Ajker Patrika

মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক তৎপরতায় দুই বছরে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয় ৩৪ বিলিয়ন ডলার, ইসরায়েলই পেয়েছে ২১ বিলিয়ন

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ০৭ অক্টোবর ২০২৫, ১৪: ০১
যুক্তরাজ্যের ২৪ বছর বয়সী তরুণী জর্জিয়া টেইলর। ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাজ্যের ২৪ বছর বয়সী তরুণী জর্জিয়া টেইলর। ছবি: সংগৃহীত

যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাওয়া বিপুল আর্থিক সহায়তা না থাকলে ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারত না। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত ইসরায়েলকে ওয়াশিংটনের দেওয়া সহায়তার অঙ্ক ২১ বিলিয়ন ডলারের বেশি। ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কস্ট অব ওয়ার প্রজেক্ট’-এর নতুন দুই প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ও অর্থ না পেলে ইসরায়েল গাজায় গণহত্যার যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারত না, ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করতে পারত না কিংবা ইয়েমেনে বারবার বিমান হামলা চালাতেও সক্ষম হতো না। এই বিশ্লেষণকে সমর্থন করেছেন বিভিন্ন বিশেষজ্ঞও। তাঁদের মতে, গাজা এবং পুরো অঞ্চলে ইসরায়েলের যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হতে পারত না যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক ও কূটনৈতিক সহায়তা ছাড়া।

মধ্যপ্রাচ্য কাউন্সিল অন গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্সের ফেলো ওমর এইচ রহমান আল জাজিরাকে বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা ছাড়া ইসরায়েল গাজা কিংবা অঞ্চলের অন্য কোথাও যুদ্ধ চালাতে পারত না। এ সহায়তা সব দিক থেকেই অপরিহার্য।’

শুধু গাজাতেই ইসরায়েলের হামলায় ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ৬৭ হাজার ১৬০ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ১ লাখ ৬৯ হাজার ৬৭৯ জন। ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনো অগণিত মানুষ চাপা পড়ে আছে। এ ছাড়া ইয়েমেনে বিমান হামলায় ইসরায়েল কয়েক শ মানুষকে হত্যা করেছে। গত জুনে ইরানে হামলায় নিহত হয় হাজারের বেশি মানুষ।

দুই বছর আগে হামাসের নেতৃত্বে ইসরায়েলে হামলায় ১ হাজার ১৩৯ জন নিহত হয়। বন্দী হন দুই শতাধিক। এর প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েল গাজা ধ্বংস করে দেয়। একই সঙ্গে অঞ্চলের যেকোনো বিরোধী শক্তিকে লক্ষ্য করে বৃহত্তর যুদ্ধ শুরু করে। তারা পশ্চিম তীর ও জেরুজালেমে হামলা বাড়ায়, লেবাননে ৪ হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করে গ্রামের পর গ্রাম ধ্বংস করে দেয়। লেবানন ও সিরিয়ার ভূমি দখল করে। দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে বোমা মারে এবং ইরানের সঙ্গে ১২ দিনের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ইয়েমেনের হুতিদের সঙ্গেও সংঘাতে নামে। গবেষকেরা বলছেন, এসব যুদ্ধ চালিয়ে যেতে ইসরায়েলের স্থায়ীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার প্রয়োজন হয়েছিল।

‘ইউএস মিলিটারি এইড অ্যান্ড আর্মস ট্রান্সফার্স টু ইসরায়েল, অক্টোবর ২০২৩–সেপ্টেম্বর ২০২৫’ শিরোনামের প্রতিবেদনে কুইন্সি ইনস্টিটিউটের সিনিয়র গবেষক উইলিয়াম ডি হার্টাং লিখেছেন, ‘বর্তমান ও ভবিষ্যতের বিপুল ব্যয় বিবেচনায় পরিষ্কার, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ, অস্ত্র আর রাজনৈতিক সহায়তা ছাড়া ইসরায়েল গাজায় যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে কিংবা অন্যত্র সামরিক কর্মকাণ্ড বাড়িয়েছে, তা সম্ভব হতো না।’

এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ‘কস্ট অব ওয়ার প্রজেক্ট’ ও কুইন্সি ইনস্টিটিউট। কুইন্সি নিজেদের পরিচয় দেয় এমন এক প্রতিষ্ঠান হিসেবে, যারা মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিকে অবিরাম যুদ্ধ থেকে কূটনীতি ও সংযমের দিকে নিয়ে যেতে চায়। হার্টাংয়ের প্রতিবেদন এবং হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের বাজেট বিশেষজ্ঞ লিন্ডা জে বিলমেসের আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে সামরিক সহায়তা এবং অঞ্চলে নিজেদের সামরিক কর্মকাণ্ডে মোট ৩১ দশমিক ৩৫ থেকে ৩৩ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে।

এতে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা ছাড়া ইসরায়েল একাধিক ফ্রন্টে দুই বছর ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারত না। বিশ্লেষকেরাও এ সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছেন। ওমর এইচ রহমান বলেন, ‘ইসরায়েল যা কিছু ঘটিয়েছে, তা যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ছাড়া সম্ভব নয়। ইসরায়েল বিপুল পরিমাণ বোমা ফেলেছে। কিছু অস্ত্র তারা নিজেরা বানালেও বোমা তৈরি করে না। তাই যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া তাদের এসব ফেলার উপায় নেই।’

ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় সমর্থক সব সময়ই যুক্তরাষ্ট্র। বিদেশি সাহায্যের ক্ষেত্রে ইসরায়েল সবচেয়ে বড় বার্ষিক প্রাপক (প্রায় ৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার) এবং সবচেয়ে বড় মোট প্রাপকও (২০২২ পর্যন্ত ১৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি)। প্রশাসন বদলালেও এই সমর্থনে পরিবর্তন আসেনি। হার্টাংয়ের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং তাঁর উত্তরসূরি ডোনাল্ড ট্রাম্প দুজনই বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র চুক্তি করেছেন। এসব অস্ত্র ও সেবা আগামী বছরগুলোতে টাকার বিনিময়ে সরবরাহ করা হবে।

ওমর এইচ রহমান বলেন, ‘এটাই হলো আসল চিত্র—একটি দেশ যেটি প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই ধারাবাহিকভাবে আন্তর্জাতিক আইন ভেঙে আসছে, তাকে গণতান্ত্রিক পশ্চিমা বিশ্ব কোনো প্রশ্ন ছাড়াই সমর্থন দিয়েছে।’

তবে যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলকে সমর্থনের প্রবাহ ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে। গাজায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে যখন গবেষকেরা গণহত্যা বলছেন, তখন মার্কিন জনগণের বড় অংশ ইসরায়েলের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করছেন। আমেরিকান ইহুদিদের মধ্যেও এ বিরূপতা বাড়ছে। ওয়াশিংটন পোস্টের এক জরিপ অনুযায়ী, ১০ জনের মধ্যে চারজন ইহুদি বিশ্বাস করেন, ইসরায়েল গণহত্যা চালাচ্ছে। ৬০ শতাংশের বেশি মনে করেন, গাজায় যুদ্ধাপরাধ করেছে ইসরায়েল।

বিশ্লেষকদের মতে, এ প্রবণতা ভবিষ্যতে মার্কিন রাজনীতিতে বড় প্রভাব ফেলতে পারে। ওয়াশিংটনের সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল পলিসির নির্বাহী সহসভাপতি ম্যাট ডাস বলেন, ‘কিছু সাবেক বাইডেন প্রশাসনের কর্মকর্তা হয়তো ভাবছেন, বিষয়টি তাঁদের মোকাবিলা করতে হবে না। কিন্তু তারা ভুল করছেন। ২০২৮ সালের নির্বাচনে কোনো ডেমোক্র্যাট প্রার্থী এড়িয়ে যেতে পারবে না যে, বাইডেন প্রশাসন গণহত্যা ঘটিয়েছে এবং এতে সহায়তা করেছে।’

যুক্তরাষ্ট্রে সমালোচকেরা বলছেন, এই বিপুল অর্থসাহায্যের কারণে সাধারণ আমেরিকানরা হতাশ। কারণ, তাঁদের করের টাকা ইসরায়েলের যুদ্ধে ব্যয় হচ্ছে। ম্যাট ডাস বলেন, ‘বাজেট আসলে অগ্রাধিকার নির্ধারণের বিষয়। অথচ আমেরিকানদের সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা সবচেয়ে দুর্বল। তবু ইসরায়েলের যুদ্ধে সহায়তা দিতে বিলিয়ন ডলার বের করা হয়। যে কেউ পারিবারিক বাজেট বোঝে, সে বুঝতে পারবে, বিষয়টি কতটা অন্তঃসারশূন্য।’

তিনি যোগ করেন, ‘এ শুধু ইসরায়েলের স্বার্থ নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শিল্প জটিলতার স্বার্থও বটে। কারণ এই সহায়তার বড় অংশ যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো পাচ্ছে। তারা বিপুল মুনাফা করছে, হাতিয়ে নিচ্ছে অস্ত্র বিক্রির বাজার।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত