Ajker Patrika

অপারেশন রেড ওয়েডিং ও নার্নিয়া: ইরানের সেনা কর্মকর্তা ও পরমাণুবিজ্ঞানীদের হত্যায় ইসরায়েলি অভিযান

অনলাইন ডেস্ক
ইসরায়েলি হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ইরানের রাজধানী তেহরানের একটি ভবন। ছবি: এএফপি
ইসরায়েলি হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ইরানের রাজধানী তেহরানের একটি ভবন। ছবি: এএফপি

ইরানে ইসরায়েলি হামলা এবং দেশটির পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংসের পরিকল্পনা আসলে কয়েক দশক আগেই শুরু হয়েছিল। এমনটাই উঠে এসেছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের নতুন এক প্রতিবেদনে। ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরির খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে এমন অভিযোগে গত ১৩ জুন, ইসরায়েল সরাসরি ইরানে হামলা চালায়। এই হামলায় দুটি বিশেষ অভিযান চালানো হয়। যার মূল লক্ষ্য ছিল ইরানের শীর্ষ সামরিক কমান্ডারদের হত্যা করা।

ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদনে ১৮ জন বর্তমান ও সাবেক ইসরায়েলি এবং মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, এই হামলার জন্য জটিল পরিকল্পনা ও কৌশল নেওয়া হয়েছিল। তবে এই পরিকল্পনার যাত্রা শুরু ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে।

ইরানে সর্বশেষ সংঘাতের সময় ‘রেড ওয়েডিং’ বা ‘রক্তাক্ত বিবাহ’ নামে এক বিশেষ অভিযান চালানো হয়। এই অভিযানের নামকরণ করা হয়েছিল জনপ্রিয় সিরিজ ‘গেম অব থ্রোনসে’র এক নির্মম বিয়ের ঘটনার নামে। এই বিয়েতে সিরিজটির বেশ কয়েকজন শীর্ষ চরিত্রকে হত্যা করা হয়। আর ‘রেড ওয়েডিং’ অভিযানেও ইরানের বেশ কয়েকজন শীর্ষ সামরিক নেতাদের একসঙ্গে হত্যা করা হয়। এই অভিযানে এক জায়গায় সমবেত হওয়া ইরানের বিমানবাহিনীর শীর্ষ কয়েক নেতা ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় নিহত হন।

এই যুদ্ধে আরেকটি অভিযানের নাম ছিল ‘অপারেশন নার্নিয়া।’ নামের মতোই এই পরিকল্পনাটিকে অনেকের কাছে অবাস্তব বলে মনে হলেও, এটি সফলভাবে বাস্তবায়ন করা হয়। এর আওতায় ইরানের রাজধানী তেহরানে একযোগে ৯ জন শীর্ষ পারমাণবিক বিজ্ঞানীকে নিজ নিজ বাড়িতে হত্যা করা হয়। ১২ দিনের যুদ্ধে ইসরায়েলের হামলায় অন্তত ১ হাজার ১৯০ জন ইরানি নিহত হয়েছেন বলে ওয়াশিংটনভিত্তিক একটি মানবাধিকার সংস্থা দাবি করেছে। আহত হয়েছেন আরও ৪ হাজার ৪৭৫ জন।

ইসরায়েলের হামলার পর পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ইরানও ইসরায়েলে একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। বীর শেবা, তেল আবিবসহ বিভিন্ন শহর লক্ষ্য করে এই হামলা চালানো হয়। এতে অন্তত ২৮ জন নিহত ও তিন হাজারের বেশি মানুষ আহত হয় বলে ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইসরায়েল জানিয়েছে।

উভয় পক্ষই যুদ্ধ শেষে নিজেদের বিজয়ী দাবি করেছে। যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি বলেন, তাঁর দেশ এই যুদ্ধে ‘বিজয় অর্জন’ করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্র যদি উসকানি দেয়, তবে তারা আরও কঠোর জবাব দেবে। তিনি বলেন, ‘যদি কেউ আক্রমণ করে, শত্রুকে অবশ্যই চরম মূল্য দিতে হবে।’

ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েল মাত্র চার ঘণ্টায় ইরানের শীর্ষ সামরিক নেতা ও বিজ্ঞানীদের বিরুদ্ধে সফল অভিযান চালানোয় এমনকি পরিকল্পনাকারীরাও বিস্মিত হয়েছেন বলে জানা যায়। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর অপারেশন ডিরেক্টরেটের প্রধান ও এই হামলার মূল পরিকল্পনাকারী মেজর জেনারেল ওডেড বাসিউক বলেন, ‘যখন আমরা এই পরিকল্পনা নিয়ে বিস্তারিত কাজ শুরু করি, তখনো নিশ্চিত ছিলাম না এটা সফল হবে কি না।’

তথ্য অনুযায়ী, ইরানের ভেতরে এত বড় ইসরায়েলি গুপ্তচর নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছিল যে, দেশটির শীর্ষ সামরিক নেতাদের গতিবিধি সহজেই নজরদারিতে রাখা সম্ভব হচ্ছিল। মোসাদের এজেন্টরা মাসের পর মাস ধরে স্যুটকেস, শিপিং কনটেইনার ও ট্রাক ব্যবহার করে শত শত বিস্ফোরকযুক্ত ড্রোনের যন্ত্রাংশ ইরানে পাচার করে। পরে সেগুলো দিয়ে ড্রোন ঘাঁটি তৈরি করা হয়, যা ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসে সাহায্য করে।

তবে ইসরায়েলের লক্ষ্য ছিল ১ হাজার মাইলেরও বেশি দূরের, ফলে ইসরায়েলি বৈমানিকদের বিশেষ প্রশিক্ষণের দরকার হয়। তারা শিখে নেয় কীভাবে ১০টি করে বিমান একসঙ্গে উড়বে, কীভাবে জ্বালানি নেওয়ার সময় পালাক্রমে অবস্থান নেবে এবং কীভাবে ক্ষেপণাস্ত্রগুলো এমনভাবে ছোড়া হবে, যাতে সব একসঙ্গে লক্ষ্যে আঘাত হানে।

এই প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল ২০০৮ সালে ‘অপারেশন গ্লোরিয়াস স্পার্টান’ নামের মহড়ার মাধ্যমে। তখন ১০০ টিরও বেশি ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান ১ হাজার মাইল দূরে গ্রিসে গিয়ে অনুশীলন করে। এর পর থেকে এসব মহড়ার সংখ্যা আরও বাড়ানো হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বহুবার ইরানে সরাসরি বিমান হামলার অনুমতি চাইলে তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তবে সিরিয়ার সরকার পতনের পর আকাশপথ অনেকটাই ফাঁকা হয়ে যাওয়ায় নেতানিয়াহু সুযোগ পান।

গত ৯ জুন নেতানিয়াহু সিদ্ধান্ত নেন চার দিনের মাথায় হামলা চালাবেন। পরিকল্পনা ফাঁস এড়াতে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেন, তিনি কয়েক দিনের ছুটিতে যাচ্ছেন এবং ১৬ জুন তাঁর বড় ছেলে অ্যাভনের বিয়ে হবে। কিন্তু বিয়ে পিছিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গোপন রাখা হয়, যাতে ইরান সন্দেহ না করে এবং বিজ্ঞানী বা শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের সরিয়ে নিতে না পারে। আরও একটি কৌশলে, ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ইঙ্গিত ছড়ান, নেতানিয়াহু এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে ইরান আক্রমণ নিয়ে মতভেদ রয়েছে।

বাস্তবে, ট্রাম্প নিজ মালিকানাধীন ট্রুথ সোশ্যালে লেখেন, ‘আমরা ইরান পারমাণবিক ইস্যুর কূটনৈতিক সমাধানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ অথচ এরই মধ্যে ইসরায়েলি বিমানবাহিনী হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। পরে ট্রাম্পও ইরানে হামলা চালানোর নির্দেশ দেন। মার্কিন বিমানবাহিনী ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় বাংকার-বাস্টার বোমা ফেলে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দাবি করেন, এতে ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা ‘সম্পূর্ণ ধ্বংস’ হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা এখনো এই হামলায় প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ মূল্যায়ন করছেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সাইপ্রাসে বিপুল জমি কিনছে ইসরায়েলিরা, দেশ বেদখলের শঙ্কা রাজনীতিবিদদের

যুদ্ধের পর এ যেন এক নতুন ইরান, জনগণের মতো বদলে গেছে সরকারও

কর্মীদের হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার নিষিদ্ধ করল বিমান বাংলাদেশ

বংশরক্ষায় মৃত ছেলের শুক্রাণু চান মা, সংরক্ষণের নির্দেশ মুম্বাই হাইকোর্টের

আমাকে ধর্ষণের সময় পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিল দুই যুবক: ধর্ষণের শিকার তরুণী

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত