Ajker Patrika

বোমায় ইরানের পরমাণু স্থাপনার ক্ষতি কেমন, স্যাটেলাইট চিত্রে যা দেখা গেল

অনলাইন ডেস্ক
একই জায়গায় একাধিকবার বোমা ফেলেছে যুক্তরাষ্ট্র। ছবি: ম্যাক্সার
একই জায়গায় একাধিকবার বোমা ফেলেছে যুক্তরাষ্ট্র। ছবি: ম্যাক্সার

ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনাকে লক্ষ্য করে গত শনিবার দিবাগত রাতে বিমান হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। এই হামলা সফল হয়েছে বলে দাবি করে নিজের সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে পোস্ট করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এদিকে ইরান জানায়, এই মার্কিন বোমায় পারমাণবিক কেন্দ্রগুলোর খুব বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। এই পরস্পরবিরোধী দাবির কারণে হামলায় প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃত্রিম উপগ্রহের (স্যাটেলাইট) তোলা চিত্র বিশ্লেষণ করে প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণ করা কঠিন হলেও এ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়।

যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ফোরদো, নাতাঞ্জ ও ইস্পাহানে হামলা চালায়। তবে এই হামলার প্রধান লক্ষ্য ছিল ফোরদো। মার্কিন বাহিনী তাদের ‘মিডনাইট হ্যামার’ অভিযানের অংশ হিসেবে সেখানে এক ডজন জেবিইউ-৫৭ ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর ফেলেছিল। এই ৩০ হাজার পাউন্ডের বোমাগুলো বিস্ফোরণের আগে প্রায় ২০০ মিটার মাটি ভেদ করতে পারে। আর ফোরদো কমপ্লেক্স মাটির প্রায় ২৬০ ফিট নিচে। এই ব্যবধানটাই ফোরদো স্থাপনাটি ঠিক কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা নিয়ে কিছুটা অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করেছে।

হামলার পর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে একটি পোস্ট শেয়ার করেন, যেখানে বলা হয়, ‘ফোরদো আর নেই’ এবং পরে এক টেলিভিশন ভাষণে তিনি বলেন, ‘ইরানের প্রধান পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ স্থাপনাগুলো সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা হয়েছে।’

তবে রোববার সকালে এক ব্রিফিংয়ে এই ফলাফল নিয়ে কিছুটা সংযত অবস্থান নেয় তাঁর নিজস্ব সেনাবাহিনী। জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের চেয়ারম্যান জেনারেল ড্যান কেইন বলেন, ‘ঠিক এখনই মন্তব্য করা খুব তাড়াহুড়ো হয়ে যাবে যে সেখানে কী আছে বা নেই।’

স্যাটেলাইটের ছবি বিশ্লেষণ করে স্বাভাবিকভাবেই মাটির অনেক গভীরে অবস্থিত কোনো কাঠামো সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা সম্ভব নয়। তবে বোমা হামলার প্রভাব সম্পর্কে সাধারণ মানুষের জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য হচ্ছে হামলার আগে ও পরে তোলা স্যাটেলাইট চিত্র।

ইরানে এসব সাইটে বোমা পড়ার আগে ও পরের ছবি বিশ্লেষণ করেন মিডলবেরি ইনস্টিটিউটের জেমস মার্টিন সেন্টার ফর ননপ্রোলিফারেশন স্টাডিজের ইস্ট এশিয়া ননপ্রোলিফারেশন প্রোগ্রামের পরিচালক জেফরি লুইস। তিনি জানান, ‘আমরা যা দেখছি তা হলো—দুটি ক্লাস্টার বা গুচ্ছে ভাগ করা ছয়টি গর্ত। প্রতিটি গুচ্ছে তিনটি করে গর্ত রয়েছে, যেখানে ১২টি ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর ফেলা হয়েছিল। এই কৌশলের উদ্দেশ্য হলো একই জায়গায় বারবার আঘাত করে ধীরে ধীরে ভেতরে ঢুকে যাওয়া।’

এদিকে স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ সেন্টারের পারমাণবিক ইস্যুবিষয়ক প্রকল্পের উপপরিচালক জোসেফ রজার্স বলেন, ‘সেই গর্তগুলোর নির্দিষ্ট অবস্থানগুলোও গুরুত্বপূর্ণ। ফোরদো সাইটটি নির্মাণের প্রাথমিক স্যাটেলাইট চিত্র তুলনা করে ধারণা করা হচ্ছে, ফোরদো কমপ্লেক্সের প্রবেশ ট্যানেলগুলোর ওপর বোমা ফেলা হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের বোমাগুলো সম্ভবত বায়ু চলাচলের ছিদ্র বা ভেন্টিলেশন শ্যাফটের ওপর পড়েছে।’

রজার্স আরও বলেন, ভেন্টিলেশন শ্যাফটগুলো ভূগর্ভস্থ স্থাপনার মূল অংশগুলোতে পৌঁছানোর একটি সরাসরি পথ বলে এগুলোকে লক্ষ্য করে হামলাটি করা হয়।

ফরোদো সাইটটি মাটির অনেক গভীরে থাকায় এই সরাসরি পথগুলো বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

সাইটটির ‘কম্পিউটার মডেল’-এর ওপর নির্ভর করে যুক্তরাষ্ট্র এই হামলা চালিয়েছে। এই মডেলের মাধ্যমে মার্কিন বাহিনী বুঝতে পারে যে সাইটটি আংশিক বা পুরোপুরি ধ্বংস করতে তাদের কতটুকু চাপ প্রয়োগ করতে হবে। একই জায়গায় একাধিকবার বোমা ফেলায় ২৬০ ফুট গভীর সাইটে যুক্তরাষ্ট্রে ভালোই ক্ষতি করতে পেরেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

লুইস আরও বলেন, নির্দিষ্ট লক্ষ্যস্থলগুলোতে একাধিক বোমা বর্ষণ ফেলায় যুক্তরাষ্ট্রের এমন বোমার প্রয়োজন হয়নি, যা পুরো ২৬০ ফুট গভীরতার আঘাত করতে পারে। এরপরও তারা সাইটটির ব্যাপক ক্ষতি করতে পেরেছে বলে ধারণা করা যায়।

অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র হয়তো পুরো স্থাপনাটি ভেদ করতে চাইছিল না। তারা হয়তো শুধু এর কাছাকাছি গিয়ে শকওয়েভ দিয়ে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। কারণ, এই শক্তিশালী শকওয়েভ স্থাপনার মধ্যে থাকা মানুষকে মেরে ফেলবে এবং স্থাপনাটির ক্ষতি করবে।

যেসব জায়গায় যুক্তরাষ্ট্র বোমা ফেলেনি, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা গেছে, ফোরদোর একটি লম্বাটে সাদা ভবন সম্ভবত এই স্থাপনাটির জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো। যেখানে হয়তো শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা (এসি), ব্যাকআপ পাওয়ার জেনারেশন ইত্যাদি আছে।

তবে জোসেফ রজার্স মনে করেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র একদমই চেষ্টা করেনি ওই ভবনটিতে আঘাত হানার। এটা স্পষ্ট করে দেয় যে তারা ফোরদোকে সাময়িকভাবে বন্ধ করার লক্ষ্য নিয়ে হামলা করেনি। তারা যেসব ভেন্টিলেশন শ্যাফটকে লক্ষ্য করেছে, তার উদ্দেশ্য ছিল কাঠামোগতভাবে ধ্বংস বা যতটা সম্ভব ক্ষতি করা, অস্থায়ীভাবে বন্ধ করা নয়।’

২০০৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ফোরদো স্থাপনাটির অস্তিত্ব স্বীকার করে ইরান সরকার। ধারণা করা হয়, এই স্থাপনাটি ইউরেনিয়াম ৬০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ করতে পারে। সেখান থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ করা (পরমাণু অস্ত্র তৈরির জন্য প্রয়োজন) তুলনামূলকভাবে সহজ।

এই বোমা হামলার এক সপ্তাহেরও আগে ইরানের ওপর একাধিক হামলা চালায় ইসরায়েল। তাদের দাবি, তারা পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ করার জন্য এই হামলা করেছে। তবে ইসরায়েলের কাছে এমন বোমা নেই, যা ফোরদোর মতো গভীরে থাকা স্থাপনায় আঘাত করতে পারে। আর এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি এতে জড়ায়।

যুক্তরাষ্ট্রের বোমা হামলা এক সপ্তাহ আগের স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা গেছে, ফোরদো সাইটে কর্মকাণ্ড অস্বাভাবিক ছিল, অন্তত ডজনখানেক ট্রাক যাওয়া-আসা করেছে।

রজার্স বলেন, ‘আমি মনে করি, কিছু প্রতিরক্ষা কার্যক্রম চলছিল। সম্ভবত তারা ওই ড্যাম্প ট্রাকগুলো দিয়ে টানেল বন্ধ করে দিতে চেয়েছিল, যাতে হামলা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।’

এ ছাড়া হামলার আগেই ইরান পারমাণবিক উপাদান সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, ফলে হামলার কার্যকারিতা কমে গেছে।

তথ্যসূত্র: ওয়্যারড

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ইরানের পতন হলে, এরপরই রাশিয়া—অভিমত রুশ বিশ্লেষকদের

সাবেক সিইসি নূরুল হুদার গলায় ‘জুতার মালা’ দিয়ে পুলিশে সোপর্দ

ইসরায়েলে ২০ লাখ রুশভাষীর বাস, রাশিয়াকে তাঁদের কথা ভাবতে হয়: পুতিন

হরমুজ প্রণালিতে প্রবেশ করে ইউটার্ন নিল দুটি জাহাজ

লাইভ-২ (২৩ জুন, ২০২৫): ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলা, হরমুজ প্রণালী বন্ধের হুঁশিয়ারি, জাতিসংঘে জরুরি বৈঠক

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত