Ajker Patrika

সংবিধান সংশোধনে ক্ষুব্ধ হয়ে পদত্যাগ করলেন পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতি

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ২২: ৫৮
বিচারপতি মনসুর আলী শাহ ও আতহার মিনাল্লাহ। ছবি: সংগৃহীত
বিচারপতি মনসুর আলী শাহ ও আতহার মিনাল্লাহ। ছবি: সংগৃহীত

পাকিস্তানের পার্লামেন্ট দেশটির সংবিধানের ২৭তম সংশোধনী পাস করেছে। এরপরই ‘সংবিধান আর রইল না’ এমন আক্ষেপ করে দেশটির সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতি পদত্যাগ করেছেন।

পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম দ্য ডনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আজ বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রপতি আসিফ আলী জারদারির স্বাক্ষরের মাধ্যমে বিতর্কিত ২৭তম সাংবিধানিক সংশোধনী আইনে পরিণত হয়। এর কয়েক ঘণ্টার পরই পদত্যাগপত্র জমা দেন বিচারপতি মনসুর আলী শাহ ও আতহার মিনাল্লাহ।

এর আগে দুজন বিচারপতিই পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি ইয়াহিয়া আফ্রিদিকে চিঠি দিয়ে ফুল কোর্ট বৈঠক ও বিচারবিষয়ক সম্মেলন ডাকার অনুরোধ করেছিলেন, যাতে ২৭তম সংশোধনী নিয়ে আদালতের মধ্যে খোলামেলা আলোচনা হয়।

রাষ্ট্রপতিকে লেখা পদত্যাগপত্রে বিচারপতি মনসুর আলী শাহ এই সংশোধনীকে আখ্যা দিয়েছেন ‘পাকিস্তানের সংবিধানের ওপর এক গুরুতর আঘাত’ হিসেবে। তিনি লিখেছেন, ‘এটি সুপ্রিম কোর্টকে ভেঙে দিয়েছে, বিচার বিভাগকে নির্বাহী নিয়ন্ত্রণে এনেছে এবং আমাদের সাংবিধানিক গণতন্ত্রের মূল ভিত্তিতেই আঘাত হেনেছে।’

মনসুর আলী আরও লিখেছেন, জাতির সর্বোচ্চ আদালতের ঐক্যকে ভেঙে এই সংশোধনী বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও সততাকে পঙ্গু করেছে, দেশকে বহু দশক পিছিয়ে দিয়েছে।

মনসুর আলী শাহ বলেন, তাঁর সামনে দুটি পথ ছিল—এক, আদালতের বিচারপতি হিসেবে থাকা, যা হবে সেই প্রতিষ্ঠানটির ভিত্তি দুর্বল করার সমান; দুই, পদত্যাগ করা। তিনি বলেন, এই আদালতে থেকে যাওয়া মানে হবে সংবিধানবিরোধী কর্মকাণ্ডে নীরব সম্মতি জানানো এবং এমন এক আদালতে বসা, যার কণ্ঠস্বর ইতিমধ্যে রুদ্ধ করা হয়েছে।

মনসুর আলী অভিযোগ করেন, ‘২৬তম সংশোধনীর সময়ও সুপ্রিম কোর্ট সাংবিধানিক প্রশ্নে রায় দিতে পারতেন, কিন্তু ২৭তম সংশোধনী সেই ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে। এমন একটি ক্ষীণ ও অক্ষম আদালতে থেকে আমি সংবিধান রক্ষা করতে পারি না।’

অন্যদিকে বিচারপতি আতহার মিনাল্লাহ তাঁর পদত্যাগপত্রে লিখেছেন, ‘আমি ১১ বছর আগে যে সংবিধানের শপথ নিয়েছিলাম, তা আর নেই।’

আতহার জানান, সংশোধনী পাসের আগে তিনি প্রধান বিচারপতিকে একটি চিঠি লিখে এর সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেন, আজ সেই আশঙ্কাগুলোই সত্য প্রমাণিত হলো।

আতহার লিখেছেন, ‘আমি যে সংবিধান রক্ষা করার শপথ নিয়েছিলাম, তা এখন আর নেই। নতুন যে ভিত্তি স্থাপন করা হচ্ছে, তা ওই সংবিধানের কবরের ওপর দাঁড়িয়ে।’

আতহার আরও বলেন, ‘যে পোশাক আমরা পরি, তা কেবল সাজসজ্জা নয়; এটি জনগণের প্রতি আমাদের দায়িত্বের প্রতীক। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, নীরবতা ও আপসের মাধ্যমে এই পোশাক অনেক সময় বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

বিচারপতি আতহার মিনাল্লাহ নাসরুম মিনাল্লাহর পুত্র এবং বিচারপতি সফদার শাহের জামাতা—যিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া বেঞ্চের সদস্য ছিলেন। কিন্তু রায়টির বিরোধিতা করে ভিন্নমত পোষণ করায় পরে জেনারেল জিয়া-উল-হকের রোষানলে পড়েন।

আতহার মিনাল্লাহ কর্মজীবনের শুরুতে পাকিস্তান কাস্টমস বিভাগে যোগ দেন, পরে পদত্যাগ করে আইন পেশায় আসেন। প্রধান বিচারপতি ইফতেখার চৌধুরীর বরখাস্তের পর তিনি বিচার বিভাগের পুনর্বহাল আন্দোলনে যোগ দেন। তবে পুনর্বহালের পর সুপ্রিম কোর্টের অতিরিক্ত সুয়ো মটো মামলার (স্বতঃপ্রণোদিত মামলা) কারণে তিনি বিচারব্যবস্থার সমালোচক হয়ে ওঠেন।

২০২২ সালের নভেম্বরে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি উমর আতা বান্দিয়াল তাঁকে এবং বিচারপতি মনসুর আলী শাহ, শাহিদ ওয়াহিদ ও হাসান আজহার রিজভিকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হিসেবে শপথবাক্য পাঠ করান।

রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের আগে আজ বিকেলে সিনেট দ্বিতীয়বারের মতো ভোটাভুটির মাধ্যমে সংশোধনীটি পাস করে। বিরোধী দল প্রতিবাদ জানালেও ৬৪ ভোট পক্ষে ও ৪ ভোট বিপক্ষে পড়ে। সিনেট চেয়ারম্যান ইউসুফ রেজা গিলানি ফলাফল ঘোষণা করে বলেন, দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বিলটি পাস হয়েছে।

এই সংশোধনীর মূল লক্ষ্য বলা হয়েছে, শাসনব্যবস্থা সহজতর করা। এর আওতায় নতুন সাংবিধানিক আদালত বা ‘ফেডারেল কনস্টিটিউশনাল কোর্ট’ (এফসিসি), নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ব্যবস্থা এবং সেনা নেতৃত্বের কাঠামোয় পরিবর্তন আনা হয়েছে।

এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো ফেডারেল সাংবিধানিক আদালতের গঠন, যা প্রতিটি প্রদেশের বিচারপতিদের নিয়ে গঠিত হবে এবং কেবল সংবিধানসংক্রান্ত মামলা শুনবে। অন্য মামলাগুলো চলবে প্রচলিত আদালতগুলোতে।

এই সংশোধনীর ধারা ২৩ অনুযায়ী, বর্তমান প্রধান বিচারপতি ইয়াহিয়া আফ্রিদি তাঁর মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত দায়িত্বে থাকবেন। ধারা ৫৬ অনুযায়ী, তাঁর মেয়াদ শেষে ভবিষ্যতে সর্বোচ্চ আদালত ও ফেডারেল সাংবিধানিক আদালতের মধ্যে জ্যেষ্ঠতম প্রধান বিচারপতিই নতুন প্রধান বিচারপতি হবেন।

ডনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি জারদারি আগামীকাল শুক্রবার প্রেসিডেন্সিতে নবগঠিত ফেডারেল সাংবিধানিক আদালতের প্রধান বিচারপতিকে শপথবাক্য পাঠ করাবেন। এর মাধ্যমে কার্যত ২৭তম সংশোধনীর পূর্ণ বাস্তবায়ন হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...