Ajker Patrika

‘এই মুখ আমি কীভাবে দেখাব?’ 

আপডেট : ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১২: ৫৪
‘এই মুখ আমি কীভাবে দেখাব?’ 

মাত্র এগারো বছর বয়সেই উচ্ছল কিশোরী রোজা বারাকাতের জীবনে নেমে এসেছিল গভীর অন্ধকার। সেই অন্ধকার তাকে সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে, ভাবতেই দুচোখ অশ্রুতে ভরে ওঠে তার। যতবার মনে পড়ে সেই নৃশংস দিনগুলো, ততবার লজ্জায় মুখ ঢেকে ফেলেন রোজা। অস্ফুটে বলে ওঠেন, ‘এই মুখ আমি কীভাবে দেখাব?’

ইয়াজিদি কিশোরী রোজা। উত্তর ইরাকের সিনজার শহরে জন্ম তার। শহরটি ধর্মীয় ইয়াজিদি সংখ্যালঘুদের ছিটমহল হিসেবে পরিচিত। ২০১৪ সালে রোজার বয়স ছিল মাত্র এগারো, তখন একদিন ইসলামিক স্টেট (আইএস) বাহিনীর সদস্যরা তুলে নিয়ে যায় রোজাকে। ২০১৪ সালের সেই দিনে শুধু রোজাকেই তুলে নিয়ে যায়নি আইএস বাহিনী, তুলে নিয়ে গিয়েছিল আরও কয়েক হাজার ইয়াজিদি নারীকে। 

সিনজার শহর থেকে কিশোরী রোজাকে সিরিয়ার নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দেওয়া হয়। শুধু একবার নয়, একাধিকবার বিভিন্ন জনের কাছে বিক্রি করা হয় তাকে। শুরু হয় বন্দী জীবন, জিম্মি জীবন, ভয়াবহ নির্যাতনের জীবন। 

সময় গড়াতে থাকে। কিশোরী থেকে তরুণী হয়ে ওঠেন রোজা। বয়স হয়ে যায় আঠারো। কিন্তু নির্যাতনের সূর্য অস্তমিত হয় না তাঁর জীবন থেকে। আঠারো বছর বয়স হতে হতে কতবার যে তাকে ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে, তা আজও আঙুলে গুণে শেষ করতে পারেন না। এর মধ্যে একটি ছেলে সন্তানের জন্ম হয় তাঁর। এক সময় সেই ছেলেটিকেও হারিয়ে ফেলেন। আজও তাকে খুঁজে পাননি রোজা। জীবন থেকে কত কিছু হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে স্থানীয় কুর্দি উপভাষা কুরমাঞ্জি, যে ভাষায় তিনি এক সময় কথা বলতেন, সেই ভাষায় এখন খুব একটা কথা বলতে পারেন না। প্রায় ভুলে গেছেন মাতৃভাষা, কিন্তু ভোলেননি তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া নির্যাতনের দিনগুলো। 

২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযানে আইএস বাহিনী আপাত পরাজিত হয়। গ্রেপ্তার করা হয় আইএস যোদ্ধাদের। সেই সঙ্গে তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয় আটক শিবিরে। সে সময় কপালগুণে পালিয়ে যেতে সক্ষম হোন রোজা। কিন্তু পালিয়ে আর যাবেন কোথায়? বাড়িতে? বাড়ি যেন কোথায়? রোজা ভাবতে থাকেন, সেই সিনজার শহর কি এখনো তেমন আছে? মা–বাবা কি বেঁচে আছে? সেই ছোট্ট ছিমছাম বাড়িটা কি এখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে? রোজা ভেবে কূল পান না, তিনি বাড়িতে ফিরবেন কী করে, রাস্তা তো চিনেন না। যদিও বা একে ওকে জিজ্ঞেস করে রাস্তা চিনে নেওয়া যায়, কিন্তু এই মুখ তিনি নিজ সম্প্রদায়ের মানুষকে দেখাবেন কি করে! ডুকরে কেঁদে ওঠেন রোজা বারাকাত। 

নানা পথ ঘুরে অবশেষে রোজার ঠাঁই হয় সিরিয়ার হাসাকেহ প্রদেশের বারজান গ্রামের তুজুর গোষ্ঠীর এক আশ্রয়কেন্দ্রে। সেখান থেকেই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রোজা বলেন, ‘আমার সঙ্গে আরও যারা আইএস শিবিরে বন্দী ছিল, তারা বছরের পর পর বছর ধরে আমাকে বলেছে যে আমি ফিরে গেলে আমাকে আমার সম্প্রদায় কখনোই গ্রহণ করবে না। আমি তাদের কথা বিশ্বাস করেছি।’ 

ইয়াজিদি ও সিরীয় কুর্দি কর্মকর্তারা বলেন, আইএস বাহিনীর নৃশংস নির্যাতনের শিকার হওয়া নারীদের ইয়াজিদি সম্প্রদায় কীভাবে গ্রহণ করবে, তা নিয়ে সত্যিই মতভেদ রয়েছে। উত্তর-পূর্ব সিরিয়ার ইয়াজিদি সংগঠন ইয়াজিদি হাউসের কো-চেয়ার ফারুক তুজু বলেন, ‘১২ বছর বয়সে ধর্ষিত হওয়া শিশুটির কাছ থেকে আপনি কী আশা করেন? তারা এত বেশি আঘাত পেয়েছে, এত বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছে যে, তারা এই পৃথিবীর ওপর থেকেই বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে। এ পৃথিবীর কোথাও নেই তারা।’ 

সাক্ষাৎকারে রোজা নির্যাতনের যে বর্ণনা দিয়েছেন তা এক কথায় ভয়াবহ। তিনি বলেন, ‘সর্বপ্রথম আমাকে যার কাছে বিক্রি করা হয়েছিল, তিনি ছিলেন আমার বাবার চেয়েও বয়সে বড় এক ব্যক্তি। তিনি আমাকে দিনের পর দিন ধর্ষণ করেছেন। এরপর তিনি আমাকে বিক্রি করে দেন অন্য একজনের কাছে।’ 

এরপর এক শুভাকাঙ্ক্ষী রোজাকে পরামর্শ দেন, তিনি যদি ইসলামে ধর্মান্তরিত হোন এবং একজন আইএস যোদ্ধাকে বিয়ে করেন তাহলে এভাবে আর বিক্রি হতে হবে না। বিক্রি হওয়া এড়াতে রোজা ধর্মান্তরিত হোন এবং আইএস যোদ্ধাদের খাবার সরবরাহ করত এমন একজন লেবানিজকে বিয়ে করেন। 

রোজা বলেন, ‘এই লেবানিজ ভদ্রলোক অন্যদের চেয়ে তুলনামূলক ভালো ছিলেন। তার সঙ্গে আমি আইএসের রাজধানী রাক্কা শহরে বাস করতাম। সে সময় ‘হুদ’ নামে একটি পুত্র সন্তান হয় আমাদের।’ 

২০১৯ সালের দিকে আইএসের শাসন যখন ভেঙে পড়ছিল, তখন রোজা তার স্বামীর সঙ্গে সিরিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় শহর দেইর এল-জোরে পালিয়ে যান। সেখান থেকে আবার পালিয়ে যান বাঘৌজ শহরে। এই শহরটি আইএসের শেষ ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত কুর্দি সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক বাহিনী এক সময় বাঘৌজকে ঘিরে ফেলে এবং নারী ও শিশুদের নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। 

এই সুযোগ রোজা গ্রহণ করতে পারতেন এবং নিজেকে ইয়াজিদি পরিচয় দিয়ে নিরাপত্তা চাইতে পারতেন। কিন্তু তার পরিবর্তে, তিনি হুদকে আঁকড়ে আইএস যোদ্ধাদের অন্যান্য স্ত্রীদের সঙ্গে শহর থেকে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। 

এই সিদ্ধান্তই কাল হয় রোজার জীবনে। পালাতে গিয়ে তার স্বামী নিহত হয়। হারিয়ে ফেলেন সন্তান। সে আদৌ বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে, জানেন না রোজা। বিশ্বাস করতে চান, তার সন্তান হুদ এখনো বেঁচে আছে এই পৃথিবীর কোথাও না কোথাও। 

বাঘৌজ থেকে পালিয়ে উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ার ইদলিবে আইএস যোদ্ধাদের বিধবা স্ত্রীদের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেন রোজা বারাকাত। সেখানে একজন চোরাকারবারির সাহায্য নিয়ে তিনি দেইর এল-জোর শহরে চলে যান এবং সেখান থেকে তুরস্কে পালিয়ে যান। তুরস্কে একটি পোশাকের বাজারে কাজ জুটিয়ে নেন রোজা বারাকাত। কিন্তু গত মাসে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বাহিনী তাকে ধরে ফেলে। নানা জিজ্ঞাসাবাদের পর রোজাকে সিরিয়ার হাসাকেহ প্রদেশের বারজান গ্রামে একটি নিরাপদ বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। রোজা এখনো সেখানেই আছেন। 

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রোজা বলেন, তিনি আর ইরাকের সিনজারে ফিরে যেতে চান না। তাঁর ধারণা, সিনজারে তাঁর পরিবারের কেউ বেঁচে নেই। কান্নাজড়িত কণ্ঠে রোজা বারাকাত বলছিলেন, ‘সেখানে ফিরে যাওয়ার কী আছে! আমার এখন নিজেকে সময় দেওয়া দরকার।’ 

তথ্যসূত্র: ওয়াশিংটন পোস্ট, আরব নিউজ, এবিসি নিউজ, নাইন নিউজ ডট কম ও ইয়াহু নিউজ

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত