Ajker Patrika

ভারতে ক্যানসার বেশি নারীদের, মৃত্যু বেশি পুরুষের

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ভারতে ক্যানসার চিকিৎসায় সচেতনতা বাড়ছে। ছবি: এক্স
ভারতে ক্যানসার চিকিৎসায় সচেতনতা বাড়ছে। ছবি: এক্স

ভারতে নারী ও পুরুষের ক্যানসার আক্রান্ত ও মৃত্যুহারে দেখা যাচ্ছে অদ্ভুত এক বৈপরীত্য। দেশটিতে নারীরা বেশি ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন কিন্তু ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়াদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা বেশি।

দেশের সর্বশেষ ক্যানসার রেজিস্ট্রির একটি সমীক্ষায় এই তথ্য উঠে এসেছে। সমীক্ষাটিতে দেখা গেছে, নতুন ক্যানসার আক্রান্তদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি নারী, অথচ ক্যানসারে মৃতদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যাই বেশি।

বিশ্বের গড় পরিস্থিতি থেকে ভারত এখানে ব্যতিক্রমী। ওয়ার্ল্ড ক্যানসার রিসার্চ ফান্ডের তথ্যানুযায়ী, ২০২২ সালে বিশ্বে প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে গড়ে প্রায় ১৯৭ জন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এর মধ্যে পুরুষের হার ছিল বেশি। যেখানে প্রতি এক লাখ পুরুষের মধ্যে ২১২ জন ক্যানসার আক্রান্ত, সেখানে ১ লাখ নারীর মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১৮৬।

ওই বছর বিশ্বব্যাপী প্রায় ২ কোটি মানুষের ক্যানসার ধরা পড়ে। যার মধ্যে পুরুষ প্রায় এক কোটি তিন লাখ এবং নারী প্রায় ৯৭ লাখ। আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটির হিসাব অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাব্য ঝুঁকি নারী ও পুরুষদের মধ্যে প্রায় সমান।

ভারতে নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় স্তন, জরায়ু এবং ডিম্বাশয়ের ক্যানসার। নারী ক্যানসার রোগীদের মধ্যে ৪০ শতাংশ স্তন এবং জরায়ুর ক্যানসারে আক্রান্ত।

জরায়ুমুখ ক্যানসারের প্রধান কারণ হিসেবে মানব প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি)-এর মতো সংক্রমণকে দায়ী করা হলেও স্তন ও ডিম্বাশয়ের ক্যানসার সাধারণত হরমোন-সম্পর্কিত কারণে বাড়ে। হরমোনজনিত এই ক্যানসার বাড়ার পেছনে জীবনযাত্রার পরিবর্তনও জড়িত। যার মধ্যে রয়েছে—বেশি বয়সে গর্ভধারণ, কম স্তন্যপান করানো, স্থূলতা এবং অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন।

অন্যদিকে, পুরুষদের মধ্যে মুখগহ্বর, ফুসফুস ও প্রোস্টেট ক্যানসারই বেশি দেখা যায়। পুরুষদের প্রতিরোধযোগ্য ক্যানসারের ৪০ শতাংশ হয় তামাক সেবনের কারণে, যার মধ্যে মুখগহ্বর ও ফুসফুস ক্যানসার সবচেয়ে বেশি।

এ কারণে প্রশ্ন উঠছে ভারতে এমনটা কেন ঘটছে? এর কারণ কি নারীদের ক্যানসার আগে ধরা পড়া? না কি পুরুষদের যে ধরনের ক্যানসার হয় সেগুলো প্রকৃতিগতভাবে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে? নাকি ধূমপান ও তামাক চিবানোর মতো অভ্যাস তাদের মৃত্যুঝুঁকি বাড়াচ্ছে? নাকি পুরুষ ও নারীর মধ্যে চিকিৎসা-সুবিধা, সচেতনতা ও সেবাপ্রাপ্তির পার্থক্যেও কি উত্তর লুকিয়ে আছে?

বলা হচ্ছে, সচেতনতামূলক প্রচার এবং উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার কারণে নারীদের সাধারণত যে ক্যানসারগুলো দেখা যায়, সেগুলো প্রায়শই আগে শনাক্ত করা যায়।

ক্যানসার সৃষ্টিকারী ক্ষতিকর উপাদানের সংস্পর্শে আসা থেকে শুরু করে রোগ শনাক্ত হওয়া পর্যন্ত সময়ের ব্যবধান বেশি হওয়ায়, এই ধরনের ক্যানসার চিকিৎসায় ভালো করা সম্ভব হয়।

এ কারণে, নারীদের মধ্যে ক্যানসারে মৃত্যুহারও তুলনামূলক কম।

অন্যদিকে পুরুষদের অবস্থা তুলনামূলক খারাপ। তাদের ক্যানসারগুলো সাধারণত জীবনযাত্রার সঙ্গে সম্পর্কিত। পুরুষদের তামাক সেবন ও মদ্যপানের কারণে ফুসফুস ও মুখের ক্যানসার হয়। এ ধরনের ক্যানসার অনেক দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং চিকিৎসায় ভালো হওয়ার সম্ভাবনাও কম থাকে।

আর পুরুষেরা স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো বা দ্রুত চিকিৎসা নিতে চিকিৎসকের কাছে যেতে তেমন আগ্রহী হয় না। যার ফলে ক্যানসারে আক্রান্তের সংখ্যা নারীদের তুলনায় কম হলেও পুরুষদের মধ্যে মৃত্যুহার এবং জটিলতা বেশি।

এ প্রসঙ্গে ক্যানসার বিশেষজ্ঞ এবং নন-প্রফিট সংস্থা সেন্টার ফর হেলথ ইনোভেশন অ্যান্ড পলিসি (সিএইচআইপি) ফাউন্ডেশনের প্রধান রবি মেহরোত্রা বলেন, ‘নারীস্বাস্থ্য এখন জনস্বাস্থ্য প্রচারণার বড় একটি অগ্রাধিকার হয়ে উঠেছে, যা একদিকে সুফল বয়ে আনলেও অন্যদিকে পুরুষদের ক্ষেত্রে ঘাটতি তৈরি করছে। বেশি সচেতনতা ও নিয়মিত স্ক্রিনিংয়ের কারণে নারীদের ক্যানসার আগেভাগেই শনাক্ত হয়। কিন্তু পুরুষদের ক্ষেত্রে আলোচনা সচরাচর তামাক ও মুখগহ্বর ক্যানসারের বাইরে যায় না।’

তিনি আরও বলেন, ‘নারীরা প্রজনন স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য কোনো না কোনো সময়ে চিকিৎসকের কাছে যান। কিন্তু অনেক পুরুষই আছেন, যারা হয়তো জীবনে কখনো চিকিৎসকের কাছে যাননি।’

সংখ্যাগুলো খতিয়ে দেখলে ক্যানসারের আসল চিত্র স্পষ্ট হয়। ভারতে এ রোগের মাত্রা অঞ্চলভেদে অসমভাবে ছড়িয়ে রয়েছে, তেমনি ভিন্ন ভিন্ন ক্যানসারেও পার্থক্য স্পষ্ট।

দেশজুড়ে ৪৩টি রেজিস্ট্রির তথ্য বলছে, ভারতে প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ১১ জনের জীবদ্দশায় কোনো না কোনো সময়ে ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। শুধু ২০২৪ সালেই দেশে আনুমানিক ১৫ লাখ ৬০ হাজার নতুন ক্যানসার শনাক্ত এবং ৮ লাখ ৭৪ হাজার মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।

দুর্গম ও পাহাড়ি উত্তর-পূর্বাঞ্চল ভারতের ক্যানসারের হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত। মিজোরামের আইজল জেলায় ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি জাতীয় গড়ের চেয়ে দ্বিগুণ। চিকিৎসকেরা বলছেন, এর বেশিরভাগই জীবনযাত্রার কারণে ঘটে।

আসামের কাছাড় ক্যানসার হাসপাতাল এবং গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান আর. রবি কান্নান বলেন, ‘উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর বেশিরভাগ ক্যানসারের মূল কারণ জীবনযাত্রার ধরন। এ এলাকার মানুষ প্রচুর তামাক সেবন করে। যা দেশের অন্য যেকোনো অঞ্চলের চেয়ে অনেক বেশি।’

ড. কান্নান আরও বলেন, ‘আসামের বরাক ভ্যালিতে মূলত পান-গুটখা চিবানো প্রচলিত, আর এর ২৫ কিলোমিটার দূরের মিজোরামে সিগারেট বা ধূমপান বেশি। আর মদ্যপান, সুপারি খাওয়া তো আছেই। আবার অঞ্চলভেদে মাংস রান্নার ধরনও শরীরে প্রভাব ফেলে। খাদ্যাভ্যাস ও রান্নার ধরনই ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়। এখানে কোনো বিশেষ ক্যানসার-সৃষ্টিকারী জিন নেই। বংশগত ক্যানসারের হারও ভারতের অন্য অংশগুলোর চেয়ে এখানে বেশি নয়।’

