Ajker Patrika

ভারতীয়রা ভিসা ছাড় পাবে না, স্বার্থ হাসিলে ‘দুদিনের বাণিজ্য মিশনে’ মুম্বাইয়ে স্টারমার

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
মুম্বাইয়ে স্টারমারকে স্বাগত জানান মহারাষ্ট্রের গভর্নর আচার্য দেবব্রত ও মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিশ। ছবি: সংগৃহীত
মুম্বাইয়ে স্টারমারকে স্বাগত জানান মহারাষ্ট্রের গভর্নর আচার্য দেবব্রত ও মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিশ। ছবি: সংগৃহীত

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার আজ বুধবার ভোরে ভারতের মুম্বাইয়ে পৌঁছেছেন। ১২৫ সদস্যের প্রতিনিধি দল নিয়ে তিনি দুদিনের সফরে এসেছেন। দলে রয়েছেন ব্রিটিশ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়, শিল্প সংগঠন ও বড় কোম্পানির সিইওরা। মূল লক্ষ্য হলো ভারত-যুক্তরাজ্যের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দুর খবরে বলা হয়েছে, স্টারমারের এই সফর হচ্ছে এমন সময়ে—যার কয়েক মাস আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ইউরোপ সফরের সময় যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ঐতিহাসিক বাণিজ্যচুক্তি সিইটিএ (Comprehensive Economic and Trade Agreement) স্বাক্ষরিত হয়েছে। সেই চুক্তির বাস্তবায়ন এবং দুই দেশের সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নেওয়ার অংশ হিসেবেই এই সফর। এ নিয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এটা শুধু একটা কাগজ নয়, এটা প্রবৃদ্ধির জন্য একধরনের লঞ্চপ্যাড।’

তবে প্রবৃদ্ধির কথা বললেও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ভারতীয়দের জন্য ভিসা ছাড় দিতে নারাজ। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, কিয়ার স্টারমার বলেছেন, যুক্তরাজ্য ভারতকে ভিসার নিয়মের ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেবে না। ভারতের মাটিতে নামার আগেই তিনি এ কথা বলেন।

তাঁর লক্ষ্য যুক্তরাজ্যে বিনিয়োগ বাড়ানো এবং ধীর গতির অর্থনীতিকে চাঙা করা। কিয়ার স্টারমার বলেন, ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বাড়ানোর বিশাল সুযোগ আছে। তবে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন, ভারতীয় কর্মী বা শিক্ষার্থীদের জন্য ভিসার নতুন কোনো পথ খোলার পরিকল্পনা নেই। তাঁর ভাষায়, ‘এখানে আসল বিষয় ভিসা নয়। আসল বিষয় হলো ব্যবসা থেকে ব্যবসায় সম্পর্ক, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান আর সমৃদ্ধি যুক্তরাজ্যে আসা।’

দুই দেশ এখন বৈশ্বিক পরিবর্তনের সময় পার করছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে বাণিজ্য সম্পর্কের নতুন বাস্তবতায় ভারত ও যুক্তরাজ্য নিজেদের অবস্থান মজবুত করতে চাইছে। এই কারণেই মুম্বাই সফরকে ডাউনিং স্ট্রিট ‘দুদিনের বাণিজ্য মিশন’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। প্রতিনিধি দলে রয়েছেন বাণিজ্য ও ব্যবসা মন্ত্রী পিটার কাইল এবং বিনিয়োগমন্ত্রী জেসন স্টকউড।

ভারত সরকার জানিয়েছে, এই সফরে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নানা ইস্যুতে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হবে আগামীকাল বৃহস্পতিবার। আলোচনায় প্রযুক্তি অংশীদারত্ব ও ২০২৪ সালের জুলাইয়ে চালু হওয়া টেকনোলজি সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভ অন্তর্ভুক্ত থাকবে। মোদির ইউরোপ সফরের সময় দুই দেশের সম্পর্ককে নতুনভাবে সাজানো হয়েছিল। তখন ‘ভিশন—২০৩৫’ নামে ১০ বছরের একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়, যেখানে বাণিজ্য, জলবায়ু, শিক্ষা, প্রযুক্তি এবং জনগণের মধ্যে সম্পর্ক সবকিছু অন্তর্ভুক্ত।

স্টারমার ২০২০ সালে লেবার পার্টির নেতৃত্ব নেওয়ার পর থেকে ভারত নিয়ে দলের অবস্থান পরিবর্তন করতে শুরু করেন। কাশ্মীর ও পাকিস্তান ইস্যুতে লেবারের আগের অবস্থানের কারণে ভারত-যুক্তরাজ্যের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। অন্যদিকে, ভারত সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিল যুক্তরাজ্যে সক্রিয় খালিস্তানি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কারণে ভারতীয় কূটনীতিক ও সম্পদের নিরাপত্তা। এ অবস্থায় জুলাইয়ের বাণিজ্যচুক্তি ও ভিশন ২০৩৫ উভয় পক্ষের জন্য সম্পর্ক পুনর্গঠনের সুযোগ তৈরি করেছে। বৃহস্পতিবার মোদি ও স্টারমার মুম্বাইয়ে গ্লোবাল ফিনটেক ফেস্টে মূল বক্তৃতা দেবেন এবং শীর্ষ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন।

চুক্তি অনুযায়ী, যুক্তরাজ্য ৯৯ শতাংশ ভারতীয় পণ্যের ওপর থেকে শুল্ক তুলে নিয়েছে। তবে এর প্রভাব পড়বে ভারতের রপ্তানির মাত্র ৪৫ শতাংশের (৬.৫ বিলিয়ন ডলার) ওপর। এর মধ্যে রয়েছে টেক্সটাইল, জুতা, মাছ, গাড়িসহ নানা পণ্য। অন্যদিকে, যুক্তরাজ্যের জন্য বড় সাফল্য এসেছে অ্যালকোহলিক পানীয় খাতে। স্কটিশ হুইস্কির ওপর শুল্ক ১৫০ শতাংশ থেকে সঙ্গে সঙ্গে ৭৫ শতাংশে নেমে আসবে এবং ১০ বছরের মধ্যে তা আরও কমে ৪০ শতাংশে পৌঁছাবে। স্কটল্যান্ড বিষয়ক সচিব ডগলাস আলেকজান্ডার এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘ভারতের সঙ্গে এ বছরের ঐতিহাসিক চুক্তি আমাদের হুইস্কি শিল্পের জন্য দারুণ খবর। তবে চুক্তি কার্যকর করাই এখন আসল দায়িত্ব।’

তবে এই বাণিজ্যচুক্তি এখনো কার্যকর হয়নি। এটি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রক্রিয়াধীন। সবকিছু ঠিক থাকলেও ২০২৬ সালের শুরুর আগে বাস্তবায়ন হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ব্রিটিশ হাউস অব লর্ডসের সদস্য ও কোবরা বিয়ারের প্রতিষ্ঠাতা করণ বিলিমোরিয়া সফরকে কেবল প্রতীকী নয়, বরং বাস্তবসম্মত মনে করছেন। তিনি বলেন, ‘ব্রিটেন ব্যবসায়ে সিরিয়াস। আমরা দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াতে চাই।’ তাঁর আশা, আগামী পাঁচ বছরে ভারত-যুক্তরাজ্যের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য দ্বিগুণ হবে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মার্চে শেষ হওয়া অর্থবছরে দুই দেশের মধ্যে পণ্য ও সেবার বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৪৪.১ বিলিয়ন পাউন্ড (৫৯.১৪ বিলিয়ন ডলার)।

ভারত বর্তমানে যুক্তরাজ্যের ১১ তম বৃহৎ বাণিজ্য অংশীদার। দীর্ঘ মেয়াদে এই চুক্তি যুক্তরাজ্যের জিডিপিতে মাত্র দশমিক ১৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি আনবে, অর্থাৎ বার্ষিক ৪.৮ বিলিয়ন পাউন্ড। তবে স্টারমার এই চুক্তিকে কর্মসংস্থান সৃষ্টির বড় দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখাচ্ছেন। ডাউনিং স্ট্রিট জানিয়েছে, এর মাধ্যমে ভারতের কাছে যুক্তরাজ্যের রপ্তানি ৬০ শতাংশ বাড়বে। মুম্বাই পৌঁছে নিজের দলের সদস্যদের সঙ্গে ছবি পোস্ট করে স্টারমার লিখেছেন, তিনি একটি মিশনে নেমেছেন, যা হলো ‘নিজের দেশের মানুষের জন্য কাজ করা।’

লেবার সরকার নিজ দেশে বড় অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। কম উৎপাদনশীলতা, বিপুল জাতীয় ঋণ আর দুর্বল প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি অভিবাসনেও কঠোরতা এনেছে তারা। বিশেষ করে দক্ষ ও বৈধ কর্মীদের যুক্তরাজ্যে প্রবেশে নানা নিয়ন্ত্রণ জারি করা হয়েছে। কনজারভেটিভ ও রিফর্ম ইউকে পার্টির চাপের কারণেই এ সিদ্ধান্ত। অথচ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতীয় নাগরিকরাই সবচেয়ে বেশি দক্ষ কর্মীর ভিসা পেয়েছেন।

যুক্তরাজ্য ইন্ডিয়া বিজনেস কাউন্সিল (ইউকেআইবিসি) এই প্রসঙ্গে জানিয়েছে, ‘অন্যান্য দেশও একই দক্ষ জনশক্তি পাওয়ার প্রতিযোগিতায় আছে। তাই খোলামেলা নীতির ধারণা বিনিয়োগ সিদ্ধান্তে বড় ভূমিকা রাখে।’ সংস্থাটির মতে, ‘সুষম ও পূর্বানুমেয় অভিবাসন কাঠামো থাকা দরকার, যাতে উচ্চ চাহিদাসম্পন্ন খাতে প্রতিভাবান জনশক্তি যুক্তরাজ্যে আসতে পারে।’

স্টারমারের প্রতিনিধি দলে রয়েছেন সিবিআই, রোলস রয়েস, ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, বার্কলেস, ন্যাটওয়েস্ট, এইচএসবিসি, অ্যালকোহল কোম্পানি ডায়াজিও, প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান আরাপ এবং টেলিকম কোম্পানি বিটি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত