙ্ক্ষিত অধ্যায়, যা আমি কখনো ভাবিনি। কিন্তু এখন সেই দায়িত্বেই আছি। তাই আজকের আলোচনা সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই হবে।
ব্রনওয়েন ম্যাডক্স: ধন্যবাদ। আমরা জানি, আপনি ব্রিটেনের রাজা চার্লসের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছেন পরিবেশ ও সামাজিক উদ্যোগ নিয়ে। আবার বর্তমান দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবেও সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আপনার বৈঠক হয়েছে।
চলুন, আমরা মূল আলোচনায় যাই, শুরুতেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্বাচন। আপনি সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছেন, আগামী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২০২৫ সালের এপ্রিলে। কিন্তু সেনাবাহিনী ও কিছু রাজনৈতিক মহল চায়, নির্বাচন হোক চলতি বছরের মধ্যেই। অন্যদিকে আপনার সরকার আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ দিচ্ছে না, যা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচনা শুরু হয়েছে। আপনার জবাব কী?
অধ্যাপক ইউনূস: আমি বারবার বলেছি, এটি হবে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সুন্দর নির্বাচন। সময় উপযোগী নির্বাচন। দীর্ঘ ১৭ বছর পর আমরা একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক নির্বাচন করতে যাচ্ছি। এটি শুধু রাজনৈতিক ঘটনা নয়, এটি এক ঐতিহাসিক সুযোগ।
ধরুন, এক তরুণ ১৭ বছর আগে ভোটার হতে পেরেছে, কিন্তু কখনো ভোট দিতে পারেনি। এমন হাজারো তরুণ এখন প্রথমবারের মতো ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবে। তারা বলছে, ‘এবার আমার সিদ্ধান্তই মুখ্য। আমার ভোটেই গঠিত হবে বাংলাদেশ।’
এই তারুণ্যের শক্তি কাজে লাগাতে চাই আমরা। নির্বাচন শুধু সরকার গঠনের জন্য নয়, এটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার রেফারেন্ডাম। তরুণদের রক্ত আর আত্মত্যাগে আমরা ঋণী। আমরা সেই আত্মত্যাগকে সম্মান জানাতে চাই।
এই নতুন বাংলাদেশের ভিত্তি স্থাপিত হচ্ছে তিনটি মূল স্তম্ভে—
১. সংস্থার সংস্কার: যেসব প্রতিষ্ঠান সংকট তৈরি করেছে, সেগুলোর কাঠামোগত রূপান্তর দরকার। আমরা এর জন্য আলাদা আলাদা কমিশন গঠন করেছি—সংবিধান, সংসদ, নির্বাচন ব্যবস্থা, সিভিল সার্ভিসসহ প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সংস্কারের জন্য। কমিশনগুলোর সুপারিশ হাতে এসেছে। এগুলো শুধু সামান্য সংস্কার নয়, গভীর পরিবর্তনের প্রস্তাব রয়েছে।
২. আলোচনা ও ঐকমত্য: সংস্কারের আগে দরকার সর্বদলীয় ঐকমত্য। এ জন্যই আমরা গঠন করেছি ‘ঐকমত্য কমিশন’। এই কমিশনের কাজ হলো বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে বাস্তবসম্মত ও গ্রহণযোগ্য সংস্কার প্রস্তাব চূড়ান্ত করা। হয়তো বিশ্বের কোথাও এ ধরনের উদ্যোগ খুব একটা দেখা যায় না। তবে বাংলাদেশের মতো জটিল রাজনৈতিক বাস্তবতায় এটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
৩. নতুন ভবিষ্যৎ নির্মাণ: আমরা চাই একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই গণতন্ত্র। অবশ্যই এটি সহজ নয়—বাংলাদেশের রাজনীতিকদের মধ্যে ঐকমত্য গড়ে তোলা কঠিন কাজ। কিন্তু আমরা যদি সত্যিই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই, তাহলে এটাই পথ।
ব্রনউইন ম্যাডক্স: আমি বলতে চাই, এটি অনেক রাজনীতিকের জন্যই কঠিন বিষয়, এটি আমি কোনো রকম ঠাট্টা করে বলছি না। কেউ কেউ বলতেই পারেন, ‘আপনার এই প্রক্রিয়া তো গণতন্ত্রের মৌলিক উপাদানকেই বাদ দিচ্ছে। ভোটারদের বিশ্বাস করুন। জনগণকে স্বাধীনভাবে সব দল ও মতবাদের মধ্যে থেকে বেছে নেওয়ার সুযোগ দিন। তাদের বিচার–বুদ্ধির ওপর আস্থা রাখুন। তাঁরা নিজেরাই ঠিক পথটি খুঁজে নেবেন।
অধ্যাপক ইউনূস: আমি নিজেও চাই, সবকিছু যদি শুধু ভোটারদের সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দেওয়া যেত! কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ যদি রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক কাঠামোর জটিল বিষয়গুলো—দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ কিংবা অনুপাতভিত্তিক ভোটব্যবস্থার মতো ধারণা পুরোপুরি বুঝত! উল্টো তারা বলবে, ‘আমরা এসব বুঝি না! আমি তোমাকে ভোট দেব, কয় টাকা দেবে?’—সহজ ভাষায় বললে বিষয়টি তা-ই—‘তুমি টাকা দাও, আমি ভোট দেব।’ দেশে ভোটের চর্চা সেটাই।
আমরা বলেছি, আমরা সেই চর্চায় ফিরতে চাই না। তাই আমরা ভিন্ন পথে হেঁটেছি। আমরা সবকিছু জনসমক্ষে করছি। এই সব বিতর্ক, সুপারিশ, সংলাপ প্রতিদিন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। মানুষ নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছে—কী আলোচনা হচ্ছে, কী ঝুঁকি আছে, কী সম্ভাবনা আছে।
আমাদের লক্ষ্য একদম স্পষ্ট—যেসব সংস্কার প্রস্তাবে সব রাজনৈতিক দলের সম্মতি রয়েছে, সেগুলো একত্র করে একটি ঐক্যমতের দলিল তৈরি করা। আমরা এটির নাম দিয়েছি ‘জুলাই সনদ’।
এই সনদ আগামী মাসে জাতির সামনে উপস্থাপন করব। এটি যখন চূড়ান্ত হবে এবং সব রাজনৈতিক দল স্বাক্ষর করবে, তখন আমরা এটিকে উদ্যাপন করব একটি জাতীয় ঐকমত্য হিসেবে। এর ভিত্তিতেই পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
তাই নির্বাচন আসলে আমাদের বৃহত্তর কর্মসূচির একটি অংশ। সেই বৃহৎ কর্মসূচির প্রথম স্তম্ভ হলো সংস্কার। আমাদের সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে পুরোনো প্রতিষ্ঠানগুলোই। তাই প্রতিটি প্রতিষ্ঠান নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে।
আমরা প্রধান প্রধান প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য পৃথক কমিশন গঠন করেছি। তারা যে সুপারিশগুলো করেছে, তা অনেক ক্ষেত্রে কঠিন, কিছুটা নাটকীয়ও। নির্বাচন কমিশন, সংসদ, সংবিধান, প্রশাসন—সবকিছু নিয়ে আমরা গভীরভাবে কাজ করছি।
পরবর্তী ধাপ হলো ঐকমত্যের ভিত্তি তৈরি। আমরা সব দলকে নিয়ে ঐকমত্য গঠনে কমিশন তৈরি করেছি। এ রকম কিছুর নাম হয়তো আপনি এর আগে শোনেননি। এই কমিশনের কাজ হলো সব দলের অংশগ্রহণে প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনা করে সেই সংস্কারগুলো খুঁজে বের করা, যেগুলো নিয়ে সমঝোতা সম্ভব।
হ্যাঁ, এটা সহজ নয়; বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরে ঐক্য তৈরি করা কঠিন কাজ। কিন্তু আমরা যদি সত্যিকার অর্থেই একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, স্থিতিশীল গণতন্ত্র গড়তে চাই, তাহলে এটাই প্রয়োজন।
ব্রনউইন ম্যাডক্স: আমি বিচারপ্রক্রিয়ার বিষয়ে পরে আসছি, তবে ‘জুলাই সনদ’ নিয়ে একটু কথা আছে। সমালোচকদের মতে, এই সনদ নিয়ে ঐকমত্য বাধ্যতামূলক করে আপনি কার্যত কিছু রাজনৈতিক দলকে—যেমন আওয়ামী লীগকে গোটা প্রক্রিয়া থেকেই বাদ দিয়ে দিচ্ছেন। তারা বলছে, আপনি জনগণের সামনে প্রকৃত কোনো বিকল্প তুলে ধরছেন না। তাদের চোখে, এই পুরো প্রক্রিয়া ‘ঐকমত্যের’ ভাষায় মোড়ানো একধরনের কর্তৃত্ববাদ।
অধ্যাপক ইউনূস: প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ। তবে আওয়ামী লীগকে এখন আর রাজনৈতিক দল হিসেবে গণ্য করা যায় কি না, সেই বিতর্ক তৈরি হয়েছে। যদি কোনো দল রাস্তায় তরুণদের গুলি করে মারে, মানুষকে গুম করে, রাষ্ট্রীয় অর্থ চুরি করে, তাহলে সেটিকে কি রাজনৈতিক দল বলা যায়? আমি কোনো ব্যক্তিগত রায় দিচ্ছি না, এটি একটি জাতীয় বিতর্ক।
গত ৫ আগস্ট যখন সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান, তখনই এই প্রশ্ন তীব্র হয়ে ওঠে। সেদিন পুরো বাংলাদেশে মানুষ রাস্তায় নেমে উৎসব করেছিল—তাদের মনে হয়েছিল, তারা মুক্ত। আমরা ভেবেছিলাম, ওই দিনই একটি অধ্যায়ের শেষ। সেই সাথে একটি অন্ধকার যুগও শেষ।
কিন্তু যারা পালিয়ে গেছে, তারা থামেনি। বিদেশ থেকে তারা সহিংসতা উসকে দিচ্ছে, বিশৃঙ্খলা ছড়াচ্ছে। এ প্রক্রিয়া এখনো চলছে। এই পুরো সময়জুড়ে দলটির কোনো সদস্য একটিবারও অনুশোচনা প্রকাশ করেনি; কেউ বলেনি, ‘আমার কষ্ট লাগছে কিংবা আমরা ভুল করেছি।’ তাই আমাদের জন্য অধ্যায়টি শেষ হলেও তাদের জন্য শেষ হয়নি।
এখনো তারা মাঠে-ময়দানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে, সেই তরুণদের ওপর হামলা করছে, যারা এই গণ-আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে। এ কারণেই জননিরাপত্তার স্বার্থে রাষ্ট্র আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে।
আমি স্পষ্ট করে বলছি, আমরা দলটিকে নিষিদ্ধ করিনি। কোনো স্থায়ী সিদ্ধান্ত নিইনি। আমরা শুধু বিচারপ্রক্রিয়ার ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করছি।
ব্রনউইন ম্যাডক্স: বিচারপ্রক্রিয়া মানে এই দলের নেতা-কর্মীদের বিচার?
অধ্যাপক ইউনূস: যেসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, তাদের সবার।
ব্রনউইন ম্যাডক্স: শেখ হাসিনা বর্তমানে ভারতের আশ্রয়ে একটি নিরাপদ স্থানে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। প্রশ্ন হলো—এই বিচারপর্ব কি নির্বাচিত সরকার আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারত না? অন্তর্বর্তী সরকার কেন এখনই এটি সম্পন্ন করতে চাইছে?
অধ্যাপক ইউনূস: এই সিদ্ধান্ত আমি একা নিইনি। যখন আমরা দায়িত্ব নিই, তখন গণ-আন্দোলনের নেতারা আমাদের তিনটি কাজের দায়িত্ব দেয়, আমরা সেটি গ্রহণ করি। এটা সেই দায়িত্বেরই একটি অংশ। আমরা শুধু আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করছি; আর কিছু না।
ব্রনউইন ম্যাডক্স: এই সময়কাল নিয়ে আরেকটি প্রশ্ন। আমি সংবাদমাধ্যমে দেখেছি, এই সময়ে বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হ্রাস পেয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আপনার জবাব কী?
অধ্যাপক ইউনূস: এই অভিযোগ মিথ্যা। সংবাদমাধ্যম আগে কখনো এত স্বাধীন ছিল না। তারা প্রতিদিন স্বাধীনভাবে সব কথা বলছে, তাদের কেউ থামাচ্ছে না।
ব্রনউইন ম্যাডক্স: এখন আমি আসতে চাই আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে—অর্থনীতি। যেকোনো সরকারের জন্যই অর্থনীতি পরিচালনা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। জটিল বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আপনি এই দায়িত্ব নিয়েছেন। তার মধ্যে এসেছে শুল্কযুদ্ধ, এই পরিবর্তন বাংলাদেশের ওপর কী প্রভাব ফেলেছে?
অধ্যাপক ইউনূস: আমাদের জন্য এটি সত্যিই কঠিন এক সময়। যখন বিশ্ব বাণিজ্য, শুল্ক ও সরবরাহব্যবস্থার সংকটে জর্জরিত, তখন আমরা একেবারে অন্য রকম সংকটে পড়েছি।
আমরা বলতে গেলে শূন্য থেকে নয়, ঋণাত্মক জায়গা থেকে শুরু করেছি। শূন্য হলে অন্তত কিছু থাকে; কিন্তু আমরা এমন একটি অবস্থায় ছিলাম, যেখানে কিছুই ছিল না।
এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে পূর্ববর্তী সরকারের তথাকথিত ‘মেগা প্রকল্প’ থেকে। প্রকল্পগুলোর বেশির ভাগই জনগণের উপকারের জন্য নয়, ব্যক্তিগত লাভের উদ্দেশ্যে তৈরি। এখন এসব প্রকল্পের অর্থায়ন চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে—দেনা পরিশোধের সময় হয়েছে। কিন্তু সরকারি কোষাগারে অর্থ নেই।
আমরা একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছি, যেখানে বলা হয়েছে, প্রায় ২৩৪ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে, যা ব্যাংক ও ব্যাংকের বাইরের বিভিন্ন উৎস থেকে আত্মসাৎ করা হয়েছে। এই অর্থ পাচারের ফলে ব্যাংকিং ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। রাজনৈতিক চাপ ও ভয়ভীতির মাধ্যমে ব্যাংকের পরিচালকেরা পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন, আর তাঁদের জায়গায় বসানো হয়েছে অনুগতদের। অনেকে কোনো জামানত ছাড়াই ঋণ পেয়েছেন এমন এক বোঝাপড়ায় যে এই ঋণ ফেরত দিতে হবে না।
এখন সেই ঋণদাতারা, ঠিকাদারেরা দাবি তুলেছে, তাদের অর্থ ফেরত দিতে হবে। না দিলে তারা আন্তর্জাতিক আদালতে যাবে, এটি সত্যিই এক ভয়াবহ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি।
তবুও এই সংকটের মধ্যেও একটি আশার আলো আছে—প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। বিশ্বজুড়ে, বিশেষ করে যুক্তরাজ্য, মধ্যপ্রাচ্য এবং আরও অনেক দেশে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশিরা টাকা পাঠিয়ে যাচ্ছেন। এই রেমিট্যান্স আমাদের দেশের অর্থনীতিকে এখনো টিকিয়ে রেখেছে। তাঁদের কারণেই আমাদের ব্যালান্স অব পেমেন্ট কিছুটা স্থিতিশীল হয়েছে।
ব্রনউইন ম্যাডক্স: আপনি ঠিকই বললেন, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স আমাদের জন্য জীবনরেখা হয়ে উঠেছে। কিন্তু আরেকটি বড় আন্তর্জাতিক অংশীদার আইএমএফ, এই মুহূর্তে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত। তারা স্পষ্টভাবে বলেছে, এই অন্তর্বর্তী সরকারকেই অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু করতে হবে।
বিশেষ করে তারা কর ব্যবস্থার সংস্কার চায়; কর-ভিত্তি প্রসার, রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি ও কর-ফাঁকি রোধ। আপনার কি মনে হয়, এই অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে এসব করা সম্ভব?
অধ্যাপক ইউনূস: প্রথমেই আমি যে বিষয়টি বলব, তা হলো বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সরকার আমাদের যে সমর্থন দিয়েছে, তা অভাবনীয়। অনেক দেশ থেকেই বলা হয়েছে, ‘আপনারা যা প্রয়োজন, জানিয়ে দিন, আমরা সাহায্য করতে প্রস্তুত।’
এটি আমাদের জন্য এক বিশাল নৈতিক অনুপ্রেরণা। এটি আমাদের আশ্বস্ত করেছে যে আমরা একা নই। যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, চীন—প্রতিটি বড় দেশের পক্ষ থেকেই আমাদের প্রতি সহানুভূতি জানানো হয়েছে। এই সংহতি আমাদের মনোবল বাড়িয়েছে।
আপনি আইএমএফের কথা বললেন—হ্যাঁ, তারা আমাদের পাশে রয়েছে, ঠিক যেমন বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও রয়েছে।
ব্রনওয়েন ম্যাডক্স: সবাই মনে হয় এমন প্রশংসামূলক শব্দ ব্যবহার করছে না, তাই আমি একটু...
অধ্যাপক ইউনূস: না, আমি বাস্তব অভিজ্ঞতার কথাই বলছি। আইএমএফ তখন যুক্ত হয়, যখন তারা অর্থ ছাড়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল। তারা জোর দিয়ে বলল, আমাদের অবশ্যই মুদ্রার বিনিময় হার বাজারে ছেড়ে দিতে হবে। আমরা এতে শঙ্কিত ছিলাম; কারণ, এত দিন ধরে সরকার-নিয়ন্ত্রিত বিনিময় হার বজায় রেখেছিলাম, যাতে বৈদেশিক মুদ্রা দ্রুত বেরিয়ে না যায়। এটিকে বাজারে ছেড়ে দেওয়া একটি বড় সিদ্ধান্ত ছিল।
আমরা অনেক আলোচনা করেছি। কিন্তু আইএমএফ বলল, ‘আমরা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেছি, আপনি এই ঝুঁকি নিতে পারেন।’ তখন আমরা একটি শর্তে সম্মত হই, যদি পরিস্থিতি খারাপ হয়, আমরা আবার আগের ব্যবস্থায় ফিরতে পারব। আইএমএফ এতে সম্মত হয় এবং আমরা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করি।
এরপর দেখা গেল পরিস্থিতি খুব বেশি খারাপ হয়নি। বিনিময় হার কিছুটা ওঠানামা করেছে, তবে সেটি স্বাভাবিক পর্যায়েই থেকেছে। এখন আমরা এটিকে একধরনের সাফল্য হিসেবে দেখছি। এটি প্রমাণ করে, আমাদের অর্থনীতি একেবারে ধ্বংসপ্রাপ্ত নয়।
তাই আমি বলব, আইএমএফ আমাদের বিপদে ফেলতে নয়, বরং সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়েছে। তারা বলেছে, ‘আপনারা পারবেন’,— আমরাও তা প্রমাণ করেছি। এ জন্য আমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।
ব্রনওয়েন ম্যাডক্স: আচ্ছা, এখন আমি জানতে চাই ভারত ও চীনের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে। শেখ হাসিনার আমলে ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, দিল্লির সঙ্গে আপনার সরকারের সম্পর্ক কিছুটা শীতল। আর চীনের সঙ্গে সম্পর্ক যেন একটু উষ্ণতর। আপনার মূল্যায়ন কী?
অধ্যাপক ইউনূস: আমরা সবার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাই। আমি আগেই বলেছি, পৃথিবীর সব দেশই আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, আমরা এ জন্য কৃতজ্ঞ। আমরা যেটা করছি, তা হলো—যেসব সহযোগিতা অতীতে পাওয়া যায়নি, এখন আমরা তা চাচ্ছি।
সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি আমরা মোকাবিলা করছি, তা হলো দুর্নীতি। বাংলাদেশ একটি দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। প্রশাসনের অনেক স্তর এতে জড়িত। এখন প্রশ্ন হলো, আমরা কীভাবে এই ব্যবস্থা পরিষ্কার করব? কী ধরনের সংস্কার আনতে হবে, যাতে সরকার দুর্নীতিমুক্ত হয়?
গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বৈঠকে এ বিষয়ে আমি বিশ্বের বিভিন্ন নেতার সঙ্গে আলোচনা করেছি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লেনের সঙ্গেও আমার কথা হয়েছিল। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আমাদের মতো দেশে এই দুর্নীতির দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী হতে পারে?’ তিনি হেসে বললেন, ‘আপনারা বিশ্বাস করবেন না, ইউরোপে এমন অনেক দেশ ছিল, যেখানে দুর্নীতি এর চেয়েও খারাপ ছিল।’
তাঁরা ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের লক্ষ্যে নিজেদের পরিষ্কার করতে বাধ্য হয়েছিল। এ জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল—সিস্টেম গড়ে তোলা হয়েছিল। আমরা সেখান থেকেই শিক্ষা নিচ্ছি—দুর্নীতি দমন করতে কীভাবে একটি কার্যকর ব্যবস্থাপনা কাঠামো গড়ে তোলা যায়।
ব্রনওয়েন ম্যাডক্স: তবে ইউরোপের দেশগুলোর ক্ষেত্রে চাপটা এসেছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের ইচ্ছা থেকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এমন কোনো চাপ আছে কি—রাজনীতি বা সমাজের পক্ষ থেকে?
অধ্যাপক ইউনূস: এই মুহূর্ত আমাদের জন্য ঐতিহাসিক। আমরা যদি এখন এটি না করতে পারি, তাহলে আর কোনো দিন পারব না। আমরা বিশ্বাস করি, এই মুহূর্ত আমাদের সামনে ইতিহাসের একটি জানালা খুলে দিয়েছে। অন্য কোনো সরকার এমন সুযোগ পায়নি; কারণ, তাদের ভোটের রাজনীতি আছে, পছন্দ-অপছন্দ আছে। আমাদের তেমন কিছু নেই। আমরা কারও ভোটে নির্বাচিত হইনি, কাউকে তুষ্ট করার দরকার নেই। এই নিরপেক্ষতা থেকেই আমাদের নৈতিক শক্তি আসে।

ব্রনওয়েন ম্যাডক্স: এই অল্প সময় ৯ বা ১০ মাসে আপনারা কীভাবে এটি করবেন? আমি জানি, দুর্নীতি আছে নাইজেরিয়ায়, দুর্নীতি প্রায় সব দেশেই সমস্যা। আপনি কী করছেন—একটু বলুন।
অধ্যাপক ইউনূস: আমি একটি উদাহরণ দিচ্ছি। ধরুন, কেউ পাসপোর্ট বানাতে গেল। তখন কেউ একজন বলে, ‘সরকারি প্রক্রিয়ায় গেলে কয়েক বছর লেগে যাবে—হয়তো পাবেনই না। আমাকে কিছু টাকা দিন, বাসায় পৌঁছে দেব।’ এই লোক আসলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার ‘মানুষ’।
মানে অফিশিয়াল ব্যবস্থা আসলে নিয়ন্ত্রিত হয় দালালদের মাধ্যমে। কর্মকর্তারা এই টাকার ভাগ পান। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এখন থেকে পাসপোর্ট অনলাইনে দেওয়া হবে। মানুষ খুশি—ভাবল, এবার বুঝি সত্যি সেবা মিলবে। কিন্তু দেখা গেল, অনলাইন ফর্ম খোলে না, সার্ভার ডাউন, কেউ ইচ্ছা করে জটিলতা তৈরি করে রেখেছে। ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত...
ব্রনওয়েন ম্যাডক্স: হ্যাঁ... অনেক দেশ প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে দালালনির্ভরতা কমাতে সফল হয়েছে...
অধ্যাপক ইউনূস: আমরাও সে পথেই এগোচ্ছি। আমরা ‘সরকারি’ শব্দটি ব্যবহার না করে ‘বাংলাদেশ সেবা কেন্দ্র’ নামে নতুন একটি উদ্যোগ চালু করেছি। এখানে প্রশিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা বসে থাকেন, কম্পিউটারে নানা ধরনের সরকারি সেবা দিয়ে থাকেন। গত কয়েক মাসে আমরা সব মন্ত্রণালয়কে প্রস্তুত করেছি, যাতে কর পরিশোধ, ড্রাইভিং লাইসেন্স, পাসপোর্ট নবায়ন, এমনকি জটিল ভূমি করের মতো বিষয়গুলো অনলাইনে করা যায়।
এই সেবাকেন্দ্রগুলো আমরা গত মাসে শুরু করেছি। কেউ কেন্দ্রে এলে স্পষ্টভাবে নির্ধারিত মূল্যের তালিকা দেখতে পাবেন। যত দ্রুত সেবা চান, তার ভিত্তিতে হয়তো আপনার বাসায় ডেলিভারি হবে, অথবা মেসেজ পেয়ে আপনি এসে নিয়ে যাবেন। এই মুহূর্তে আমাদের তিনটি কেন্দ্র চালু রয়েছে এবং আগামী এক মাসে অনেকগুলো চালু করার পরিকল্পনা আছে।
আমরা প্রতিটি মন্ত্রণালয়কে চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি—তোমরা কতগুলো সেবা অনলাইনে দিতে পারবে? কেউ বলছে ৫টি, কেউ ১০টি, কেউ আরও বেশি। আমরা বলি, যতগুলো পারো, দাও, আর আমরা স্টাফদের প্রশিক্ষণ দেব। কোথাও কোনো সমস্যা হলে আমরা একসঙ্গে বসে সমাধান করি। এটাই আমাদের কাজ।
এই অন্তর্বর্তী সরকারের লক্ষ্য হলো, আমাদের মেয়াদ শেষে দেশের সব নাগরিক যেন ঘরে বসেই সরকারি সেবা পেতে পারেন। গ্রামের গৃহিণী বা দূরের কোনো নারীর শহরে আসার দরকার পড়বে না। কম্পিউটার বা মোবাইল ফোন দিয়েই তিনি সেবা নিতে পারবেন।
আমরা এই যাত্রাপথ সম্পন্ন করতে চাই।
ব্রনওয়েন ম্যাডক্স: এই ব্যাখ্যার জন্য ধন্যবাদ—বলা যায়, এটি সত্যিই অনুপ্রেরণাদায়ক। এবার আমি আরও কঠিন একটি বিষয়ে আসতে চাই—রোহিঙ্গা সংকট। লাখ লাখ রোহিঙ্গা এখন শিবিরে বসবাস করছে। এখন কী পরিকল্পনা? কী হবে ভবিষ্যতে?
অধ্যাপক ইউনূস: এই প্রশ্নই আমি প্রথমে তুলেছিলাম দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই। রোহিঙ্গা নিয়ে আলোচনা বলতে গেলে কে খাবার দিচ্ছে, কারা শিশুদের পড়ালেখার খরচ দিচ্ছে—এ পর্যন্তই সীমিত। কিন্তু আমি বলেছি, তাদের ভবিষ্যৎ কী? কবে তারা ফিরবে? এই প্রশ্নই কেউ করছে না।
আন্তর্জাতিক কিছু সংস্থা সহায়তা দিচ্ছে বটে, কিন্তু প্রত্যাবাসনের জন্য কোনো রোডম্যাপ নেই।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে আমি সংশ্লিষ্ট দাতাদেশগুলোর সঙ্গে বিশেষ বৈঠক করেছিলাম। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনাদের কি কোনো রোডম্যাপ আছে? তারা বলল, না, এখনো কোনো পরিকল্পনা হয়নি। তখন আমি বলি, প্ল্যান করেন, সেটা ১০ বছর লাগুক, ২০ বছর লাগুক, একটা তারিখ অন্তত থাকুক। প্রতিবছর পার হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কোনো অগ্রগতি নেই।
আমরা এখন চেষ্টা করছি যেন নিরাপদে প্রত্যাবাসন সম্ভব হয়। তার মাঝেই হঠাৎ করে যুক্তরাষ্ট্র ইউএসএইডের সব অর্থ সহায়তা বন্ধ করে দিল। যেমন খাদ্য বাবদ মাথাপিছু ১২ ডলার দেওয়া হতো—সেটা বন্ধ। কেউ বলল ৬ ডলার করা হোক, কেউ বলল ৩ ডলার—কিন্তু ৩ ডলারে মাসে কী খাওয়ানো যায় কাউকে? আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বারবার বলেছি, ‘আপনারা বলেছিলেন রাখুন, আমরা রেখেছি। কিন্তু তাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব আপনাদের। একে আমাদের একক দায়িত্ব ভাববেন না।’
যুক্তরাজ্য এখনো আমাদের অন্যতম প্রধান সহায়ক, বিশেষ করে এই সংকটকালে।
আমরা সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের অধিবেশনের সঙ্গে মিলিয়ে রোহিঙ্গা ইস্যুতে একটি বৈশ্বিক সম্মেলন করার জন্য চাপ দিচ্ছি।

এদিকে মিয়ানমারে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটেছে। রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি এখন নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে, এটাই মূল রোহিঙ্গা-অধ্যুষিত এলাকা। ফলে সেখান থেকে প্রায় ২ লাখ নতুন রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে, ১২ লাখের বেশি হয়ে গেছে শরণার্থীর সংখ্যা।
সবচেয়ে বড় বিপদের বিষয় যেটা আমি তুলে ধরছি, তা হলো এই নতুন প্রজন্ম। যারা এসেছিল, তাদের বয়স তখন পাঁচ কিংবা এর কম ছিল—এখন সাত বছর পর তারা বারো বছর বয়সে পৌঁছেছে। প্রতিবছর শিবিরে প্রায় ৩৫ হাজার শিশু জন্ম নিচ্ছে। এই প্রজন্ম বেড়ে উঠছে কোনো পরিচয় ছাড়াই, আশাহীন অবস্থায়। তারা যেন একপ্রকার কারাগারে বাস করছে, অথচ তাদের হাতে মোবাইল, কম্পিউটার আছে—বিশ্ব দেখছে তারা।
এই অবস্থায় এমন এক প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে, যারা হতাশ, ক্ষুব্ধ এবং তাদের ভবিষ্যৎ নেই।
এই ক্ষোভ কোন পথে যাবে, সেটা এখনো বোঝা যাচ্ছে না। তবে এটা নিশ্চিত, যদি কিছু করা না হয়, তাহলে একদিন এর পরিণতি ভয়ংকর হবে।
আমি সবাইকে বলছি, আমাদের এই চূড়ান্ত বিস্ফোরণ থেকে বাঁচাতে সাহায্য করুন। এই শিশুরা প্রতিভাবান, সৃষ্টিশীল, কিন্তু তারা বন্দী অবস্থায় আছে। তাদের মা-বাবার কথা শুনে বড় হচ্ছে, কিন্তু নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতেই হবে।
ব্রনওয়েন ম্যাডক্স: তাহলে আপনার পরিকল্পনা এখনো প্রত্যাবাসনের দিকেই, তা-ই তো? তাদের বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে রাখার কোনো পরিকল্পনা নেই?
অধ্যাপক ইউনূস: না, সেটা একেবারেই অসম্ভব। শিবিরসংলগ্ন এলাকার মানুষ খুব বিরূপ এবং তাদের ক্ষোভটা কিছুটা যৌক্তিক। তারা দেখে, রোহিঙ্গারা সব কিছু বিনা মূল্যে পাচ্ছে, আর তারা নিজেরাই টিকে থাকার লড়াই করছে। তারা বলে, ‘তোমরা আমাদের চাকরি নিচ্ছ, খাবার নিচ্ছ, আমাদের জীবন কেড়ে নিচ্ছ। তোমরা নিজের দেশে যাও, আমাদের জীবনে হস্তক্ষেপ কোরো না।’
রোহিঙ্গাদের অনেকের কাছে শিবিরজীবন হয়তো মজার, অলস সময় কাটানোর মতো; কিন্তু স্থানীয় শিশুদের কঠিন বাস্তবতা আছে, যাদের কোনো সুযোগ নেই। এর ফলে একধরনের ক্ষোভ ও উত্তেজনা তৈরি হচ্ছে। সরকার এই মর্মে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে—রোহিঙ্গারা ফিরবে। তারা সেটা বোঝে। বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দল বা সরকার স্থায়ী বসবাসের পক্ষে নয়।
ব্রনওয়েন ম্যাডক্স: আপনার বক্তব্য পরিষ্কার। এখন অনলাইনে অনেকেই প্রশ্ন পাঠাচ্ছেন—আমি প্রশ্ন পর্বে যাচ্ছি।

বাংলাদেশের সামনে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। ২০২৪ সালে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর গণতান্ত্রিক রূপান্তরের পথে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে দেশ। দেশের মানুষ একদিকে যেমন বড় রকমের পরিবর্তনের মুখোমুখি, অন্যদিকে রাজনৈতিক রূপান্তর নিয়ে রয়েছে তীব্র উৎকণ্ঠা। সামনের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনাগুলো নিয়ে যুক্তরাজ্যের থিংকট্যাংক চ্যাথাম হাউসের পরিচালক ব্রনওয়েন ম্যাডক্সের সঙ্গে কথা বলেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সাক্ষাৎকারটির হুবহু বাংলা অনুবাদ আজকের পত্রিকার পাঠকদের সামনে তুলে ধরা হলো—
হুসাইন আহমদ

ব্রনওয়েন ম্যাডক্স: আপনাদের সবাইকে চ্যাথাম হাউসে স্বাগত জানাচ্ছি। বিশেষভাবে স্বাগত জানাই বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে।
আমি ব্রনওয়েন ম্যাডক্স, চ্যাথাম হাউসের পরিচালক। দর্শকদের ভিড় এবং আগ্রহ দেখে বোঝা যায়, ইউনূস সাহেবকে আলাদাভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার খুব একটা প্রয়োজন নেই।
আপনারা জানেন, অধ্যাপক ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা। এই উদ্যোগের জন্য তিনি এবং তাঁর প্রতিষ্ঠান ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান। এরপর তিনি ৫০টির বেশি সামাজিক ব্যবসা উদ্যোগ গড়ে তুলেছেন।
২০২৪ সালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট ও দীর্ঘদিনের শাসনামলের অবসানের পর আন্দোলনকারীরা তাঁকে অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব দেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি সেই দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং এখন বাংলাদেশের নতুন যাত্রার নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
আজকের আলোচনায় থাকছে নির্বাচন, গণমাধ্যম, অর্থনীতি, জলবায়ু পরিবর্তন, যুব উন্নয়ন, রোহিঙ্গা সংকট ও আন্তর্জাতিক কূটনীতি—সবকিছু।
এই অনুষ্ঠান চ্যাথাম হাউস রুল বা চ্যাথাম হাউসের নীতিসংশ্লিষ্ট নয়। এটি সরাসরি সম্প্রচারিত হচ্ছে এবং সম্পূর্ণ অন দ্য রেকর্ড।
অধ্যাপক ইউনূস: আমাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য অনেক ধন্যবাদ।
আমি বহুবার লন্ডনে এসেছি—বিভিন্ন ভূমিকায়। প্রথম এসেছিলাম ১৯৫৫ সালে, কানাডায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব স্কাউট জাম্বুরি শেষে। সেবার বিবিসির একটি বাংলা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে দুই গিনি সম্মানী পেয়েছিলাম, এখনো মনে আছে!
এরপর বহুবার এসেছি মাইক্রোক্রেডিট, সামাজিক ব্যবসা, তরুণদের নেতৃত্ব এবং আমার তিনটি শূন্যের দর্শন প্রচারে—শূন্য কার্বন নির্গমন, শূন্য সম্পদের কেন্দ্রীকরণ, শূন্য বেকারত্ব।
আমার বিশ্বাস, বর্তমান সভ্যতা ভুল পথে হাঁটছে—এটি আত্মবিনাশী। আমাদের টিকে থাকতে হলে নতুন এক সভ্যতা গড়ে তুলতে হবে এই তিন শূন্যের ভিত্তিতে।
এটি নিছক তাত্ত্বিক নয়, আমার জীবনের অভিজ্ঞতা ও বাস্তব কাজের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে।
তবে এবার এসেছি এক ভিন্ন ভূমিকায়—সরকারপ্রধান হিসেবে। এটি আমার জীবনে এক অনাকাঙ্ক্ষিত অধ্যায়, যা আমি কখনো ভাবিনি। কিন্তু এখন সেই দায়িত্বেই আছি। তাই আজকের আলোচনা সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই হবে।
ব্রনওয়েন ম্যাডক্স: ধন্যবাদ। আমরা জানি, আপনি ব্রিটেনের রাজা চার্লসের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছেন পরিবেশ ও সামাজিক উদ্যোগ নিয়ে। আবার বর্তমান দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবেও সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আপনার বৈঠক হয়েছে।
চলুন, আমরা মূল আলোচনায় যাই, শুরুতেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্বাচন। আপনি সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছেন, আগামী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২০২৫ সালের এপ্রিলে। কিন্তু সেনাবাহিনী ও কিছু রাজনৈতিক মহল চায়, নির্বাচন হোক চলতি বছরের মধ্যেই। অন্যদিকে আপনার সরকার আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ দিচ্ছে না, যা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচনা শুরু হয়েছে। আপনার জবাব কী?
অধ্যাপক ইউনূস: আমি বারবার বলেছি, এটি হবে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সুন্দর নির্বাচন। সময় উপযোগী নির্বাচন। দীর্ঘ ১৭ বছর পর আমরা একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক নির্বাচন করতে যাচ্ছি। এটি শুধু রাজনৈতিক ঘটনা নয়, এটি এক ঐতিহাসিক সুযোগ।
ধরুন, এক তরুণ ১৭ বছর আগে ভোটার হতে পেরেছে, কিন্তু কখনো ভোট দিতে পারেনি। এমন হাজারো তরুণ এখন প্রথমবারের মতো ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবে। তারা বলছে, ‘এবার আমার সিদ্ধান্তই মুখ্য। আমার ভোটেই গঠিত হবে বাংলাদেশ।’
এই তারুণ্যের শক্তি কাজে লাগাতে চাই আমরা। নির্বাচন শুধু সরকার গঠনের জন্য নয়, এটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার রেফারেন্ডাম। তরুণদের রক্ত আর আত্মত্যাগে আমরা ঋণী। আমরা সেই আত্মত্যাগকে সম্মান জানাতে চাই।
এই নতুন বাংলাদেশের ভিত্তি স্থাপিত হচ্ছে তিনটি মূল স্তম্ভে—
১. সংস্থার সংস্কার: যেসব প্রতিষ্ঠান সংকট তৈরি করেছে, সেগুলোর কাঠামোগত রূপান্তর দরকার। আমরা এর জন্য আলাদা আলাদা কমিশন গঠন করেছি—সংবিধান, সংসদ, নির্বাচন ব্যবস্থা, সিভিল সার্ভিসসহ প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সংস্কারের জন্য। কমিশনগুলোর সুপারিশ হাতে এসেছে। এগুলো শুধু সামান্য সংস্কার নয়, গভীর পরিবর্তনের প্রস্তাব রয়েছে।
২. আলোচনা ও ঐকমত্য: সংস্কারের আগে দরকার সর্বদলীয় ঐকমত্য। এ জন্যই আমরা গঠন করেছি ‘ঐকমত্য কমিশন’। এই কমিশনের কাজ হলো বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে বাস্তবসম্মত ও গ্রহণযোগ্য সংস্কার প্রস্তাব চূড়ান্ত করা। হয়তো বিশ্বের কোথাও এ ধরনের উদ্যোগ খুব একটা দেখা যায় না। তবে বাংলাদেশের মতো জটিল রাজনৈতিক বাস্তবতায় এটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
৩. নতুন ভবিষ্যৎ নির্মাণ: আমরা চাই একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই গণতন্ত্র। অবশ্যই এটি সহজ নয়—বাংলাদেশের রাজনীতিকদের মধ্যে ঐকমত্য গড়ে তোলা কঠিন কাজ। কিন্তু আমরা যদি সত্যিই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই, তাহলে এটাই পথ।
ব্রনউইন ম্যাডক্স: আমি বলতে চাই, এটি অনেক রাজনীতিকের জন্যই কঠিন বিষয়, এটি আমি কোনো রকম ঠাট্টা করে বলছি না। কেউ কেউ বলতেই পারেন, ‘আপনার এই প্রক্রিয়া তো গণতন্ত্রের মৌলিক উপাদানকেই বাদ দিচ্ছে। ভোটারদের বিশ্বাস করুন। জনগণকে স্বাধীনভাবে সব দল ও মতবাদের মধ্যে থেকে বেছে নেওয়ার সুযোগ দিন। তাদের বিচার–বুদ্ধির ওপর আস্থা রাখুন। তাঁরা নিজেরাই ঠিক পথটি খুঁজে নেবেন।
অধ্যাপক ইউনূস: আমি নিজেও চাই, সবকিছু যদি শুধু ভোটারদের সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দেওয়া যেত! কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ যদি রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক কাঠামোর জটিল বিষয়গুলো—দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ কিংবা অনুপাতভিত্তিক ভোটব্যবস্থার মতো ধারণা পুরোপুরি বুঝত! উল্টো তারা বলবে, ‘আমরা এসব বুঝি না! আমি তোমাকে ভোট দেব, কয় টাকা দেবে?’—সহজ ভাষায় বললে বিষয়টি তা-ই—‘তুমি টাকা দাও, আমি ভোট দেব।’ দেশে ভোটের চর্চা সেটাই।
আমরা বলেছি, আমরা সেই চর্চায় ফিরতে চাই না। তাই আমরা ভিন্ন পথে হেঁটেছি। আমরা সবকিছু জনসমক্ষে করছি। এই সব বিতর্ক, সুপারিশ, সংলাপ প্রতিদিন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। মানুষ নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছে—কী আলোচনা হচ্ছে, কী ঝুঁকি আছে, কী সম্ভাবনা আছে।
আমাদের লক্ষ্য একদম স্পষ্ট—যেসব সংস্কার প্রস্তাবে সব রাজনৈতিক দলের সম্মতি রয়েছে, সেগুলো একত্র করে একটি ঐক্যমতের দলিল তৈরি করা। আমরা এটির নাম দিয়েছি ‘জুলাই সনদ’।
এই সনদ আগামী মাসে জাতির সামনে উপস্থাপন করব। এটি যখন চূড়ান্ত হবে এবং সব রাজনৈতিক দল স্বাক্ষর করবে, তখন আমরা এটিকে উদ্যাপন করব একটি জাতীয় ঐকমত্য হিসেবে। এর ভিত্তিতেই পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
তাই নির্বাচন আসলে আমাদের বৃহত্তর কর্মসূচির একটি অংশ। সেই বৃহৎ কর্মসূচির প্রথম স্তম্ভ হলো সংস্কার। আমাদের সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে পুরোনো প্রতিষ্ঠানগুলোই। তাই প্রতিটি প্রতিষ্ঠান নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে।
আমরা প্রধান প্রধান প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য পৃথক কমিশন গঠন করেছি। তারা যে সুপারিশগুলো করেছে, তা অনেক ক্ষেত্রে কঠিন, কিছুটা নাটকীয়ও। নির্বাচন কমিশন, সংসদ, সংবিধান, প্রশাসন—সবকিছু নিয়ে আমরা গভীরভাবে কাজ করছি।
পরবর্তী ধাপ হলো ঐকমত্যের ভিত্তি তৈরি। আমরা সব দলকে নিয়ে ঐকমত্য গঠনে কমিশন তৈরি করেছি। এ রকম কিছুর নাম হয়তো আপনি এর আগে শোনেননি। এই কমিশনের কাজ হলো সব দলের অংশগ্রহণে প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনা করে সেই সংস্কারগুলো খুঁজে বের করা, যেগুলো নিয়ে সমঝোতা সম্ভব।
হ্যাঁ, এটা সহজ নয়; বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরে ঐক্য তৈরি করা কঠিন কাজ। কিন্তু আমরা যদি সত্যিকার অর্থেই একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, স্থিতিশীল গণতন্ত্র গড়তে চাই, তাহলে এটাই প্রয়োজন।
ব্রনউইন ম্যাডক্স: আমি বিচারপ্রক্রিয়ার বিষয়ে পরে আসছি, তবে ‘জুলাই সনদ’ নিয়ে একটু কথা আছে। সমালোচকদের মতে, এই সনদ নিয়ে ঐকমত্য বাধ্যতামূলক করে আপনি কার্যত কিছু রাজনৈতিক দলকে—যেমন আওয়ামী লীগকে গোটা প্রক্রিয়া থেকেই বাদ দিয়ে দিচ্ছেন। তারা বলছে, আপনি জনগণের সামনে প্রকৃত কোনো বিকল্প তুলে ধরছেন না। তাদের চোখে, এই পুরো প্রক্রিয়া ‘ঐকমত্যের’ ভাষায় মোড়ানো একধরনের কর্তৃত্ববাদ।
অধ্যাপক ইউনূস: প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ। তবে আওয়ামী লীগকে এখন আর রাজনৈতিক দল হিসেবে গণ্য করা যায় কি না, সেই বিতর্ক তৈরি হয়েছে। যদি কোনো দল রাস্তায় তরুণদের গুলি করে মারে, মানুষকে গুম করে, রাষ্ট্রীয় অর্থ চুরি করে, তাহলে সেটিকে কি রাজনৈতিক দল বলা যায়? আমি কোনো ব্যক্তিগত রায় দিচ্ছি না, এটি একটি জাতীয় বিতর্ক।
গত ৫ আগস্ট যখন সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান, তখনই এই প্রশ্ন তীব্র হয়ে ওঠে। সেদিন পুরো বাংলাদেশে মানুষ রাস্তায় নেমে উৎসব করেছিল—তাদের মনে হয়েছিল, তারা মুক্ত। আমরা ভেবেছিলাম, ওই দিনই একটি অধ্যায়ের শেষ। সেই সাথে একটি অন্ধকার যুগও শেষ।
কিন্তু যারা পালিয়ে গেছে, তারা থামেনি। বিদেশ থেকে তারা সহিংসতা উসকে দিচ্ছে, বিশৃঙ্খলা ছড়াচ্ছে। এ প্রক্রিয়া এখনো চলছে। এই পুরো সময়জুড়ে দলটির কোনো সদস্য একটিবারও অনুশোচনা প্রকাশ করেনি; কেউ বলেনি, ‘আমার কষ্ট লাগছে কিংবা আমরা ভুল করেছি।’ তাই আমাদের জন্য অধ্যায়টি শেষ হলেও তাদের জন্য শেষ হয়নি।
এখনো তারা মাঠে-ময়দানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে, সেই তরুণদের ওপর হামলা করছে, যারা এই গণ-আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে। এ কারণেই জননিরাপত্তার স্বার্থে রাষ্ট্র আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে।
আমি স্পষ্ট করে বলছি, আমরা দলটিকে নিষিদ্ধ করিনি। কোনো স্থায়ী সিদ্ধান্ত নিইনি। আমরা শুধু বিচারপ্রক্রিয়ার ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করছি।
ব্রনউইন ম্যাডক্স: বিচারপ্রক্রিয়া মানে এই দলের নেতা-কর্মীদের বিচার?
অধ্যাপক ইউনূস: যেসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, তাদের সবার।
ব্রনউইন ম্যাডক্স: শেখ হাসিনা বর্তমানে ভারতের আশ্রয়ে একটি নিরাপদ স্থানে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। প্রশ্ন হলো—এই বিচারপর্ব কি নির্বাচিত সরকার আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারত না? অন্তর্বর্তী সরকার কেন এখনই এটি সম্পন্ন করতে চাইছে?
অধ্যাপক ইউনূস: এই সিদ্ধান্ত আমি একা নিইনি। যখন আমরা দায়িত্ব নিই, তখন গণ-আন্দোলনের নেতারা আমাদের তিনটি কাজের দায়িত্ব দেয়, আমরা সেটি গ্রহণ করি। এটা সেই দায়িত্বেরই একটি অংশ। আমরা শুধু আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করছি; আর কিছু না।
ব্রনউইন ম্যাডক্স: এই সময়কাল নিয়ে আরেকটি প্রশ্ন। আমি সংবাদমাধ্যমে দেখেছি, এই সময়ে বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হ্রাস পেয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আপনার জবাব কী?
অধ্যাপক ইউনূস: এই অভিযোগ মিথ্যা। সংবাদমাধ্যম আগে কখনো এত স্বাধীন ছিল না। তারা প্রতিদিন স্বাধীনভাবে সব কথা বলছে, তাদের কেউ থামাচ্ছে না।
ব্রনউইন ম্যাডক্স: এখন আমি আসতে চাই আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে—অর্থনীতি। যেকোনো সরকারের জন্যই অর্থনীতি পরিচালনা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। জটিল বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আপনি এই দায়িত্ব নিয়েছেন। তার মধ্যে এসেছে শুল্কযুদ্ধ, এই পরিবর্তন বাংলাদেশের ওপর কী প্রভাব ফেলেছে?
অধ্যাপক ইউনূস: আমাদের জন্য এটি সত্যিই কঠিন এক সময়। যখন বিশ্ব বাণিজ্য, শুল্ক ও সরবরাহব্যবস্থার সংকটে জর্জরিত, তখন আমরা একেবারে অন্য রকম সংকটে পড়েছি।
আমরা বলতে গেলে শূন্য থেকে নয়, ঋণাত্মক জায়গা থেকে শুরু করেছি। শূন্য হলে অন্তত কিছু থাকে; কিন্তু আমরা এমন একটি অবস্থায় ছিলাম, যেখানে কিছুই ছিল না।
এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে পূর্ববর্তী সরকারের তথাকথিত ‘মেগা প্রকল্প’ থেকে। প্রকল্পগুলোর বেশির ভাগই জনগণের উপকারের জন্য নয়, ব্যক্তিগত লাভের উদ্দেশ্যে তৈরি। এখন এসব প্রকল্পের অর্থায়ন চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে—দেনা পরিশোধের সময় হয়েছে। কিন্তু সরকারি কোষাগারে অর্থ নেই।
আমরা একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছি, যেখানে বলা হয়েছে, প্রায় ২৩৪ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে, যা ব্যাংক ও ব্যাংকের বাইরের বিভিন্ন উৎস থেকে আত্মসাৎ করা হয়েছে। এই অর্থ পাচারের ফলে ব্যাংকিং ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। রাজনৈতিক চাপ ও ভয়ভীতির মাধ্যমে ব্যাংকের পরিচালকেরা পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন, আর তাঁদের জায়গায় বসানো হয়েছে অনুগতদের। অনেকে কোনো জামানত ছাড়াই ঋণ পেয়েছেন এমন এক বোঝাপড়ায় যে এই ঋণ ফেরত দিতে হবে না।
এখন সেই ঋণদাতারা, ঠিকাদারেরা দাবি তুলেছে, তাদের অর্থ ফেরত দিতে হবে। না দিলে তারা আন্তর্জাতিক আদালতে যাবে, এটি সত্যিই এক ভয়াবহ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি।
তবুও এই সংকটের মধ্যেও একটি আশার আলো আছে—প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। বিশ্বজুড়ে, বিশেষ করে যুক্তরাজ্য, মধ্যপ্রাচ্য এবং আরও অনেক দেশে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশিরা টাকা পাঠিয়ে যাচ্ছেন। এই রেমিট্যান্স আমাদের দেশের অর্থনীতিকে এখনো টিকিয়ে রেখেছে। তাঁদের কারণেই আমাদের ব্যালান্স অব পেমেন্ট কিছুটা স্থিতিশীল হয়েছে।
ব্রনউইন ম্যাডক্স: আপনি ঠিকই বললেন, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স আমাদের জন্য জীবনরেখা হয়ে উঠেছে। কিন্তু আরেকটি বড় আন্তর্জাতিক অংশীদার আইএমএফ, এই মুহূর্তে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত। তারা স্পষ্টভাবে বলেছে, এই অন্তর্বর্তী সরকারকেই অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু করতে হবে।
বিশেষ করে তারা কর ব্যবস্থার সংস্কার চায়; কর-ভিত্তি প্রসার, রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি ও কর-ফাঁকি রোধ। আপনার কি মনে হয়, এই অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে এসব করা সম্ভব?
অধ্যাপক ইউনূস: প্রথমেই আমি যে বিষয়টি বলব, তা হলো বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সরকার আমাদের যে সমর্থন দিয়েছে, তা অভাবনীয়। অনেক দেশ থেকেই বলা হয়েছে, ‘আপনারা যা প্রয়োজন, জানিয়ে দিন, আমরা সাহায্য করতে প্রস্তুত।’
এটি আমাদের জন্য এক বিশাল নৈতিক অনুপ্রেরণা। এটি আমাদের আশ্বস্ত করেছে যে আমরা একা নই। যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, চীন—প্রতিটি বড় দেশের পক্ষ থেকেই আমাদের প্রতি সহানুভূতি জানানো হয়েছে। এই সংহতি আমাদের মনোবল বাড়িয়েছে।
আপনি আইএমএফের কথা বললেন—হ্যাঁ, তারা আমাদের পাশে রয়েছে, ঠিক যেমন বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও রয়েছে।
ব্রনওয়েন ম্যাডক্স: সবাই মনে হয় এমন প্রশংসামূলক শব্দ ব্যবহার করছে না, তাই আমি একটু...
অধ্যাপক ইউনূস: না, আমি বাস্তব অভিজ্ঞতার কথাই বলছি। আইএমএফ তখন যুক্ত হয়, যখন তারা অর্থ ছাড়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল। তারা জোর দিয়ে বলল, আমাদের অবশ্যই মুদ্রার বিনিময় হার বাজারে ছেড়ে দিতে হবে। আমরা এতে শঙ্কিত ছিলাম; কারণ, এত দিন ধরে সরকার-নিয়ন্ত্রিত বিনিময় হার বজায় রেখেছিলাম, যাতে বৈদেশিক মুদ্রা দ্রুত বেরিয়ে না যায়। এটিকে বাজারে ছেড়ে দেওয়া একটি বড় সিদ্ধান্ত ছিল।
আমরা অনেক আলোচনা করেছি। কিন্তু আইএমএফ বলল, ‘আমরা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেছি, আপনি এই ঝুঁকি নিতে পারেন।’ তখন আমরা একটি শর্তে সম্মত হই, যদি পরিস্থিতি খারাপ হয়, আমরা আবার আগের ব্যবস্থায় ফিরতে পারব। আইএমএফ এতে সম্মত হয় এবং আমরা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করি।
এরপর দেখা গেল পরিস্থিতি খুব বেশি খারাপ হয়নি। বিনিময় হার কিছুটা ওঠানামা করেছে, তবে সেটি স্বাভাবিক পর্যায়েই থেকেছে। এখন আমরা এটিকে একধরনের সাফল্য হিসেবে দেখছি। এটি প্রমাণ করে, আমাদের অর্থনীতি একেবারে ধ্বংসপ্রাপ্ত নয়।
তাই আমি বলব, আইএমএফ আমাদের বিপদে ফেলতে নয়, বরং সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়েছে। তারা বলেছে, ‘আপনারা পারবেন’,— আমরাও তা প্রমাণ করেছি। এ জন্য আমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।
ব্রনওয়েন ম্যাডক্স: আচ্ছা, এখন আমি জানতে চাই ভারত ও চীনের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে। শেখ হাসিনার আমলে ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, দিল্লির সঙ্গে আপনার সরকারের সম্পর্ক কিছুটা শীতল। আর চীনের সঙ্গে সম্পর্ক যেন একটু উষ্ণতর। আপনার মূল্যায়ন কী?
অধ্যাপক ইউনূস: আমরা সবার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাই। আমি আগেই বলেছি, পৃথিবীর সব দেশই আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, আমরা এ জন্য কৃতজ্ঞ। আমরা যেটা করছি, তা হলো—যেসব সহযোগিতা অতীতে পাওয়া যায়নি, এখন আমরা তা চাচ্ছি।
সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি আমরা মোকাবিলা করছি, তা হলো দুর্নীতি। বাংলাদেশ একটি দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। প্রশাসনের অনেক স্তর এতে জড়িত। এখন প্রশ্ন হলো, আমরা কীভাবে এই ব্যবস্থা পরিষ্কার করব? কী ধরনের সংস্কার আনতে হবে, যাতে সরকার দুর্নীতিমুক্ত হয়?
গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বৈঠকে এ বিষয়ে আমি বিশ্বের বিভিন্ন নেতার সঙ্গে আলোচনা করেছি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লেনের সঙ্গেও আমার কথা হয়েছিল। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আমাদের মতো দেশে এই দুর্নীতির দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী হতে পারে?’ তিনি হেসে বললেন, ‘আপনারা বিশ্বাস করবেন না, ইউরোপে এমন অনেক দেশ ছিল, যেখানে দুর্নীতি এর চেয়েও খারাপ ছিল।’
তাঁরা ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের লক্ষ্যে নিজেদের পরিষ্কার করতে বাধ্য হয়েছিল। এ জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল—সিস্টেম গড়ে তোলা হয়েছিল। আমরা সেখান থেকেই শিক্ষা নিচ্ছি—দুর্নীতি দমন করতে কীভাবে একটি কার্যকর ব্যবস্থাপনা কাঠামো গড়ে তোলা যায়।
ব্রনওয়েন ম্যাডক্স: তবে ইউরোপের দেশগুলোর ক্ষেত্রে চাপটা এসেছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের ইচ্ছা থেকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এমন কোনো চাপ আছে কি—রাজনীতি বা সমাজের পক্ষ থেকে?
অধ্যাপক ইউনূস: এই মুহূর্ত আমাদের জন্য ঐতিহাসিক। আমরা যদি এখন এটি না করতে পারি, তাহলে আর কোনো দিন পারব না। আমরা বিশ্বাস করি, এই মুহূর্ত আমাদের সামনে ইতিহাসের একটি জানালা খুলে দিয়েছে। অন্য কোনো সরকার এমন সুযোগ পায়নি; কারণ, তাদের ভোটের রাজনীতি আছে, পছন্দ-অপছন্দ আছে। আমাদের তেমন কিছু নেই। আমরা কারও ভোটে নির্বাচিত হইনি, কাউকে তুষ্ট করার দরকার নেই। এই নিরপেক্ষতা থেকেই আমাদের নৈতিক শক্তি আসে।

ব্রনওয়েন ম্যাডক্স: এই অল্প সময় ৯ বা ১০ মাসে আপনারা কীভাবে এটি করবেন? আমি জানি, দুর্নীতি আছে নাইজেরিয়ায়, দুর্নীতি প্রায় সব দেশেই সমস্যা। আপনি কী করছেন—একটু বলুন।
অধ্যাপক ইউনূস: আমি একটি উদাহরণ দিচ্ছি। ধরুন, কেউ পাসপোর্ট বানাতে গেল। তখন কেউ একজন বলে, ‘সরকারি প্রক্রিয়ায় গেলে কয়েক বছর লেগে যাবে—হয়তো পাবেনই না। আমাকে কিছু টাকা দিন, বাসায় পৌঁছে দেব।’ এই লোক আসলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার ‘মানুষ’।
মানে অফিশিয়াল ব্যবস্থা আসলে নিয়ন্ত্রিত হয় দালালদের মাধ্যমে। কর্মকর্তারা এই টাকার ভাগ পান। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এখন থেকে পাসপোর্ট অনলাইনে দেওয়া হবে। মানুষ খুশি—ভাবল, এবার বুঝি সত্যি সেবা মিলবে। কিন্তু দেখা গেল, অনলাইন ফর্ম খোলে না, সার্ভার ডাউন, কেউ ইচ্ছা করে জটিলতা তৈরি করে রেখেছে। ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত...
ব্রনওয়েন ম্যাডক্স: হ্যাঁ... অনেক দেশ প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে দালালনির্ভরতা কমাতে সফল হয়েছে...
অধ্যাপক ইউনূস: আমরাও সে পথেই এগোচ্ছি। আমরা ‘সরকারি’ শব্দটি ব্যবহার না করে ‘বাংলাদেশ সেবা কেন্দ্র’ নামে নতুন একটি উদ্যোগ চালু করেছি। এখানে প্রশিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা বসে থাকেন, কম্পিউটারে নানা ধরনের সরকারি সেবা দিয়ে থাকেন। গত কয়েক মাসে আমরা সব মন্ত্রণালয়কে প্রস্তুত করেছি, যাতে কর পরিশোধ, ড্রাইভিং লাইসেন্স, পাসপোর্ট নবায়ন, এমনকি জটিল ভূমি করের মতো বিষয়গুলো অনলাইনে করা যায়।
এই সেবাকেন্দ্রগুলো আমরা গত মাসে শুরু করেছি। কেউ কেন্দ্রে এলে স্পষ্টভাবে নির্ধারিত মূল্যের তালিকা দেখতে পাবেন। যত দ্রুত সেবা চান, তার ভিত্তিতে হয়তো আপনার বাসায় ডেলিভারি হবে, অথবা মেসেজ পেয়ে আপনি এসে নিয়ে যাবেন। এই মুহূর্তে আমাদের তিনটি কেন্দ্র চালু রয়েছে এবং আগামী এক মাসে অনেকগুলো চালু করার পরিকল্পনা আছে।
আমরা প্রতিটি মন্ত্রণালয়কে চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি—তোমরা কতগুলো সেবা অনলাইনে দিতে পারবে? কেউ বলছে ৫টি, কেউ ১০টি, কেউ আরও বেশি। আমরা বলি, যতগুলো পারো, দাও, আর আমরা স্টাফদের প্রশিক্ষণ দেব। কোথাও কোনো সমস্যা হলে আমরা একসঙ্গে বসে সমাধান করি। এটাই আমাদের কাজ।
এই অন্তর্বর্তী সরকারের লক্ষ্য হলো, আমাদের মেয়াদ শেষে দেশের সব নাগরিক যেন ঘরে বসেই সরকারি সেবা পেতে পারেন। গ্রামের গৃহিণী বা দূরের কোনো নারীর শহরে আসার দরকার পড়বে না। কম্পিউটার বা মোবাইল ফোন দিয়েই তিনি সেবা নিতে পারবেন।
আমরা এই যাত্রাপথ সম্পন্ন করতে চাই।
ব্রনওয়েন ম্যাডক্স: এই ব্যাখ্যার জন্য ধন্যবাদ—বলা যায়, এটি সত্যিই অনুপ্রেরণাদায়ক। এবার আমি আরও কঠিন একটি বিষয়ে আসতে চাই—রোহিঙ্গা সংকট। লাখ লাখ রোহিঙ্গা এখন শিবিরে বসবাস করছে। এখন কী পরিকল্পনা? কী হবে ভবিষ্যতে?
অধ্যাপক ইউনূস: এই প্রশ্নই আমি প্রথমে তুলেছিলাম দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই। রোহিঙ্গা নিয়ে আলোচনা বলতে গেলে কে খাবার দিচ্ছে, কারা শিশুদের পড়ালেখার খরচ দিচ্ছে—এ পর্যন্তই সীমিত। কিন্তু আমি বলেছি, তাদের ভবিষ্যৎ কী? কবে তারা ফিরবে? এই প্রশ্নই কেউ করছে না।
আন্তর্জাতিক কিছু সংস্থা সহায়তা দিচ্ছে বটে, কিন্তু প্রত্যাবাসনের জন্য কোনো রোডম্যাপ নেই।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে আমি সংশ্লিষ্ট দাতাদেশগুলোর সঙ্গে বিশেষ বৈঠক করেছিলাম। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনাদের কি কোনো রোডম্যাপ আছে? তারা বলল, না, এখনো কোনো পরিকল্পনা হয়নি। তখন আমি বলি, প্ল্যান করেন, সেটা ১০ বছর লাগুক, ২০ বছর লাগুক, একটা তারিখ অন্তত থাকুক। প্রতিবছর পার হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কোনো অগ্রগতি নেই।
আমরা এখন চেষ্টা করছি যেন নিরাপদে প্রত্যাবাসন সম্ভব হয়। তার মাঝেই হঠাৎ করে যুক্তরাষ্ট্র ইউএসএইডের সব অর্থ সহায়তা বন্ধ করে দিল। যেমন খাদ্য বাবদ মাথাপিছু ১২ ডলার দেওয়া হতো—সেটা বন্ধ। কেউ বলল ৬ ডলার করা হোক, কেউ বলল ৩ ডলার—কিন্তু ৩ ডলারে মাসে কী খাওয়ানো যায় কাউকে? আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বারবার বলেছি, ‘আপনারা বলেছিলেন রাখুন, আমরা রেখেছি। কিন্তু তাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব আপনাদের। একে আমাদের একক দায়িত্ব ভাববেন না।’
যুক্তরাজ্য এখনো আমাদের অন্যতম প্রধান সহায়ক, বিশেষ করে এই সংকটকালে।
আমরা সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের অধিবেশনের সঙ্গে মিলিয়ে রোহিঙ্গা ইস্যুতে একটি বৈশ্বিক সম্মেলন করার জন্য চাপ দিচ্ছি।

এদিকে মিয়ানমারে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটেছে। রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি এখন নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে, এটাই মূল রোহিঙ্গা-অধ্যুষিত এলাকা। ফলে সেখান থেকে প্রায় ২ লাখ নতুন রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে, ১২ লাখের বেশি হয়ে গেছে শরণার্থীর সংখ্যা।
সবচেয়ে বড় বিপদের বিষয় যেটা আমি তুলে ধরছি, তা হলো এই নতুন প্রজন্ম। যারা এসেছিল, তাদের বয়স তখন পাঁচ কিংবা এর কম ছিল—এখন সাত বছর পর তারা বারো বছর বয়সে পৌঁছেছে। প্রতিবছর শিবিরে প্রায় ৩৫ হাজার শিশু জন্ম নিচ্ছে। এই প্রজন্ম বেড়ে উঠছে কোনো পরিচয় ছাড়াই, আশাহীন অবস্থায়। তারা যেন একপ্রকার কারাগারে বাস করছে, অথচ তাদের হাতে মোবাইল, কম্পিউটার আছে—বিশ্ব দেখছে তারা।
এই অবস্থায় এমন এক প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে, যারা হতাশ, ক্ষুব্ধ এবং তাদের ভবিষ্যৎ নেই।
এই ক্ষোভ কোন পথে যাবে, সেটা এখনো বোঝা যাচ্ছে না। তবে এটা নিশ্চিত, যদি কিছু করা না হয়, তাহলে একদিন এর পরিণতি ভয়ংকর হবে।
আমি সবাইকে বলছি, আমাদের এই চূড়ান্ত বিস্ফোরণ থেকে বাঁচাতে সাহায্য করুন। এই শিশুরা প্রতিভাবান, সৃষ্টিশীল, কিন্তু তারা বন্দী অবস্থায় আছে। তাদের মা-বাবার কথা শুনে বড় হচ্ছে, কিন্তু নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতেই হবে।
ব্রনওয়েন ম্যাডক্স: তাহলে আপনার পরিকল্পনা এখনো প্রত্যাবাসনের দিকেই, তা-ই তো? তাদের বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে রাখার কোনো পরিকল্পনা নেই?
অধ্যাপক ইউনূস: না, সেটা একেবারেই অসম্ভব। শিবিরসংলগ্ন এলাকার মানুষ খুব বিরূপ এবং তাদের ক্ষোভটা কিছুটা যৌক্তিক। তারা দেখে, রোহিঙ্গারা সব কিছু বিনা মূল্যে পাচ্ছে, আর তারা নিজেরাই টিকে থাকার লড়াই করছে। তারা বলে, ‘তোমরা আমাদের চাকরি নিচ্ছ, খাবার নিচ্ছ, আমাদের জীবন কেড়ে নিচ্ছ। তোমরা নিজের দেশে যাও, আমাদের জীবনে হস্তক্ষেপ কোরো না।’
রোহিঙ্গাদের অনেকের কাছে শিবিরজীবন হয়তো মজার, অলস সময় কাটানোর মতো; কিন্তু স্থানীয় শিশুদের কঠিন বাস্তবতা আছে, যাদের কোনো সুযোগ নেই। এর ফলে একধরনের ক্ষোভ ও উত্তেজনা তৈরি হচ্ছে। সরকার এই মর্মে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে—রোহিঙ্গারা ফিরবে। তারা সেটা বোঝে। বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দল বা সরকার স্থায়ী বসবাসের পক্ষে নয়।
ব্রনওয়েন ম্যাডক্স: আপনার বক্তব্য পরিষ্কার। এখন অনলাইনে অনেকেই প্রশ্ন পাঠাচ্ছেন—আমি প্রশ্ন পর্বে যাচ্ছি।
ব্রনওয়েন ম্যাডক্স: আপনাদের সবাইকে চ্যাথাম হাউসে স্বাগত জানাচ্ছি। বিশেষভাবে স্বাগত জানাই বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে।
আমি ব্রনওয়েন ম্যাডক্স, চ্যাথাম হাউসের পরিচালক। দর্শকদের ভিড় এবং আগ্রহ দেখে বোঝা যায়, ইউনূস সাহেবকে আলাদাভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার খুব একটা প্রয়োজন নেই।
আপনারা জানেন, অধ্যাপক ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা। এই উদ্যোগের জন্য তিনি এবং তাঁর প্রতিষ্ঠান ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান। এরপর তিনি ৫০টির বেশি সামাজিক ব্যবসা উদ্যোগ গড়ে তুলেছেন।
২০২৪ সালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট ও দীর্ঘদিনের শাসনামলের অবসানের পর আন্দোলনকারীরা তাঁকে অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব দেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি সেই দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং এখন বাংলাদেশের নতুন যাত্রার নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
আজকের আলোচনায় থাকছে নির্বাচন, গণমাধ্যম, অর্থনীতি, জলবায়ু পরিবর্তন, যুব উন্নয়ন, রোহিঙ্গা সংকট ও আন্তর্জাতিক কূটনীতি—সবকিছু।
এই অনুষ্ঠান চ্যাথাম হাউস রুল বা চ্যাথাম হাউসের নীতিসংশ্লিষ্ট নয়। এটি সরাসরি সম্প্রচারিত হচ্ছে এবং সম্পূর্ণ অন দ্য রেকর্ড।
অধ্যাপক ইউনূস: আমাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য অনেক ধন্যবাদ।
আমি বহুবার লন্ডনে এসেছি—বিভিন্ন ভূমিকায়। প্রথম এসেছিলাম ১৯৫৫ সালে, কানাডায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব স্কাউট জাম্বুরি শেষে। সেবার বিবিসির একটি বাংলা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে দুই গিনি সম্মানী পেয়েছিলাম, এখনো মনে আছে!
এরপর বহুবার এসেছি মাইক্রোক্রেডিট, সামাজিক ব্যবসা, তরুণদের নেতৃত্ব এবং আমার তিনটি শূন্যের দর্শন প্রচারে—শূন্য কার্বন নির্গমন, শূন্য সম্পদের কেন্দ্রীকরণ, শূন্য বেকারত্ব।
আমার বিশ্বাস, বর্তমান সভ্যতা ভুল পথে হাঁটছে—এটি আত্মবিনাশী। আমাদের টিকে থাকতে হলে নতুন এক সভ্যতা গড়ে তুলতে হবে এই তিন শূন্যের ভিত্তিতে।
এটি নিছক তাত্ত্বিক নয়, আমার জীবনের অভিজ্ঞতা ও বাস্তব কাজের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে।
তবে এবার এসেছি এক ভিন্ন ভূমিকায়—সরকারপ্রধান হিসেবে। এটি আমার জীবনে এক অনাকাঙ্ক্ষিত অধ্যায়, যা আমি কখনো ভাবিনি। কিন্তু এখন সেই দায়িত্বেই আছি। তাই আজকের আলোচনা সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই হবে।
ব্রনওয়েন ম্যাডক্স: ধন্যবাদ। আমরা জানি, আপনি ব্রিটেনের রাজা চার্লসের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছেন পরিবেশ ও সামাজিক উদ্যোগ নিয়ে। আবার বর্তমান দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবেও সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আপনার বৈঠক হয়েছে।
চলুন, আমরা মূল আলোচনায় যাই, শুরুতেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্বাচন। আপনি সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছেন, আগামী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২০২৫ সালের এপ্রিলে। কিন্তু সেনাবাহিনী ও কিছু রাজনৈতিক মহল চায়, নির্বাচন হোক চলতি বছরের মধ্যেই। অন্যদিকে আপনার সরকার আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ দিচ্ছে না, যা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচনা শুরু হয়েছে। আপনার জবাব কী?
অধ্যাপক ইউনূস: আমি বারবার বলেছি, এটি হবে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সুন্দর নির্বাচন। সময় উপযোগী নির্বাচন। দীর্ঘ ১৭ বছর পর আমরা একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক নির্বাচন করতে যাচ্ছি। এটি শুধু রাজনৈতিক ঘটনা নয়, এটি এক ঐতিহাসিক সুযোগ।
ধরুন, এক তরুণ ১৭ বছর আগে ভোটার হতে পেরেছে, কিন্তু কখনো ভোট দিতে পারেনি। এমন হাজারো তরুণ এখন প্রথমবারের মতো ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবে। তারা বলছে, ‘এবার আমার সিদ্ধান্তই মুখ্য। আমার ভোটেই গঠিত হবে বাংলাদেশ।’
এই তারুণ্যের শক্তি কাজে লাগাতে চাই আমরা। নির্বাচন শুধু সরকার গঠনের জন্য নয়, এটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার রেফারেন্ডাম। তরুণদের রক্ত আর আত্মত্যাগে আমরা ঋণী। আমরা সেই আত্মত্যাগকে সম্মান জানাতে চাই।
এই নতুন বাংলাদেশের ভিত্তি স্থাপিত হচ্ছে তিনটি মূল স্তম্ভে—
১. সংস্থার সংস্কার: যেসব প্রতিষ্ঠান সংকট তৈরি করেছে, সেগুলোর কাঠামোগত রূপান্তর দরকার। আমরা এর জন্য আলাদা আলাদা কমিশন গঠন করেছি—সংবিধান, সংসদ, নির্বাচন ব্যবস্থা, সিভিল সার্ভিসসহ প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সংস্কারের জন্য। কমিশনগুলোর সুপারিশ হাতে এসেছে। এগুলো শুধু সামান্য সংস্কার নয়, গভীর পরিবর্তনের প্রস্তাব রয়েছে।
২. আলোচনা ও ঐকমত্য: সংস্কারের আগে দরকার সর্বদলীয় ঐকমত্য। এ জন্যই আমরা গঠন করেছি ‘ঐকমত্য কমিশন’। এই কমিশনের কাজ হলো বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে বাস্তবসম্মত ও গ্রহণযোগ্য সংস্কার প্রস্তাব চূড়ান্ত করা। হয়তো বিশ্বের কোথাও এ ধরনের উদ্যোগ খুব একটা দেখা যায় না। তবে বাংলাদেশের মতো জটিল রাজনৈতিক বাস্তবতায় এটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
৩. নতুন ভবিষ্যৎ নির্মাণ: আমরা চাই একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই গণতন্ত্র। অবশ্যই এটি সহজ নয়—বাংলাদেশের রাজনীতিকদের মধ্যে ঐকমত্য গড়ে তোলা কঠিন কাজ। কিন্তু আমরা যদি সত্যিই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই, তাহলে এটাই পথ।
ব্রনউইন ম্যাডক্স: আমি বলতে চাই, এটি অনেক রাজনীতিকের জন্যই কঠিন বিষয়, এটি আমি কোনো রকম ঠাট্টা করে বলছি না। কেউ কেউ বলতেই পারেন, ‘আপনার এই প্রক্রিয়া তো গণতন্ত্রের মৌলিক উপাদানকেই বাদ দিচ্ছে। ভোটারদের বিশ্বাস করুন। জনগণকে স্বাধীনভাবে সব দল ও মতবাদের মধ্যে থেকে বেছে নেওয়ার সুযোগ দিন। তাদের বিচার–বুদ্ধির ওপর আস্থা রাখুন। তাঁরা নিজেরাই ঠিক পথটি খুঁজে নেবেন।
অধ্যাপক ইউনূস: আমি নিজেও চাই, সবকিছু যদি শুধু ভোটারদের সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দেওয়া যেত! কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ যদি রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক কাঠামোর জটিল বিষয়গুলো—দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ কিংবা অনুপাতভিত্তিক ভোটব্যবস্থার মতো ধারণা পুরোপুরি বুঝত! উল্টো তারা বলবে, ‘আমরা এসব বুঝি না! আমি তোমাকে ভোট দেব, কয় টাকা দেবে?’—সহজ ভাষায় বললে বিষয়টি তা-ই—‘তুমি টাকা দাও, আমি ভোট দেব।’ দেশে ভোটের চর্চা সেটাই।
আমরা বলেছি, আমরা সেই চর্চায় ফিরতে চাই না। তাই আমরা ভিন্ন পথে হেঁটেছি। আমরা সবকিছু জনসমক্ষে করছি। এই সব বিতর্ক, সুপারিশ, সংলাপ প্রতিদিন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। মানুষ নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছে—কী আলোচনা হচ্ছে, কী ঝুঁকি আছে, কী সম্ভাবনা আছে।
আমাদের লক্ষ্য একদম স্পষ্ট—যেসব সংস্কার প্রস্তাবে সব রাজনৈতিক দলের সম্মতি রয়েছে, সেগুলো একত্র করে একটি ঐক্যমতের দলিল তৈরি করা। আমরা এটির নাম দিয়েছি ‘জুলাই সনদ’।
এই সনদ আগামী মাসে জাতির সামনে উপস্থাপন করব। এটি যখন চূড়ান্ত হবে এবং সব রাজনৈতিক দল স্বাক্ষর করবে, তখন আমরা এটিকে উদ্যাপন করব একটি জাতীয় ঐকমত্য হিসেবে। এর ভিত্তিতেই পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
তাই নির্বাচন আসলে আমাদের বৃহত্তর কর্মসূচির একটি অংশ। সেই বৃহৎ কর্মসূচির প্রথম স্তম্ভ হলো সংস্কার। আমাদের সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে পুরোনো প্রতিষ্ঠানগুলোই। তাই প্রতিটি প্রতিষ্ঠান নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে।
আমরা প্রধান প্রধান প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য পৃথক কমিশন গঠন করেছি। তারা যে সুপারিশগুলো করেছে, তা অনেক ক্ষেত্রে কঠিন, কিছুটা নাটকীয়ও। নির্বাচন কমিশন, সংসদ, সংবিধান, প্রশাসন—সবকিছু নিয়ে আমরা গভীরভাবে কাজ করছি।
পরবর্তী ধাপ হলো ঐকমত্যের ভিত্তি তৈরি। আমরা সব দলকে নিয়ে ঐকমত্য গঠনে কমিশন তৈরি করেছি। এ রকম কিছুর নাম হয়তো আপনি এর আগে শোনেননি। এই কমিশনের কাজ হলো সব দলের অংশগ্রহণে প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনা করে সেই সংস্কারগুলো খুঁজে বের করা, যেগুলো নিয়ে সমঝোতা সম্ভব।
হ্যাঁ, এটা সহজ নয়; বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরে ঐক্য তৈরি করা কঠিন কাজ। কিন্তু আমরা যদি সত্যিকার অর্থেই একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, স্থিতিশীল গণতন্ত্র গড়তে চাই, তাহলে এটাই প্রয়োজন।
ব্রনউইন ম্যাডক্স: আমি বিচারপ্রক্রিয়ার বিষয়ে পরে আসছি, তবে ‘জুলাই সনদ’ নিয়ে একটু কথা আছে। সমালোচকদের মতে, এই সনদ নিয়ে ঐকমত্য বাধ্যতামূলক করে আপনি কার্যত কিছু রাজনৈতিক দলকে—যেমন আওয়ামী লীগকে গোটা প্রক্রিয়া থেকেই বাদ দিয়ে দিচ্ছেন। তারা বলছে, আপনি জনগণের সামনে প্রকৃত কোনো বিকল্প তুলে ধরছেন না। তাদের চোখে, এই পুরো প্রক্রিয়া ‘ঐকমত্যের’ ভাষায় মোড়ানো একধরনের কর্তৃত্ববাদ।
অধ্যাপক ইউনূস: প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ। তবে আওয়ামী লীগকে এখন আর রাজনৈতিক দল হিসেবে গণ্য করা যায় কি না, সেই বিতর্ক তৈরি হয়েছে। যদি কোনো দল রাস্তায় তরুণদের গুলি করে মারে, মানুষকে গুম করে, রাষ্ট্রীয় অর্থ চুরি করে, তাহলে সেটিকে কি রাজনৈতিক দল বলা যায়? আমি কোনো ব্যক্তিগত রায় দিচ্ছি না, এটি একটি জাতীয় বিতর্ক।
গত ৫ আগস্ট যখন সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান, তখনই এই প্রশ্ন তীব্র হয়ে ওঠে। সেদিন পুরো বাংলাদেশে মানুষ রাস্তায় নেমে উৎসব করেছিল—তাদের মনে হয়েছিল, তারা মুক্ত। আমরা ভেবেছিলাম, ওই দিনই একটি অধ্যায়ের শেষ। সেই সাথে একটি অন্ধকার যুগও শেষ।
কিন্তু যারা পালিয়ে গেছে, তারা থামেনি। বিদেশ থেকে তারা সহিংসতা উসকে দিচ্ছে, বিশৃঙ্খলা ছড়াচ্ছে। এ প্রক্রিয়া এখনো চলছে। এই পুরো সময়জুড়ে দলটির কোনো সদস্য একটিবারও অনুশোচনা প্রকাশ করেনি; কেউ বলেনি, ‘আমার কষ্ট লাগছে কিংবা আমরা ভুল করেছি।’ তাই আমাদের জন্য অধ্যায়টি শেষ হলেও তাদের জন্য শেষ হয়নি।
এখনো তারা মাঠে-ময়দানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে, সেই তরুণদের ওপর হামলা করছে, যারা এই গণ-আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে। এ কারণেই জননিরাপত্তার স্বার্থে রাষ্ট্র আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে।
আমি স্পষ্ট করে বলছি, আমরা দলটিকে নিষিদ্ধ করিনি। কোনো স্থায়ী সিদ্ধান্ত নিইনি। আমরা শুধু বিচারপ্রক্রিয়ার ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করছি।
ব্রনউইন ম্যাডক্স: বিচারপ্রক্রিয়া মানে এই দলের নেতা-কর্মীদের বিচার?
অধ্যাপক ইউনূস: যেসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, তাদের সবার।
ব্রনউইন ম্যাডক্স: শেখ হাসিনা বর্তমানে ভারতের আশ্রয়ে একটি নিরাপদ স্থানে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। প্রশ্ন হলো—এই বিচারপর্ব কি নির্বাচিত সরকার আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারত না? অন্তর্বর্তী সরকার কেন এখনই এটি সম্পন্ন করতে চাইছে?
অধ্যাপক ইউনূস: এই সিদ্ধান্ত আমি একা নিইনি। যখন আমরা দায়িত্ব নিই, তখন গণ-আন্দোলনের নেতারা আমাদের তিনটি কাজের দায়িত্ব দেয়, আমরা সেটি গ্রহণ করি। এটা সেই দায়িত্বেরই একটি অংশ। আমরা শুধু আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করছি; আর কিছু না।
ব্রনউইন ম্যাডক্স: এই সময়কাল নিয়ে আরেকটি প্রশ্ন। আমি সংবাদমাধ্যমে দেখেছি, এই সময়ে বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হ্রাস পেয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আপনার জবাব কী?
অধ্যাপক ইউনূস: এই অভিযোগ মিথ্যা। সংবাদমাধ্যম আগে কখনো এত স্বাধীন ছিল না। তারা প্রতিদিন স্বাধীনভাবে সব কথা বলছে, তাদের কেউ থামাচ্ছে না।
ব্রনউইন ম্যাডক্স: এখন আমি আসতে চাই আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে—অর্থনীতি। যেকোনো সরকারের জন্যই অর্থনীতি পরিচালনা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। জটিল বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আপনি এই দায়িত্ব নিয়েছেন। তার মধ্যে এসেছে শুল্কযুদ্ধ, এই পরিবর্তন বাংলাদেশের ওপর কী প্রভাব ফেলেছে?
অধ্যাপক ইউনূস: আমাদের জন্য এটি সত্যিই কঠিন এক সময়। যখন বিশ্ব বাণিজ্য, শুল্ক ও সরবরাহব্যবস্থার সংকটে জর্জরিত, তখন আমরা একেবারে অন্য রকম সংকটে পড়েছি।
আমরা বলতে গেলে শূন্য থেকে নয়, ঋণাত্মক জায়গা থেকে শুরু করেছি। শূন্য হলে অন্তত কিছু থাকে; কিন্তু আমরা এমন একটি অবস্থায় ছিলাম, যেখানে কিছুই ছিল না।
এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে পূর্ববর্তী সরকারের তথাকথিত ‘মেগা প্রকল্প’ থেকে। প্রকল্পগুলোর বেশির ভাগই জনগণের উপকারের জন্য নয়, ব্যক্তিগত লাভের উদ্দেশ্যে তৈরি। এখন এসব প্রকল্পের অর্থায়ন চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে—দেনা পরিশোধের সময় হয়েছে। কিন্তু সরকারি কোষাগারে অর্থ নেই।
আমরা একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছি, যেখানে বলা হয়েছে, প্রায় ২৩৪ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে, যা ব্যাংক ও ব্যাংকের বাইরের বিভিন্ন উৎস থেকে আত্মসাৎ করা হয়েছে। এই অর্থ পাচারের ফলে ব্যাংকিং ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। রাজনৈতিক চাপ ও ভয়ভীতির মাধ্যমে ব্যাংকের পরিচালকেরা পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন, আর তাঁদের জায়গায় বসানো হয়েছে অনুগতদের। অনেকে কোনো জামানত ছাড়াই ঋণ পেয়েছেন এমন এক বোঝাপড়ায় যে এই ঋণ ফেরত দিতে হবে না।
এখন সেই ঋণদাতারা, ঠিকাদারেরা দাবি তুলেছে, তাদের অর্থ ফেরত দিতে হবে। না দিলে তারা আন্তর্জাতিক আদালতে যাবে, এটি সত্যিই এক ভয়াবহ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি।
তবুও এই সংকটের মধ্যেও একটি আশার আলো আছে—প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। বিশ্বজুড়ে, বিশেষ করে যুক্তরাজ্য, মধ্যপ্রাচ্য এবং আরও অনেক দেশে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশিরা টাকা পাঠিয়ে যাচ্ছেন। এই রেমিট্যান্স আমাদের দেশের অর্থনীতিকে এখনো টিকিয়ে রেখেছে। তাঁদের কারণেই আমাদের ব্যালান্স অব পেমেন্ট কিছুটা স্থিতিশীল হয়েছে।
ব্রনউইন ম্যাডক্স: আপনি ঠিকই বললেন, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স আমাদের জন্য জীবনরেখা হয়ে উঠেছে। কিন্তু আরেকটি বড় আন্তর্জাতিক অংশীদার আইএমএফ, এই মুহূর্তে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত। তারা স্পষ্টভাবে বলেছে, এই অন্তর্বর্তী সরকারকেই অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু করতে হবে।
বিশেষ করে তারা কর ব্যবস্থার সংস্কার চায়; কর-ভিত্তি প্রসার, রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি ও কর-ফাঁকি রোধ। আপনার কি মনে হয়, এই অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে এসব করা সম্ভব?
অধ্যাপক ইউনূস: প্রথমেই আমি যে বিষয়টি বলব, তা হলো বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সরকার আমাদের যে সমর্থন দিয়েছে, তা অভাবনীয়। অনেক দেশ থেকেই বলা হয়েছে, ‘আপনারা যা প্রয়োজন, জানিয়ে দিন, আমরা সাহায্য করতে প্রস্তুত।’
এটি আমাদের জন্য এক বিশাল নৈতিক অনুপ্রেরণা। এটি আমাদের আশ্বস্ত করেছে যে আমরা একা নই। যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, চীন—প্রতিটি বড় দেশের পক্ষ থেকেই আমাদের প্রতি সহানুভূতি জানানো হয়েছে। এই সংহতি আমাদের মনোবল বাড়িয়েছে।
আপনি আইএমএফের কথা বললেন—হ্যাঁ, তারা আমাদের পাশে রয়েছে, ঠিক যেমন বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও রয়েছে।
ব্রনওয়েন ম্যাডক্স: সবাই মনে হয় এমন প্রশংসামূলক শব্দ ব্যবহার করছে না, তাই আমি একটু...
অধ্যাপক ইউনূস: না, আমি বাস্তব অভিজ্ঞতার কথাই বলছি। আইএমএফ তখন যুক্ত হয়, যখন তারা অর্থ ছাড়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল। তারা জোর দিয়ে বলল, আমাদের অবশ্যই মুদ্রার বিনিময় হার বাজারে ছেড়ে দিতে হবে। আমরা এতে শঙ্কিত ছিলাম; কারণ, এত দিন ধরে সরকার-নিয়ন্ত্রিত বিনিময় হার বজায় রেখেছিলাম, যাতে বৈদেশিক মুদ্রা দ্রুত বেরিয়ে না যায়। এটিকে বাজারে ছেড়ে দেওয়া একটি বড় সিদ্ধান্ত ছিল।
আমরা অনেক আলোচনা করেছি। কিন্তু আইএমএফ বলল, ‘আমরা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেছি, আপনি এই ঝুঁকি নিতে পারেন।’ তখন আমরা একটি শর্তে সম্মত হই, যদি পরিস্থিতি খারাপ হয়, আমরা আবার আগের ব্যবস্থায় ফিরতে পারব। আইএমএফ এতে সম্মত হয় এবং আমরা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করি।
এরপর দেখা গেল পরিস্থিতি খুব বেশি খারাপ হয়নি। বিনিময় হার কিছুটা ওঠানামা করেছে, তবে সেটি স্বাভাবিক পর্যায়েই থেকেছে। এখন আমরা এটিকে একধরনের সাফল্য হিসেবে দেখছি। এটি প্রমাণ করে, আমাদের অর্থনীতি একেবারে ধ্বংসপ্রাপ্ত নয়।
তাই আমি বলব, আইএমএফ আমাদের বিপদে ফেলতে নয়, বরং সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়েছে। তারা বলেছে, ‘আপনারা পারবেন’,— আমরাও তা প্রমাণ করেছি। এ জন্য আমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।
ব্রনওয়েন ম্যাডক্স: আচ্ছা, এখন আমি জানতে চাই ভারত ও চীনের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে। শেখ হাসিনার আমলে ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, দিল্লির সঙ্গে আপনার সরকারের সম্পর্ক কিছুটা শীতল। আর চীনের সঙ্গে সম্পর্ক যেন একটু উষ্ণতর। আপনার মূল্যায়ন কী?
অধ্যাপক ইউনূস: আমরা সবার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাই। আমি আগেই বলেছি, পৃথিবীর সব দেশই আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, আমরা এ জন্য কৃতজ্ঞ। আমরা যেটা করছি, তা হলো—যেসব সহযোগিতা অতীতে পাওয়া যায়নি, এখন আমরা তা চাচ্ছি।
সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি আমরা মোকাবিলা করছি, তা হলো দুর্নীতি। বাংলাদেশ একটি দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। প্রশাসনের অনেক স্তর এতে জড়িত। এখন প্রশ্ন হলো, আমরা কীভাবে এই ব্যবস্থা পরিষ্কার করব? কী ধরনের সংস্কার আনতে হবে, যাতে সরকার দুর্নীতিমুক্ত হয়?
গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বৈঠকে এ বিষয়ে আমি বিশ্বের বিভিন্ন নেতার সঙ্গে আলোচনা করেছি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লেনের সঙ্গেও আমার কথা হয়েছিল। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আমাদের মতো দেশে এই দুর্নীতির দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী হতে পারে?’ তিনি হেসে বললেন, ‘আপনারা বিশ্বাস করবেন না, ইউরোপে এমন অনেক দেশ ছিল, যেখানে দুর্নীতি এর চেয়েও খারাপ ছিল।’
তাঁরা ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের লক্ষ্যে নিজেদের পরিষ্কার করতে বাধ্য হয়েছিল। এ জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল—সিস্টেম গড়ে তোলা হয়েছিল। আমরা সেখান থেকেই শিক্ষা নিচ্ছি—দুর্নীতি দমন করতে কীভাবে একটি কার্যকর ব্যবস্থাপনা কাঠামো গড়ে তোলা যায়।
ব্রনওয়েন ম্যাডক্স: তবে ইউরোপের দেশগুলোর ক্ষেত্রে চাপটা এসেছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের ইচ্ছা থেকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এমন কোনো চাপ আছে কি—রাজনীতি বা সমাজের পক্ষ থেকে?
অধ্যাপক ইউনূস: এই মুহূর্ত আমাদের জন্য ঐতিহাসিক। আমরা যদি এখন এটি না করতে পারি, তাহলে আর কোনো দিন পারব না। আমরা বিশ্বাস করি, এই মুহূর্ত আমাদের সামনে ইতিহাসের একটি জানালা খুলে দিয়েছে। অন্য কোনো সরকার এমন সুযোগ পায়নি; কারণ, তাদের ভোটের রাজনীতি আছে, পছন্দ-অপছন্দ আছে। আমাদের তেমন কিছু নেই। আমরা কারও ভোটে নির্বাচিত হইনি, কাউকে তুষ্ট করার দরকার নেই। এই নিরপেক্ষতা থেকেই আমাদের নৈতিক শক্তি আসে।

ব্রনওয়েন ম্যাডক্স: এই অল্প সময় ৯ বা ১০ মাসে আপনারা কীভাবে এটি করবেন? আমি জানি, দুর্নীতি আছে নাইজেরিয়ায়, দুর্নীতি প্রায় সব দেশেই সমস্যা। আপনি কী করছেন—একটু বলুন।
অধ্যাপক ইউনূস: আমি একটি উদাহরণ দিচ্ছি। ধরুন, কেউ পাসপোর্ট বানাতে গেল। তখন কেউ একজন বলে, ‘সরকারি প্রক্রিয়ায় গেলে কয়েক বছর লেগে যাবে—হয়তো পাবেনই না। আমাকে কিছু টাকা দিন, বাসায় পৌঁছে দেব।’ এই লোক আসলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার ‘মানুষ’।
মানে অফিশিয়াল ব্যবস্থা আসলে নিয়ন্ত্রিত হয় দালালদের মাধ্যমে। কর্মকর্তারা এই টাকার ভাগ পান। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এখন থেকে পাসপোর্ট অনলাইনে দেওয়া হবে। মানুষ খুশি—ভাবল, এবার বুঝি সত্যি সেবা মিলবে। কিন্তু দেখা গেল, অনলাইন ফর্ম খোলে না, সার্ভার ডাউন, কেউ ইচ্ছা করে জটিলতা তৈরি করে রেখেছে। ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত...
ব্রনওয়েন ম্যাডক্স: হ্যাঁ... অনেক দেশ প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে দালালনির্ভরতা কমাতে সফল হয়েছে...
অধ্যাপক ইউনূস: আমরাও সে পথেই এগোচ্ছি। আমরা ‘সরকারি’ শব্দটি ব্যবহার না করে ‘বাংলাদেশ সেবা কেন্দ্র’ নামে নতুন একটি উদ্যোগ চালু করেছি। এখানে প্রশিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা বসে থাকেন, কম্পিউটারে নানা ধরনের সরকারি সেবা দিয়ে থাকেন। গত কয়েক মাসে আমরা সব মন্ত্রণালয়কে প্রস্তুত করেছি, যাতে কর পরিশোধ, ড্রাইভিং লাইসেন্স, পাসপোর্ট নবায়ন, এমনকি জটিল ভূমি করের মতো বিষয়গুলো অনলাইনে করা যায়।
এই সেবাকেন্দ্রগুলো আমরা গত মাসে শুরু করেছি। কেউ কেন্দ্রে এলে স্পষ্টভাবে নির্ধারিত মূল্যের তালিকা দেখতে পাবেন। যত দ্রুত সেবা চান, তার ভিত্তিতে হয়তো আপনার বাসায় ডেলিভারি হবে, অথবা মেসেজ পেয়ে আপনি এসে নিয়ে যাবেন। এই মুহূর্তে আমাদের তিনটি কেন্দ্র চালু রয়েছে এবং আগামী এক মাসে অনেকগুলো চালু করার পরিকল্পনা আছে।
আমরা প্রতিটি মন্ত্রণালয়কে চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি—তোমরা কতগুলো সেবা অনলাইনে দিতে পারবে? কেউ বলছে ৫টি, কেউ ১০টি, কেউ আরও বেশি। আমরা বলি, যতগুলো পারো, দাও, আর আমরা স্টাফদের প্রশিক্ষণ দেব। কোথাও কোনো সমস্যা হলে আমরা একসঙ্গে বসে সমাধান করি। এটাই আমাদের কাজ।
এই অন্তর্বর্তী সরকারের লক্ষ্য হলো, আমাদের মেয়াদ শেষে দেশের সব নাগরিক যেন ঘরে বসেই সরকারি সেবা পেতে পারেন। গ্রামের গৃহিণী বা দূরের কোনো নারীর শহরে আসার দরকার পড়বে না। কম্পিউটার বা মোবাইল ফোন দিয়েই তিনি সেবা নিতে পারবেন।
আমরা এই যাত্রাপথ সম্পন্ন করতে চাই।
ব্রনওয়েন ম্যাডক্স: এই ব্যাখ্যার জন্য ধন্যবাদ—বলা যায়, এটি সত্যিই অনুপ্রেরণাদায়ক। এবার আমি আরও কঠিন একটি বিষয়ে আসতে চাই—রোহিঙ্গা সংকট। লাখ লাখ রোহিঙ্গা এখন শিবিরে বসবাস করছে। এখন কী পরিকল্পনা? কী হবে ভবিষ্যতে?
অধ্যাপক ইউনূস: এই প্রশ্নই আমি প্রথমে তুলেছিলাম দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই। রোহিঙ্গা নিয়ে আলোচনা বলতে গেলে কে খাবার দিচ্ছে, কারা শিশুদের পড়ালেখার খরচ দিচ্ছে—এ পর্যন্তই সীমিত। কিন্তু আমি বলেছি, তাদের ভবিষ্যৎ কী? কবে তারা ফিরবে? এই প্রশ্নই কেউ করছে না।
আন্তর্জাতিক কিছু সংস্থা সহায়তা দিচ্ছে বটে, কিন্তু প্রত্যাবাসনের জন্য কোনো রোডম্যাপ নেই।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে আমি সংশ্লিষ্ট দাতাদেশগুলোর সঙ্গে বিশেষ বৈঠক করেছিলাম। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনাদের কি কোনো রোডম্যাপ আছে? তারা বলল, না, এখনো কোনো পরিকল্পনা হয়নি। তখন আমি বলি, প্ল্যান করেন, সেটা ১০ বছর লাগুক, ২০ বছর লাগুক, একটা তারিখ অন্তত থাকুক। প্রতিবছর পার হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কোনো অগ্রগতি নেই।
আমরা এখন চেষ্টা করছি যেন নিরাপদে প্রত্যাবাসন সম্ভব হয়। তার মাঝেই হঠাৎ করে যুক্তরাষ্ট্র ইউএসএইডের সব অর্থ সহায়তা বন্ধ করে দিল। যেমন খাদ্য বাবদ মাথাপিছু ১২ ডলার দেওয়া হতো—সেটা বন্ধ। কেউ বলল ৬ ডলার করা হোক, কেউ বলল ৩ ডলার—কিন্তু ৩ ডলারে মাসে কী খাওয়ানো যায় কাউকে? আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বারবার বলেছি, ‘আপনারা বলেছিলেন রাখুন, আমরা রেখেছি। কিন্তু তাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব আপনাদের। একে আমাদের একক দায়িত্ব ভাববেন না।’
যুক্তরাজ্য এখনো আমাদের অন্যতম প্রধান সহায়ক, বিশেষ করে এই সংকটকালে।
আমরা সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের অধিবেশনের সঙ্গে মিলিয়ে রোহিঙ্গা ইস্যুতে একটি বৈশ্বিক সম্মেলন করার জন্য চাপ দিচ্ছি।

এদিকে মিয়ানমারে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটেছে। রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি এখন নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে, এটাই মূল রোহিঙ্গা-অধ্যুষিত এলাকা। ফলে সেখান থেকে প্রায় ২ লাখ নতুন রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে, ১২ লাখের বেশি হয়ে গেছে শরণার্থীর সংখ্যা।
সবচেয়ে বড় বিপদের বিষয় যেটা আমি তুলে ধরছি, তা হলো এই নতুন প্রজন্ম। যারা এসেছিল, তাদের বয়স তখন পাঁচ কিংবা এর কম ছিল—এখন সাত বছর পর তারা বারো বছর বয়সে পৌঁছেছে। প্রতিবছর শিবিরে প্রায় ৩৫ হাজার শিশু জন্ম নিচ্ছে। এই প্রজন্ম বেড়ে উঠছে কোনো পরিচয় ছাড়াই, আশাহীন অবস্থায়। তারা যেন একপ্রকার কারাগারে বাস করছে, অথচ তাদের হাতে মোবাইল, কম্পিউটার আছে—বিশ্ব দেখছে তারা।
এই অবস্থায় এমন এক প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে, যারা হতাশ, ক্ষুব্ধ এবং তাদের ভবিষ্যৎ নেই।
এই ক্ষোভ কোন পথে যাবে, সেটা এখনো বোঝা যাচ্ছে না। তবে এটা নিশ্চিত, যদি কিছু করা না হয়, তাহলে একদিন এর পরিণতি ভয়ংকর হবে।
আমি সবাইকে বলছি, আমাদের এই চূড়ান্ত বিস্ফোরণ থেকে বাঁচাতে সাহায্য করুন। এই শিশুরা প্রতিভাবান, সৃষ্টিশীল, কিন্তু তারা বন্দী অবস্থায় আছে। তাদের মা-বাবার কথা শুনে বড় হচ্ছে, কিন্তু নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতেই হবে।
ব্রনওয়েন ম্যাডক্স: তাহলে আপনার পরিকল্পনা এখনো প্রত্যাবাসনের দিকেই, তা-ই তো? তাদের বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে রাখার কোনো পরিকল্পনা নেই?
অধ্যাপক ইউনূস: না, সেটা একেবারেই অসম্ভব। শিবিরসংলগ্ন এলাকার মানুষ খুব বিরূপ এবং তাদের ক্ষোভটা কিছুটা যৌক্তিক। তারা দেখে, রোহিঙ্গারা সব কিছু বিনা মূল্যে পাচ্ছে, আর তারা নিজেরাই টিকে থাকার লড়াই করছে। তারা বলে, ‘তোমরা আমাদের চাকরি নিচ্ছ, খাবার নিচ্ছ, আমাদের জীবন কেড়ে নিচ্ছ। তোমরা নিজের দেশে যাও, আমাদের জীবনে হস্তক্ষেপ কোরো না।’
রোহিঙ্গাদের অনেকের কাছে শিবিরজীবন হয়তো মজার, অলস সময় কাটানোর মতো; কিন্তু স্থানীয় শিশুদের কঠিন বাস্তবতা আছে, যাদের কোনো সুযোগ নেই। এর ফলে একধরনের ক্ষোভ ও উত্তেজনা তৈরি হচ্ছে। সরকার এই মর্মে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে—রোহিঙ্গারা ফিরবে। তারা সেটা বোঝে। বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দল বা সরকার স্থায়ী বসবাসের পক্ষে নয়।
ব্রনওয়েন ম্যাডক্স: আপনার বক্তব্য পরিষ্কার। এখন অনলাইনে অনেকেই প্রশ্ন পাঠাচ্ছেন—আমি প্রশ্ন পর্বে যাচ্ছি।

নাট্যদল বিবেকানন্দ থিয়েটারের ২৫তম প্রযোজনা ‘ভাসানে উজান’। গত নভেম্বরে মঞ্চে এসেছে নাটকটি। ২৯ ডিসেম্বর রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলে সন্ধ্যা ৭টায় মঞ্চস্থ হবে নাটকটির চতুর্থ প্রদর্শনী। অপূর্ব কুমার কুণ্ডুর নাট্যরূপ এবং শুভাশীষ দত্ত তন্ময়ের নির্দেশনায় একক অভিনয় করেছেন মো. এরশাদ হাসান।
৬ ঘণ্টা আগে
টেলিভিশন চ্যানেল বাংলা ভিশনের জনপ্রিয় সংবাদ উপস্থাপক মামুন আব্দুল্লাহর সাবলীল উপস্থাপনার পেছনে রয়েছে দীর্ঘ অনুশীলন, দক্ষতা ও অবিচল আত্মবিশ্বাস। তাঁর সঙ্গে কথোপকথনে উঠে এসেছে সংবাদ উপস্থাপনার কৌশল, লাইভ সম্প্রচারের চাপ সামলানোর বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং এ পেশায় আগ্রহীদের জন্য মূল্যবান পরামর্শ।
১৩ দিন আগে
দীর্ঘদিন আটকে থাকার পর রায়হান রাফী পরিচালিত ‘অমীমাংসিত’ ওয়েব ফিল্মের মুক্তির ঘোষণা এসেছে। ৪ ডিসেম্বর ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আইস্ক্রিনে মুক্তি পাবে সিনেমাটি। এতে অভিনয় করেছেন ইমতিয়াজ বর্ষণ। এ ছাড়া আসছে ডিসেম্বরে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাবে তাঁর অভিনীত ‘এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি’।
০১ ডিসেম্বর ২০২৫
ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগ থেকে সিজিপিএ–৪ এর মধ্যে ৪ পেয়েছেন ইউসুফ ইবনে কামাল নিলয়। গত ২৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টির ৩৭তম সমাবর্তনে এমন সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে ওআইসি স্বর্ণপদক দেওয়া হয়।
১৫ নভেম্বর ২০২৫
নাট্যদল বিবেকানন্দ থিয়েটারের ২৫তম প্রযোজনা ‘ভাসানে উজান’। গত নভেম্বরে মঞ্চে এসেছে নাটকটি। ২৯ ডিসেম্বর রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলে সন্ধ্যা ৭টায় মঞ্চস্থ হবে নাটকটির চতুর্থ প্রদর্শনী। অপূর্ব কুমার কুণ্ডুর নাট্যরূপ এবং শুভাশীষ দত্ত তন্ময়ের নির্দেশনায় একক অভিনয় করেছেন মো. এরশাদ হাসান। নাটকটি নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন এই অভিনেতা।
বিনোদন প্রতিবেদক, ঢাকা

‘ভাসানে উজান’ নাটকের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার অভিজ্ঞতাটা কেমন?
দস্তয়ভস্কির বিখ্যাত ছোটগল্প দ্য জেন্টেল স্পিরিট অবলম্বনে এই নাটক। দস্তয়ভস্কি মানেই মানুষের অন্তর্লোকের গভীরতম স্তরে প্রবেশ। ভাসানে উজান আমার জন্য শুধুই একটি নাটক নয়, এটি একধরনের আত্মসংলাপ। এই গল্পে ঢুকতে গিয়ে আমাকে বারবার নিজের ভেতরের অচেনা কোণগুলোর মুখোমুখি হতে হয়েছে। এ ছাড়া অপূর্বদার নাট্যরূপে সাহিত্যের সৌন্দর্য যেমন অটুট আছে, তেমনি আছে মঞ্চের ভাষা। আর শুভাশীষদার নির্দেশনা ছিল ধ্যানের মতো—নীরব, গভীর এবং সংযত। এই দুজনের সমন্বয় আমাকে অভিনয়ে আরও সংযমী করেছে।
ভাসানে উজানের চরিত্রটি উপস্থাপনে মানসিকভাবে কতটা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন?
এই চরিত্রটি বাহিরের নয়, ভেতরের অভিনয় দাবি করে। এখানে কান্না নেই, চিৎকার নেই—আছে চাপা অপরাধবোধ আর নীরব অনুশোচনা। এই নীরবতাই ছিল সবচেয়ে কঠিন। আমি মনে করি, আজকের মানুষ ভেতরে ভেতরে খুব একা। ভাসানে উজান সেই একাকিত্বের আয়না। দর্শক যদি নিজের ছায়াটা একটু দেখতে পান, সেটাই আমাদের সাফল্য।
চতুর্থ প্রদর্শনীতে এসে ভাসানে উজান নাটকে কি কোনো পরিবর্তন বা পরিণতি এসেছে?
প্রতিটি প্রদর্শনীতেই নাটকটা একটু একটু করে বদলায়। আমি নিজেও বদলাই। দর্শকের নিশ্বাস, নীরবতা—সবকিছু মিলিয়ে নাটকটি আরও পরিণত হয়ে ওঠে।
একক অভিনয়ে দীর্ঘ সময় মঞ্চে থাকতে হয়, সঙ্গ দেওয়ার কেউ থাকে না। এই একাকিত্বকে কীভাবে অনুভব করেন?
একাকিত্ব এখানে শূন্যতা নয়, বরং একধরনের গভীর উপস্থিতি। দর্শক, আলো, নীরবতা—সবকিছু মিলিয়ে এক অদৃশ্য সংলাপ তৈরি হয়। সেই সংলাপই আমাকে টেনে নেয় পুরো সময়জুড়ে।
দীর্ঘ দুই দশকের নাট্যচর্চার পরেও কি নাট্যমঞ্চে অভিনয়ের ক্ষেত্রে নতুন করে ভয় বা উত্তেজনা কাজ করে?
ভয় না থাকলে অভিনয় মৃত হয়ে যায়। প্রতিটি প্রদর্শনীর আগে আমি নতুন করে ভয় পাই, এই ভয় আমাকে সৎ রাখে, জীবিত রাখে একজন অভিনেতা হিসেবে।
ভবিষ্যতে একক নাটক ও থিয়েটার নিয়ে আপনার স্বপ্ন কী?
আমি চাই, থিয়েটার আরও স্থির হোক, আরও গভীর হোক। একক নাটক নিয়ে আরও গবেষণাধর্মী কাজ করতে চাই, যেখানে অভিনয় হবে আত্মানুসন্ধানের একটি মাধ্যম।
মঞ্চ ও টেলিভিশনের আসন্ন কাজ নিয়ে দর্শকদের জন্য কী বলতে চান?
আমার অভিনীত নাটকগুলোর নিয়মিত প্রদর্শনী চলছে। পাশাপাশি নতুন একটি রেপার্টরি নাটকে যুক্ত হচ্ছি। এ ছাড়া কয়েকটি টেলিভিশন নাটকের কাজও শেষের পথে। নাটকগুলো শিগগির দর্শকদের সামনে আসবে।
‘ভাসানে উজান’ নাটকের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার অভিজ্ঞতাটা কেমন?
দস্তয়ভস্কির বিখ্যাত ছোটগল্প দ্য জেন্টেল স্পিরিট অবলম্বনে এই নাটক। দস্তয়ভস্কি মানেই মানুষের অন্তর্লোকের গভীরতম স্তরে প্রবেশ। ভাসানে উজান আমার জন্য শুধুই একটি নাটক নয়, এটি একধরনের আত্মসংলাপ। এই গল্পে ঢুকতে গিয়ে আমাকে বারবার নিজের ভেতরের অচেনা কোণগুলোর মুখোমুখি হতে হয়েছে। এ ছাড়া অপূর্বদার নাট্যরূপে সাহিত্যের সৌন্দর্য যেমন অটুট আছে, তেমনি আছে মঞ্চের ভাষা। আর শুভাশীষদার নির্দেশনা ছিল ধ্যানের মতো—নীরব, গভীর এবং সংযত। এই দুজনের সমন্বয় আমাকে অভিনয়ে আরও সংযমী করেছে।
ভাসানে উজানের চরিত্রটি উপস্থাপনে মানসিকভাবে কতটা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন?
এই চরিত্রটি বাহিরের নয়, ভেতরের অভিনয় দাবি করে। এখানে কান্না নেই, চিৎকার নেই—আছে চাপা অপরাধবোধ আর নীরব অনুশোচনা। এই নীরবতাই ছিল সবচেয়ে কঠিন। আমি মনে করি, আজকের মানুষ ভেতরে ভেতরে খুব একা। ভাসানে উজান সেই একাকিত্বের আয়না। দর্শক যদি নিজের ছায়াটা একটু দেখতে পান, সেটাই আমাদের সাফল্য।
চতুর্থ প্রদর্শনীতে এসে ভাসানে উজান নাটকে কি কোনো পরিবর্তন বা পরিণতি এসেছে?
প্রতিটি প্রদর্শনীতেই নাটকটা একটু একটু করে বদলায়। আমি নিজেও বদলাই। দর্শকের নিশ্বাস, নীরবতা—সবকিছু মিলিয়ে নাটকটি আরও পরিণত হয়ে ওঠে।
একক অভিনয়ে দীর্ঘ সময় মঞ্চে থাকতে হয়, সঙ্গ দেওয়ার কেউ থাকে না। এই একাকিত্বকে কীভাবে অনুভব করেন?
একাকিত্ব এখানে শূন্যতা নয়, বরং একধরনের গভীর উপস্থিতি। দর্শক, আলো, নীরবতা—সবকিছু মিলিয়ে এক অদৃশ্য সংলাপ তৈরি হয়। সেই সংলাপই আমাকে টেনে নেয় পুরো সময়জুড়ে।
দীর্ঘ দুই দশকের নাট্যচর্চার পরেও কি নাট্যমঞ্চে অভিনয়ের ক্ষেত্রে নতুন করে ভয় বা উত্তেজনা কাজ করে?
ভয় না থাকলে অভিনয় মৃত হয়ে যায়। প্রতিটি প্রদর্শনীর আগে আমি নতুন করে ভয় পাই, এই ভয় আমাকে সৎ রাখে, জীবিত রাখে একজন অভিনেতা হিসেবে।
ভবিষ্যতে একক নাটক ও থিয়েটার নিয়ে আপনার স্বপ্ন কী?
আমি চাই, থিয়েটার আরও স্থির হোক, আরও গভীর হোক। একক নাটক নিয়ে আরও গবেষণাধর্মী কাজ করতে চাই, যেখানে অভিনয় হবে আত্মানুসন্ধানের একটি মাধ্যম।
মঞ্চ ও টেলিভিশনের আসন্ন কাজ নিয়ে দর্শকদের জন্য কী বলতে চান?
আমার অভিনীত নাটকগুলোর নিয়মিত প্রদর্শনী চলছে। পাশাপাশি নতুন একটি রেপার্টরি নাটকে যুক্ত হচ্ছি। এ ছাড়া কয়েকটি টেলিভিশন নাটকের কাজও শেষের পথে। নাটকগুলো শিগগির দর্শকদের সামনে আসবে।

‘বাংলাদেশের মানুষ যদি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ কিংবা অনুপাতভিত্তিক ভোটব্যবস্থা বুঝত! উল্টো তারা বলবে, আমরা এসব বুঝি না! আমি তোমাকে ভোট দেব, কয় টাকা দেবে? সহজ ভাষায় বললে বিষয়টি তা-ই—তুমি টাকা দাও, আমি ভোট দেব—দেশে ভোটের চর্চা এমনই।’
১৫ জুন ২০২৫
টেলিভিশন চ্যানেল বাংলা ভিশনের জনপ্রিয় সংবাদ উপস্থাপক মামুন আব্দুল্লাহর সাবলীল উপস্থাপনার পেছনে রয়েছে দীর্ঘ অনুশীলন, দক্ষতা ও অবিচল আত্মবিশ্বাস। তাঁর সঙ্গে কথোপকথনে উঠে এসেছে সংবাদ উপস্থাপনার কৌশল, লাইভ সম্প্রচারের চাপ সামলানোর বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং এ পেশায় আগ্রহীদের জন্য মূল্যবান পরামর্শ।
১৩ দিন আগে
দীর্ঘদিন আটকে থাকার পর রায়হান রাফী পরিচালিত ‘অমীমাংসিত’ ওয়েব ফিল্মের মুক্তির ঘোষণা এসেছে। ৪ ডিসেম্বর ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আইস্ক্রিনে মুক্তি পাবে সিনেমাটি। এতে অভিনয় করেছেন ইমতিয়াজ বর্ষণ। এ ছাড়া আসছে ডিসেম্বরে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাবে তাঁর অভিনীত ‘এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি’।
০১ ডিসেম্বর ২০২৫
ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগ থেকে সিজিপিএ–৪ এর মধ্যে ৪ পেয়েছেন ইউসুফ ইবনে কামাল নিলয়। গত ২৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টির ৩৭তম সমাবর্তনে এমন সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে ওআইসি স্বর্ণপদক দেওয়া হয়।
১৫ নভেম্বর ২০২৫
টেলিভিশন চ্যানেল বাংলা ভিশনের জনপ্রিয় সংবাদ উপস্থাপক মামুন আব্দুল্লাহর সাবলীল উপস্থাপনার পেছনে রয়েছে দীর্ঘ অনুশীলন, দক্ষতা ও অবিচল আত্মবিশ্বাস। তাঁর সঙ্গে কথোপকথনে উঠে এসেছে সংবাদ উপস্থাপনার কৌশল, লাইভ সম্প্রচারের চাপ সামলানোর বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং এ পেশায় আগ্রহীদের জন্য মূল্যবান পরামর্শ। তাঁর সঙ্গে কথা বলে পর্দার আড়ালের সেই অভিজ্ঞতাগুলোই তুলে ধরেছেন মনিরুল ইসলাম।
মনিরুল ইসলাম

কীভাবে আপনি সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন?
প্রতিটি স্বপ্নের পেছনে একটি করে গল্প থাকে। আমার সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার অনুপ্রেরণারও তেমনি একটি গল্প আছে। সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার আগেও ছোটবেলা থেকে আমার বড় মামাকে দেখেছি, তাঁর কথা বলার স্টাইল ছিল ভীষণ হৃদয়গ্রাহী, যা মানুষকে খুব কাছে টানত। ঠিক তখন থেকেই বড় মামা হয়ে যান আমার সুপার হিরো। আমিও চেষ্টা করতাম তেমন করে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। তারপর দেখলাম এর সেরা উপায় হলো সংবাদ উপস্থাপক হওয়া। তাঁদের সুন্দর করে কথা বলাটা আমার পছন্দ হতো। সেখান থেকেই মূলত অনুপ্রাণিত হওয়া। তা ছাড়া আমার মরহুম আব্বুর প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। তাঁর উৎসাহ আর অনুপ্রেরণা এবং আমার আম্মুর নীরব সমর্থন আমাকে এ পেশায় আসতে সহযোগিতা করেছে।
শুরুতে সংবাদ উপস্থাপনার প্রশিক্ষণ বা প্রস্তুতি কেমন ছিল?
ছোটবেলা থেকেই কবিতা আবৃত্তি করতাম। সেটাও বড় মামার হাত ধরেই। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই যখন নিউজ প্রেজেন্টার হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম, তখন থেকেই চিন্তা করতাম এখানে শুদ্ধ উচ্চারণের বিকল্প নেই। তাই উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে টিএসসিভিত্তিক একটি আবৃত্তি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হই। সেখানেও নিউজ প্রেজেন্টেশনের ক্লাস হতো। তারপর শুধু নিউজ প্রেজেন্টেশনের জন্য একটা একাডেমিতে ভর্তি হই। সেখানে ভর্তি ফি ছিল ৭ হাজার টাকা। পুরোটা দেওয়ার সামর্থ্য তখন ছিল না। তাই তাদের বলেছিলাম, ইনশা আল্লাহ একদিন নিউজ প্রেজেন্টার হয়ে আপনাদের এখানে ফ্রি ক্লাস নেব। সেই থেকে মনের মধ্যে ইচ্ছাটাও প্রবল হয়েছিল।
প্রথমবার লাইভ নিউজ উপস্থাপন করার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
প্রথমবার একটা অনলাইন টিভিতে নিউজ পড়েছিলাম। তাদেরও অভিষেক হয়েছিল আমাকে দিয়ে। তাই উচ্ছ্বাসটা দু’পক্ষেরই একটু বেশি ছিল। আমি তাদের গ্রুমিং করা প্রেজেন্টারদের মধ্যে প্রথম ছিলাম। নিজেকে প্রথম কোনো পর্দায় দেখে কি যে ভালো লেগেছিল, তা বলার ভাষা নেই।
উপস্থাপনায় ভাষা, উচ্চারণ ও টোন কতটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন?
এ পেশাটা অন্য যেকোনো পেশার চেয়ে একটু আলাদা। এমনকি বাচিক যেকোনো পেশার চেয়েও। যেমন কাস্টমার কেয়ার, কিংবা কল সেন্টার থেকেও। এখানে ভুল উচ্চারণের কোনো মার্সি বা ক্ষমা নেই। তবে এখানে সংবাদের ভিন্নতার কারণে টোনের পরিবর্তন করতে হয়। নিউজের ভিন্ন ভিন্ন আবেদন টোনের ওঠানামায় ফুটিয়ে তুলতে হয়। টোনের ভেরিয়েশনের কারণে দর্শকের কানও প্রশান্তি পায়।
সংবাদ উপস্থাপনায় সময় ব্যবস্থাপনা বা কলাকৌশল কীভাবে পালন করেন?
এখানে সময় ব্যবস্থাপনাটা সবার আগে। প্রতিটি ন্যানো সেকেন্ডের মূল্য এখানে দিতে হয়। নিউজ শুরুর অনেক আগেই একজন প্রেজেন্টারকে স্টেশনে হাজির থাকতে হয়। সবকিছু বুঝে নিতে হয়। নিউজ শুরু হলে তো তাঁকে আরও বেশি প্রস্তুত থাকতে হয় সময় সম্পর্কে। কারণ প্রতিটি টাইমফ্রেম এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
লাইভ সম্প্রচারে হঠাৎ সময় পরিবর্তন হলে কীভাবে সামলান?
লাইভ নিউজে যেকোনো কিছুর জন্যই প্রস্তুত থাকতে হয়। প্রেজেন্টারদের কানে একটা গোপন টকব্যাক লাগানো থাকে। যার সঙ্গে পিসিআর অর্থাৎ প্রডিউসার কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতে হয়। প্রডিউসার যেকোনো আপডেট নিউজ টকব্যাকে জানিয়ে দেন। সেটার জন্য সব সময় প্রস্তুত থাকতে হয়। খুব ঠান্ডা মাথায় যেকোনো ব্রেকিং বুঝে তারপর ডেলিভারি দিতে হয়।
উপস্থাপনার সময় ঘড়ি বা প্রম্পটার দেখে কীভাবে সময় নিয়ন্ত্রণ করেন?
পুরো নিউজটা একটা টাইমফ্রেমে বাঁধা থাকে। বিশেষ কারণ ছাড়া এর বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়। প্রতিটি নিউজের জন্য আলাদা সময় নির্ধারণ থাকে। সেটা বিবেচনা করেই নিউজ পড়ার গতি নির্ধারণ করতে হয়। সময় কন্ট্রোল করার জন্য পিসিআর এবং এমসিআর-মাস্টার কন্ট্রোল রুম সদা তৎপর থাকে। সেভাবেই একজন নিউজ প্রেজেন্টারকে চলতে হয়।
ক্যামেরার সামনে আত্মবিশ্বাস ধরে রাখার কৌশল কী?
আত্মবিশ্বাসটা অনেক কিছুর সমন্বিত একটা রূপ। যেকোনো ভালো প্রিপারেশন আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। এখানে একজন নিউজ প্রেজেন্টারের ভালো প্রিপারেশন অনেক কিছুর সমন্বয়ে হয়ে থাকে। যেমন তাঁর উচ্চারণ, নিউজ সম্পর্কে সঠিক ধারণা। নিউজ রুম, পিসিআর, এমসিআর, রানডাউন (যেখানে নিউজের ধারাবাহিকতা সাজানো থাকে) সম্পর্কে ধারণা থাকলে তাঁর আত্মবিশ্বাস অটুট থাকে।
ভুল হয়ে গেলে কীভাবে পরিস্থিতি সামলান?
লাইভ নিউজে ভুল হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। তবে বারবার একই ভুল যাতে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হয়। ভুল হলে দর্শকের কাছে বিনয়ের সঙ্গে সেটি উপস্থাপন করাটাও ভালো প্রেজেন্টারের কাজ। দর্শকের সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ রাখতে হয়।
লাইভ নিউজে হঠাৎ অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি এলে আপনার মানসিক কৌশল কেমন থাকে?
লাইভ নিউজে প্রতিটি সেকেন্ডই চ্যালেঞ্জের। যেকোনো অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হলে মাথা সম্পূর্ণ ঠান্ডা রেখে সামলাতে হয়। মানসিকভাবে সব সময় প্রস্তুত থাকতে হয়। আমি সব সময় একটা কথা বলি, একজন নিউজ প্রেজেন্টারকে একটা লোকাল বাসের ড্রাইভারের ভূমিকা পালন করতে হয়। লোকাল বাসের ড্রাইভারকে যেমনিভাবে হরেক রকমের যাত্রীর কথা শুনেও হেলপারের সহযোগিতায় সঠিকভাবে গাড়ি চালাতে হয়, তেমনি প্রেজেন্টারকেও পিসিআরের শত কথা কানে নিয়েও প্রডিউসারের সঠিক দিকনির্দেশনায় টিভি স্টেশন চালাতে হয়। মনে রাখতে হয়, একজন নিউজ প্রেজেন্টার একটি নিউজ বুলেটিনের লাস্ট গেটওয়ে। তাই তাঁকে অনেক সতর্ক থাকতে হয়।
দর্শকদের আগ্রহ ধরে রাখতে আপনি কীভাবে সংবাদ উপস্থাপন করেন?
আমি তো ভাবি, আমি একজন দর্শকের ঘরের লোক। ভাবি নিউজের মাধ্যমে আমি গ্রামের একজন চাষি থেকে শুরু করে দেশের প্রধানের সঙ্গেও নিউজের মাধ্যমে যোগাযোগ করে থাকি। প্রতিটি সংবাদের আলাদা আবেদন আছে। চেষ্টা করি সেটাকে সেভাবেই উপস্থাপনের। দর্শক যেমন আমাদের সবচেয়ে কাছের মানুষ মনে করে, তেমনি সেভাবেই তার মনোজগতের কথা চিন্তা করে সংবাদ পরিবেশনের চেষ্টা করি।
সংবাদ উপস্থাপক হিসেবে আপনি কতটা নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করেন?
শিশু আর পাগল ছাড়া সবারই নিজস্ব মতাদর্শ আছে। এটা যেমন সঠিক, তেমনি সংবাদিকদেরও নিজস্ব মতাদর্শ থাকাটা স্বাভাবিক। কিন্তু পেশাগত দায়িত্ব পালনে তাঁকে শতভাগ সেটি নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। কারণ দর্শক পক্ষপাতদুষ্ট নিউজ প্রেজেন্টার কিংবা সাংবাদিক কাউকেই পছন্দ করেন না। সচেতন দর্শকও চান না তাঁর দলের হয়ে সাংবাদিক কথা বলুক। তিনিও চান সাংবাদিক তাঁর নিউজে বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রাখুক। তাই এসব ব্যাপার মাথায় রেখেই আমাদের চলতে হয়।
যারা ভবিষ্যতে সংবাদ উপস্থাপক হতে চান, তাঁদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
অধ্যবসায়ের কোনো বিকল্প নেই। আমার মনে আছে, যখন থেকে সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার জন্য মনস্থির করেছি, তখন রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতেও নিউজের লিংক পড়তাম। চেষ্টা করতাম কতটা হৃদয়গ্রাহী করে একটা সংবাদ উপস্থাপন করা যায়। তাই আমার কাছে মনে হয়, সঠিক রাস্তা চিনে লেগে থাকতে পারলে সফলতা আসবেই। সেটা ভিন্নভাবে হলেও। তবে পরিশ্রম কখনো বৃথা যায় না। সেটা কোনো না কোনোভাবে কাজে লাগে।
সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার জন্য কোন গুণ বা দক্ষতা সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বলে মনে করেন?
সবার আগে এটাকে পেশা হিসেবে নিতে মনস্থির করা। শখের বসে নয়। আপনাকে কোনো একটি পেশায় টিকে থাকতে হলে সে পেশার উপযোগী যত গুণ আছে, সেগুলো রপ্ত করার চেষ্টা করতে হবে। যেমন নিজের উচ্চারণ ঠিক রাখ, আঞ্চলিকতা পরিহার করা। সর্বোপরি নিজেকে একজন ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা।
কীভাবে আপনি সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন?
প্রতিটি স্বপ্নের পেছনে একটি করে গল্প থাকে। আমার সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার অনুপ্রেরণারও তেমনি একটি গল্প আছে। সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার আগেও ছোটবেলা থেকে আমার বড় মামাকে দেখেছি, তাঁর কথা বলার স্টাইল ছিল ভীষণ হৃদয়গ্রাহী, যা মানুষকে খুব কাছে টানত। ঠিক তখন থেকেই বড় মামা হয়ে যান আমার সুপার হিরো। আমিও চেষ্টা করতাম তেমন করে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। তারপর দেখলাম এর সেরা উপায় হলো সংবাদ উপস্থাপক হওয়া। তাঁদের সুন্দর করে কথা বলাটা আমার পছন্দ হতো। সেখান থেকেই মূলত অনুপ্রাণিত হওয়া। তা ছাড়া আমার মরহুম আব্বুর প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। তাঁর উৎসাহ আর অনুপ্রেরণা এবং আমার আম্মুর নীরব সমর্থন আমাকে এ পেশায় আসতে সহযোগিতা করেছে।
শুরুতে সংবাদ উপস্থাপনার প্রশিক্ষণ বা প্রস্তুতি কেমন ছিল?
ছোটবেলা থেকেই কবিতা আবৃত্তি করতাম। সেটাও বড় মামার হাত ধরেই। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই যখন নিউজ প্রেজেন্টার হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম, তখন থেকেই চিন্তা করতাম এখানে শুদ্ধ উচ্চারণের বিকল্প নেই। তাই উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে টিএসসিভিত্তিক একটি আবৃত্তি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হই। সেখানেও নিউজ প্রেজেন্টেশনের ক্লাস হতো। তারপর শুধু নিউজ প্রেজেন্টেশনের জন্য একটা একাডেমিতে ভর্তি হই। সেখানে ভর্তি ফি ছিল ৭ হাজার টাকা। পুরোটা দেওয়ার সামর্থ্য তখন ছিল না। তাই তাদের বলেছিলাম, ইনশা আল্লাহ একদিন নিউজ প্রেজেন্টার হয়ে আপনাদের এখানে ফ্রি ক্লাস নেব। সেই থেকে মনের মধ্যে ইচ্ছাটাও প্রবল হয়েছিল।
প্রথমবার লাইভ নিউজ উপস্থাপন করার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
প্রথমবার একটা অনলাইন টিভিতে নিউজ পড়েছিলাম। তাদেরও অভিষেক হয়েছিল আমাকে দিয়ে। তাই উচ্ছ্বাসটা দু’পক্ষেরই একটু বেশি ছিল। আমি তাদের গ্রুমিং করা প্রেজেন্টারদের মধ্যে প্রথম ছিলাম। নিজেকে প্রথম কোনো পর্দায় দেখে কি যে ভালো লেগেছিল, তা বলার ভাষা নেই।
উপস্থাপনায় ভাষা, উচ্চারণ ও টোন কতটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন?
এ পেশাটা অন্য যেকোনো পেশার চেয়ে একটু আলাদা। এমনকি বাচিক যেকোনো পেশার চেয়েও। যেমন কাস্টমার কেয়ার, কিংবা কল সেন্টার থেকেও। এখানে ভুল উচ্চারণের কোনো মার্সি বা ক্ষমা নেই। তবে এখানে সংবাদের ভিন্নতার কারণে টোনের পরিবর্তন করতে হয়। নিউজের ভিন্ন ভিন্ন আবেদন টোনের ওঠানামায় ফুটিয়ে তুলতে হয়। টোনের ভেরিয়েশনের কারণে দর্শকের কানও প্রশান্তি পায়।
সংবাদ উপস্থাপনায় সময় ব্যবস্থাপনা বা কলাকৌশল কীভাবে পালন করেন?
এখানে সময় ব্যবস্থাপনাটা সবার আগে। প্রতিটি ন্যানো সেকেন্ডের মূল্য এখানে দিতে হয়। নিউজ শুরুর অনেক আগেই একজন প্রেজেন্টারকে স্টেশনে হাজির থাকতে হয়। সবকিছু বুঝে নিতে হয়। নিউজ শুরু হলে তো তাঁকে আরও বেশি প্রস্তুত থাকতে হয় সময় সম্পর্কে। কারণ প্রতিটি টাইমফ্রেম এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
লাইভ সম্প্রচারে হঠাৎ সময় পরিবর্তন হলে কীভাবে সামলান?
লাইভ নিউজে যেকোনো কিছুর জন্যই প্রস্তুত থাকতে হয়। প্রেজেন্টারদের কানে একটা গোপন টকব্যাক লাগানো থাকে। যার সঙ্গে পিসিআর অর্থাৎ প্রডিউসার কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতে হয়। প্রডিউসার যেকোনো আপডেট নিউজ টকব্যাকে জানিয়ে দেন। সেটার জন্য সব সময় প্রস্তুত থাকতে হয়। খুব ঠান্ডা মাথায় যেকোনো ব্রেকিং বুঝে তারপর ডেলিভারি দিতে হয়।
উপস্থাপনার সময় ঘড়ি বা প্রম্পটার দেখে কীভাবে সময় নিয়ন্ত্রণ করেন?
পুরো নিউজটা একটা টাইমফ্রেমে বাঁধা থাকে। বিশেষ কারণ ছাড়া এর বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়। প্রতিটি নিউজের জন্য আলাদা সময় নির্ধারণ থাকে। সেটা বিবেচনা করেই নিউজ পড়ার গতি নির্ধারণ করতে হয়। সময় কন্ট্রোল করার জন্য পিসিআর এবং এমসিআর-মাস্টার কন্ট্রোল রুম সদা তৎপর থাকে। সেভাবেই একজন নিউজ প্রেজেন্টারকে চলতে হয়।
ক্যামেরার সামনে আত্মবিশ্বাস ধরে রাখার কৌশল কী?
আত্মবিশ্বাসটা অনেক কিছুর সমন্বিত একটা রূপ। যেকোনো ভালো প্রিপারেশন আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। এখানে একজন নিউজ প্রেজেন্টারের ভালো প্রিপারেশন অনেক কিছুর সমন্বয়ে হয়ে থাকে। যেমন তাঁর উচ্চারণ, নিউজ সম্পর্কে সঠিক ধারণা। নিউজ রুম, পিসিআর, এমসিআর, রানডাউন (যেখানে নিউজের ধারাবাহিকতা সাজানো থাকে) সম্পর্কে ধারণা থাকলে তাঁর আত্মবিশ্বাস অটুট থাকে।
ভুল হয়ে গেলে কীভাবে পরিস্থিতি সামলান?
লাইভ নিউজে ভুল হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। তবে বারবার একই ভুল যাতে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হয়। ভুল হলে দর্শকের কাছে বিনয়ের সঙ্গে সেটি উপস্থাপন করাটাও ভালো প্রেজেন্টারের কাজ। দর্শকের সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ রাখতে হয়।
লাইভ নিউজে হঠাৎ অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি এলে আপনার মানসিক কৌশল কেমন থাকে?
লাইভ নিউজে প্রতিটি সেকেন্ডই চ্যালেঞ্জের। যেকোনো অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হলে মাথা সম্পূর্ণ ঠান্ডা রেখে সামলাতে হয়। মানসিকভাবে সব সময় প্রস্তুত থাকতে হয়। আমি সব সময় একটা কথা বলি, একজন নিউজ প্রেজেন্টারকে একটা লোকাল বাসের ড্রাইভারের ভূমিকা পালন করতে হয়। লোকাল বাসের ড্রাইভারকে যেমনিভাবে হরেক রকমের যাত্রীর কথা শুনেও হেলপারের সহযোগিতায় সঠিকভাবে গাড়ি চালাতে হয়, তেমনি প্রেজেন্টারকেও পিসিআরের শত কথা কানে নিয়েও প্রডিউসারের সঠিক দিকনির্দেশনায় টিভি স্টেশন চালাতে হয়। মনে রাখতে হয়, একজন নিউজ প্রেজেন্টার একটি নিউজ বুলেটিনের লাস্ট গেটওয়ে। তাই তাঁকে অনেক সতর্ক থাকতে হয়।
দর্শকদের আগ্রহ ধরে রাখতে আপনি কীভাবে সংবাদ উপস্থাপন করেন?
আমি তো ভাবি, আমি একজন দর্শকের ঘরের লোক। ভাবি নিউজের মাধ্যমে আমি গ্রামের একজন চাষি থেকে শুরু করে দেশের প্রধানের সঙ্গেও নিউজের মাধ্যমে যোগাযোগ করে থাকি। প্রতিটি সংবাদের আলাদা আবেদন আছে। চেষ্টা করি সেটাকে সেভাবেই উপস্থাপনের। দর্শক যেমন আমাদের সবচেয়ে কাছের মানুষ মনে করে, তেমনি সেভাবেই তার মনোজগতের কথা চিন্তা করে সংবাদ পরিবেশনের চেষ্টা করি।
সংবাদ উপস্থাপক হিসেবে আপনি কতটা নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করেন?
শিশু আর পাগল ছাড়া সবারই নিজস্ব মতাদর্শ আছে। এটা যেমন সঠিক, তেমনি সংবাদিকদেরও নিজস্ব মতাদর্শ থাকাটা স্বাভাবিক। কিন্তু পেশাগত দায়িত্ব পালনে তাঁকে শতভাগ সেটি নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। কারণ দর্শক পক্ষপাতদুষ্ট নিউজ প্রেজেন্টার কিংবা সাংবাদিক কাউকেই পছন্দ করেন না। সচেতন দর্শকও চান না তাঁর দলের হয়ে সাংবাদিক কথা বলুক। তিনিও চান সাংবাদিক তাঁর নিউজে বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রাখুক। তাই এসব ব্যাপার মাথায় রেখেই আমাদের চলতে হয়।
যারা ভবিষ্যতে সংবাদ উপস্থাপক হতে চান, তাঁদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
অধ্যবসায়ের কোনো বিকল্প নেই। আমার মনে আছে, যখন থেকে সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার জন্য মনস্থির করেছি, তখন রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতেও নিউজের লিংক পড়তাম। চেষ্টা করতাম কতটা হৃদয়গ্রাহী করে একটা সংবাদ উপস্থাপন করা যায়। তাই আমার কাছে মনে হয়, সঠিক রাস্তা চিনে লেগে থাকতে পারলে সফলতা আসবেই। সেটা ভিন্নভাবে হলেও। তবে পরিশ্রম কখনো বৃথা যায় না। সেটা কোনো না কোনোভাবে কাজে লাগে।
সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার জন্য কোন গুণ বা দক্ষতা সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বলে মনে করেন?
সবার আগে এটাকে পেশা হিসেবে নিতে মনস্থির করা। শখের বসে নয়। আপনাকে কোনো একটি পেশায় টিকে থাকতে হলে সে পেশার উপযোগী যত গুণ আছে, সেগুলো রপ্ত করার চেষ্টা করতে হবে। যেমন নিজের উচ্চারণ ঠিক রাখ, আঞ্চলিকতা পরিহার করা। সর্বোপরি নিজেকে একজন ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা।

‘বাংলাদেশের মানুষ যদি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ কিংবা অনুপাতভিত্তিক ভোটব্যবস্থা বুঝত! উল্টো তারা বলবে, আমরা এসব বুঝি না! আমি তোমাকে ভোট দেব, কয় টাকা দেবে? সহজ ভাষায় বললে বিষয়টি তা-ই—তুমি টাকা দাও, আমি ভোট দেব—দেশে ভোটের চর্চা এমনই।’
১৫ জুন ২০২৫
নাট্যদল বিবেকানন্দ থিয়েটারের ২৫তম প্রযোজনা ‘ভাসানে উজান’। গত নভেম্বরে মঞ্চে এসেছে নাটকটি। ২৯ ডিসেম্বর রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলে সন্ধ্যা ৭টায় মঞ্চস্থ হবে নাটকটির চতুর্থ প্রদর্শনী। অপূর্ব কুমার কুণ্ডুর নাট্যরূপ এবং শুভাশীষ দত্ত তন্ময়ের নির্দেশনায় একক অভিনয় করেছেন মো. এরশাদ হাসান।
৬ ঘণ্টা আগে
দীর্ঘদিন আটকে থাকার পর রায়হান রাফী পরিচালিত ‘অমীমাংসিত’ ওয়েব ফিল্মের মুক্তির ঘোষণা এসেছে। ৪ ডিসেম্বর ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আইস্ক্রিনে মুক্তি পাবে সিনেমাটি। এতে অভিনয় করেছেন ইমতিয়াজ বর্ষণ। এ ছাড়া আসছে ডিসেম্বরে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাবে তাঁর অভিনীত ‘এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি’।
০১ ডিসেম্বর ২০২৫
ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগ থেকে সিজিপিএ–৪ এর মধ্যে ৪ পেয়েছেন ইউসুফ ইবনে কামাল নিলয়। গত ২৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টির ৩৭তম সমাবর্তনে এমন সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে ওআইসি স্বর্ণপদক দেওয়া হয়।
১৫ নভেম্বর ২০২৫
দীর্ঘদিন আটকে থাকার পর রায়হান রাফী পরিচালিত ‘অমীমাংসিত’ ওয়েব ফিল্মের মুক্তির ঘোষণা এসেছে। ৪ ডিসেম্বর ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আইস্ক্রিনে মুক্তি পাবে সিনেমাটি। এতে অভিনয় করেছেন ইমতিয়াজ বর্ষণ। এ ছাড়া আসছে ডিসেম্বরে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাবে তাঁর অভিনীত ‘এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি’। আগামী জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশে প্যানোরামা বিভাগে জায়গা করে নিয়েছে বর্ষণ অভিনীত দুটি সিনেমা। ইমতিয়াজ বর্ষণের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শিহাব আহমেদ।
শিহাব আহমেদ

দীর্ঘদিন আটকে থাকার পর অবশেষে মুক্তি পাচ্ছে ওয়েব ফিল্ম অমীমাংসিত। কেমন লাগছে?
আমরা অভিনয়শিল্পীরা কাজ করি দর্শকের জন্য। সেই কাজটা অনেক দিন আটকে থাকা অবশ্যই কষ্টের। অবশেষে ওয়েব ফিল্মটি দর্শক দেখতে পারবেন, এটাই সবচেয়ে ভালো লাগার। সিনেমাটিতে রহস্যের গন্ধ রয়েছে। রহস্যজনকভাবে কে বা কারা খুন করেছে, এর প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। এটি বানিয়েছেন রায়হান রাফী। ভিজ্যুয়াল লুকেও দর্শক নতুনত্ব পাবেন।
ওটিটি কনটেন্ট হওয়ার পরেও গত বছর তৎকালীন সেন্সর বোর্ড আটকে দিয়েছিল সিনেমাটি। অনেকেই বলছেন এটি নির্মিত হয়েছে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড নিয়ে। আপনিও কি মনে করেন এই কারণেই এটি আটকে দেওয়া হয়েছিল?
একদম তাই। সবাই যেটা ধারণা করেছে, সেই কারণেই সিনেমাটি এত দিন আটকে ছিল। তৎকালীন সেন্সর বোর্ড গল্পটি সেনসেটিভ ভেবে সিনেমাটি আটকে দিয়েছিল। মুক্তির আগে এর বেশি এখন বলতে চাই না।
এটা নিয়ে প্রথম থেকেই অনেক আলোচনা। দর্শকেরও আলাদা আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে কোনো চাপ অনুভব করছেন?
প্রতিটি কাজই শিল্পী ও নির্মাতাদের একধরনের প্রেশার ক্রিয়েট করে। আমি নিজেও যেকোনো কাজ মুক্তির আগে চাপ অনুভব করি। দর্শক কীভাবে নেবেন, তাঁদের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে। আমরা তো আসলে দর্শকদের ভালো লাগার জন্য, তাঁদের বিনোদন দেওয়ার জন্য কাজ করি। দর্শকের সন্তুষ্টি আমাদের জন্য আশীর্বাদ। অভিনেতা হিসেবে সব সময় আশা রাখি আমার কাজটি যেন দর্শকের ভালো লাগে, গুণে মানে যেন সবার মনঃপূত হয়।
ডিসেম্বরে প্রেক্ষাগৃহেও আপনার সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে। সেই সিনেমা নিয়ে কিছু বলুন।
‘এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি’ নামের সিনেমাটি বানিয়েছেন আহমেদ হাসান সানি। ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলন, এর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ের গল্প নিয়ে সিনেমা। আমাদের দেশের রাজনীতির হালচাল দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। ফুটে উঠেছে রাজনীতি নিয়ে মানুষের ভাবনা। আমাদের দেশে অনেক রেস্টুরেন্ট বা আড্ডার স্থানে লেখা থাকে এখানে রাজনৈতিক আলাপ নিষিদ্ধ বা করা যাবে না। আমি মনে করি, এটা মিস কনসেপ্ট। রাজনৈতিক আলাপ প্রতিটি জায়গায় হওয়া উচিত। কারণ, আমরা কেউ রাজনীতির বাইরে নই। প্রতিটি মানুষ রাজনীতির অংশ। সেটা সচেতনভাবে হোক কিংবা অসচেতনভাবে। যারা সচেতন, তারা একটু দায়িত্বশীলতার সঙ্গে সক্রিয় থাকে। কিন্তু যারা রাজনৈতিকভাবে অসচেতন বা কেয়ারলেস, তাদেরও একটা ভূমিকা থাকে।
এটা আহমেদ হাসান সানির প্রথম সিনেমা। নির্মাতা হিসেবে কেমন লাগল তাঁকে?
এর আগে আহমেদ হাসান সানির নির্দেশনায় বিজ্ঞাপনে কাজ করেছি। তবে নির্মাতা হিসেবে আগে থেকেই তাঁকে চিনি। উনি একজন আধুনিক নির্মাতা, তাঁর ভাবনাও আধুনিক। ছোটখাটো বিষয়েও সমান খেয়াল রাখেন তিনি। চিত্রনাট্য, অ্যাক্টিং, সেট—সব ব্যাপারেই তিনি খুঁতখুঁতে। এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি সিনেমাটি দেখার সময় দর্শক তাঁর যত্নের ছাপ দেখতে পাবেন। আমি বিশ্বাস করি, ওনার কাছ থেকে ভালো মানের আরও কাজ পাওয়া যাবে।
সম্প্রতি ছাড়পত্র পেয়েছে আপনার আরেক সিনেমা ‘যাপিত জীবন’। সেই সিনেমার গল্প কী নিয়ে?
এটি একটি পিরিয়ডিকাল সিনেমা। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে গল্প। এই সিনেমায় আরও অভিনয় করেছেন আফজাল হোসেন, রোকেয়া প্রাচী, আশনা হাবিব ভাবনা প্রমুখ। পরিচালনা করেছেন হাবিবুল ইসলাম হাবিব।
এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি এবং যাপিত জীবন সিনেমা দুটি ঢাকা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের বাংলাদেশ প্যানোরামা বিভাগে প্রদর্শিত হবে। কেমন অনুভূতি?
২০২০ সাল থেকে প্রায় প্রতিবছর ঢাকা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে আমার কোনো না কোনো সিনেমা প্রদর্শিত হয়। এটা আমার জন্য আনন্দের ও গর্বের। এ বছর দুটি পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা জায়গা পেয়েছে বাংলাদেশ প্যানোরামা বিভাগে। শুনছি দুটি সিনেমাই ডিসেম্বরে মুক্তি পাবে। এটা নিয়ে আমার আপত্তি আছে। ভিন্ন সময়ে সিনেমা দুটি মুক্তি পেলে ভালো হতো।
সিনেমা মুক্তি নিয়ে এই আপত্তির কথা জানিয়েছেন নির্মাতাদের?
এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি নিয়ে নির্মাতার সঙ্গে আলাপ হয়েছে। ওনারা সিনেমার মুক্তি ও প্রমোশন নিয়ে তাঁদের পরিকল্পনার কথা আমাকে জানিয়েছেন। যাপিত জীবন নিয়ে আমি অফিশিয়ালি এখনো কিছু জানি না। তাই কথা হয়নি।
‘রবি ইন ঢাকা’ নামের সিনেমার শুটিং করছেন। এ সিনেমাটি নিয়ে বলুন।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এই সিনেমার শুটিং শিডিউল আছে। এরপর একটা বিরতি নিয়ে শুরু হবে পরের লটের শুটিং। এই সিনেমার গল্পটিও সমকালীন। নতুন প্রজন্মের কথা আছে। আসলে আমরা যেই সময়েই বসবাস করি না কেন, দুঃখ-কষ্ট, আনন্দ-বেদনা আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে। এই শহরে অনেক মানুষ দেখি যাদের দূর থেকে দেখলে মনে হয় সুখে আছে। কিন্তু আসলে তাদের ভেতরে অনেক কষ্ট। নানা ধরনের কষ্টের মাঝেও আমরা এই শহরে আনন্দ খুঁজে বেড়াই। এমন একটা গল্প নিয়েই রবি ইন ঢাকা। গল্পে মিস্ট্রি আছে, সাসপেন্সও আছে। পরিচালনা করছেন রাজীব সালেহীন।
দীর্ঘদিন আটকে থাকার পর অবশেষে মুক্তি পাচ্ছে ওয়েব ফিল্ম অমীমাংসিত। কেমন লাগছে?
আমরা অভিনয়শিল্পীরা কাজ করি দর্শকের জন্য। সেই কাজটা অনেক দিন আটকে থাকা অবশ্যই কষ্টের। অবশেষে ওয়েব ফিল্মটি দর্শক দেখতে পারবেন, এটাই সবচেয়ে ভালো লাগার। সিনেমাটিতে রহস্যের গন্ধ রয়েছে। রহস্যজনকভাবে কে বা কারা খুন করেছে, এর প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। এটি বানিয়েছেন রায়হান রাফী। ভিজ্যুয়াল লুকেও দর্শক নতুনত্ব পাবেন।
ওটিটি কনটেন্ট হওয়ার পরেও গত বছর তৎকালীন সেন্সর বোর্ড আটকে দিয়েছিল সিনেমাটি। অনেকেই বলছেন এটি নির্মিত হয়েছে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড নিয়ে। আপনিও কি মনে করেন এই কারণেই এটি আটকে দেওয়া হয়েছিল?
একদম তাই। সবাই যেটা ধারণা করেছে, সেই কারণেই সিনেমাটি এত দিন আটকে ছিল। তৎকালীন সেন্সর বোর্ড গল্পটি সেনসেটিভ ভেবে সিনেমাটি আটকে দিয়েছিল। মুক্তির আগে এর বেশি এখন বলতে চাই না।
এটা নিয়ে প্রথম থেকেই অনেক আলোচনা। দর্শকেরও আলাদা আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে কোনো চাপ অনুভব করছেন?
প্রতিটি কাজই শিল্পী ও নির্মাতাদের একধরনের প্রেশার ক্রিয়েট করে। আমি নিজেও যেকোনো কাজ মুক্তির আগে চাপ অনুভব করি। দর্শক কীভাবে নেবেন, তাঁদের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে। আমরা তো আসলে দর্শকদের ভালো লাগার জন্য, তাঁদের বিনোদন দেওয়ার জন্য কাজ করি। দর্শকের সন্তুষ্টি আমাদের জন্য আশীর্বাদ। অভিনেতা হিসেবে সব সময় আশা রাখি আমার কাজটি যেন দর্শকের ভালো লাগে, গুণে মানে যেন সবার মনঃপূত হয়।
ডিসেম্বরে প্রেক্ষাগৃহেও আপনার সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে। সেই সিনেমা নিয়ে কিছু বলুন।
‘এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি’ নামের সিনেমাটি বানিয়েছেন আহমেদ হাসান সানি। ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলন, এর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ের গল্প নিয়ে সিনেমা। আমাদের দেশের রাজনীতির হালচাল দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। ফুটে উঠেছে রাজনীতি নিয়ে মানুষের ভাবনা। আমাদের দেশে অনেক রেস্টুরেন্ট বা আড্ডার স্থানে লেখা থাকে এখানে রাজনৈতিক আলাপ নিষিদ্ধ বা করা যাবে না। আমি মনে করি, এটা মিস কনসেপ্ট। রাজনৈতিক আলাপ প্রতিটি জায়গায় হওয়া উচিত। কারণ, আমরা কেউ রাজনীতির বাইরে নই। প্রতিটি মানুষ রাজনীতির অংশ। সেটা সচেতনভাবে হোক কিংবা অসচেতনভাবে। যারা সচেতন, তারা একটু দায়িত্বশীলতার সঙ্গে সক্রিয় থাকে। কিন্তু যারা রাজনৈতিকভাবে অসচেতন বা কেয়ারলেস, তাদেরও একটা ভূমিকা থাকে।
এটা আহমেদ হাসান সানির প্রথম সিনেমা। নির্মাতা হিসেবে কেমন লাগল তাঁকে?
এর আগে আহমেদ হাসান সানির নির্দেশনায় বিজ্ঞাপনে কাজ করেছি। তবে নির্মাতা হিসেবে আগে থেকেই তাঁকে চিনি। উনি একজন আধুনিক নির্মাতা, তাঁর ভাবনাও আধুনিক। ছোটখাটো বিষয়েও সমান খেয়াল রাখেন তিনি। চিত্রনাট্য, অ্যাক্টিং, সেট—সব ব্যাপারেই তিনি খুঁতখুঁতে। এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি সিনেমাটি দেখার সময় দর্শক তাঁর যত্নের ছাপ দেখতে পাবেন। আমি বিশ্বাস করি, ওনার কাছ থেকে ভালো মানের আরও কাজ পাওয়া যাবে।
সম্প্রতি ছাড়পত্র পেয়েছে আপনার আরেক সিনেমা ‘যাপিত জীবন’। সেই সিনেমার গল্প কী নিয়ে?
এটি একটি পিরিয়ডিকাল সিনেমা। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে গল্প। এই সিনেমায় আরও অভিনয় করেছেন আফজাল হোসেন, রোকেয়া প্রাচী, আশনা হাবিব ভাবনা প্রমুখ। পরিচালনা করেছেন হাবিবুল ইসলাম হাবিব।
এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি এবং যাপিত জীবন সিনেমা দুটি ঢাকা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের বাংলাদেশ প্যানোরামা বিভাগে প্রদর্শিত হবে। কেমন অনুভূতি?
২০২০ সাল থেকে প্রায় প্রতিবছর ঢাকা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে আমার কোনো না কোনো সিনেমা প্রদর্শিত হয়। এটা আমার জন্য আনন্দের ও গর্বের। এ বছর দুটি পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা জায়গা পেয়েছে বাংলাদেশ প্যানোরামা বিভাগে। শুনছি দুটি সিনেমাই ডিসেম্বরে মুক্তি পাবে। এটা নিয়ে আমার আপত্তি আছে। ভিন্ন সময়ে সিনেমা দুটি মুক্তি পেলে ভালো হতো।
সিনেমা মুক্তি নিয়ে এই আপত্তির কথা জানিয়েছেন নির্মাতাদের?
এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি নিয়ে নির্মাতার সঙ্গে আলাপ হয়েছে। ওনারা সিনেমার মুক্তি ও প্রমোশন নিয়ে তাঁদের পরিকল্পনার কথা আমাকে জানিয়েছেন। যাপিত জীবন নিয়ে আমি অফিশিয়ালি এখনো কিছু জানি না। তাই কথা হয়নি।
‘রবি ইন ঢাকা’ নামের সিনেমার শুটিং করছেন। এ সিনেমাটি নিয়ে বলুন।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এই সিনেমার শুটিং শিডিউল আছে। এরপর একটা বিরতি নিয়ে শুরু হবে পরের লটের শুটিং। এই সিনেমার গল্পটিও সমকালীন। নতুন প্রজন্মের কথা আছে। আসলে আমরা যেই সময়েই বসবাস করি না কেন, দুঃখ-কষ্ট, আনন্দ-বেদনা আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে। এই শহরে অনেক মানুষ দেখি যাদের দূর থেকে দেখলে মনে হয় সুখে আছে। কিন্তু আসলে তাদের ভেতরে অনেক কষ্ট। নানা ধরনের কষ্টের মাঝেও আমরা এই শহরে আনন্দ খুঁজে বেড়াই। এমন একটা গল্প নিয়েই রবি ইন ঢাকা। গল্পে মিস্ট্রি আছে, সাসপেন্সও আছে। পরিচালনা করছেন রাজীব সালেহীন।

‘বাংলাদেশের মানুষ যদি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ কিংবা অনুপাতভিত্তিক ভোটব্যবস্থা বুঝত! উল্টো তারা বলবে, আমরা এসব বুঝি না! আমি তোমাকে ভোট দেব, কয় টাকা দেবে? সহজ ভাষায় বললে বিষয়টি তা-ই—তুমি টাকা দাও, আমি ভোট দেব—দেশে ভোটের চর্চা এমনই।’
১৫ জুন ২০২৫
নাট্যদল বিবেকানন্দ থিয়েটারের ২৫তম প্রযোজনা ‘ভাসানে উজান’। গত নভেম্বরে মঞ্চে এসেছে নাটকটি। ২৯ ডিসেম্বর রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলে সন্ধ্যা ৭টায় মঞ্চস্থ হবে নাটকটির চতুর্থ প্রদর্শনী। অপূর্ব কুমার কুণ্ডুর নাট্যরূপ এবং শুভাশীষ দত্ত তন্ময়ের নির্দেশনায় একক অভিনয় করেছেন মো. এরশাদ হাসান।
৬ ঘণ্টা আগে
টেলিভিশন চ্যানেল বাংলা ভিশনের জনপ্রিয় সংবাদ উপস্থাপক মামুন আব্দুল্লাহর সাবলীল উপস্থাপনার পেছনে রয়েছে দীর্ঘ অনুশীলন, দক্ষতা ও অবিচল আত্মবিশ্বাস। তাঁর সঙ্গে কথোপকথনে উঠে এসেছে সংবাদ উপস্থাপনার কৌশল, লাইভ সম্প্রচারের চাপ সামলানোর বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং এ পেশায় আগ্রহীদের জন্য মূল্যবান পরামর্শ।
১৩ দিন আগে
ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগ থেকে সিজিপিএ–৪ এর মধ্যে ৪ পেয়েছেন ইউসুফ ইবনে কামাল নিলয়। গত ২৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টির ৩৭তম সমাবর্তনে এমন সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে ওআইসি স্বর্ণপদক দেওয়া হয়।
১৫ নভেম্বর ২০২৫
ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগ থেকে সিজিপিএ–৪ এর মধ্যে ৪ পেয়েছেন ইউসুফ ইবনে কামাল নিলয়। গত ২৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টির ৩৭তম সমাবর্তনে এমন সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে ওআইসি স্বর্ণপদক দেওয়া হয়। নিলয় বিশ্ববিদ্যালয়টির ২০তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি নিজের অসামান্য কৃতিত্বের নেপথ্যের গল্প জানিয়েছেন আজকের পত্রিকাকে। তার কথাগুলো শুনেছেন ইলিয়াস শান্ত।
ইলিয়াস শান্ত

গত ২৭ অক্টোবর আইইউটির ৩৭ তম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আপনি এতে অংশ নিয়েছেন। আপনার বিভাগ ও ফলাফল সম্পর্কে বলুন।
কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগ থেকে আমি গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেছি। প্রথম সেমিস্টারে একটি কোর্সে এ+ পাইনি। তাই সেই সেমিস্টারে আমার জিপিএ ছিল ৩.৯৭। তবে এরপরের সাতটি সেমিস্টারেই আমি ধারাবাহিকভাবে ৪.০০ পেয়েছি।
দ্বিতীয় সেমিস্টারে ৪ পাওয়ার পর আমার সিজিপিএ দাঁড়ায় ৩.৯৮। তৃতীয় সেমিস্টারের পর হয় ৩.৯৯। চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ সেমিস্টারে ৪ ধরে রাখতে পারলেও সিজিপিএ তখনও ৩.৯৯ ছিল। শেষ পর্যন্ত সপ্তম সেমিস্টারে ৪ পাওয়ার পর সিজিপিএ অবশেষে ৪–এ পৌঁছায়। তখন সত্যিই আমি খুব খুশি হয়েছিলাম। এরপর শেষ বা অষ্টম সেমিস্টারেও একই পারফরম্যান্স ধরে রাখার চেষ্টা করি। আলহামদুলিল্লাহ সেটাও সম্ভব হয়। ফলে আমি সিজিপিএ ৪ নিয়ে স্নাতক সম্পন্ন করতে পেরেছি।
এমন সাফল্যের কৃতিত্ব কাকে দিতে চান?
সবার আগে আমি আমার পরিবারের প্রতি কৃতজ্ঞ জানাচ্ছি। তারা সবসময় আমার পাশে থেকেছে। প্রতিটি মুহূর্তে আমাকে সাহস আর অনুপ্রেরণা দিয়েছে। এরপর আমার শিক্ষকদের কথা, যাদের দিকনির্দেশনা ও আন্তরিক সহযোগিতা আমাকে প্রতিটি ধাপে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। আর আমার বন্ধুদের কথাও বলতে হবে। এই চার বছরের যাত্রায় আমার বন্ধুরা সবসময় পাশে থেকেছে–কখনো সহায়তায়, কখনো বা মোটিভেশনে। সবার সম্মিলিত সহযোগিতা আর আমার প্রচেষ্টায় এ জায়গায় পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে।
আপনার বড় বোনের কথা শুনেছি। তাঁর অবদান কতটুকু?
হ্যাঁ, আমার দুজন বড় বোন আছেন। একজন ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা শেষ করেছেন। অন্যজন আইইউটির ছাত্রী ছিলেন। তিনি আইইউটির ১৭ তম ব্যাচের বিজনেস টেকনোলজি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ছাত্রী ছিলেন। তিনি শুরু থেকেই আমার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণার একজন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই তিনি আমাকে পড়াশোনার প্রতি সিরিয়াস থাকতে উৎসাহ দিয়েছেন। বিশেষ করে তিনি আমাকে বোঝাতেন নিয়মিত উপস্থিতি বজায় রাখা, কুইজ ও মিডটার্মের মতো মূল্যায়নগুলো গুরুত্ব সহকারে দেওয়া কতটা জরুরি। এগুলোই আসলে একটি ভালো ফলের ভিত্তি তৈরি করেছে। তার দেওয়া পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা আমার পুরো চার বছরের যাত্রায় দারুণভাবে কাজে দিয়েছে।
স্বর্ণপদক পাওয়ার খবরে আপনার বাবা–মা কী বলেছিলেন?
তারা উভয়েই খুব খুশি হয়েছিলেন। তাঁদের মুখে আনন্দের হাসিটা দেখে মনে হয়েছিল, এই মুহূর্তের জন্যই হয়তো তারা এত বছর ধরে পরিশ্রম আর ত্যাগ স্বীকার করে এসেছেন। আমার বাবা একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার। জীবনে তিনি সবসময় নিয়ম, অধ্যবসায় আর সততার মূল্য শিখিয়েছেন। আর মা একজন গৃহিণী। মা আমাদের পরিবারের মূল শক্তি। ছোটবেলা থেকেই তিনি আমাদেরকে শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারূপ করেছেন। সবসময় পাশে থেকেছেন, কখনো ক্লান্ত হননি।
এমন অসামান্য ফলাফল অর্জনে নিজেকে কীভাবে প্রস্তুত করেছিলেন, পড়ালেখার ধরন কেমন ছিল?
প্রথম থেকেই আমি জানতাম সিএসই এমন একটি বিষয়, যেখানে ধারাবাহিক পরিশ্রম ও মনোযোগ ছাড়া ভালো ফল করা সম্ভব নয়। যেহেতু ভর্তি হওয়ার আগে আমার কোডিং নিয়ে তেমন কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না, তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকেই আমি নিজের ঘাটতি পূরণ করার চেষ্টা শুরু করেছি। ইউটিউবে বিভিন্ন টিউটোরিয়াল দেখে প্রোগ্রামিংয়ের বেসিকগুলো ভালোভাবে আয়ত্ত্ব করে নিয়েছি। আর সেগুলোর ওপর ভিত্তি করে ধীরে ধীরে নিজের দক্ষতা বাড়িয়েছি।
আমার পড়ালেখার ধরনটা ছিল বেশ দলভিত্তিক। আমি সবসময় বন্ধুদের সঙ্গে গ্রুপ স্টাডি করতাম। এতে করে অনেক কঠিন বিষয় সহজে বোঝা যেত। আর কাউকে কোনো বিষয় বুঝিয়ে বলতে গিয়ে নিজের বোঝাটাও আরও মজবুত হতো। এই সহযোগিতামূলক পরিবেশটাই আসলে আমাকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে। এ ছাড়া আমি ক্লাসের উপস্থিতি, কুইজ ও মিডটার্ম পরীক্ষাগুলোতে বেশ গুরুত্ব দিয়েছি। কারণ এগুলোই মূলত চূড়ান্ত ফলে বড় ভূমিকা রাখে। সিনিয়র ভাইদের তৈরি করা নোটগুলোও অনেক সময় কাজে দিয়েছে, বিশেষ করে প্রস্তুতির শেষ মুহূর্তে। সবশেষে, প্রতিটি প্রজেক্টও আমি সমান গুরুত্ব দিয়ে করতাম। যেন শুধু নম্বরের জন্য নয়, শেখার জন্যও কাজটা সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়।
সিজিপিএ–৪ এর মধ্যে ৪ পেয়ে আপনি এখন গ্র্যাজুয়েট। আপনি ওআইসি স্বর্ণপদক পেয়েছেন। অন্য শিক্ষার্থীরা কীভাবে প্রস্তুতি নিলে এমন ফল করতে পারতেন, তাদের প্রস্তুতির কোন কোন জায়গায় ঘাটতি ছিল বলে মনে হয়?
আসলে প্রত্যেকের পড়ার ধরনটা আলাদা হয়। এখানে যে ধরন একজনের জন্য সবচেয়ে কার্যকর, সেটা অন্য কারও জন্য নাও হতে পারে। তাই একেবারে নির্দিষ্টভাবে বলা কঠিন যে, কে কীভাবে পড়লে এমন ফল করতে পারতেন। তবুও আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, কয়েকটা জিনিস নিয়মিতভাবে মেনে চললে ভালো ফলাফল পাওয়া সম্ভব। সবচেয়ে আগে, ক্লাসের উপস্থিতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারপর কুইজ আর মিডটার্ম। অনেকে এগুলোকে হালকাভাবে নেন। আমি মনে করি ফলাফলে এগুলোই আসলে মূল ভিত্তি তৈরি করে দেয়। যদি আগে থেকেই কুইজ ও মিডটার্মে ভালো করা যায়, তাহলে ফাইনাল পরীক্ষার সময় চাপ অনেকটাই কমে যায়। আমার গ্রুপ স্টাডির কথা তো আগেই বলেছি। গ্রুপ স্টাডি শেখার পরিবেশটাকে আরও আনন্দদায়ক করে তোলে। কেউ নির্দিষ্ট কোনো বিষয় না বুঝলে অন্য সেটা কেউ বুঝিয়ে দিতে পারছে। এতে পারস্পরিকভাবে সবারই উপকার হয়।
আপনার শৈশব, মাধ্যমিক–উচ্চ মাধ্যমিক ও পরিবার সম্পর্কে জানতে চাই।
আমাদের পারিবারিক শেকড় বরিশালে। তবে আমার শৈশবের একটা অংশ কেটেছে ফরিদপুরে। সেখানে আমি সানরাইজ স্কুলে পড়ালেখা করেছি। পরে পরিবারসহ ঢাকায় চলে আসি। উত্তরায় আসার পর আমি ক্লাস ৩–৫ শ্রেণি পর্যন্ত মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজে পড়েছি। এরপর ৬–৯ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছি রাজউক উত্তরা মডেল কলেজে। পরবর্তীতে আমি আবার মাইলস্টোন কলেজে ভর্তি হই এবং সেখান থেকে মাধ্যমিক সম্পন্ন করি। নটর ডেম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করেছি। এখানে আমার কলেজ জীবনের সুন্দর দুইটি বছর কেটেছে।
ছোটবেলায় আপনার কি হওয়ার স্বপ্ন ছিল?
ছোটবেলায় আকাশে প্লেন উড়তে দেখলেই মনে হতো, ‘ইশ! একদিন যদি আমিও এমন করে উড়তে পারতাম!’ তখন পাইলট হওয়ার স্বপ্নটাই ছিল সবচেয়ে বড়। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, আর বাস্তবতা একটু একটু করে বুঝতে শুরু করার পর সেই স্বপ্নটা বদলে গেছে। এটা অনেকের ক্ষেত্রেই হয়। এখন আমার স্বপ্ন একটু অন্যরকম।
পরবর্তী লক্ষ্য কী, কেমন জব অফার পাচ্ছেন?
এখন আমার মূল লক্ষ্য হলো আইইউটির কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করা। এজন্যই আমি নিজেকে ধীরে ধীরে প্রস্তুত করছি। যাতে ক্লাসে পড়ানো এবং গবেষণার কাজ–দুটোই ভালোভাবে করতে পারি। একইসঙ্গে গবেষণার মাধ্যমে নতুন কিছু আবিষ্কার করতে চাই। শেখা আর শেখানোর এই প্রক্রিয়াটার ভেতরেই আমি এখন সবচেয়ে বেশি আনন্দ খুঁজে পাই। দূরদৃষ্টি হিসেবে আমার আরও বড় লক্ষ্য হলো–ভবিষ্যতে বিদেশে গিয়ে উচ্চশিক্ষা, বিশেষ করে পিএইচডি করা। আমি গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন বিষয় জানা ও শেখার সুযোগকে আরও প্রসারিত করতে চাই। আমার বিশ্বাস, এই প্রচেষ্টা আমাদের শিক্ষার্থীদের কাজে দেবে।
আইইউটিতে ফ্যাকাল্টি হিসেবে যোগদানে আগ্রহীদের কোন কোন বিষয়গুলো বেশি বিবেচনায় নেওয়া হয়?
আমার জানা মতে, নির্দিষ্ট কিছু বিষয়কে বিশেষভাবে বিবেচনা করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো: একাডেমিক রেজাল্ট, অর্থাৎ শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং পূর্ববর্তী ফলাফল। এছাড়া গবেষণার অভিজ্ঞতা, প্রকাশনা ও সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতেও গুরুত্ব দেওয়া হয়।
দেশের বাস্তবতায় সিএসই গ্র্যাজুয়েটদের চাকরির সুযোগ কেমন?
বর্তমান বাজারে সিএসই গ্র্যাজুয়েটদের জন্য চাকরি সুযোগ খুবই প্রশস্ত। তবে এতে প্রতিযোগিতা রয়েছে। আমি বলবো, প্রয়োজনীয় দক্ষতা থাকলে চাকরি পাওয়া কঠিন কিছু নয়। আমার বন্ধুবান্ধবের মধ্যে অনেকেই আছেন, যারা তাদের গ্র্যাজুয়েশন শেষ হওয়ার আগেই চাকরি পেয়ে গেছেন। এটা আইইউটির ঐতিহ্য। আইইউটি শিক্ষার্থীদের গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার আগেই চাকরির অফার পাওয়ার বেশ নজির আছে। এটা ভালো একাডেমিক পরিবেশ, যুগোপযোগী সিলেবাস এবং শিক্ষার্থীদের প্রচেষ্টার কারণে সম্ভব হয়েছে। বিভিন্ন কোম্পানি এন্ট্রি লেভেলের চাকরির জন্যেও আইইউটি গ্র্যাজুয়েটদের ভালো বেতন অফার করে থাকে।
উচ্চশিক্ষার জন্য আপনি আইইউটিকে কেন বেছে নিয়েছিলেন?
কলেজ লাইফ শুরুর আগে আমার স্বপ্ন ছিল বুয়েটে পড়ার। তবে তখনো নির্দিষ্ট করে ভাবিনি কোন বিষয়ে পড়বো। এইচএসসির পর আইইউটিতে পরীক্ষা দিয়ে সিএসই বিভাগে চান্স পাই। এরপর বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায়ও সাফল্য আসে। সেখানে পেয়েছিলাম ইইই বিভাগ। কিন্তু ততদিন বুয়েটের ক্লাস শুরু করতে করতে আইইউটিতে আমার প্রথম সেমিস্টারের বেশিরভাগ সময় পার যায়। ওই সময়টায় আমি উপলব্ধি করি, কম্পিউটার সায়েন্সের প্রতি আমার গভীর ভালোবাসা তৈরি হয়েছে। আমি এতে ভালোও করছি। আইইউটির সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এখানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো দীর্ঘ সেশনজট নেই। তাই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ডিগ্রি সম্পন্ন করা যায়। একাডেমিক জীবনটা অনেক বেশি সুসংগঠিত থাকে। সবমিলিয়ে আমি বুঝতে পারি, একটি বিষয়ের প্রতি ভালোবাসা এবং একটি অনুকূল একাডেমিক পরিবেশই সর্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তাই বুয়েটের ইইই–এর পরিবর্তে আইইউটির সিএসইতে স্থির হয়ে যাই।
স্নাতকের পুরো জার্নিতে পড়ালেখার পাশাপাশি আপনি আর কি কি করেছিলেন?
পড়ালেখার পাশাপাশি আমি বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছি। নতুন নতুন জায়গা ঘুরে দেখেছি। মাঝে মাঝে ফুটবল, ক্যারমের মতো খেলা খেলেছি। এছাড়া কম্পিউটারে গেমও খেলেছি। পড়ালেখার পাশাপাশি কিছু সময় টিউশনি করেছি। যা নিজের ধারণাকে পরিষ্কার করতে এবং আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে সহায়ক হয়েছে।
সিএসই নিয়ে পড়তে আসা নবীন শিক্ষার্থীদের প্রতি আপনার কি বার্তা থাকবে?
নিজেকে শুধুমাত্র একাডেমিক সিলেবাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না। প্রথম থেকেই নিজের মধ্যে বাড়তি শেখার আগ্রহ জাগিয়ে তুলতে হবে। কোড ফোর্স, হ্যাকার র্যাঙ্ক–এর মতো প্ল্যাটফর্মের কনটেস্টে নিয়মিত অংশ নিতে হবে। এ ছাড়া কম্পেটিটিভ প্রোগ্রামিংয়ে মনোযোগ দিলে সমস্যা সমাধানের দক্ষতা যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনি যুক্তির গভীরতাও শাণিত হবে। ইউটিউবেও পছন্দের বিষয়গুলোর অসংখ্য টিউটোরিয়াল রয়েছে। সেগুলো কাজে লাগিয়ে শেখার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে, চাকরির ক্ষেত্রে যে স্কিলগুলো সবচেয়ে বেশি কাজে লাগে, তা অনেক সময় একাডেমিক পড়ালেখার চেয়ে কিছুটা আলাদা। একাডেমিক প্রোজেক্টগুলোও কখনই হালকাভাবে নেওয়া যাবে না। এগুলো যতটা সম্ভব ভালোভাবে করতে হবে। কারণ ভবিষ্যতে সেগুলোই সিভিতে স্থান করবে এবং দক্ষতার প্রমাণ হিসেবে কাজ করবে।
আপনার গুরুত্বপূর্ণ সময়ের জন্য ধন্যবাদ।
আজকের পত্রিকার জন্যেও শুভকামনা রইলো।
গত ২৭ অক্টোবর আইইউটির ৩৭ তম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আপনি এতে অংশ নিয়েছেন। আপনার বিভাগ ও ফলাফল সম্পর্কে বলুন।
কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগ থেকে আমি গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেছি। প্রথম সেমিস্টারে একটি কোর্সে এ+ পাইনি। তাই সেই সেমিস্টারে আমার জিপিএ ছিল ৩.৯৭। তবে এরপরের সাতটি সেমিস্টারেই আমি ধারাবাহিকভাবে ৪.০০ পেয়েছি।
দ্বিতীয় সেমিস্টারে ৪ পাওয়ার পর আমার সিজিপিএ দাঁড়ায় ৩.৯৮। তৃতীয় সেমিস্টারের পর হয় ৩.৯৯। চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ সেমিস্টারে ৪ ধরে রাখতে পারলেও সিজিপিএ তখনও ৩.৯৯ ছিল। শেষ পর্যন্ত সপ্তম সেমিস্টারে ৪ পাওয়ার পর সিজিপিএ অবশেষে ৪–এ পৌঁছায়। তখন সত্যিই আমি খুব খুশি হয়েছিলাম। এরপর শেষ বা অষ্টম সেমিস্টারেও একই পারফরম্যান্স ধরে রাখার চেষ্টা করি। আলহামদুলিল্লাহ সেটাও সম্ভব হয়। ফলে আমি সিজিপিএ ৪ নিয়ে স্নাতক সম্পন্ন করতে পেরেছি।
এমন সাফল্যের কৃতিত্ব কাকে দিতে চান?
সবার আগে আমি আমার পরিবারের প্রতি কৃতজ্ঞ জানাচ্ছি। তারা সবসময় আমার পাশে থেকেছে। প্রতিটি মুহূর্তে আমাকে সাহস আর অনুপ্রেরণা দিয়েছে। এরপর আমার শিক্ষকদের কথা, যাদের দিকনির্দেশনা ও আন্তরিক সহযোগিতা আমাকে প্রতিটি ধাপে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। আর আমার বন্ধুদের কথাও বলতে হবে। এই চার বছরের যাত্রায় আমার বন্ধুরা সবসময় পাশে থেকেছে–কখনো সহায়তায়, কখনো বা মোটিভেশনে। সবার সম্মিলিত সহযোগিতা আর আমার প্রচেষ্টায় এ জায়গায় পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে।
আপনার বড় বোনের কথা শুনেছি। তাঁর অবদান কতটুকু?
হ্যাঁ, আমার দুজন বড় বোন আছেন। একজন ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা শেষ করেছেন। অন্যজন আইইউটির ছাত্রী ছিলেন। তিনি আইইউটির ১৭ তম ব্যাচের বিজনেস টেকনোলজি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ছাত্রী ছিলেন। তিনি শুরু থেকেই আমার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণার একজন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই তিনি আমাকে পড়াশোনার প্রতি সিরিয়াস থাকতে উৎসাহ দিয়েছেন। বিশেষ করে তিনি আমাকে বোঝাতেন নিয়মিত উপস্থিতি বজায় রাখা, কুইজ ও মিডটার্মের মতো মূল্যায়নগুলো গুরুত্ব সহকারে দেওয়া কতটা জরুরি। এগুলোই আসলে একটি ভালো ফলের ভিত্তি তৈরি করেছে। তার দেওয়া পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা আমার পুরো চার বছরের যাত্রায় দারুণভাবে কাজে দিয়েছে।
স্বর্ণপদক পাওয়ার খবরে আপনার বাবা–মা কী বলেছিলেন?
তারা উভয়েই খুব খুশি হয়েছিলেন। তাঁদের মুখে আনন্দের হাসিটা দেখে মনে হয়েছিল, এই মুহূর্তের জন্যই হয়তো তারা এত বছর ধরে পরিশ্রম আর ত্যাগ স্বীকার করে এসেছেন। আমার বাবা একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার। জীবনে তিনি সবসময় নিয়ম, অধ্যবসায় আর সততার মূল্য শিখিয়েছেন। আর মা একজন গৃহিণী। মা আমাদের পরিবারের মূল শক্তি। ছোটবেলা থেকেই তিনি আমাদেরকে শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারূপ করেছেন। সবসময় পাশে থেকেছেন, কখনো ক্লান্ত হননি।
এমন অসামান্য ফলাফল অর্জনে নিজেকে কীভাবে প্রস্তুত করেছিলেন, পড়ালেখার ধরন কেমন ছিল?
প্রথম থেকেই আমি জানতাম সিএসই এমন একটি বিষয়, যেখানে ধারাবাহিক পরিশ্রম ও মনোযোগ ছাড়া ভালো ফল করা সম্ভব নয়। যেহেতু ভর্তি হওয়ার আগে আমার কোডিং নিয়ে তেমন কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না, তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকেই আমি নিজের ঘাটতি পূরণ করার চেষ্টা শুরু করেছি। ইউটিউবে বিভিন্ন টিউটোরিয়াল দেখে প্রোগ্রামিংয়ের বেসিকগুলো ভালোভাবে আয়ত্ত্ব করে নিয়েছি। আর সেগুলোর ওপর ভিত্তি করে ধীরে ধীরে নিজের দক্ষতা বাড়িয়েছি।
আমার পড়ালেখার ধরনটা ছিল বেশ দলভিত্তিক। আমি সবসময় বন্ধুদের সঙ্গে গ্রুপ স্টাডি করতাম। এতে করে অনেক কঠিন বিষয় সহজে বোঝা যেত। আর কাউকে কোনো বিষয় বুঝিয়ে বলতে গিয়ে নিজের বোঝাটাও আরও মজবুত হতো। এই সহযোগিতামূলক পরিবেশটাই আসলে আমাকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে। এ ছাড়া আমি ক্লাসের উপস্থিতি, কুইজ ও মিডটার্ম পরীক্ষাগুলোতে বেশ গুরুত্ব দিয়েছি। কারণ এগুলোই মূলত চূড়ান্ত ফলে বড় ভূমিকা রাখে। সিনিয়র ভাইদের তৈরি করা নোটগুলোও অনেক সময় কাজে দিয়েছে, বিশেষ করে প্রস্তুতির শেষ মুহূর্তে। সবশেষে, প্রতিটি প্রজেক্টও আমি সমান গুরুত্ব দিয়ে করতাম। যেন শুধু নম্বরের জন্য নয়, শেখার জন্যও কাজটা সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়।
সিজিপিএ–৪ এর মধ্যে ৪ পেয়ে আপনি এখন গ্র্যাজুয়েট। আপনি ওআইসি স্বর্ণপদক পেয়েছেন। অন্য শিক্ষার্থীরা কীভাবে প্রস্তুতি নিলে এমন ফল করতে পারতেন, তাদের প্রস্তুতির কোন কোন জায়গায় ঘাটতি ছিল বলে মনে হয়?
আসলে প্রত্যেকের পড়ার ধরনটা আলাদা হয়। এখানে যে ধরন একজনের জন্য সবচেয়ে কার্যকর, সেটা অন্য কারও জন্য নাও হতে পারে। তাই একেবারে নির্দিষ্টভাবে বলা কঠিন যে, কে কীভাবে পড়লে এমন ফল করতে পারতেন। তবুও আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, কয়েকটা জিনিস নিয়মিতভাবে মেনে চললে ভালো ফলাফল পাওয়া সম্ভব। সবচেয়ে আগে, ক্লাসের উপস্থিতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারপর কুইজ আর মিডটার্ম। অনেকে এগুলোকে হালকাভাবে নেন। আমি মনে করি ফলাফলে এগুলোই আসলে মূল ভিত্তি তৈরি করে দেয়। যদি আগে থেকেই কুইজ ও মিডটার্মে ভালো করা যায়, তাহলে ফাইনাল পরীক্ষার সময় চাপ অনেকটাই কমে যায়। আমার গ্রুপ স্টাডির কথা তো আগেই বলেছি। গ্রুপ স্টাডি শেখার পরিবেশটাকে আরও আনন্দদায়ক করে তোলে। কেউ নির্দিষ্ট কোনো বিষয় না বুঝলে অন্য সেটা কেউ বুঝিয়ে দিতে পারছে। এতে পারস্পরিকভাবে সবারই উপকার হয়।
আপনার শৈশব, মাধ্যমিক–উচ্চ মাধ্যমিক ও পরিবার সম্পর্কে জানতে চাই।
আমাদের পারিবারিক শেকড় বরিশালে। তবে আমার শৈশবের একটা অংশ কেটেছে ফরিদপুরে। সেখানে আমি সানরাইজ স্কুলে পড়ালেখা করেছি। পরে পরিবারসহ ঢাকায় চলে আসি। উত্তরায় আসার পর আমি ক্লাস ৩–৫ শ্রেণি পর্যন্ত মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজে পড়েছি। এরপর ৬–৯ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছি রাজউক উত্তরা মডেল কলেজে। পরবর্তীতে আমি আবার মাইলস্টোন কলেজে ভর্তি হই এবং সেখান থেকে মাধ্যমিক সম্পন্ন করি। নটর ডেম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করেছি। এখানে আমার কলেজ জীবনের সুন্দর দুইটি বছর কেটেছে।
ছোটবেলায় আপনার কি হওয়ার স্বপ্ন ছিল?
ছোটবেলায় আকাশে প্লেন উড়তে দেখলেই মনে হতো, ‘ইশ! একদিন যদি আমিও এমন করে উড়তে পারতাম!’ তখন পাইলট হওয়ার স্বপ্নটাই ছিল সবচেয়ে বড়। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, আর বাস্তবতা একটু একটু করে বুঝতে শুরু করার পর সেই স্বপ্নটা বদলে গেছে। এটা অনেকের ক্ষেত্রেই হয়। এখন আমার স্বপ্ন একটু অন্যরকম।
পরবর্তী লক্ষ্য কী, কেমন জব অফার পাচ্ছেন?
এখন আমার মূল লক্ষ্য হলো আইইউটির কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করা। এজন্যই আমি নিজেকে ধীরে ধীরে প্রস্তুত করছি। যাতে ক্লাসে পড়ানো এবং গবেষণার কাজ–দুটোই ভালোভাবে করতে পারি। একইসঙ্গে গবেষণার মাধ্যমে নতুন কিছু আবিষ্কার করতে চাই। শেখা আর শেখানোর এই প্রক্রিয়াটার ভেতরেই আমি এখন সবচেয়ে বেশি আনন্দ খুঁজে পাই। দূরদৃষ্টি হিসেবে আমার আরও বড় লক্ষ্য হলো–ভবিষ্যতে বিদেশে গিয়ে উচ্চশিক্ষা, বিশেষ করে পিএইচডি করা। আমি গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন বিষয় জানা ও শেখার সুযোগকে আরও প্রসারিত করতে চাই। আমার বিশ্বাস, এই প্রচেষ্টা আমাদের শিক্ষার্থীদের কাজে দেবে।
আইইউটিতে ফ্যাকাল্টি হিসেবে যোগদানে আগ্রহীদের কোন কোন বিষয়গুলো বেশি বিবেচনায় নেওয়া হয়?
আমার জানা মতে, নির্দিষ্ট কিছু বিষয়কে বিশেষভাবে বিবেচনা করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো: একাডেমিক রেজাল্ট, অর্থাৎ শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং পূর্ববর্তী ফলাফল। এছাড়া গবেষণার অভিজ্ঞতা, প্রকাশনা ও সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতেও গুরুত্ব দেওয়া হয়।
দেশের বাস্তবতায় সিএসই গ্র্যাজুয়েটদের চাকরির সুযোগ কেমন?
বর্তমান বাজারে সিএসই গ্র্যাজুয়েটদের জন্য চাকরি সুযোগ খুবই প্রশস্ত। তবে এতে প্রতিযোগিতা রয়েছে। আমি বলবো, প্রয়োজনীয় দক্ষতা থাকলে চাকরি পাওয়া কঠিন কিছু নয়। আমার বন্ধুবান্ধবের মধ্যে অনেকেই আছেন, যারা তাদের গ্র্যাজুয়েশন শেষ হওয়ার আগেই চাকরি পেয়ে গেছেন। এটা আইইউটির ঐতিহ্য। আইইউটি শিক্ষার্থীদের গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার আগেই চাকরির অফার পাওয়ার বেশ নজির আছে। এটা ভালো একাডেমিক পরিবেশ, যুগোপযোগী সিলেবাস এবং শিক্ষার্থীদের প্রচেষ্টার কারণে সম্ভব হয়েছে। বিভিন্ন কোম্পানি এন্ট্রি লেভেলের চাকরির জন্যেও আইইউটি গ্র্যাজুয়েটদের ভালো বেতন অফার করে থাকে।
উচ্চশিক্ষার জন্য আপনি আইইউটিকে কেন বেছে নিয়েছিলেন?
কলেজ লাইফ শুরুর আগে আমার স্বপ্ন ছিল বুয়েটে পড়ার। তবে তখনো নির্দিষ্ট করে ভাবিনি কোন বিষয়ে পড়বো। এইচএসসির পর আইইউটিতে পরীক্ষা দিয়ে সিএসই বিভাগে চান্স পাই। এরপর বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায়ও সাফল্য আসে। সেখানে পেয়েছিলাম ইইই বিভাগ। কিন্তু ততদিন বুয়েটের ক্লাস শুরু করতে করতে আইইউটিতে আমার প্রথম সেমিস্টারের বেশিরভাগ সময় পার যায়। ওই সময়টায় আমি উপলব্ধি করি, কম্পিউটার সায়েন্সের প্রতি আমার গভীর ভালোবাসা তৈরি হয়েছে। আমি এতে ভালোও করছি। আইইউটির সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এখানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো দীর্ঘ সেশনজট নেই। তাই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ডিগ্রি সম্পন্ন করা যায়। একাডেমিক জীবনটা অনেক বেশি সুসংগঠিত থাকে। সবমিলিয়ে আমি বুঝতে পারি, একটি বিষয়ের প্রতি ভালোবাসা এবং একটি অনুকূল একাডেমিক পরিবেশই সর্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তাই বুয়েটের ইইই–এর পরিবর্তে আইইউটির সিএসইতে স্থির হয়ে যাই।
স্নাতকের পুরো জার্নিতে পড়ালেখার পাশাপাশি আপনি আর কি কি করেছিলেন?
পড়ালেখার পাশাপাশি আমি বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছি। নতুন নতুন জায়গা ঘুরে দেখেছি। মাঝে মাঝে ফুটবল, ক্যারমের মতো খেলা খেলেছি। এছাড়া কম্পিউটারে গেমও খেলেছি। পড়ালেখার পাশাপাশি কিছু সময় টিউশনি করেছি। যা নিজের ধারণাকে পরিষ্কার করতে এবং আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে সহায়ক হয়েছে।
সিএসই নিয়ে পড়তে আসা নবীন শিক্ষার্থীদের প্রতি আপনার কি বার্তা থাকবে?
নিজেকে শুধুমাত্র একাডেমিক সিলেবাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না। প্রথম থেকেই নিজের মধ্যে বাড়তি শেখার আগ্রহ জাগিয়ে তুলতে হবে। কোড ফোর্স, হ্যাকার র্যাঙ্ক–এর মতো প্ল্যাটফর্মের কনটেস্টে নিয়মিত অংশ নিতে হবে। এ ছাড়া কম্পেটিটিভ প্রোগ্রামিংয়ে মনোযোগ দিলে সমস্যা সমাধানের দক্ষতা যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনি যুক্তির গভীরতাও শাণিত হবে। ইউটিউবেও পছন্দের বিষয়গুলোর অসংখ্য টিউটোরিয়াল রয়েছে। সেগুলো কাজে লাগিয়ে শেখার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে, চাকরির ক্ষেত্রে যে স্কিলগুলো সবচেয়ে বেশি কাজে লাগে, তা অনেক সময় একাডেমিক পড়ালেখার চেয়ে কিছুটা আলাদা। একাডেমিক প্রোজেক্টগুলোও কখনই হালকাভাবে নেওয়া যাবে না। এগুলো যতটা সম্ভব ভালোভাবে করতে হবে। কারণ ভবিষ্যতে সেগুলোই সিভিতে স্থান করবে এবং দক্ষতার প্রমাণ হিসেবে কাজ করবে।
আপনার গুরুত্বপূর্ণ সময়ের জন্য ধন্যবাদ।
আজকের পত্রিকার জন্যেও শুভকামনা রইলো।

‘বাংলাদেশের মানুষ যদি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ কিংবা অনুপাতভিত্তিক ভোটব্যবস্থা বুঝত! উল্টো তারা বলবে, আমরা এসব বুঝি না! আমি তোমাকে ভোট দেব, কয় টাকা দেবে? সহজ ভাষায় বললে বিষয়টি তা-ই—তুমি টাকা দাও, আমি ভোট দেব—দেশে ভোটের চর্চা এমনই।’
১৫ জুন ২০২৫
নাট্যদল বিবেকানন্দ থিয়েটারের ২৫তম প্রযোজনা ‘ভাসানে উজান’। গত নভেম্বরে মঞ্চে এসেছে নাটকটি। ২৯ ডিসেম্বর রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলে সন্ধ্যা ৭টায় মঞ্চস্থ হবে নাটকটির চতুর্থ প্রদর্শনী। অপূর্ব কুমার কুণ্ডুর নাট্যরূপ এবং শুভাশীষ দত্ত তন্ময়ের নির্দেশনায় একক অভিনয় করেছেন মো. এরশাদ হাসান।
৬ ঘণ্টা আগে
টেলিভিশন চ্যানেল বাংলা ভিশনের জনপ্রিয় সংবাদ উপস্থাপক মামুন আব্দুল্লাহর সাবলীল উপস্থাপনার পেছনে রয়েছে দীর্ঘ অনুশীলন, দক্ষতা ও অবিচল আত্মবিশ্বাস। তাঁর সঙ্গে কথোপকথনে উঠে এসেছে সংবাদ উপস্থাপনার কৌশল, লাইভ সম্প্রচারের চাপ সামলানোর বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং এ পেশায় আগ্রহীদের জন্য মূল্যবান পরামর্শ।
১৩ দিন আগে
দীর্ঘদিন আটকে থাকার পর রায়হান রাফী পরিচালিত ‘অমীমাংসিত’ ওয়েব ফিল্মের মুক্তির ঘোষণা এসেছে। ৪ ডিসেম্বর ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আইস্ক্রিনে মুক্তি পাবে সিনেমাটি। এতে অভিনয় করেছেন ইমতিয়াজ বর্ষণ। এ ছাড়া আসছে ডিসেম্বরে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাবে তাঁর অভিনীত ‘এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি’।
০১ ডিসেম্বর ২০২৫