তবে ক্যানসারের এই প্রবণতা শুধু উত্তর-পূর্বেই সীমাবদ্ধ নয়। ভারত শাসিত কাশ্মীরের শ্রীনগর পুরুষদের মধ্যে ফুসফুসের ক্যানসারের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে, আর দক্ষিণের হায়দরাবাদ স্তন ক্যানসারে এগিয়ে আছে। বয়সজনিত পার্থক্য বিবেচনা করার পরেও, রাজধানী দিল্লির পুরুষদের মধ্যে সব ধরনের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার হার অন্যান্য অঞ্চলের পুরুষদের তুলনায় বেশি।

মুখের ক্যানসারের ক্ষেত্রে দেশের ১৪টি জনসংখ্যাভিত্তিক রেজিস্ট্রি পুরুষদের মধ্যে এবং চারটি নারীদের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধির তথ্য জানিয়েছে।

ভারতের এই ঝুঁকির চিত্র আসলে বৃহত্তর এক বাস্তবতারই প্রতিফলন। ক্যানসার একইসঙ্গে বিশ্বের সবচেয়ে সর্বজনীন আবার সবচেয়ে বৈষম্যমূলক রোগ। ভারতের রাজ্যভেদে যে বৈষম্য দেখা যায়, তা বৈশ্বিক বিভাজনের প্রতিচ্ছবি। যে বৈষম্য ভৌগোলিক অবস্থান, আয় এবং চিকিৎসার সুযোগের কারণে সৃষ্ট।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্যমতে, ধনী দেশগুলোতে প্রতি ১২ জন নারীর মধ্যে একজন জীবদ্দশায় স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হন, তবে তাদের মধ্যে মাত্র ৭১ জনে একজন এ রোগে মারা যান।

অন্যদিকে দরিদ্র দেশগুলোতে চিত্র সম্পূর্ণ উল্টো। প্রতি ২৭ জন নারীর মধ্যে একজন ক্যানসার শনাক্ত করার সুযোগ পান, কিন্তু মৃত্যুহার দাঁড়ায় প্রতি ৪৮ জনে একজনের।

আন্তর্জাতিক ক্যানসার গবেষণা সংস্থা (আইএআরসি)-এর ক্যানসার সার্ভেইলেন্স শাখার ডেপুটি প্রধান ইসাবেল সোরজোমাতারাম বলেন, ‘ম্ন মানব উন্নয়ন সূচক (এইচডিআই) সম্পন্ন দেশগুলোতে নারীদের স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা উচ্চ এইচডিআই দেশগুলোর নারীদের তুলনায় ৫০ শতাংশ কম। কিন্তু দেরিতে রোগ নির্ণয় এবং মানসম্মত চিকিৎসার অপ্রতুলতার কারণে এই রোগে তাদের মৃত্যুর ঝুঁকি অনেক বেশি।

এর বাইরেও রয়েছে নানা বৈষম্য। আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটির মতে, যুক্তরাষ্ট্রে নেটিভ আমেরিকানদের ক্যানসারে মৃত্যুহার সবচেয়ে বেশি। কিডনি, লিভার পাকস্থলী এবং জরায়ু ক্যানসারে তাদের মৃত্যুহার শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় দুই থেকে তিন গুণ বেশি। একইভাবে প্রোস্টেট, পাকস্থলি এবং জরায়ু ক্যানসারে কৃষ্ণাঙ্গদের মৃত্যুহার শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় দ্বিগুণ।

ভারতে ক্যানসারের বোঝা কেবল বাড়ছেই না, বরং এটি আরও জটিল হয়ে উঠছে। রেজিস্ট্রি থেকে পাওয়া তথ্য এক পরিবর্তনশীল সমাজের প্রতিফলন দেখাচ্ছে যেখানে দীর্ঘায়ু, জীবনযাত্রা এবং পরিবেশ স্বাস্থ্যের ঝুঁকিগুলোকে নতুনভাবে রূপ দিচ্ছে।

তবুও এই পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে অনেক প্রশ্নই অমীমাংসিত থেকে যাচ্ছে, যা সুনির্দিষ্ট প্রতিরোধ ব্যবস্থা, দ্রুত রোগ নির্ণয় এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রার মতো অভ্যাস পরিবর্তনের জরুরি প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত